সাকিব আল হাসান। আমাদের সুপারম্যান। বাংলাদেশের জন্য ব্যর্থতার এই বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরম্যান্সই আমাদের একমাত্র পাওয়া। সাকিব যেন নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন এই বিশ্বকাপে। বর্তমান সময়ের সেরা অলরাউন্ডার তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে। সর্বকালের সেরা হওয়ার পথেও আছেন ভালোমতোই। তবুও ক্রিকেটের ঐতিহ্যবাহী আর প্রভাবশালী দেশের সদস্য না হওয়ার জন্যই হয়তো বহির্বিশ্ব তার শ্রেষ্ঠত্ব মানতে কুণ্ঠাবোধ করতো। বহির্বিশ্বের কথা বাদই দিলাম, আমরা নিজেরাও সাকিবের শ্রেষ্ঠত্বের যোগ্য সম্মান দিই নি। বরং বিভিন্নভাবে তাকে অবহেলা অপমান করার উদাহরণ আছে আমাদের। আবার বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরম্যান্সও এতদিন ঠিক ‘সাকিবসুলভ’ ছিল না। ২১ ম্যাচে ৫৪০ রান আর ২৩ উইকেট যথেষ্টই ভালো, কিন্তু আমাদের ‘সুপারম্যান’ সাকিবের সাথে এই পরিসংখ্যান মানায় না। সাকিব তাই এই বিশ্বকাপকে বেছে নিলেন নিজেকে নতুন উচ্চতায় তুলতে, নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে পোক্ত করতে। ৮ ম্যাচে ৬০৬ রান আর ১১ উইকেট নিয়ে এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের একজন তিনি। এ বিশ্বকাপে তার রেকর্ড ভাঙাগড়ার কাহিনী পড়েছি আমরা প্রতি ম্যাচেই। বিশ্ব মিডিয়ায়, স্পোর্টস ওয়েবসাইটগুলোতে, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মুখে মুখে এখন সাকিব বন্দনা। বিশ্বকাপের কিংবদন্তিদের ভীড়ে এখন সাকিবের উজ্জ্বল অবস্থান। চলুন কিছু পরিসংখ্যানে দেখে আসি বিশ্বকাপে সাকিবের অবস্থান।
শুরুতে আমরা দেখবো, এই বিশ্বকাপে সাকিবের অবস্থান। ৬০৬ রান নিয়ে তিনি সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় ৩য় স্থানে আছেন। ব্যাটিং অ্যাভারেজেও তার অবস্থান তৃতীয়, সর্বোচ্চ সংখ্যক ফিফটি করেছেন, সেঞ্চুরির তালিকায় তিন নম্বরে, আর পঞ্চাশোর্ধ ইনিংসও খেলেছেন সবার চেয়ে বেশি। বাউন্ডারি হাঁকানোতেও তিনি তৃতীয় অবস্থানে আছেন, উইন্ডিজের সাথে তার সেঞ্চুরি এই বিশ্বকাপের চতুর্থ দ্রুততম। বোলিংয়ে ১১ উইকেট নিয়ে ১৬তম স্থানে আছেন। কিন্তু স্পিনারদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি উইকেট পায়নি কেউ। এই বিশ্বকাপকে নিজের রঙে রাঙিয়েছেন সাকিব।
এবার আমরা এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা খেলোয়াড়দের তালিকা দেখবো। এ কাজে আমাদের একটা ওয়েটেড স্কোরের প্রয়োজন হবে। এজন্য আমরা ধরে নিচ্ছি, ১ রান = ১ পয়েন্ট এবং ১ উইকেট = ২৫ পয়েন্ট। বিশ্বকাপে অন্য খেলোয়াড়দের চেয়ে সাকিব কতটা এগিয়ে আছেন, তা সাকিবের টোটাল ওয়েটেড স্কোরই স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা স্টার্কের চেয়ে প্রায় ২০০ পয়েন্ট এগিয়ে সাকিব।
এখন আমরা দেখবো ম্যাচপ্রতি অবদান বা গড় ওয়েটেড স্কোর। এক্ষত্রে যারা কমপক্ষে ২০০ টোটাল স্কোর পেয়েছেন শুধু তাদেরকে বিবেচনা করা হয়েছে, যেন ১-২ ম্যাচ খেলে কেউ এই লিস্টে আসতে না পারে। এখানেও অনুমিতভাবেই সাকিব সবার উপরে।
এবার দেখা যাক বিশ্বকাপের সেরা অলরাউন্ডারদের পারফরম্যান্স। কমপক্ষে ১২৫ রান করেছেন এবং ৫ উইকেট নিয়েছেন, এমন খেলোয়াড় আছেন ১০ জন। সাকিব যে অনেক ব্যবধানে তাদের মধ্যে সেরা, তা’ও সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে নিচের তালিকায়।
এই বিশ্বকাপে সাকিব যে অন্যদের চেয়ে কত এগিয়ে আছেন, তা দেখলাম আমরা। কিন্তু সতীর্থদের ব্যর্থতায় সেমিফাইনালের আগেই বিদায় নিতে হচ্ছে তাকে। বাংলাদেশের তিনটি জয়েই ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন, অন্য ম্যাচগুলোতেও জয়ের পথেই রেখেছিলেন দলকে, কিন্তু সতীর্থদের যোগ্য সহায়তা পাননি। এই সাকিব সেমিফাইনাল খেলতে পারেননি, এটা হয়তো বিশ্বকাপেরই দুর্ভাগ্য।
এই অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সে সাকিব বিশ্বকাপের ইতিহাসেরই সেরা একজন হয়ে উঠেছেন। বিশ্বকাপের আকাশে জ্বলজ্বলে তারাদের মাঝে সবচেয়ে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র সাকিব। চলুন দেখে নিই বিশ্বকাপের ইতিহাসে সাকিবের কৃতিত্ব।
-
একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ১০০০+ রান এবং ৩০+ উইকেট
-
প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে ৬০০ রান
-
বিশ্বকাপের এক আসরে পঞ্চম সর্বোচ্চ রান
-
দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের এক ম্যাচে ফিফটি ও পাঁচ উইকেট
-
তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট
২৯ ম্যাচে ১,১৪৬ রান নিয়ে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রানস্কোরারের তালিকায় সাকিব আছেন ৯ম স্থানে, সাথে ৩৪ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারীর তালিকায় আছেন ১৬তম স্থানে (স্পিনারদের মধ্যে ৪র্থ)। সাকিবই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি দুই ক্ষেত্রেই টপ টোয়েন্টিতে আছেন। প্রথম ত্রিশের মধ্যেও এরকম আর কেউ নেই। পরিসরটাকে আরো বড় করে আমরা যদি টপ ৫০ দেখি, তাহলে দু’ক্ষেত্রেই আছেন, এরকম আর মাত্র দু’জনকে পাওয়া যাবে- সনাৎ জয়াসুরিয়া এবং স্টিভ ওয়াহ। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সাকিব যে কতটা এগিয়ে আছেন, এ তথ্য থেকেই তা বোঝা যায়।
এখন দেখি, বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা সেরা খেলোয়াড়দের তালিকা। সর্বোচ্চ রান শচীনের, সর্বোচ্চ উইকেট ম্যাকগ্রার, আর অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সেরা সাকিব। কিন্তু যদি আমরা সবাইকে একটা লিস্টে আনতে চাই, তাহলে আমাদেরকে আবার সেই ওয়েটেড স্কোরের সাহায্য নিতে হবে। এজন্য আমরা পূর্বের মতোই ১ রান = ১ পয়েন্ট এবং ১ উইকেট =২৫ পয়েন্ট ধরে নিয়ে ওয়েটেড স্কোর বের করবো।
এ হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জন করেছেন শচীন (২,৪৭৮), আর ১,৯৯৬ পয়েন্ট নিয়ে এর পরের অবস্থানেই আমাদের সাকিব! পরের তিনটি অবস্থানে আছেন জয়াসুরিয়া (১,৮৪০), ওয়াসিম আকরাম (১,৮০১) আর গ্লেন ম্যাকগ্রা (১,৭৭৮)। বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবদান রাখা খেলোয়াড়টিই যখন সাকিব আল হাসান, আর একটা বিশ্বকাপ খেললে এক নম্বরে চলে আসারও খুব ভালো সম্ভাবনা আছে তার।
এ তালিকা দেখে বিশ্বকাপে কারা দলকে বেশি সার্ভিস দিয়েছে, তার একটা ধারণা আমরা পাচ্ছি। কিন্তু একটা ব্যাপার থেকেই যায়। যারা বেশি ম্যাচ খেলেছে, তাদের স্কোর তো বেশি হবেই! তাই আমরা অ্যাভারেজ স্কোর, তথা ম্যাচপ্রতি স্কোরটাও দেখি…
খুব অল্প ম্যাচে ভালো করে এ তালিকায় যেন কেউ ঢুকতে না পারেন, এজন্য আমরা টোটাল ওয়েটেড স্কোরে টপ ১০০ জন খেলোয়াড়কে এখানে বিবেচনা করবো… এ হিসাবে দেখা যায়, প্রতি ম্যাচে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট মিচেল স্টার্কের (৭২.৮৮)। সাকিব ৬৮.৮৩ পয়েন্ট নিয়ে আছেন তালিকার তিন নাম্বারে!
সবশেষে আসি, অলরাউন্ডারদের ক্ষেত্রে অ্যাভারেজ ডিফারেন্সে (ব্যাটিং এভারেজ- বোলিং এভারেজ)। আমরা এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৫০০ রান এবং ১৫ উইকেটকে ‘কাট পয়েন্ট’ হিসেবে ব্যবহার করব। মাত্র ১৩ জন অলরাউন্ডার এই কাট পয়েন্টে উত্তীর্ণ হয়েছেন, যার মধ্যে ৮ জনের আছে পজিটিভ অ্যাভারেজ ডিফারেন্স। এবং আবশ্যিকভাবেই সাকিব তাদেরই একজন।
আরো কিছু প্যারামিটারে সাকিবের অবস্থান দেখা যাক। সর্বাধিক ফিফটির তালিকায় শচীনের (১৫) পরই আছেন সাকিব (১০)। পঞ্চাশোর্ধ ইনিংসের ক্ষেত্রেও তাই, শচীনের (২১) পরই সাকিব (১২)। আবার ডট বল করার ক্ষেত্রে মালিঙ্গা (৭৮৭) এবং ভেট্টোরির (৭০২) পরই আছেন সাকিব (৬৭৯)।
এতক্ষণ আমরা পরিসংখ্যানে দেখলাম সাকিবের শ্রেষ্ঠত্ব। তারপরও অনেক কিছুই বাকি থেকে যায়। সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের ব্যাটিং-বোলিং দু’ক্ষেত্রেই প্রধান ভূমিকার চাপ নিয়ে খেলেন, যা অন্য কোনো খেলোয়াড়কে করতে হয়নি। সাকিব এদিক থেকে অনন্য। অন্য খেলোয়াড়দের তুলনায় সতীর্থদের অনেক কম সাহায্য পেয়েছেন সাকিব, তাই দলীয় সাফল্য অতটা সমৃদ্ধ নয়। এ বিশ্বকাপই তার একটা বড় প্রমাণ। তারপরও যেমন অবিশ্বাস্যভাবে একটা দলকে তিনি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, তা রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়। সামনের দিনগুলোতে হয়তো নিজেকে এমন এক অনতিক্রম্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন, ভবিষ্যতের খেলোয়াড়েরা সেখানে যাওয়ার স্বপ্নই দেখতে চাইবে। এই সাকিবের খেলা আমরা দেখতে পারছি, এই সাকিব আমাদের দেশের হয়ে খেলেন, এটাই আমাদের অনেক বড় পাওয়া। আমরা ভাগ্যবান, আমরা সাকিবের যুগে বাস করি।
(সকল ডাটা ৭ জুলাই, ২০১৯ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ম্যাচের)