জাতীয় দলের কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো নিজেও হতাশ। মাঝে তো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছে গিয়ে বলেই ফেলেছিলেন,
‘তোমাদের ক্রিকেটারদের ফিটনেসের এমন হাল কেন?’
ক্রিকেটে সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা খুব বেমানান। তারপরও প্রায়শই এই কথাটা শুনতে হয়। বাংলাদেশে ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলে কথাটা বেশি সাজে। ক্রুসিয়ান কোচ থাকাকালে একবার বলে ফেলেছিলেন,
‘এই মুরগীর মতো পা নিয়ে ফুটবল খেলা হয় না।’
তারপরও ফুটবল খেলছে বাংলাদেশ। কিন্তু ক্রিকেটে এই হাল হলে তো খুব বিপদ! তার উপরে আবার ক’দিন পরই শুরু হচ্ছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে ‘হেরেমেরে খাবি খাওয়া’ অবস্থা শেষে তাই দলের ফিটনেস নিয়েই বেশি ভুগতে হচ্ছে বিসিবিকে। আর তাই, হুট করেই নিয়ম করে দেওয়া হলো, জাতীয় লিগে খেলতে হবে জাতীয় দলের সবাইকে। ব্যস, আলোচনা তুঙ্গে।
অনেক তারকা ক্রিকেটার জাতীয় লিগে ফিরলেন। খবরটা ‘সুখবর’ বটে। কিন্তু দিনশেষে অঘটন অন্যখানে। এই তামিম-মুশফিকদের জায়গা দিতে গিয়ে সঙ্কটে পড়লো নিয়মিত ক্রিকেটারদের ভাগ্য। তাদের অংশগ্রহণ করতে পারা আর না পারা নিয়ে যখন আলোচনা, তখনই এলো বিপ টেস্টে ১১ পয়েন্ট তোলার ইস্যু। বিসিবি থেকে বলে দেওয়া হলো, জাতীয় লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে হলে বিপ টেস্টে ন্যূনতম ১১ তুলতেই হবে।
নিয়ম অনুযায়ী, বিসিবির সিদ্ধান্ত যথার্থ। পরিস্থিতির বিচারেও তা অত্যন্ত সময়োপযোগী। কিন্তু গোল বাঁধে বয়স্ক ক্রিকেটারদের নিয়ে। মোদ্দা কথা, তুষার ইমরান, আব্দুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ আশরাফুল; প্রমুখ ক্রিকেটাররা এই ৩০ পেরিয়েও বিপ টেস্টে ১১ তুলতে পারবেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তার উপর জাতীয় দলের মতো সুযোগ-সুবিধা ঘরোয়া ক্রিকেটাররা পায় না। সেখানে নিজেদের ফিটনেস প্রমাণ করাটা সত্যিকার অর্থেই চ্যালেঞ্জিং হয়ে যায়। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে এসব ‘বয়স্ক’ তকমা পাওয়া ক্রিকেটাররাই ঘরোয়া লিগের অলঙ্কার।
তারপরও বিসিবির চ্যালেঞ্জ নিতে মুখিয়ে ছিল ক্রিকেটাররা। কিন্তু আশাবাদী, নৈরাশ্যবাদী; অনেকেই উতরে গেছেন, অনেকেই পারেননি। দিনশেষে তাদের জন্য আবার ‘স্পেস’ রেখেছে নির্বাচকরা। বিপ টেস্টে ১১ তুলতে না পারা ব্যর্থদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। প্রথম দফায় তিনি ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় আবারও বিপ টেস্ট দেন তিনি। কিন্তু সেখানেও পুরোপুরি ১১ তুলতে পারেননি। শেষপর্যন্ত ‘বিশেষ বিবেচনায়’ ‘পাস’ মার্ক দেন নির্বাচকরা। শুধু আশরাফুল নন, সিনিয়রদের পাশাপাশি নাসির হোসেনের মতো অনেক তরুণ ক্রিকেটারও নিজেদের ফিটনেসের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
জাতীয় দলে একসময়ে নিয়মিত সদস্য হিসেবে খেলা অনেক ক্রিকেটারই বিসিবির নতুন এই নিয়মের বিরোধিতা করেছেন, সমালোচনা করেছেন। নাসির হোসেন তো বিপ টেস্টের আগেই বলে দিয়েছিলেন,
‘বিপ টেস্ট দিয়ে পারফরম্যান্স বিচার করা যায় না। যারা বিপ টেস্টে ভালো করছে তারাই দেখা যাবে আমাদের চাইতে খারাপ খেলছে।’
অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটার এই মানদণ্ডকে মানতে নারাজ। এদের মধ্যে বিপ টেস্টে ৯.৭ পাওয়া নাসির হোসেন ছাড়াও আছেন আশরাফুল (প্রথমবার ৯.৬), আব্দুর রাজ্জাক (৯.৪), আরাফাত সানি (১০.৯), ইলিয়াস সানি (১০), নাদিফ চৌধুরী (১০.৪) এবং মোহাম্মদ শরীফ (১০.৬)। তারপরও, শুভাগত হোম, নাজমুল অপু, শাহাদাত হোসেন রাজিবের মতো পুরনোরা বিসিবির ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ উতরেও গেছেন।
বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট স্ট্রেন্থ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ তুষার কান্তি হাওলাদার, যিনি কি না জাতীয় লিগের জন্য বিপ টেস্ট পরিচালনা করেছিলেন, তিনি বলেছেন,
‘খুব ভালো একটা উদ্যোগ ছিল। বেশিরভাগই ভালো করেছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে সবাই ১১ তুলতে পারবে না, কিন্তু যা করেছে তা স্বাভাবিক। সবার শারীরিক গঠন এক নয়, তাই সবাই নির্ধারিত অবস্থানে পৌঁছতে পারবে তা অসম্ভব। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি এই ন্যূনতম পয়েন্ট (১১), তুলতে না পারে তাহলে তিনি এনসিএল খেলার টিকিট পাবেন না। সবার জন্য একই সুযোগ। চাইলে ক্রিকেটাররা সময় নিয়েও বিপ টেস্টে অংশগ্রহণ করত পারেন।’
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের নির্বাচক সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারও বিপ টেস্ট নিয়ে তুষার কান্তির মতো একই ধারণা পোষণ করেন। তবে তিনি বলেছেন, ১১ পয়েন্ট তুলতে একজন ক্রিকেটার প্রথমবারই নয়; চাইলে পাঁচবার বিপ টেস্টে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
তিনি বলেন,
‘যদি প্রয়োজন হয়, আমরা ক্রিকেটারকে আরও সুযোগ দেব। পাঁচবার পর্যন্ত সে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। গেল বছরে আমরা চারজন ক্রিকেটারকে পেয়েছিলাম যারা বিপ টেস্টে ব্যর্থ হয়েছিল। আমরা বলেছিলাম যখন খুশি তারা আবার পরীক্ষা দিতে পারে। কিন্তু ন্যূনতম পয়েন্ট তুলতে না পারলে তাকে খেলতে দেওয়া যাবে না। সেই চারজনের মধ্যে তিনজনই পরবর্তীতে বিপ টেস্ট পাশ করে এনসিএলে নাম লিখিয়েছিল।’
বিপ টেস্ট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাকে সেভাবে পাত্তা দিতে চান না হাবিবুল বাশার। তার মতে, দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে বিসিবির এই উদ্যোগ যথার্থ। এক্ষেত্রে ক্রিকেটারদের ফিটনেস খেলায় সাফল্যে এনে দেওয়ার পথে প্রথম সিঁড়ি হবে। এ ব্যাপারে সামনের দিনগুলোতে আরও উন্নয়ন করার তাগিদও অনুভব করেন তিনি। জাতীয় দলের বাইরে ঘরোয়া ক্রিকেটারাও যেন নিজেদের ফিটনেস নিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়, সেই উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ তার।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
‘গেলবার বিপ টেস্টের পাশ মার্ক আরও বেশি ছিল। কেউ এ ব্যাপারে জানে না, এমন নয়। তাই এ নিয়ে বেশি আলোচনা কেন হচ্ছে আমি জানি না। তবে যে যা-ই বলুক, আমি মনে করি সবাই এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই নিচ্ছে এবং আমি এ নিয়ে খুশি। আমি মনে করি ক্রিকেটাররা বুঝতে পারছে ফিটনেস কতটা জরুরি। আমরা চেষ্টা করছি ফিটনেসে একটা নতুন স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করতে, যেন সবাই এর গুরুত্ব অনুভব করতে পারে।’
তবে বিপ টেস্টে ব্যর্থ হওয়ায় সবচেয়ে আলোচিত হয়েছেন মোহাম্মদ আশরাফুল। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ওঠার পর থেকে নিয়মিত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছিলেন তিনি। এমনকি ইংল্যান্ডে কেন্ট লিগও খেলেছেন তিনি। বারবার জানিয়ে আসছিলেন নিজের ফিটনেস নিয়ে ইতিবাচকতার কথা। সেই আশরাফুলও প্রথম ধাক্কায় পার হতে পারেননি।
আশরাফুল অবশ্য এ নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাইলেন। বললেন,
‘যদি এটা ১০.৪ কিংবা ১০.৫ হতো, তাহলে আমার জন্য ভালো হতো। কিন্তু আমি বিপ টেস্টে এবার ৯.৭ (প্রকৃতপক্ষে ৯.৬) তুলতে পেরেছি। অবশ্যই হতাশ। আরও একবার দেব। দেখি কী হয়।’
আশরাফুল গেল ৪ অক্টোবর আবারও বিপ টেস্ট দিয়েছিলেন। এবার তুলেছেন ১০.৫। নির্বাচকরা তাকে শেষপর্যন্ত সবুজ সংকেত দিয়েছেন বিশেষ বিবেচনায়। দীর্ঘদিন ঢাকা মেট্রোতে খেলা এই ক্রিকেটার এবার খেলছেন বরিশালের হয়ে।
ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ফিটনেস নিয়ে বিসিবির এমন ‘শক্ত অবস্থান’ এর মূল কারণ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। কারণ, সেখানে ভালো করার উপরেই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ২০২৩ বিশ্বকাপ।
ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো:
১) এগারো (বাংলাদেশের ১১ ক্রিকেটারের গল্প)
২) কাছের ক্রিকেট দূরের ক্রিকেট
৩) মাশরাফি