[১ম পর্ব পড়ুন]
শিল্প এবং দাবা যে পরস্পর সমার্থক এবং খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের- তা আমরা জেনেছি বেশ আগেই; দাবা-বোদ্ধারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। ষষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মিখাইল বৎভিনিক যেমন বলেছেন,
“দাবা হলো এমন এক আর্ট যেখানে বিজ্ঞানের যুক্তি প্রকাশ পায়!”
আর আজ যাদের নিয়ে আলোচনা হবে, তাদের মধ্যে একজন আনাতোলি কারপভ। তার উক্তি তো সর্বজনবিদগ্ধ,
“দাবাই সব- আর্টস, সায়েন্স বা স্পোর্টস!”
অর্থাৎ দাবার সাথে বিজ্ঞানের পাশাপাশি শিল্প, কলা, আর্ট, ড্রয়িং এসবের যোগসাজশ রয়েছে বৈকি!
এই সম্পর্ককে অন্য মাত্রা দিয়েছেন অস্ট্রেলীয় দাবা কোচ ব্র্যাড অ্যাশলক। ক্লাসিক্যাল দাবার ১৬ বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে তার ক্যানভাসে তুলে এনেছেন ব্র্যাড। তার ইচ্ছা- নতুন দাবার প্রজন্ম তার শেকড়কে যেন ভুলে না যায়। অত্যাধুনিক চেস ইঞ্জিনগুলোর যুগে পুরনো চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে না ঘাঁটাঘাঁটি করলে যদিও আহামরি কোনো ক্ষতি হবে না, তবুও দাবার হেরিটেজ বলে তো একটা বিষয় আছে! পূর্বসূরিদের না চিনলে তাদের অবদান ছোট করে দেখা হয়। তাই অ্যাশলক আশা করেন, তার পোর্ট্রেটগুলো দেখে যেন নবীনরা তাদের সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী হয়।
প্রথম পর্বে আমরা শুরুর ৮ জন বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের দেখেছি। এ পর্বে ৯ম থেকে ১২তম, অর্থাৎ কারপভ পর্যন্ত আলোচনা আছে। শেষ পর্বে আমরা সর্বশেষ ৪ জন তথা গ্যারি ক্যাসপারভ থেকে ম্যাগনাস কার্লসেন পর্যন্ত দেখব।
৯. তিগ্রান পেত্রশিয়ান (১৯৬৩-৬৯)
তিগ্রান ভার্তানোভিচ পেত্রশিয়ান ছিলেন সম্ভবত সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডার, তার উপাধিই ছিল আয়রন তিগ্রান। যেকোনো থ্রেটকে ১০ মুভ আগে থেকেই আঁচ করতে পারতেন তিগ্রান, এজন্যই সবসময়ের সেরা সলিড প্লেয়ার বলা হয় তাকে। বৎভিনিকের রাজত্ব চিরতরে শেষ করে দেন প্রফ্যালেকটিক ডিফেন্সের অধিকারী পেত্রশিয়ান; অ্যালিয়েইখিন কারপভের মাঝে এই দুজনই কেবল একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। খেলোয়াড় হিসেবে পেত্রশিয়ান দেখিয়ে গেছেন যেকোনো পজিশন থেকেই ডিফেন্ড করা সম্ভব। অনেক ডিফেন্সিভ রসদের সাথে দাবাজগৎ পরিচিত হয়েছে তার হাত ধরেই।
ব্রিলিয়ান্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে খ্যাত ছিলেন তিগ্রান, সাথে পজিশনাল স্ট্রেংথ আর ট্যাকটিক্সেও তার দখল ছিল। তবে তিনি মোটেই অ্যাটাকার ছিলেন না, ছিলেন একজন ডিফেন্স মাস্টার। পজিশনাল স্কিলে দক্ষতা থাকলেও তার অমোঘ অস্ত্র ছিল ডিফেন্স। তিগ্রান ছিলেন খুব স্মুদ, বেশ শান্ত, ব্যালান্সড আর ঠাণ্ডা মাথার। স্নায়ুতন্ত্র ভালো কাজ করত তার, খুব সমন্বিত আর অবিচ্ছেদ্যভাবে। এভাবেই পেত্রশিয়ান উন্নতি করেছিলেন নিজের, কোনো তাড়াহুড়ো ছাড়া, সিস্টেম্যাটিকভাবে আর কোনো ব্রেকডাউন না ঘটিয়ে।
১০. বরিস স্পাস্কি (১৯৬৯-৭২)
প্রথম ট্রু মডার্ন ইউনিভার্সাল চ্যাম্পিয়ন বলা হয় বরিস ভাসিলিয়েভিচ স্পাস্কিকে। বোর্ডের যেকোনো পজিশন থেকে খেলা বের করে আনার সক্ষমতা ছিল তার। তিনিই কিং’স গ্যাম্বিট ওপেনিং ব্যবহার করা শেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, তিনি তা সফলভাবেই ব্যবহার করেছিলেন। স্পাস্কি খুব নিখুঁত দাবা খেলতেন। এদিক থেকে আবার স্মিস্লভের সাথে তার মিল পাওয়া যায়। তিনি মূলত একেক গ্রেট থেকে একেকটি গুণ আত্তীকরণ করেছিলেন। স্মিস্লভ যেখানে শান্ত-সৌম্য খেলা খেলতেন, স্পাস্কি সেখানে আগ্রাসী ধাঁচে খেলতেন। সবচেয়ে বড় কথা, স্পাস্কি প্রতি খেলায় নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে খেলতেন। সাথে পুরো বোর্ড জুড়েই খেলতেন। তার গেমগুলো দেখতেও দৃষ্টিসুখকর।
স্কোরলাইনই যে সবটা বলে দেয় না, তার প্রমাণ মিলেছিল ইতিহাসে হাতেগোনা কিছু ম্যাচে, তেমন একটা ম্যাচ ছিল ফিশার-স্পাস্কি ম্যাচ। ছোটখাট বিষয়গুলো আমলে নিতেন না স্পাস্কি, এটা কখনো কখনো সমস্যায় ফেলেছে তাকে। দেখা গেল, উইনিং পজিশনে তিনি, তাই তেমন ক্যালকুলেশন না করেই হুট করেই একটা দান দিয়ে দিলেন। ফলে তার শক্তিই দুর্বলতায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। আর তিনি কিছুটা দুর্ভাগাও ছিলেন, কারণ ফিশার যুগে খেলতে হয়েছিল তাকে। খুব কম বিশ্বচ্যাম্পিয়নই ফিশারকে রুখতে পেরেছিল।
১১. ববি ফিশার (১৯৭২-৭৫)
রবার্ট জেমস ফিশার, বা দাবা-দুনিয়া তাকে যে নামে চেনে ববি ফিশার, ছিলেন খুব এনার্জেটিক। একসময় তিনি সবাইকে সবকিছুতে টেক্কা দিয়েছিলেন; এনার্জি, ফোর্স, প্রিপারেশন, প্লেইং স্ট্রেংথ- সবকিছুতে। সব রশ্মি যেন এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। তার বলতে গেলে কোনো দুর্বলতাই ছিল না তখন! সব গ্রেট প্লেয়ারই তাদের ক্যারিয়ারের একসময়ে সবাইকে সব দিক থেকে ছাড়িয়ে যান। ফিশারের ক্ষেত্রে সেসময়টা ছিল ক্যান্ডিডেটস সাইকেল এবং স্পাস্কির সাথে ম্যাচের সময়কাল।
১৯৬৯-৭২ সালে তিনি টানা ২০ জয়ের কীর্তি গড়েন, এমনকি একটা ড্রও হয়নি! এটা ছিল অবিশ্বাস্য, আর তার জয়গুলো ছিল বিধ্বংসী! এর মধ্যে ছিল ১৯৬৯ ইন্টারজোনালের শেষ ৭ গেম, মার্ক তাইমানোভের সাথে ক্যান্ডিডেটস কোয়ার্টারফাইনালে ৬-০ তে জয় এবং একইভাবে সেমিফাইনালে বেন্ট লার্সেনের সাথেও ৬-০ তে জয়! এরপর ক্যান্ডিডেটস ফাইনালে পেত্রশিয়ানকে ৬.৫-২.৫ পয়েন্টে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন। বাকিটা সবারই জানা, ১৯৭২ সালের চ্যাম্পিয়নশিপে বরিস স্পাস্কিকে ১২.৫-৮.৫ পয়েন্টে হারিয়ে দিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন!
ফিশারের এই বিদ্যুৎগতির দাবার প্রশংসায় ক্রামনিক বলেন,
“ফিশারের কথা আর কী বলব? কী-ই বা বলার আছে তাকে নিয়ে। বলা হয়, তার নিয়তিই নির্ধারিত হয়েছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া, কিছুই তাকে সেটি অর্জন থেকে থামাতে পারত না। এটা ছিল পূর্বনির্ধারিত। তার খেলার শুরুর দিক থেকেই এর আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। যে পাঁচ বছর তিনি ফর্মের চূড়ায় ছিলেন, সে সময়েই এটা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, চ্যাম্পিয়ন তিনিই হতে যাচ্ছেন! স্পাস্কি বুঝেই উঠতে পারেননি তাকে কী আঘাত হানতে চলেছে। আমার মনে হয়, অন্য যেকোনো বিশ্বচ্যাম্পিয়নও স্পাস্কির জায়গায় থাকলে হেরে যেতেন। এর কারণ এটা নয় যে তারা ফিশারের থেকে দুর্বল দাবাড়ু, বরং দুরন্ত ফিশারের নিয়তিই বোধহয় এমন ছিল যে তার সামনে কেউই দাঁড়াতে পারবে না। যেকোনো ডিফেন্স গুঁড়িয়ে দেয়ার সক্ষমতা তার ছিল।”
১২. আনাতোলি কারপভ (১৯৭৫-৮৫)
ফিশার-ক্যাসপারভের মাঝে পড়ে যাওয়ায় অনেকটা পাদপ্রদীপের আড়ালেই থেকে যান আনাতোলি ইউভগেনেভিচ কারপভ, তবে কারপভের মতো পজিশনাল জিনিয়াস দাবার দুনিয়া দেখেছে খুব কমই। ইতিহাসে একমাত্র বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রতিপক্ষের ফোরফিটের দ্বারা শিরোপা হস্তান্তর হয়েছে তার সময়ই। কারপভ চ্যাম্পিয়ন থাকাবস্থায় অনেক টুর্নামেন্ট খেলে জিতেছেন এবং দেখিয়ে দিয়েছেন কেন তিনি সেরা। তিনি দুবার তার টাইটেল ডিফেন্ড করেন ভিক্টর কোর্চনোইয়ের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে।
কারপভও ইউনিভার্সাল খেলতেন, ভালো ট্যাকটিশিয়ান ছিলেন। ভ্যারিয়েন্ট গণনাতেও দক্ষতা ছিল, সাথে তার একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। স্টাইনিসের একটা নীতি তিনি মানতেন না, সেটা হলো- খেলায় এগিয়ে থাকলেই আক্রমণ করতে হবে। কারপভ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় আক্রমণ শুরু করতেন না, এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, তার সুবিধা আরও বাড়তেই থাকত। এমনকি যখন চূড়ান্ত আক্রমণের প্রয়োজন, তখন তিনি a3 বা h3 এর মতো ঠাণ্ডা চাল দিতেন, আর অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিপক্ষ ভেঙে পড়ত!
কারপভের দম ছিল অনেক বেশি, তার মতো ফাইটিং স্পিরিট খুব কম দাবাড়ুরই ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে খেলে যেতে পারেন তিনি। আর আগের গেমে কী হয়েছে, তা বেমালুম ভুলে যেতে পারতেন। তার সাথে ইকুয়াল গেম ড্র হলে প্রতিপক্ষ স্বস্তি পেত যে, মানসিক অত্যাচারটা শেষ তো হলো! কোনো ধরনের মুড সুইং জাতীয় বিষয় তাকে কখনও থামাতে পারেনি, এলেন, বসলেন, খেলা শুরু করলেন – এমন গতিতে এগোতেন তিনি!
আগামী পর্বে আমরা শেষ চার বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিষয়ে জানবো। ক্যাসপারভ, ক্রামনিক, আনন্দ এবং বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন- ব্র্যাড অ্যাশলকের আঁকা তাদের পোর্ট্রেট দেখব।