সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ এবং কোহলিদের ভূখণ্ডে গড়পড়তা ব্যাটসম্যান হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করার খুব বেশি সুযোগ আসে না। এমনও অনেক ক্রিকেটার ছিলেন, যারা প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করার খুব একটা সুযোগ পাননি। এমনই একজন ক্রিকেটার হলেন দিল্লীর অজয় কুমার শর্মা।
১
১৯৬৪ সালের ৩রা এপ্রিল, ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মাথুরায় জন্মগ্রহণ করেন অজয় শর্মা। ১৯৮৪ সালে দিল্লীর হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে অজয় শর্মার। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে সেসময়কার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। অজয় শর্মা ১২৯টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩৮টি শতক এবং ৩৬টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৭.৪৬ ব্যাটিং গড়ে ১০,১২০ রান করেছিলেন।
২
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের ইতিহাসে কমপক্ষে দশ হাজার রান সংগ্রহকারী ব্যাটসম্যানদের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় তার। তার উপরে আছেন শুধুমাত্র ডন ব্রাডম্যান (৯৫.১৪) এবং বিজয় মার্চেন্ট (৭১.৬৪)। সমীকরণটা আরেকটু নমনীয় করলেও খুব বেশি অবনমন হবে না অজয়ের। কমপক্ষে ৫০টি প্রথম শ্রেণীর ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে অজয় শর্মার ব্যাটিং গড় চতুর্থ সর্বোচ্চ। ডন ব্রাডম্যান এবং বিজয় মার্চেন্টের পর ৬৯.৮৬ ব্যাটিং গড়ে ৯,৯২১ রান করা জর্জ হ্যাডলি অবস্থান করছেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করা অজয় শর্মার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। টেস্ট ক্রিকেটে পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি, আর ওডিআইতে নিজের প্রতিভার সদ্ব্যবহার করতে পারেননি তিনি। ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট ম্যাচ খেলেন অপরাজেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। চেন্নাইতে ১৯৮৮ সালের ১১ই জুন ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৩০ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩ রান করেন। তার খেলা একমাত্র টেস্ট ম্যাচে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল ভারত।
দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫৩ রান। আহামরি কিছু না, খুব একটা খারাপও না। কিন্তু প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সেসময়কার সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন অজয় শর্মার এটিই ছিলো ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট ম্যাচ। টেস্ট ক্রিকেটের তুলনায় ওডিআইতে বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন অজয়। ৩১টি ওডিআইতে ৯০.৪০ স্ট্রাইক রেইট এবং ২০.১৯ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৪২৪ রান। এছাড়া বল হাতে তার ঝুলিতে আছে ১৫টি উইকেট।
৩
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে মেলে ধরতে না পারার পিছনে পর্যাপ্ত সুযোগের পাশাপাশি আরও একটি বড় কারণ ছিলো, ঘরোয়া ক্রিকেটে অজয় শর্মা যাদের বিপক্ষে রান করেছিলেন, তাদের বলের গতি তুলনামূলক কম ছিলো। হঠাৎ করে ঘন্টায় ২০ কিলোমিটার বেশি গতির বল খেলতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হতো তাকে, যার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আশানুরূপ পারফর্ম করতে পারেননি তিনি। ভারতের হয়ে নিজের ব্যাটিং প্রতিভা বিশ্ব ক্রিকেটকে দেখাতে না পারলেও দিল্লীর হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ঠিকই বোলারদের তুলোধুনো করতেন। ভারতের মাটি স্পিনারদের জন্য স্বর্গরাজ্য। তাই তিনি তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় স্পিনারদের বিপক্ষেই রান করেছেন। তবে সেসময়কার রঞ্জি ট্রফিতে বেশকিছু ভালোমানের পেসার ছিলেন। হারভিন্দার সিং, সন্দীপ শর্মা এবং আব্দুল কাইয়ুম ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এদের কেউই অজয় শর্মাকে বিপাকে ফেলতে পারেননি। তিনি খুব কম সময়েই হেলমেট পরতেন। পেসারদের বাউন্স এবং গতির কাছে আত্মসমর্পণ না করে স্কয়ার কাট, হুক এবং পুলের সাহায্যে বল সীমানা ছাড়া করতে পছন্দ করতেন। ঘরোয়া ক্রিকেটের পেসাররা তাকে বিপাকে ফেলতে না পারলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঠিকই বিশ্বমানের পেসারদের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
৪
বিশ্ব ক্রিকেটে এমন অনেক ক্রিকেটার আছেন, যারা তাদের ব্যাট সহজে বদলাতে চান না। কোনো ব্যাট দিয়ে শতক হাঁকালে সেটা খেলার অনুপযোগী হওয়া পর্যন্ত ব্যবহার করার অভ্যাস আছে অনেকের মাঝে। এদিক থেকে অজয় শর্মা অন্যদের চেয়ে আলাদা। ম্যাচের আগে হঠাৎ করেই নতুন একটা ব্যাট হাতে নিয়ে বলতেন, আজকের ম্যাচে শতক হাঁকাবেন। প্রায় সময় দেখা যেতো, ঠিকই শতক হাঁকিয়েছেন তিনি। অজয় শর্মা গত শতকের আশি, নব্বইয়ের দশকে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে ডন ব্রাডম্যানীয় ব্যাটিং গড়ে রান করতেন। সেসময় তাকে অনেকেই ‘দ্য ডন’ বলে ডাকতেন। ডনের সাথে তুলনাটা খুব বেশি বাড়াবাড়ি ছিলো না। রঞ্জি ট্রফিতে অজয় শর্মার ব্যাটিং গড় ছিলো ৭৮.২৯!
৫
অজয় শর্মা ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ কয়েকটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন। তার মধ্যে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস খেলেন ১৯৯৭ সালে রেলওয়ের বিপক্ষে। কর্নেল সিং স্টেডিয়ামে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। পিচ দেখে যে কেউ অনুমান করবে, দু’দিনেই ম্যাচের ফলাফল চলে আসবে। কিউরেটর হয়তো ম্যাচের কথা ভুলে গিয়ে পিচে পানি দিতে এবং পিচে রোল করতে ভুলে গিয়েছেন। যার ফলে স্পিনাররা হাত ঘুরালেই নিজেদের ঘূর্ণি জাদু দেখাতে পারবে এমন পিচ ছিলো। অজয় শর্মা ইনিংসের শুরু থেকেই দাপটের সাথে দ্বিশতক হাঁকান। তার সিংহভাগ শট ব্যাটের মধ্যখান বরাবর লেগেছে, রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলার সময়েও তিনি ছিলেন শতভাগ সফল। স্পিনারদের টার্ন এবং বাউন্স আলতো হাতে খেলেছেন, যার ফলে ক্লোজ-ইন ফিল্ডাররাও কোনো সুযোগ পায়নি। স্পিন ট্র্যাকে কীভাবে ব্যাট করতে হয়, তারই উদাহরণ দেখিয়েছিলেন তিনি।
প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও নিজের সামর্থ্যানুযায়ী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারেননি অজয় শর্মা। ততদিনে ভাগ্যকে মেনে নিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে মনোনিবেশ করেন তিনি। দিল্লীর হয়ে ১৬ বছর খেলার পর ২০০০ সালে হিমাচল প্রদেশে যোগদান করেন অজয় শর্মা। সময়টা বেশ ভালোই কাটাচ্ছিলেন তিনি। ৩৬ বছর বয়সে স্লো লেফট-আর্ম অর্থোডক্স অ্যাকশনে বল করে মাত্র ১০.৬ বোলিং গড়ে ৫৩ উইকেট শিকারের পাশাপাশি ৪৯.৫ ব্যাটিং গড়ে ৮৪১ রান করেছেন।
২০০০ সালে ক্রিকেটবিশ্ব উত্তাল ছিলো ম্যাচ পাতানোর ঘটনায়। সেসময় অজয় শর্মার ভাগ্যও পুড়ে যায়। মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, অজয় জাদেজা, মনোজ প্রভাকরদের সাথে অজয় শর্মাও নিষিদ্ধ হন। মনোজ প্রভাকর এবং অজয় জাদেজাকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করলেও আজহারউদ্দীন এবং অজয় শর্মাকে সবধরনের ক্রিকেট থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। ৩৬ বছর বয়সে অজয় শর্মার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে নিষেধাজ্ঞার কারণে।
তিনি ১২৯টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৬৭.৪৬ ব্যাটিং গড়ে ১০,১২০ রান করেছেন ৩৮টি শতক এবং ৩৬টি অর্ধশতকের সাহায্যে। বল হাতে শিকার করেছেন ৮৭ উইকেট। লিস্ট-এ ক্রিকেটে ১১৩ ম্যাচে ৩৬.০৭ ব্যাটিং গড়ে ২,৮১৪ রান করেছেন দুটি শতক এবং ২০টি অর্ধশতকের সাহায্যে। লিস্ট-এ ক্রিকেটে তিনি বল হাতে বেশ সফল ছিলেন। এই ফরম্যাটে তার শিকার সংখ্যা ১০৮টি উইকেট।
শেষপর্যন্ত অজয় শর্মাকে ম্যাচ পাতানোর কলঙ্ক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ততদিনে তার বয়স অর্ধশতক পূর্ণ করেছিলো। তাকে ২০১৪ সালে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়া হয়। দিল্লীর জেলা কোর্ট তার উপর থেকে সবধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের যেকোনো ধরনের পদে তিনি কাজ করতে পারবেন। কলঙ্ক ঘাড়ে চেপে কেউই থাকতে চায় না। অজয় শর্মাও স্বভাবত অনেক খুশি হয়েছিলেন। এই বয়সে নিজে না খেলতে পারলেও মাঠে বসে ছেলের খেলা তো উপভোগ করতে পারবেন! তার ছেলে মনন শর্মাও ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত মুখ। ঢাকা প্রিমিয়ার লীগেও নিয়মিত খেলেন অজয়ের পুত্র। ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে সর্বশেষ আসরে আবাহনীর হয়ে ১১ ম্যাচে ২৭ উইকেট শিকার করেছিলেন মনন শর্মা। রঞ্জি ট্রফিতে নিজের শেষ দুই ম্যাচে দিল্লীর হয়ে ৬৯ এবং ১৩৬ রানের ইনিংস খেলার পাশাপাশি দশ উইকেট শিকার করেছেন।
শেষ বয়সে অজয় শর্মা ছেলের খেলা মাঠে বসে দেখতে পারার সুযোগ পেলেও সারাজীবন আক্ষেপ থেকেই যাবে যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রতিভার ছাপ রাখতে পারেননি এবং ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে তার জীবন থেকে ১৪ বছরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।