এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী তরুণরা পেসার হওয়ার স্বপ্ন দেখে, অনুপ্রেরণা পায় মাশরাফি বিন মুর্তজার নামে। কিন্তু শুধু পেসার কিংবা ফাস্ট বোলার দিয়েই তো ক্রিকেট চলে না। প্রয়োজন ঘূর্ণি বোলারেরও। সাকিব আল হাসান কিংবা প্রায় ‘সাবেক’ হতে বসা আব্দুর রাজ্জাকরাও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তাদের সামনে ছিল একজন ‘আইডল’। যার নাম মোহাম্মদ রফিক। সাদা পোশাকের টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ১০০ উইকেট নেওয়া বোলার।
বাঁহাতি স্পিনার রফিক একদিনের ওয়ানডে ক্রিকেট ফরম্যাটেও সবার আগে দেশের হয়ে ১০০ উইকেট নিয়েছেন। এই দুই ফরম্যাটে এক হাজার রানও আছে তার। ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সিতে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন বারবার। খারাপ সময় কাটিয়ে অনুপ্রেরণা হয়েছেন বাকিদের জন্য। হয়তো ওই সময়ে না খেলে বর্তমান দলে খেলতে পারলে তার অর্জন হতে পারতো আকাশছোঁয়া। এমন একটা সময়ে টেস্ট খেলেছেন, যখন বাংলাদেশ প্রায় সময় দ্বিতীয় ইনিংসে বলই করতে পারেনি। তাতে করে রফিক গড়পড়তা অনেক টেস্টেই বল করার সুযোগ পেয়েছেন কেবল এক ইনিংসে। অথচ এই দ্বিতীয় ইনিংসেই উইকেট কব্জা করে বেশিরভাগ স্পিনাররা!
১০ বছর আগে লাল-সবুজ জার্সি খুলে রাখা রফিককে নিয়ে অনেক গল্প হতে পারে। তার জীবন নিয়ে গল্প হওয়াটাও জরুরি। শূন্য থেকে শীর্ষে আসার উদাহরণ যখন হাতের পাশে, তখন বিদেশি গল্পে মন ভরিয়ে কী লাভ? বুড়িগঙ্গার রাখাল বালক রফিক হয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গরীব ঘরের রফিকের চোখে স্বপ্ন দেখেছিল হাজারো তরুণ। নিজে যা করতে পারেননি, সেই পড়াশোনার জন্য সরকারি জমি দান করেছিলেন স্কুলের জন্য। এসব আখ্যান সবার জানা।
১.
আসলেই রাখাল হয়েছিলেন রফিক। জিঞ্জিরার এই ছেলে গরু চরাতে গিয়ে নৌকার মাঝিকে আকুতি জানিয়ে আসতেন ঢাকার পারে। টানটা ছিল কেবলই ক্রিকেটের জন্য। ১৯৭০ সালে জন্ম নেওয়া এই মানুষটার ক্রিকেটের প্রতি ছিল অগাধ আগ্রহ। ঢাকায় আসলে ক্রিকেট খেলা যায়, এই ভাবনাটা মনের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন হয়তো সেই ছোটবেলাতেই, গরীব ঘরে জন্মানো, পড়াশোনা করতে না পারার সব আক্ষেপ চুকিয়ে দিতে পারে এই ক্রিকেট। কেবল ঢাকাতেই নয়, বুড়িগঙ্গার এপারে আসতে না পারলে ওপারের জিঞ্জিরার বস্তিতেই চলত জমিয়ে ক্রিকেট খেলা। সেখান থেকে আজকের রফিককে কেউ হাতে করে বানিয়ে দেয়নি, নিজেই হয়েছেন।
এখনও যারা নিজেদের ভাগ্য নিয়ে আক্ষেপ করে, তারা যেন অন্তত রফিকের জীবনটা নিয়ে একটু হলেও পড়াশোনা করে। তাতে হয়তো বাড়তি অনুপ্রেরণা মিলতে পারে। অবশ্য রফিককে যে বারবার কিংবদন্তি বলা হচ্ছে, এটা কিন্তু সবাই বাধ্য হয়েছে মানতে। সেই মানানোর কাজটা করে দেখিয়েছেন তিনি নিজেই।
শুরুতে ছিলেন বাঁহাতি পেসার। পেশাদার ক্রিকেট খেলাও শুরু করেন সেই পেসার হিসেবেই। ১৯৮৫ সালে ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশ স্পোর্টিংয়ে যোগ দেন। বন্ধু ওয়াসিম হায়দার রফিককে স্পিন করার পরামর্শ দেন। কারণ পেসার হয়েও বলে ‘টার্ন’ করাতে পারার গুণটা আগে থেকেই ছিল তার মধ্যে।
বন্ধুর কথায় স্পিন শুরু করলেন। সফলও হলেন। বলা যায়, আজকের রফিকের পিছনে কিঞ্চিত হলেও অবদান আছে তার বন্ধু ওয়াসিম হায়দারের। তিনি যদি সেদিন রফিককে স্পিন করার পরামর্শ না দিতেন, তাহলে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার প্রথম বছরেই একজন ‘গ্রেট’ নিয়ে শুরু করতে পারতো না।
রফিকের বেড়ে ওঠা অবশ্য বাংলাদেশ বিমানে। সেখান থেকেই সবার চোখে পড়া শুরু করলেন তিনি।
আস্তে-ধীরে বাংলাদেশের জার্সিটাও গায়ে উঠলো তার। ১৯৯৪ সালে ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে ২৫ রান দিয়ে নিলেন ৩ উইকেট। তবে আন্তর্জাতিকভাবে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিলো পরের বছরই, ১৯৯৫ সালে। প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। আজকের আইসিসি ট্রফি জয়ের জন্য যে ইতিহাস বাংলাদেশ পেয়েছে, তার পিছনে অবদান ছিল রফিকের। কেনিয়ার বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে ২৫ রান খরচ করে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।
২.
জাতীয় দলের জার্সিতে রফিক খেলেছেন ৩৩ টেস্ট ম্যাচ। ১০০ উইকেটের সঙ্গে একটি সেঞ্চুরি ও চারটি হাফ সেঞ্চুরি মিলিয়ে মোট রান করেছেন ১,০৫৯। ওয়ানডে খেলেছেন ১২৫টি। কাকতালীয়ভাবে এই ফরম্যাটে তার উইকেটও ২৫টি। ব্যাটে দুটি হাফ সেঞ্চুরিসহ মোট রান ১,১৯১। অবসরের আগ পর্যন্ত একটি টি-টোয়েন্টি খেলেছিলেন। সেখানে এক উইকেটের সঙ্গে ১৩ রান করেছিলেন।
বোলার হয়েও বারবার রানের কথা উল্লেখ করতেই হচ্ছে। কারণ তিনি ছিলেন অলরাউন্ডার। দলের প্রয়োজনে লোয়ার অর্ডারে তার ব্যাটে বাউন্ডারির ফুলঝুরি ফুটত। বর্তমান সময়ে মাশরাফি যে কাজটা করে দেন, সেই সময়ে রফিক হারহামেশাই সেভাবে দলের জন্য ব্যাটে দ্রুত স্ট্রাইক রেট তুলতেন।
জাতীয় দলে হঠাৎ করেই নির্বাচকরা আবিষ্কার করলেন, দুজন বাঁহাতি স্পিনার খেলানো যাবে না টেস্টে। তাতেই নাম কাটা পড়লো রফিকের। বনে গেলেন পুরোদস্তুর ওয়ানডে বোলার। সেদিন নির্বাচকদের এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্তের বলি না হলে হয়তো আজ অন্তত শ’দুয়েক টেস্ট উইকেট লেখা থাকত রফিকের নামের পাশে।
জাতীয় তো গেল, ঘরোয়াতে কেমন ছিলেন রফিক? সেখানেও বিজয়ীর ঝাণ্ডা ঘুরিয়েছেন দীর্ঘদিন। প্রথম শ্রেণিতে ৬২ ম্যাচ খেলে ২৩৭ উইকেট নিয়েছেন। রান করেছেন ১,৭৪৮। একটি সেঞ্চুরি ও নয়টি হাফ সেঞ্চুরি আছে তার এখানে। লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন ১৬৪টি। মোট উইকেট ১৮৪, রান ১,৫৫১।
৩.
খুব গরীব ঘর থেকে উঠেছিলেন বলেই কিনা মানুষের কষ্টটা বুঝতেন তিনি। তাই তো আইসিসি ট্রফি জিতে যখন তাকে এই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কী চাও?
উত্তরে রফিক বলেছিলেন নিজের এলাকার কথা। তিনি বলেছিলেন, “বাবুবাজারে একটা ব্রিজ হলে খুব ভালো হতো। খুব কষ্ট হয় দু’পাড়ের মানুষের আসা-যাওয়া করতে।” রফিকের কথায় সেদিন প্রধানমন্ত্রী অবাক হয়েছিলেন কিনা জানা নেই, তবে ব্রিজ সত্যিই হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, সরকারি জমি মিলেছিল জাতীয় দলের সবার। সেই জমিতে রফিক কী করলেন? নিজে কিছুই করেননি। স্কুল তৈরির জন্য দান করে দিয়েছিলেন! এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “আমরা তো পড়াশোনা করতে পারি নাই, পোলাপাইনগুলা যেন পারে।”
সেই স্কুল নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে রাজি হন না রফিক। কোনরকম প্রচারেই আসতে চান না তিনি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আজ বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ড। ক্রিকেটারদের জন্য তারা আজ বিদেশি কোচ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। অথচ রফিককে কাজে লাগানোই যেত। এ নিয়ে হয়তো রফিকেরও আক্ষেপ আছে হয়তো, কিন্তু কারো মুখাপেক্ষী হননি তিনি। শুধু অভিমানই করেছেন। নতুন প্রজন্মকে শেখাতে মুখিয়ে থাকেন সবসময়। বিসিবির নতুন কর্মযজ্ঞ হাইপারফরম্যান্স ইউনিট (এইচপি)-তে রফিককে কোচ হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল বলে শোনা গিয়েছিল। তিনি নাকি যোগ দিয়েছিলেন। ক’দিন কাজও করেছিলেন। তারপর আর কোনো খোঁজ নেই। হয়তো বিসিবি আর তাকে কাজে লাগায়নি।
তবে দেশের ক্রিকেট সংস্থা তাকে মনে রাখুক বা না রাখুক, তাকে মনে রেখেছে বিশ্ব ক্রিকেট। শচীন টেন্ডুলকার-শেন ওয়ার্ন-শোয়েব আকতারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া মাস্টার্স চ্যাম্পিয়ন লিগে রফিককে পরামর্শক হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও (বিপিএল) কাজ করেছেন তিনি।
রফিক আছেন এ দেশের মানুষের মনে, মননে। ক্রিকেট ছেড়ে এখন ব্যবসায় মন দিয়েছেন। কিন্তু মনটা যে পড়ে থাকে ক্রিকেটেই! নিজের একটা অ্যাকাডেমি তৈরির স্বপ্ন দেখে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন। সে কাজটাও গুছিয়ে আনার লড়াই চালাচ্ছেন এখন। রফিক আছেন কিংবদন্তি হয়ে, বাংলাদেশের কিংবদন্তি।
ফিচার ইমেজ: ESPNcricinfo