অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা দেওয়ার শুরুটা হয়েছিলো ১৯৬০ এর দশকে। অনেকের কাছে অ্যাওয়ে গোলের গুরুত্ব না থাকতেই পারে। তবে এই অ্যাওয়ে গোলের কারণেই চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে কিছু ক্লাসিক ম্যাচ, কিছু বিতর্ক আর সীমাহীন হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের স্মৃতি।
চ্যাম্পিয়নস লিগে ২ লেগের কোনো ম্যাচে ৪-১ গোলের বিরাট ব্যবধানে হেরে যাওয়া মানেই সব হারানো নয়। প্রতিপক্ষের মাঠে করে আসা একমাত্র গোল সম্পূর্ণ ভাগ্য ঘুরিয়ে দিতে পারে, যদি পরের ম্যাচে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটিয়ে ফেলা যায়। আর এমন অবিশ্বাস্য ম্যাচ মাঠে গড়িয়েছে বহুবার। দুই লেগ মিলিয়ে ড্র করে অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে পরের রাউন্ডের যাবার ইতিহাস অহরহ। চ্যাম্পিয়নস লিগের তেমন কিছু ক্লাসিক ম্যাচের গল্পই আজ বলা হবে।
ইন্টার মিলান বনাম এসি মিলান (২০০২/০৩), সেমি-ফাইনাল
২০০২/২০০৩ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ ছিলো ইতালিময়। ফাইনালে ছিলো জুভেন্টাসের মতো দল। সেমি ফাইনালে মিলান ডার্বির মতো ঐতিহাসিক ম্যাচ। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমি ফাইনাল ম্যাচ এবং তাতে লড়বে এসি মিলান ও ইন্টার মিলানের মতো দল। এর থেকে উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ আর কী হতে পারে? অনেক সময় বড় দুই দলের মুখোমুখি লড়াই তেমন জমে ওঠে না। তবে ঐ মৌসুমের সেমি ফাইনাল ছিলো চিরদিন মনে রাখার মতো।
এসি মিলান ও ইন্টার মিলান দুই ক্লাবের মাঠ সান সিরো। তাই প্রথম ম্যাচটি ছিলো ইন্টার মিলানকে অ্যাওয়ে ধরে এসি মিলানের মাঠে। তবে কোনো গোল ছাড়াই শেষ হয় সেমি ফাইনালের প্রথম লেগটি। দ্বিতীয় ম্যাচ ইন্টারের মাঠে। তাই নিয়ম অনুযায়ী এসি মিলানের জন্য অ্যাওয়ে ম্যাচ।
প্রথম লেগ গোলশূন্যভাবে শেষ হওয়ায় দারুণ সুযোগ ছিলো মিলানের জন্য। সে সুযোগকেই প্রথমার্ধে ব্যবহার করে তারা। হাফ টাইমের আগে অতিরিক্ত মিনিটে ক্ল্যারেন্স সিডর্ফের দারুণ এক পাসে মিলানের হয়ে গোল করেন আন্দ্রেই শেভচেঙ্কো। ইন্টারও ম্যাচের শেষ মুহূর্তে ফিরে এসেছিলো। কিন্তু জিতে যা নেবার তা জিতে নিয়েছে মিলানই। ম্যাচ ড্র হলেও তারা লুফে নিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ে গোল, যা তাদের ফাইনালে যাবার দুয়ার খুলে দিয়েছিলো।
সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিলো ইন্টার মিলানই। জুভেন্টাসকে পেনাল্টি শ্যুটআউটে হারিয়ে ওল্ড ট্রাফোর্ডে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা উচিয়ে ধরেছিলো শেভচেঙ্কোর মিলান।
মোনাকো বনাম রিয়াল মাদ্রিদ (২০০৩/০৪), কোয়ার্টার-ফাইনাল
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ৪-২ গোলে মোনাকোকে হারিয়ে বেশ স্বস্তিতেই ছিলো লস ব্লাঙ্কোসরা। মোনাকোর পুরো লেগ জিতে পরের রাউন্ডে উঠতে পরের ম্যাচে কোনো গোল না খেলে ৩ গোল দিতে হবে। রাউল, গুতি, ক্যাসিয়াসদের ৩ গোল দেওয়া মোনাকোর পক্ষে সম্ভব না ভেবে অনেকে মোনাকোর জেতার আশা ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু মোনাকোর আছে গুরুত্বপূর্ণ ২ অ্যাওয়ে গোল, তা যেন কারও স্মরণেই ছিলো না।
মোনাকোর মাঠে যদিও প্রথম গোল করেছিলেন রাউল। অ্যাওয়ে গোল পেয়ে এবং ৩ গোলের ব্যবধানে এগিয়ে যাবার পর মাদ্রিদের বিপক্ষে চড়াও হয় মোনাকো। প্রথমে লুডোভিক জুলি গোল করেন, তারপর ফার্নান্দো মরিয়েন্তেস তার জীবনের সবথেকে অদ্ভুতুড়ে গোলটি করেন। মরিয়েন্তেস তখন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে মোনাকোতে ধারে খেলতেন। তারপরও সদ্য ছেড়ে আসা ক্লাবের বিপক্ষে উদযাপন করতে পিছপা হননি। ৬৬ মিনিটে জুলি তৃতীয় গোলটি করলে দুই লেগ মিলিয়ে ম্যাচে ৫-৫ গোলে সমতায় আসে। আর এভাবেই ড্র-তে ম্যাচটি শেষ হয়।
কিন্তু ড্র হলে জিতবে কে? ম্যাচে ব্যবধান কী? ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায় অ্যাওয়ে গোল। যেখানে মোনাকো সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে জোড়া গোল দিয়ে এসেছিলো, সেখানে মাদ্রিদ তাদের মাঠে এসে মোটে একবার বল জালে জড়াতে পেরেছে।
চেলসি বনাম বার্সেলোনা (২০০৮/০৯), সেমি-ফাইনাল
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে অন্যতম ভুতূড়ে ম্যাচের খেতাব দিলেও তেমন ভুল হবে না। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের সমর্থক থেকে কাতালান, সবাই এ ম্যাচের সুখ ও দুঃখের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত ম্যাচও এটি। এ ম্যাচের রেফারি টম ওভরেভো হয়ত চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে চাইবেন ম্যাচের স্মৃতি। অনিচ্ছাকৃতভাবেই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেবার মতো সিদ্ধান্তগুলো তিনি ভুল দিয়েছিলেন। চেলসি পক্ষে চারবার পেনাল্টির আবেদন তার চোখ এড়িয়ে যায়।
প্রথম ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হবার পর স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে প্রথমে চেলসিই এগিয়ে গিয়েছিলো। মাত্র ৯ মিনিটে মাইকেল অ্যাসিয়েন করেন বহু আকাঙ্ক্ষিত গোল। কিন্তু আসল ম্যাজিক তখনও বাকি ছিলো। ৯৩ মিনিটে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার সেই বুলেট শট ও জার্সি খুলে পাগলাটে উদযাপন যেন আজও জীবন্ত।
১-১ গোলে ড্র হবার পর বার্সেলোনা ফাইনালে উঠেছিলো চেলসির মাঠে অ্যাওয়ে গোলের বদৌলতে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাও জিতেছিলো কাতালানরা।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম বায়ার্ন মিউনিখ (২০০৯/১০), কোয়ার্টার ফাইনাল
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বড় ক্লাবগুলোর মুখোমুখি হবার সেরা মাধ্যম হলো চ্যাম্পিয়নস লিগ। আর এই চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের মতো ম্যাচে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং বায়ার্ন মিউনিখ যখন মুখোমুখি হয়, তখন সেই ম্যাচের উত্তেজনা যেন ইউরোপের বাইরে থেকেও অনুভব করা যায়।
অ্যালিয়েঞ্জ অ্যারেনাতে বায়ার্ন মিউনিখ জয় পেয়েছিলো ২-১ গোলে। তবুও ওল্ড ট্রাফোর্ডের ম্যাচটি তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিলো না। রেড ডেভিলদের একমাত্র গোলেই তাদের সমস্ত আশা, কঠোর পরিশ্রম নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কারণ তাদের একটি অ্যাওয়ে গোল আছে। ম্যাচ শুরুর পর সেটাই হতে যাচ্ছিলো। মাত্র ৪১ মিনিটেই টানা ৩ গোল করে ম্যান ইউ।
যা-ই হোক, প্রথমার্ধ শেষের আগে অলিচ একটি গোল ফেরত দিয়ে কিছু আশার সঞ্চার করেন। দ্বিতীয়ার্ধে বায়ার্ন সকল ভুল ও ব্যর্থতা শুধরে নিয়ে নতুনভাবে শুরু করার পরিকল্পনা করে। তার ফলও তারা পেয়েছিলো আরিয়েন রোবেনের দ্বিতীয় গোলের মাধ্যমে। ওল্ড ট্রাফোর্ডে বায়ার্ন মিউনিখ হারে ৩-২ গোলে। কিন্তু ২ লেগে ৪-৪ সমতা ও ২টি অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে বায়ার্ন মিউনিখই নিশ্চিত করে পরের রাউন্ড।
বায়ার্ন মিউনিখ বনাম অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ (২০১৫/১৬), সেমি ফাইনাল
২০১৬ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে একটু বেশিই আগ্রাসী হয়ে উঠেছিলো ডিয়েগো সিমিওনের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। কোয়ার্টার ফাইনালে বার্সেলোনাকে হারিয়ে সেমি ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখকে প্রথম ম্যাচেই বিপাকে ফেলে দিয়েছিলো তারা। সেমি ফাইনালের প্রথম লেগে সাউলের একমাত্র গোলে হেরেছিলো বায়ার্ন মিউনিখ।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অ্যালিয়েঞ্জ অ্যারেনা সব দলের জন্য একরকম দুর্গ। তাই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ কখনো ভাবেনি জার্মানিতে গিয়ে জয় ছিনিয়ে আনার কথা। আলোনসো আর লেভান্ডভস্কির জোড়া গোলে অ্যাটলেটিকো হারে ঠিকই, কিন্তু ৫৪ মিনিটে গ্রিজমান করেন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাঙ্খিত অ্যাওয়ে গোল। দুই লেগ মিলিয়ে ২-২ গোলে ড্র হওয়ার পর গ্রিজমানের ঐ অ্যাওয়ে গোলের উপর ভর করে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ পৌঁছে যায় ফাইনালে। যদিও ফাইনাল জয় করা হয়নি তাদের। সেবার নগর প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের কাছেই শিরোপা হারিয়েছিলো তারা।
মোনাকো বনাম ম্যানচেস্টার সিটি (২০১৬/১৭), শেষ-১৬
শেষ যেবার মোনাকো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিলো, তাদের ইতিহাসে তখন তারা সেরা একটি দল নিয়ে সেরা সময় পার করছে। বার্নার্ডো সিলভা, ফ্যাবিনহো, টিমুই বাকাইয়োকো, থমাস লেমার, কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো উঠতি তারকারা মোনাকো দলে। আর সিটিজেনদের অবস্থা তখন আরও উন্নত। পেপ গার্দিওয়ালার ছোঁয়ায় নতুন স্বপ্নে ছুঁটে চলছে তারা। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ ষোলতে সব পাল্টে যায়।
প্রথম ম্যাচটি ছিলো ইতিহাদ স্টেডিয়ামে। ম্যানচেস্টার সিটি ৫ গোলে জিতলো ঠিকই, কিন্তু মোনাকো পেল তিন তিনটি অ্যাওয়ে গোল। পরের ম্যাচ মোনাকোর মাঠে। মাত্র ৩০ মিনিটেই ২ গোল করে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৫ গোলে সমতায় আনলো তারা। সিটিজেনরা তখন বহু পিছিয়ে। তবুও লিরয় সানের গোলে আরও একবার দৃশ্যপটে ফেরে তারা। কিন্তু সানে গোল করার ৬ মিনিট পর আবার গোল করেন বাকাইয়োকো। ৬-৬ গোলে ম্যাচ শেষ হবার পর, কে আসলে জিতে পরের রাউন্ডে গেল, তা বলাই বাহুল্য।
রোমা বনাম বার্সেলোনা (২০১৭/১৮), কোয়ার্টার ফাইনাল
অসম্ভব, অদ্ভুতুড়ে, অবিশ্বাস্য। এই তিন শব্দই রোমা বনাম বার্সেলোনা ম্যাচের সাথে সম্পর্কিত। কাতালানরা যেমন রচনা করেছিলো হতাশাপূর্ণ একটি গল্পের, সেখানে রোমা তৈরি করেছিলো রূপকথার।
ক্যাম্প ন্যুতে যখন রোমা ৪-১ গোলে হেরে আসে, তখনই ধারণা করা হচ্ছিলো রোমার স্বপ্ন বার্সেলোনার কাছে শেষ। কিন্তু বার্সেলোনার খামখেয়ালিপনায় এডিন জেকোর দেওয়া গোলই যে ব্যবধান এনে দেবে, তা কেউ ভেবেছিলো কি?
৩ গোলে এগিয়ে থেকে রোমার মাঠে দ্বিতীয় লেগে যেন সম্মান রক্ষার্থে নেমেছিলো বার্সেলোনা, কারণ তাদের খেলার ভেতর প্রথম থেকেই কোনো প্রাণ ছিলো না। আর এ সুযোগটাই লুফে নিয়েছিলো রোমা। ঘরের মাঠ ৩-০ গোলে বার্সেলোনাকে হারায় তারা। আর ৪-৪ গোলে ড্র হওয়ায় ব্যবধান গড়ে দেয় এডিন জেকোর অ্যাওয়ে গোল।