ব্রাজিলের হয়ে গোলপোস্টের নিচে বিশ্বকাপ মাতাচ্ছেন অ্যালিসন বেকার। কিন্তু এই অবধি তার আসার পেছনে আছে একটা গল্প, একজন মানুষ। সেই ভাইয়ের গল্প শুনিয়েছেন অ্যালিসন বেকার নিজে।
বিশ্বকাপ ১৯৯৮।
আমার তখন ৫ বছর বয়স। আমার ভাই মুরিয়েলের বয়স ১০। ব্রাজিল-নেদারল্যান্ডস ম্যাচটা আমরা চাচির বাসায় বসে দেখছিলাম। বেশ জমাট পার্টি চলছিলো। আমার চাচি নিজের হাতে সব খাবার বানিয়েছিলেন। বড় কেক ছিলো, সবকিছুই ছিলো। খেলাটা পেনাল্টি পর্যন্ত গড়ালো। আর আমার বাবা ও চাচা একেবারে পাগল হয়ে গেলেন। ওনারা আর চাপ নিতে পারছিলেন না। এমনকি বসেও থাকতে পারছিলেন না। তাফারেল যখন শেষ পেনাল্টিটা ঠেকালো, বাবা বসার ঘর থেকে চিৎকার করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। এরপর কী করলেন? কেকের মধ্যে নিজের মাথাটা ঠেসে ধরলেন। আর সারা মুখ চুলকাতে চুলকাতে আবার বসার ঘরে ঢুকে চিৎকার করছিলেন,
“আমরা ফাইনালে যাচ্ছি! আমরা ফাইনালে যাচ্ছি!”
একজন শিশু হিসেবে এটি ছিল আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে মজার দৃশ্য। খুব ভদ্রস্থ করে বললে বলতে হয়, বাবা যেন আনন্দে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
সেই ঘটনার বিশ বছর পর তার ছেলে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে। আর আমি যদি সত্যি কথা বলি, যেটা আমি স্বীকার করতে চাই না, সেটা হলো, আমার অবস্থাও এখন বাবার মতো।
আপনি যদি আমাকে ব্রাজিল বা রোমার হয়ে খেলতে দেখেন, তাহলে আমার বেশ শান্ত উপস্থিতি দেখতে পাবেন। কিন্তু আমি চিরকাল এমন ছিলাম না। আপনি যদি এখন আমার শৈশবে একজন স্কাউট পাঠাতে পারেন, সে এসে লিখবে:
অ্যালিসন বেকার: সাত বছর বয়স, গোলরক্ষক।
বেঁটে, খ্যাপাটে এবং প্রায়শ কাঁদতে থাকে।
আমি জানি, এটা ঠিক ব্রাজিল জাতীয় দলের গোলরক্ষকের বর্ণনা বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এটাই সত্যি। আমাকে এখানে আসতে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
সত্যি কথা হলো, আমি যখন কৈশোরে পা রাখি, তখন আমি আমার পরিবারেরও সেরা গোলরক্ষক ছিলাম না। মুরিয়েল গোলরক্ষক ছিলো। ও জানতো, আমাকে খেপাতে হলে কী করতে হতো। আমার ধারণা, সব বড় ভাইয়ের এই প্রতিভাটা থাকে। আবার অন্য অর্থে ও আমাকে শিখিয়েছে, কিভাবে আবেগটা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
আমার জীবনের গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সে।
আমি তার জন্যই গোলে খেলছি শেষ অবধি। কেউ কেউ বলে, গোলরক্ষক হওয়াই আমার নিয়তি ছিলো; সেটাও হয়তো সত্যি। মানে, আমার মা ছিলেন তার স্কুল হ্যান্ডবল দলের গোলরক্ষক। আমার বাবার দাদা আমাদের নভো হামবুর্গ শহরের অপেশাদার একটা দলের গোলরক্ষক ছিলেন। আমার বাবা তার কোম্পানির দলের গোলরক্ষক ছিলেন। কে জানে, এটা হয়তো আমাকে নিয়ে ঈশ্বরের পরিকল্পনা ছিলো।
আমার যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন আমি আর ভাই বাবার খেলা দেখতে যেতাম। সেখান দেখতাম, বাবা খেলাটা কতোটা উপভোগ করছেন। সত্যি কথা বললে, বাবা মাঠেও খানিকটা পাগলাটে ছিলেন। উনি সবসময় স্ট্রাইকারের পায়ের ওপর মাথা দিয়ে লাফ দিয়ে পড়তেন বল ধরার জন্য। ওনার আসলেই একটা বুনো স্টাইল ছিলো। আমরা দুই ভাই ওনার খুব ভক্ত ছিলাম। আর ওনার স্টাইলটাই আমাদের ভেতরে খানিকটা এসেছে। আমার মনে হয়, বাচ্চারা তাই হয়, নাকি? আপনি আপনার বাবাকে কিছু একটা ভালো করতে দেখলেন, ভাবলেন, “আমাকেও তার মতো হতে হবে।”
তবে আমার গোলে দাঁড়ানোর আসল কারণ আমার ভাই। আমি ওর বন্ধুদের সাথে খেলছিলাম। ওরা সবাই আমার চেয়ে বয়সে ও আকারে বড় ছিলো। ফলে যখন দল করার সময় আসতো, অবশ্যই সবচেয়ে খাটো ছেলেটাকে গোলে পাঠানো হতো। এটা নিয়ে কেউ আলোচনারও দরকার মনে করতো নাম, জানেন?
তবে আমার জন্য এটা ঠিকই ছিলো। কারণ, আমি গোলে দাঁড়ানো পছন্দ করতাম। আসলে পছন্দ বললে ভুল হবে, গোলে দাঁড়ানোটা আমি ভালোবাসতাম।
সে সময় অবশ্য ফুটবলটা আমাদের জন্য স্রেফ মজার ব্যাপার ছিলো। তবে তখনই ২০০২ বিশ্বকাপ এলো। আমি আর ভাই ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠতাম। চকলেট, কর্নফ্লেকস, মিষ্টি দুধ দিয়ে পেট ভরাতাম এবং অবশ্যই খেলা দেখতাম। আর ব্রাজিল যখন জিতলো… সেই অনুভূতিটা ভুলার নয়। সেটা একটা নতুন জীবন আবিষ্কারের মতো ছিলো। আমি তখন ভাবলাম, আমি জীবনে এটাই করবো। আমি ব্রাজিলের হয়ে খেলবো। আমি বিশ্বকাপ খেলবো। এবং আমি এটা জিতে ফিরবো।
তখনই আমি ফুটবলটাকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া শুরু করলাম। নভো হামবুর্গতে আমরা রাস্তায় যখনই খেলতাম, আমি গোল পাহারা দিতাম। আমার পরিবার যখন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নিজেদের বাড়িতে উঠে গেলো, তখন আমি আর ভাই, এক বনাম এক ফুটবল খেলতাম; প্লাস্টিকের একটা বল দিয়ে। আমরা বসার ঘরের দরজা খুলে রাখতাম এবং ওটাই ছিলো আমাদের গোল পোস্ট। আরে ভাই, সেটা ছিলো একটা বীভৎস ব্যাপার! আর খুব মজা হতো। সম্ভবত আমার জীবনের সেরা সময়।
এই বয়সে এসে আমি পোর্তো অ্যালেগ্রেতে ইন্টারন্যাসিওনালের যুব দলে খেলা শুরু করলাম। এটি ছিলো ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলোর একটা। ফলে আমি ঠিকপথে ছিলাম। কিন্তু আমার একটা সমস্যা ছিলো।
আমি আসলেই একটু বেঁটে ছিলাম।
আপনি দেখবেন, আমি একটু দেরি করে পরিণত হয়েছি। ফলে আমার ওই বয়সে আমার বয়সী বাকি গোলরক্ষকরা আমার চেয়ে লম্বা ও শক্তিশালী ছিলো। আমাদের ওখানে বয়সের একটা পরীক্ষা ছিলো- গ্রেড এক থেকে পাঁচ অবধি। আমার সতীর্থরা পাঁচে পৌঁছে গেলেও আমি দুইয়ে পড়ে ছিলাম। আর ব্যাপারটা একজন গোলরক্ষকের জন্য ভালো না, তাই না? আপনাকে লম্বা হতে হবে, অনেক ওপরে লাফাতে পারতে হবে এবং পুরো গোলপোস্ট আগলাতে হবে।
অন্য কথায়, বেটেরা এই কাজের যোগ্য না।
ফলে আমি ওখান থেকে ফিরে আসার কথা ভাবছিলাম।
তখন ইন্টারন্যাসিওনাল পালমেইরাস থেকে নতুন একজন গোলরক্ষক নিয়ে এলো। আর চিন্তা করুন, কী হলো! সে আমার থেকে লম্বা ও শক্তিশালী। আমি ভাবলাম, “ভালো, এখন আমি তৃতীয় পছন্দ। তাহলে আমি এভাবে ব্রাজিল দলে খেলবো কেমন করে?”
আমার নিজেকে নিয়ে খুব সন্দেহ তৈরি হলো। তখন নাইকি কাপ শুরু হলো, ওটা ছিলো ১৪ ও ১৫ বছর বয়সীদের নিয়ে বিশাল একটা টুর্নামেন্ট। আমার ভাই যখন এই টুর্নামেন্ট খেলেছিলো, ও এখানকার সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলো। আমাদের বাসায় ওর সেই ট্রফিটা ছিলো। আমি ওটার দিকে তাকিয়ে বলতাম,
“ভাই, আমারও এমন একটা দরকার।”
কিন্তু আমি তো খেলতেই পারলাম না। সত্যি বলি, আমি তখন সবকিছু গোছানোর চিন্তা করছি। আমি তো গ্রেট খেলোয়াড়দের কাহিনী জানতাম। ইকার ক্যাসিয়াস, জিয়ানলুইজি বুফনের মতো খেলোয়াড়রা সব ১৭ বছর বয়সে প্রথম একাদশে চলে এসেছেন। আমি ওনাদের মতো হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আর কতো অপেক্ষা করবো?
আমার জীবনে কী আদৌ সেই দিন আসবে? তখন অন্তত তেমন মনে হচ্ছিলো না।
ক্লাবও দ্বিধায় পড়ে গেলো, আমি কী আদৌ বাড়তে শুরু করবো? নাকি আসলেই আমি বেটে-খাটো থেকে যাবো। আমার ধারণা, ঈশ্বর ওপর থেকে আমার ওপর নজর রাখছিলেন। কারণ, ওরা আরও এক বছর দেখার সিদ্ধান্ত নিলো। দেখতে চাইলো, আমি বেড়ে উঠি কি-না।
আমার টেকনিক দ্রুতই উন্নত হচ্ছিলো। আর তখনই বিস্ময়কর এক ঘটনা ঘটলো, আমি শেষ অবধি লম্বা হতে শুরু করলাম। এক বছরে আমি ১৭০ থেকে ১৮৭ সেন্টিমিটারে পৌঁছে গেলাম! আমার বেড়ে ওঠার মাপ চারে পৌঁছে গেলো। হঠাৎ করেই আমার শরীর ও টেকনিক দুটোই ঠিক হয়ে গেলো। লোকেরা আমাকে খেয়াল করতে শুরু করলো। আমার বয়স যখন ১৬, আমি দাদাবাড়ির পাশের সৈকতে বন্ধুদের সাথে বসেছিলাম। হঠাৎ ফোন চেক করে দেখি দাদার কাছ থেকে পাঁচটা মিস কল এসেছে। আমি তো সবচেয়ে খারাপ কিছু ভয় পাচ্ছিলাম।
আমি ভাবলাম, হা ঈশ্বর, সম্ভবত বাড়ির কারো খারাপ কিছু হয়েছে। তাড়াতাড়ি আতঙ্ক নিয়ে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম,
“দাদা, কী হয়েছে?”
উনি বললেন,
“বাছা, তোমাকে এখনই বাসায় ফিরে যেতে হবে।”
“কেন? কেউ আহত হয়েছে? কেউ মরে গেছে?”
“আরেহ। না, না, না। তুমি ব্রাজিল অনূর্ধ্ব-১৭ দলে ডাক পেয়েছ।”
দেখুন, আমি আসলেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার দাদা সবসময় রসিকতা করতেন। ফলে আমার মনে হলো, আমার বাড়ি ফিরে এটা আগে যাচাই করে দেখা উচিত। তখনই আমার চাচা ফোন করলেন। আর একই কথা বললেন।
“কী রে, বাঁদর? অভিনন্দন।”
তারপরও আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম, এরা সবাই মিলে কিছু একটা রসিকতা করছে।
আমি সৈকত থেকে ৩০ মিনিট দৌড়ে বাসায় ফিরলাম। কম্পিউটারে বসে সিবিএফের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে যাচাই করলাম…
আমি পেজটায় ঢুকলাম। ওখানে লেখা ছিলো: অ্যালিসন বেকার। আমাকে আসলেই ডাকা হয়েছে!
এখন সময়টা ফিরে দেখলে মজার মনে হয়। ওই তালিকায় আরও কয়েকটা নাম ছিলো।
নেইমার, কৌতিনহো।
এরপর সবকিছু দ্রুত হতে থাকলো। ২০১৩ সালে, ২০ বছর বয়সে আমি ইন্টারন্যাসিওনালের মূল দলে খেলে ফেললাম। দুই বছর পর আমি ব্রাজিল মূল দলে আমার প্রথম ম্যাচ খেললাম। ওই খেলাটা আমার জীবন বদলে দিলো। আমি কখনো কখনো একটু থমকে দাড়াই। নিজেকে বলি,
“ওয়াও, ভাই, আজ আমি এখানে! ব্রাজিল জাতীয় দল। আমি বিশ্বকাপে খেলতে এসেছি! এটা তো ঈশ্বরের একটা চমৎকার উপহার।”
এই অবধি যা কিছু অর্জন করেছি, সে জন্য আমার ভাইকে ধন্যবাদ দিতে হবে।
আমরা একই ক্লাবে একই পজিশনে খেলতাম। সবসময় লোকেরা আমাদের তুলনা করতো। তারা বলতো,
“অ্যালিসন কী মুরিয়েলের মতো ভালো হবে?”
কেউ বলতো, হবে। কেউ বলতো, না। আমি কখনো ভাইয়ের সাথে আমার তুলনা করি না। তবে সে আমার জীবনের একটা লক্ষ্য দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একজন পেশাদার হিসেবে আমাকে সবসময় আমার ওপরে যারা আছে, তাদের সাথে নিজেকে তুলনা করতে হয়। আমি সবসময় তার চেয়ে ভালো হতে চেয়েছি। কিন্তু সে ছিলো মারাত্মক লড়াকু। আমার কাছে কখনোই হারতে চাইতো না। ফলে ইন্টারন্যাসিওনালের সেই সময়টায় আমরা প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতাম। আমরা কেউ অন্যের চেয়ে খারাপ করতে চাইতাম না। আমি যখন ক্লান্ত হয়ে যেতাম, ও বলতো, ‘আরেহ, ভাই, এসো। আরেকটু পরিশ্রম করো।’ আমি তাই করতাম।
আর ও যখন ক্লান্ত হয়ে যেতো। আমি বলতাম,
“একটু নড়ো, বুড়ো ভাই। আমার দিকে দেখো, আমি এখনও বাচ্চা একটা ছেলে। এখনই তোমাকে হারাতে পারি।”
আমরা যখন প্লাস্টিকের বল দিয়ে খেলতাম, সেই থেকে আমার জীবন এমনই চলে এসেছে। ভালোবাসায় মেশানো এক লড়াইয়ের জীবন।
কখনো কখনো আমি কতো ভাগ্যবান, এটা ভুলে যাওয়া সহজ। তবে আমি কখনোই এটা ভুলবো না যে, আমাকে এখানে আসতে কে সাহায্য করেছে। এই গ্রীষ্মে আমি কেবল ব্রাজিলের হয়ে খেলছি না, আমি ভাইয়ের হয়েও খেলছি। আর সত্যি বলি, প্রতিবার আমি ব্রাজিলের জার্সি পরি আর আমাদের একসাথে সেই পরিশ্রমের কথা মনে করি।
ভাই, তুমি যদি এই লেখাটা পড়ে থাকো, জেনো রাশিয়ায় আমি প্রতিটা সেভ করবো, সেগুলো তোমারও সেভ। আমার সাফল্য তোমার সাফল্য। কারণ, আমাদের গল্পটা যে একই। আর সে জন্য আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো।
ফিচার ইমেজ: Players Tribune