নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটা যদি আসে সতর্কবার্তা হয়ে, আফগানিস্তানের বিপক্ষে পরাজয়টা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ইংল্যান্ডের দুর্বলতাগুলো। চার বছর আগের চ্যাম্পিয়নরা এবারের অন্যান্য শিরোপাপ্রত্যাশী দলগুলোর চেয়ে কতটা পিছিয়ে, সেই সত্যটাই যেন প্রকাশিত হয়ে গেল টুর্নামেন্টের প্রথম তিন ম্যাচেই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের এই অভাবনীয় ৬৯ রানের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করেছে উইজডেন।
ওকস-কারেনের ফর্মহীনতা
ক্রিস ওকস এবং স্যাম কারেন, ইংল্যান্ডের দুই পেস বোলিং অলরাউন্ডারের জন্যই একটা ভুলে যাওয়ার মতো দিন ছিল। দুজন মিলে মোট আট ওভার বল করেছেন, খরচ করেছেন ৮৭ রান। আফগান ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজের শুরুর তাণ্ডবটা এই দুজনের ওপর দিয়েই গেছে মূলত। পরবর্তীতে দ্বিতীয় স্পেলে বোলিংয়ে এসেও একেবারে অকার্যকর ছিলেন তারা। মুদ্রার উল্টো পিঠে, আফগান পেসাররা ছিলেন বেশ কার্যকর। ফজলহক ফারুকী কিপটে বোলিংয়ের সাথে উইকেট তুলেছেন শুরুতে, মাঝের ওভারে বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগেই জস বাটলারকে ফিরিয়েছেন নাভিন-উল-হক।
দশ ওভারের বোলিং কিংবা ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম সাতের উপযোগী ব্যাটিং, স্যাম কারেনের কাছ থেকে কোনোটাই পাচ্ছে না ইংলিশ টিম ম্যানেজমেন্ট। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষের ম্যাচে বেন স্টোকস ফিরলে তাই স্যাম কারেনকেই হয়তো একাদশের জায়গা ছাড়তে হবে।
ক্রিস ওকসের হঠাৎ ফর্মহীনতাও নিশ্চিতভাবেই চিন্তায় ফেলছে টিম ম্যানেজমেন্টকে। এক মাস আগেও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষের সিরিজে চমৎকার বোলিং করছিলেন ওকস। বিশ্বকাপের তিন ম্যাচের পারফরম্যান্সের বিচারেই ওকসকে ছেঁটে ফেলে গাস আটকিনসন বা ডেভিড উইলিকে দলে ভেড়ানো হবে কি না, সেই কঠিন সিদ্ধান্তের ভার এখন টিম ম্যানেজমেন্টের কাঁধে। আর দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা যেমন আগুনে ফর্মে আছেন, ভুল সিদ্ধান্ত নিলে আরো বেশি চাপে পড়তে হবে ইংল্যান্ডকে।
অনমনীয় স্কোয়াড
মার্ক উড, ক্রিস ওকস, রিস টপলি, স্যাম কারেন, গাস আটকিনসন, ডেভিড উইলি – ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছে এই ছয়জন পেসারকে দলে নিয়ে। এর পেছনে অবশ্য কারণও রয়েছে। অন্তত দু’জন পেসারের ফিটনেস নিয়ে সংশয় ছিল টিম ম্যানেজমেন্টের, পাশাপাশি ম্যাচের সূচি ভেন্যু আর ভ্রমণক্লান্তির ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হয়েছিল। তবে এতজন পেসার নেওয়ার কারণে বিশেষজ্ঞ স্পিনার হিসেবে আদিল রশিদ ছাড়া আর কাউকে নেওয়ার সুযোগ হয়নি ইংল্যান্ডের। বিশ্বকাপটা যেহেতু ভারতের মাটিতে, বিভিন্ন মাঠে বিভিন্ন ধরণের পিচ আর কন্ডিশনের ব্যাপারটা মাথায় রেখে হয়তো দল ঘোষণায় আরেকটু নমনীয়তা দেখাতেই পারতো ইংল্যান্ড।
দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামের কথাই ধরা যাক। ধুলো ওড়ানো টার্নিং পিচ ছিল না অবশ্যই, কিন্তু তবুও পেসারদের তুলনায় বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন স্পিনাররা। আদিল রশিদের সাথে দুই পার্টটাইমার লিয়াম লিভিংস্টোন আর জো রুট মিলে মোট ২৩ ওভার বল করে ৯৫ রানের বিনিময়ে তুলে নিয়েছেন ৫ উইকেট। অপরদিকে আফগানিস্তানের তিন স্পিনার মুজিব উর রেহমান, রশিদ খান ও মোহাম্মদ নবী তাদের ২৫.৩ ওভারে ১০৭ রান খরচ করে পেয়েছেন ৮টি উইকেট। স্কোয়াডে থাকা অপর স্পিনার মঈন আলীকে না খেলিয়ে ইংল্যান্ড তাই কন্ডিশন পড়তে ভুল করল কি না, উঠতে পারে সেই প্রশ্নও।
টুর্নামেন্টের অপর শিরোপাপ্রত্যাশী দলগুলোর মধ্য ভারত, নিউ জিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছ থেকে এমন ভুল এখনো দেখা যায়নি। কন্ডিশনের ওপর ভিত্তি করে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা একজন অতিরিক্ত পেসার বা স্পিনারকে খেলাচ্ছে, নিউ জিল্যান্ড স্যান্টনার-রবীন্দ্র-ফিলিপসের ওপর ভরসা করে বসিয়ে রেখেছে লেগ স্পিনার ইশ সোধিকে।
রান তাড়ায় সাম্প্রতিক সাফল্যের অভাব
বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে ভারত সফরে এসে এখন পর্যন্ত একটা ম্যাচই রান তাড়া করে জিতেছে ইংল্যান্ড, সেটাও গা গরমের ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে। গা গরমের ম্যাচ হওয়ায় আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচের স্ট্যাটাস পায়নি ম্যাচটি, আর বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ১৯৭ রান চেজ করতে গিয়ে ১১৪ রানে ৫ উইকেট হারানো ইংল্যান্ডকে জয়ের জন্য সাতে নামা মঈন আলীর পঞ্চাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছিল।
বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ড একটা চার ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলেছিল নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। ৩-১ ব্যবধানে জেতা ঐ সিরিজের তিনটা ম্যাচেই আগে ব্যাট করেছিল ইংল্যান্ড। আরো আগে যদি যাওয়া হয়, এই বছরের মার্চে বাংলাদেশের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে জয়ী সিরিজের প্রথম ম্যাচেও রান চেজ করেছিল ইংল্যান্ড। মিরপুরের ঐ ম্যাচে ডেভিড মালানের দারুণ ব্যাটিংয়ে জয় পায় ইংল্যান্ড, যদিও সেই দলের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের চারজনই এই বিশ্বকাপে খেলছেন না। এর আগে সর্বশেষ রান তাড়া করে ইংল্যান্ডের জয়ের ঘটনা ছিল ২০২১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে। মালান আর স্টোকস ছাড়া ঐ ব্যাটং লাইনের কেউই এবারের বিশ্বকাপে খেলছেন না।
রান তাড়া করাটা তাই ইংল্যান্ডের জন্য একটা মাথাব্যথার কারণ ছিলই। বিশ্বকাপের আগে এই দলটার ওয়ানডে প্রস্তুতির অভাবটাও এই মাথাব্যথাকে বাড়িয়েছে। জো রুট, জনি বেয়ারস্টো, বেন স্টোকসরা অনেক দিন পরে ওয়ানডে দলে ফিরেছেন, নবীনদের মধ্যে হ্যারি ব্রুক এবং গাস আটকিনসনের ওয়ানডে অভিজ্ঞতা এখনো অপর্যাপ্ত।
ব্যাট হাতে ইন্টেন্টের অভাব
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ব্যাট হাতে অতিরিক্ত সাবধানী হতে দেখা গেছে ইংল্যান্ডকে, যেটা তাদের গত কয়েক বছরে গড়ে তোলা অভ্যাসের বিপরীত। আফগানিস্তানের বোলাররা চমৎকার বল করেছেন সত্যিই, কিন্তু তাদের লেন্থকে এলোমেলো করে দেওয়ার মতো খুব বেশি কিছু করার চেষ্টাও করেননি ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা। সময়ের সাথে সাথে দিল্লির পিচ ধীরগতির হয়ে পড়ছিলো, কিন্তু তখনও সেটা ব্যাটসম্যানদের জন্য একেবারে বধ্যভূমি হয়ে যায়নি, অন্তত দশম উইকেট জুটিতে রিস টপলি আর মার্ক উডের ব্যাটিংটা সেটাই প্রমাণ করে। মোদ্দা কথা, হ্যারি ব্রুক ছাড়া কোনো ইংরেজ ব্যাটসম্যানই আফগান বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে ছোট বাউন্ডারির সুবিধা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেননি।
দারুণ ব্যাটিংয়ের পর আফগানিস্তানের দুর্দান্ত বোলিং
ইংল্যান্ডের পরাজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ বোধহয় এটিই। প্রথমে ব্যাট করে আফগানিস্তান সংগ্রহ করে ২৮৪ রান, বিশ্বকাপের ইতিহাসেই এটা তাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ। রহমানউল্লাহ গুরবাজ আর ইব্রাহিম জাদরানের শতাধিক উদ্বোধনী রানের জুটির পর ছোটখাট বিপর্যয় হলেও পরবর্তীতে লোয়ার মিডল অর্ডারের নৈপুণ্যে তিনশত রানের কাছাকাছি পৌঁছে যায় কাবুলিওয়ালারা। এরপর তো স্পিনারদের জাদু। রশিদ খান, মুজিব উর রেহমান ও মোহাম্মদ নবীকে নিয়ে গঠিত আফগানিস্তানের স্পিন-আক্রমণের চেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ স্পিন-আক্রমণ এই বিশ্বকাপে খুব কমই আছে। এই তিন স্পিনারের সাথে পেসার ফারুকী আর নাভিনের কার্যকর বোলিংয়ের কোন উত্তর ছিল না।
আর এই সব কিছুর ফলাফলই এবারের বিশ্বকাপের প্রথম অঘটন – আফগানিস্তানের ইতিহাসের সেরা জয়!