একটা বাস ভ্রমণ তার জীবনটা বদলে দিয়েছিলো।
অজিত ওয়াড়েকার তখন এলফিনস্টোন কলেজের ছাত্র। বাবা-মা স্বপ্ন দেখেন, ছেলে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ওয়াড়েকার নিজেও সেই স্বপ্ন নিয়ে চলছিলেন। প্রতি রবিবার টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতেন বটে। ক্রিকেটার হবেন, এমন কোনো লক্ষ্য তখন তার ছিলো না। কিন্তু সেই বাস ভ্রমণটাই বদলে দিলো তার স্বপ্ন।
সেদিন বাসে ছিলেন ওয়াড়েকারের কলেজের এক সিনিয়র- বালু গুপ্তে, যিনি নিজেও পরে ভারতের হয়ে টেস্ট খেলেছেন। একটু উদ্বিগ্ন বালু গুপ্তে ওয়াড়েকারকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তার সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে যাবেন কি না। ওয়াড়েকার একটু অবাক হলেন।
বালু গুপ্তে বললেন, তাদের আসলে একজন দ্বাদশ ব্যক্তি দরকার। মোটে এগারোজন খেলোয়াড় জোগাড় হয়েছে। তাই তারা আরেকজন খুঁজছেন। ব্যাস, ওয়াড়েকার রাজি হয়ে গেলেন। ৩ রূপী পাওয়া যাবে হাত খরচ, এটা শুনে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু সেদিন ক্রিকেট মাঠে গিয়ে প্রকৃত বলের খেলা দেখে ওয়াড়েকার প্রেমে পড়ে গেলেন খেলাটার। ঠিক করলেন, তাকে ক্রিকেটারই হতে হবে।
একটা বাস যাত্রা ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের বাঁক বদলে দিলো।
ভারত হয়তো হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ারের ভেতর থেকে একজনকে হারিয়ে ফেললো। কিন্তু সেই ভারতের ক্রিকেটই পেয়ে গেলো তাদের ইতিহাসের অন্যতম সফল অধিনায়ক এবং অন্যতম সেরা কোচকে। অজিত ওয়াড়েকার হয়ে উঠলেন ভারতীয় ক্রিকেটের সৌভাগ্যের প্রতীক।
গত ১৫ আগস্ট মুম্বাইতে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ৭৭ বছর বয়সে মারা গেছেন প্রবীন এই মানুষটি।
ওয়াড়েকার ছিলেন ভারতের একজন স্টাইলিশ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ব্যাটসম্যান হিসেবে যতটা সফল ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন ‘পড়ে পাওয়া’ অধিনায়কত্বের কারণে। ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত দুটি সিরিজ জয় এসেছিলো তার হাত ধরে। অধিনায়কত্ব হারানোর পর অভিমান করে ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেট তাকে ছেড়ে যায়নি। ভারতের প্রথম আনুষ্ঠানিক কোচ ছিলেন তিনি। আর তার সময়েই ঘরের মাটিতে টার্নিং উইকেট বানিয়ে প্রথম অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ভারত।
আজকের মুম্বাই বা সেদিনের বোম্বেতে ১৯৪১ সালের ১ এপ্রিল জন্ম অজিত ওয়াড়েকারের। আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, ক্রিকেটের শুরু টেনিস বল ক্রিকেট দিয়ে। তারপর ঘটনাচক্রে প্রকৃত বলের খেলায় এসে খুব দ্রুত আগ্রাসী একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে বোম্বেতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। ১৯৫৮-৫৯ সালে বোম্বের হয়েই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক তার।
সে সময় ওয়াড়েকারের ব্যাটে রীতিমতো রানের বন্যা বয়ে যেত। টানা ১৫টা রঞ্জি ফাইনাল খেলেছেন তিনি, যা জিতে বম্বে রঞ্জির ইতিহাস গড়েছিলো। এই সময় ওয়াড়েকার কেন ভারতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছেন না, এটা ভারতের একটা আলোচিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। শেষাবধি প্রায় আট বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে লড়াই করার পর পেলেন জাতীয় দলে ডাক।
১৯৬৬ সালে ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হলো ওয়াড়েকারের। খুব দ্রুতই তিনি ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ‘নম্বর থ্রি’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে ফেললেন। ৩৭ ম্যাচে ৩১.০৭ গড়ে ২,১১৩ রান ঠিক ওয়াড়েকারের প্রভাবটা বোঝাতে পারে না। তার ক্যারিয়ারে ১৫টি ফিফটির পাশাপাশি ছিলো একটিমাত্র সেঞ্চুরি। কিন্তু ওয়াড়েকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেই সময়ের ক্রিকেটাররা একটা কথা খুব বলেন যে, তার প্রতিটা ইনিংসটা ছিলো দলের ভিত্তি গড়ে দেওয়া। রানের সংখ্যা দিয়ে তার প্রভাব বোঝার চেষ্টা করতে নিষেধ করা হয় প্রায়শ। তার একমাত্র সেঞ্চুরিটি ছিল ভারতকে ম্যাচ জেতানো এক সেঞ্চুরি। ১৯৬৭-৬৮ মৌসুমে নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়েলিংটন টেস্ট জয়ের পথে করেছিলেন সেঞ্চুরি। আর ওখানেই ভারত দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতে।
ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়াড়েকার হয়তো মাঝারিমানের একজন হয়েই টিকে থাকতেন। তাকে ভারতীয়রা হয়তো উত্থানযুগের একজন সৈনিক হিসেবে মনে রাখতো। কিন্তু নিয়তি এটুকুতে সন্তুষ্ট রইলো না। ওয়াড়েকারকে ইতিহাসে একটা বড় জায়গা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ভাগ্য।
ভারতের অধিনায়ক তখন নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি, যাকে দুনিয়ার ইতিহাসেই সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের একজন মনে করা হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে বেশ কিছু ঘটনাক্রমে অধিনায়কত্ব হারান ম্যাক পতৌদি। তার বদলে নতুন অধিনায়ক বেছে নিতে বসেছিলো নির্বাচক কমিটি। সেখানে কিছুতেই কোনো অধিনায়কের ব্যাপারে একমত হতে পারলেন না নির্বাচকরা। শেষ অবধি নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান বিজয় মার্চেন্ট ‘কাস্টিং ভোট’ দিয়ে অধিনায়ক করেন অজিত ওয়াড়েকারকে।
ভারতের ক্রিকেট প্রেমিকরা তখন হতভম্ব হয়ে গেছেন। তারকা খচিত এই দল কিভাবে সামাল দেবেন অনভিজ্ঞ ওয়াড়েকার? ব্যাটিংয়ে সুনীল গাভাস্কার, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। আর বোলিং আক্রমণে সেই বিশ্বখ্যাত ‘স্পিন কোয়াট্রেট’- বিশেন সিং বেদী, এরাপল্লী প্রসন্ন, ভগবত চন্দ্রশেখর এবং শ্রিনিবাসন ভেঙ্কটরাঘবন।
ট্যাকটিশিয়ান হিসেবে পতৌদি বা এরকম মানের তিনি ছিলেন না। তবে মানুষকে সামলানোর এক বিস্ময়কর ক্ষমতা ছিলো তার। কখনো চোখ লাল করে, কখনো পিঠে হাত বুলিয়ে তিনি ক্রিকেটারদের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারতেন। আর এরই ফল হিসেবে ওয়াড়েকারের অধীনে পরপর দুটি ঐতিহাসিক সিরিজ জিতলো ভারত।
দিলীপ সারদেশাই ও অভিষিক্ত সুনীল গাভাস্কারের অসামান্য ব্যাটিংয়ে ভারত ১-০ ব্যবধানে হারায় স্যার গারফিল্ড সোবার্সের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। এরপর তারা ইংল্যান্ডেও ১-০ ব্যবধানে সিরিজ জেতে। সেই সিরিজে ওভালে চন্দ্রশেখরের ৩৮ রানে ৬ উইকেট ছিল সবচেয়ে বড় ব্যাপার। ওই সিরিজ জয়ের পর ভারতকে অনেকেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বলে ডাকা শুরু করেছিল। রাতারাতি ভারত সম্ভাবনাময় দল থেকে বিশ্বসেরাদের একটি হয়ে উঠলো।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অধিনায়ক ওয়াড়েকারের আরও একটা সিরিজ জয় ছিল। ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল তার দল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে ফিরতি সফরে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ হেরে ফেরে ওয়াড়েকারের ভারত। এর মধ্যে বিখ্যাত সেই ৪২ রানে অলআউটের ঘটনাও ছিল; যেটা এখনও ভারতের সর্বনিম্ন স্কোর হয়ে আছে। এই ঘটনার পর ওয়াড়েকারকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর এটা মেনে নিতে না পেরে অবসর নিয়ে নেন এই মেজাজি মানুষটি।
এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো ওয়াড়েকারের সংক্ষিপ্ত এবং বিস্ময় তৈরি করা এই গল্পটি। কিন্তু গল্পের আরও একটা অধ্যায় বাকি।
১৯৯২ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড প্রথমবারের মতো দলের সাথে একজন অফিশিয়াল কোচ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলো। আর সেই কোচ হিসেবে বেছে নেওয়া হলো সাবেক অধিনায়ক অজিত ওয়াড়েকারকে। তিনি এই দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলেন, অন্তত দেশের মাটিতে ভারতকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে হবে।
ভারতীয় দল তখন শচীন টেন্ডুলকারের আবির্ভাব দেখছে। এছাড়া মোটামুটি ভঙ্গুর একটা দল নিয়ে পথ চলতে শুরু করেছেন মোহাম্মদ আজাহারউদ্দিন। এই ভঙ্গুর দলকেই দেশের মাটিতে অপরাজেয় বানিয়ে ফেললেন ওয়াড়েকার। কৌশলটা পরে ভারত অনেকবার ব্যবহার করেছে- টার্নিং উইকেট বানিয়ে একগাদা স্পিনার নামিয়ে দেওয়া।
তার সময়ে ভারত ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে ইংল্যান্ডকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে এই কৌশলের সফল ও সমালোচিত প্রয়োগ করে। চার বছর দায়িত্ব পালন করেন ওয়াড়েকার কোচ হিসেবে।
এরপরও ভারতীয় ক্রিকেট দলের নির্বাচক ও নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন।
২০১১ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড অজিত ওয়াড়েকারকে সিকে নাইডু আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়া ভারত সরকারের কাছ থেকে তিনি অর্জুন পুরষ্কার ও পদ্মশ্রী পুরষ্কার পেয়েছেন।
তবে এসব পুরষ্কার বা সাফল্যে নয়, শচীন টেন্ডুলকার, আজহারউদ্দিন বা সুনীল গাভাস্কারদের কাছে এক ‘পিতৃসুলভ চরিত্র’ হয়েই টিকে থাকবেন অজিত ওয়াড়েকার।