ইংল্যান্ডে গ্রীষ্মকাল মানেও শীত। জুনে তাপমাত্রা থাকে ২৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৮-৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত। তাই বলা যায়, এই বঙ্গীয়দেশের ক্রিকেটাররা যখন বিশ্বকাপ খেলতে যাবেন, তাদের কাছে সেটাও একরকম শীতকাল বলেই মনে হবে। আসন্ন ২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের প্রস্তুতিটা ক্রিকেটের পাশাপাশি সেখানকার কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জটাও থাকবে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের। কিন্তু এই আবহাওয়া কিংবা শীত-গ্রীষ্মের বাইরেও বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা করার বিস্তর জায়গা আছে। সেগুলোর সবচেয়ে বড়টি হলো – ইনজুরি।
যদিও বারবার বলা হচ্ছে, ইংল্যান্ডে এবারের বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে উইকেট ব্যাটিংসহায়ক হবে। তারপরও সহজাত পেস সহায়ক পরিবেশকে মাথায় রেখে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তাদের ১৫ সদস্যের মূল দলে ভিড়িয়েছে ৫ পেসার, যার মধ্যে রয়েছেন রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, আবু জায়েদ রাহী এবং অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। এই পাঁচজনের মধ্যে তিনজন, মুস্তাফিজ, রুবেল ও সাইফউদ্দিন রয়েছেন চোটগ্রস্থ অবস্থায়। সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থা বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজের। চলমান ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে খেলতে গিয়ে গোড়ালির চোটে ২ সপ্তাহের জন্য ছিটকে গেছেন, চলছে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া।
পেসারদের ইনজুরি নিয়ে সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত দলের পেস বোলিং কোচ ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি কোর্টনি ওয়ালশ। তাই এখন থেকেই চালিয়ে যাচ্ছেন কড়া নিয়ম আর শৃঙ্খলা। তিনি জানিয়েছেন, ইংল্যান্ডে ৩০ মে থেকে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপকে সামনে রেখে পেসারদের নিয়ে পুরো কোচিং টিম কাজ করে যাচ্ছে।
১.
যেহেতু মুস্তাফিজ এখনও পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নন, তাই তাকে শতভাগ ফিট করাটাই টিম ম্যানেজমেন্টের মূল কাজ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও দু’টি নাম, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন এবং রুবেল হোসেন। তাদের ফিটনেস নিয়েও কাজ করে যাওয়ার কথা বলেছেন ওয়ালশ।
এরই মধ্যে তিনজনের উপর আলাদা আলাদা শর্ত আরোপ করা হয়েছে। মুস্তাফিজের আগে থেকেই রুবেল স্ট্রেইনের ইনজুরিতে ভুগছিলেন। সে কারণেই ২৫ মার্চের পর থেকে লিগের সব ম্যাচ থেকে রুবেলকে বাইরে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, সাইফউদ্দিন মাঠে নামতে পারলেও তার উপর নির্দেশ, ৩০ গজের মধ্যে ফিল্ডিং করতে হবে। বলে রাখা ভালো, সাইফউদ্দিন ‘টেনিস এলবো’র ইনজুরিতে ভুগছেন।
বিশ্বকাপের আগে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়ারল্যান্ড ও উইন্ডিজের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রস্তুতি চালাচ্ছেন। যেখানে অংশ নিয়েছেন মাত্র পাঁচজন ক্রিকেটার: তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন এবং মুশফিকুর রহিম! দলের বাকিদের প্রায় সবাই প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারকা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান রয়েছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল)।
সাংবাদিকদের ওয়ালশ বলেন,
‘অনুশীলনের প্রথম দিন। দলের বেশ কিছু সদস্য প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে সময় দিচ্ছে। এটা তাদের জন্য ভালো। যারা প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে নেই, তারা আজ ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে।’
তিনি বলেন,
‘পাঁচজন পেসারের মধ্যে ফিজ (মুস্তাফিজুর রহমান), রুবেল এবং সাইফউদ্দিনের ইনজুরি আছে। আমরা তাদেরকে বোলিংয়ে ফিরিয়ে আনতে চাই। বিশ্বকাপ এবং আয়ারল্যান্ড (ত্রিদেশীয়) সফরের জন্য তাদের সর্বোচ্চ পারফরম্যান্সটা বের করে আনতে চাই।’
তবে এই তিনজন যদি বিশ্বকাপে কেবল ফিটনেসের কারণে আটকে যান, সেক্ষেত্রে কোচ ওয়ালশ হাতে ‘অপশন’ রাখছেন। এ প্রসঙ্গে তার ভাবনা,
‘আমাদের হাতে তাসকিন আহমেদ, খালেদ আহমেদ এবং শফিউল ইসলাম আছে। যদি আমাদের বিকল্প পেসার দরকার হয়, তাহলে আমরা তাদেরকে নিয়ে ভাবতে পারি। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’
এত কিছুর মধ্যে ওয়ালশের মূল দুর্ভাবনা মুস্তাফিজকে নিয়ে। বাঁহাতি এই পেসারকে নিয়ে সতর্ক ওয়ালশ এগোতে চান খুব সাবধানে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক অতীতে একাধিকবার ইনজুরিতে পড়া মুস্তাফিজ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন।
‘আসন্ন বিশ্বকাপে যদি মুস্তাফিজ শতভাগ ফিট থাকে, তাহলে বাংলাদেশের হয়ে বড় দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছে সে। কিন্তু আমার মনে হয় না, একজনের উপর আমাদের নির্ভর করা উচিত হবে। সাকিব (আল হাসান), ম্যাশ (মাশরাফি বিন মুর্তজা) এবং রুবেল ধারাবাহিক ফর্মে আছে। ইনজুরির কারণে মুস্তাফিজ এই মুহূর্তে বল হাতে সেরা ফর্মে নেই। চোট নিয়ে কিছুটা ভুগছে সে।’
তিনি আরও বলেন,
‘ফিট থাকলে মুস্তাফিজ আপনাকে ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তার আগে তাকে আমাদের ফিট হিসেবে তৈরি করতে হবে। আমাদের হাতে এখনও কিছু সময় আছে। আমার দুশ্চিন্তা হলো, তাকে যেন আমরা খুব বেশি ব্যবহার না করি আয়ারল্যান্ড সিরিজে। তাকে আমাদের বিশ্বকাপের জন্য ঠিক রাখতে হবে।’
মুস্তাফিজ নিজেও ভাবছেন তার ইনজুরি নিয়ে। তবে এই মুহূর্তে তিনি আশাবাদী। তার ইনজুরি তাকে খুব একটা বিপদে ফেলবে না বলেই বিশ্বাস তার। মুস্তাফিজ বলেছেন,
‘এখনও ব্যাথা আছে। ব্যথাটা অনুভব করা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে তাড়াহুড়োর কিছু নেই, কারণ এখনও অনেক সময় আছে। বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোর মধ্যেও বড় ছুটি আছে। আমি আশাবাদী যে, এগুলো নিয়ে আমি কোনো বিপদে পড়বো না। আর ইনজুরি নিয়ে তো কিছু বলার নেই। আপনি যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো সময়ে ইনজুরড হতে পারেন।’
২.
ওয়ালশ বিশ্বাস করেন, বিশ্বকাপে মুস্তাফিজের বোলিংয়ের বৈচিত্র্য বাংলাদেশ দলের জন্য ‘কী ফ্যাক্টর’। বিশেষ করে ব্যাটিং-সহায়ক উইকেটে মুস্তাফিজের স্লোয়ার এবং কাটার প্রতিপক্ষকে ভোগাতে দারুণ ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করেন এই ক্যারিবিয়ান।
তিনি বলেন,
‘আমাদের জন্য বিশ্বকাপ অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। বড় একটা টুর্নামেন্ট, অনেক ভালো উইকেট পাওয়া যাবে, যেগুলো ব্যাটিংসহায়ক। আমাদেরকে মেধা খাটাতে হবে, পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু বাস্তবায়ন করতে হবে।’
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ দলকে ইংল্যান্ডের কন্ডিশন নিয়ে খানিকটা পড়াশোনার পরামর্শও দেন তিনি,
‘আমাদের উচিত হবে সেখানকার (ইংল্যান্ড) কন্ডিশন এবং আবহাওয়া নিয়ে একটু খোঁজখবর নেওয়া। কিছু ভেন্যুতে অন্যান্য জায়গার চেয়ে বল বেশি সুইং করবে। আমাদেরকে এগুলো জেনে নিতে হবে। ওখানকার বেশিরভাগ উইকেটই হবে ডোসাইল এবং ফ্ল্যাট। আমাদের অবশ্যই বোলিংয়ে বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করতে হবে, সেগুলোকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’
বাংলাদেশ এখন আর আগের মতো নেই। ওয়ানডে ফরম্যাটে এই মুহূর্তে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি। সে কারণেই প্রতিপক্ষরাও যে বাংলাদেশকে সমান গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটাও মনে করিয়ে দিলেন ওয়ালশ।
তার মতে,
‘সবাই সবার শক্তি এবং দুর্বলতার জায়গা নিয়ে কাজ করছে। অন্যরাও আমাদের নিয়ে কাজ করছে। আমরাও অন্যদের শক্তি এবং দুর্বলতা জানি। আমাদের উচিত হবে, সেগুলো নিয়ে কাজ করা। এভাবেই আমরা ভালো কিছু করতে পারবো।’
শুধু পেসাররাই নয়, দীর্ঘদিন ধরে মুশফিক পাঁজরের ইনজুরিতে ভুগছেন, চোট নিয়ে চাপে আছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। যেকোনো সময় সাকিবের আঙুলের পুরনো চোট ফিরতে পারে, সেই শঙ্কা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ইনজুরি ভালোই ভোগাতে পারে বলেই দুশ্চিন্তার ভাঁজটা আরও চেপে বসছে টিম ম্যানেজমেন্টের কপালে।