ক্রাইস্টচার্চের সেই ভয়াল দুপুর

কোনো কাজে দেরি বা বিলম্ব সাধারণত বিরক্তির উদ্রেক করে। তবে জাগতিক দুনিয়ায় কিছু কিছু বিলম্ব অবশ্য শেষ পর্যন্ত ‘আর্শীবাদ’ হয়েই ধরা দেয়।

গত ১৫ মার্চ কোচ স্টিভ রোডসের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের (বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত টেস্ট অধিনায়ক) মিটিংটা পরেও হতে পারতো। কিন্তু ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনের আগেই তাদের মিটিংটা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদমাধ্যমের সামনে আসার আগে ক্রিকেটারদের আসতে হয় দলীয় জার্সি, ক্যাপ নিয়ে। ক্রিকেটারদের জন্য নৈমিত্তিক কাজের মধ্যেই পড়ে এটি। কিন্তু সেদিন ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভালে সংবাদ সম্মেলন কক্ষের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন মাহমুদউল্লাহ ক্যাপ ছাড়াই। তখন এক বাংলাদেশি সাংবাদিক মনে করিয়ে দিতেই আবার স্পন্সরদের লোগো সম্বলিত ক্যাপ আনতে ছুটলেন টেস্ট অধিনায়ক। সংবাদ সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে সেখানে বিলম্ব হয় ২-১ মিনিট।

প্রেস কনফারেন্সের জন্য দেরি হয়েছিলো সেদিন কিছুটা; Image Credit: UNB Photos

দেড়টায় শুরু হওয়া সংবাদ সম্মেলন স্থায়ী হয়েছিলো মিনিট দশেক। অধিনায়কের অপেক্ষায় তখন গোটা দল। এরপর গন্তব্য আল-নূর মসজিদ, যেখানে জুম্মার নামাজ আদায় করে ফিরে অনুশীলনে নামার কথা বাংলাদেশ দলের।

মাহমুদউল্লাহর দেরি দেখে ড্রেসিংরুমে নিজেদের মাঝে ফুটবল খেলায় মাতেন মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হক, তাইজুল ইসলাম। নিছকই সময় কাটানোর ফুটবল খেলাশেষে টিম বাসে চড়তেও কয়েক মিনিট সময় লেগেছিলো।
আগে থেকে পরিকল্পনা ছিল, জুম্মার নামাজ আদায় করে এসেই মধ্যাহ্নভোজ সারবেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু অজানা আর্শীবাদে সেদিন নামাজে যাওয়ার আগেই মধ্যাহ্নভোজ সেরেছিলেন তামিম ইকবালরা।

হ্যাঁ, এমন কিছু বিলম্বের কারণেই ১৫ মার্চ ক্রাইস্টচার্চে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়েছিলো বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। তারা পৌঁছানোর আগেই আল-নূর মসজিদ রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিলো সন্ত্রাসীর নির্বিচার গুলিবর্ষনে। মসজিদের সন্নিকটে আসতেই অজ্ঞাত এক মহিলার ইশারা ও আরেক মহিলার কথা শুনেই আর সামনে এগোয়নি বাংলাদেশের টিম বাস। নৃশংস হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যায় বাংলাদেশ দল।

তবে অকুস্থলে বাসে বসেই সেই ভয়াবহতা অবলোকন করেছেন ক্রিকেটাররা। চোখের সামনে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া মুসল্লীদের মাটিতে লুটিয়ে পড়া, প্রাণবায়ু ত্যাগের নিষ্ঠুরতম দৃশ্যও চোখে পড়েছে মুশফিক-মুমিনুলদের। সেই হামলায় ৪৯ মুসল্লী নিহত হয়েছেন। উপায়ান্তর না পেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বাস থেকে নেমে হেঁটে মাঠে ফিরেছিলেন।

Image Source: Facebook

ঘটনার কয়েক ঘন্টা পর ভয়াল সেই দুপুরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার মুমিনুল হক। টিম বাসে ২ বা ৩ নম্বর সিটে মুশফিকের সঙ্গে বসেছিলেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসীর অতর্কিত হামলার অভিমুখ থেকে ফিরে আসার আদ্যপান্ত শুনুন মুমিনুলের মুখেই,

‘আমরা মধ্যাহ্নভোজ করে বের হয়েছিলাম। ২টায় অনুশীলন ছিল, দেড়টায় যাওয়ার কথা ছিল। একটু দেরি হয়েছে, রিয়াদ (মাহমুদউল্লাহ) ভাইয়ের প্রেস কনফারেন্স ছিল, তাই ১০ মিনিট পরে বের হইছি। আর আমি, মুশফিক ভাই, তাইজুল মাঝে মাঝে ড্রেসিংরুমে ফুটবল খেলি নিজেদের মধ্যে। যার কারণে আরও ১-২ মিনিট দেরি হয়েছে। মসজিদের কাছে গিয়ে দেখি, সবাই পড়ে আছে। এক মহিলা ফোনে কথা বলছে। উনি আমাদের ইশারা করছে, ওদিকে যেও না। আরও একটু সামনে আরেকজন মহিলা ছিল। উনি গাড়ি থেকে বলছে, সামনে যেও না। ওখানে গোলাগুলি হচ্ছে।

তারপর আমরা ওখানে বাসে বসে ছিলাম ৫-১০ মিনিট। পরে পাইলট ভাই কোথায় যেন ফোনে কথা বলছে। তামিম ভাই পেছনে থেকে এগিয়ে আসে। ড্রাইভার জানালা খুললে রক্তাক্ত মানুষ বের হচ্ছে দেখি। বাস থেকেই দেখি যে, সবাই মসজিদ থেকে বের হচ্ছে আর শুয়ে পড়ছে। রক্তাক্ত মানুষ। তারপর আমরা বাসের পেছনের দরজা খুলে পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলে আসি। ৫ মিনিট আগে গেলে আমরা মসজিদেই থাকতাম, এবং সবাই শেষ হয়ে যেতাম! আল্লাহর অশেষ রহমত, দেরি করে গেছি। মসজিদে গেলে তো… আমরা হয়তো পেছনের দিকে বসতাম। ও (সন্ত্রাসী) তো কাউরে রাখে নাই। টানা গুলি করছে, ভিডিওগুলো যদি দেখেন, বুঝবেন। এত ভয় পাইছি সবাই, আমরা ঠিক কেঁদে দিছি।

Image Credit: Wikimedia

আর ভাই, এই দেশে কী নিয়ম বলেন, এমন ঘটনার মধ্যে আমরা পড়েছি, অথচ ড্রাইভার বাস পেছনে নেয় না। বাস পেছনে নিতে বললে ও (ড্রাইভার) বলেছে, সামনে যেতে পারবো, পেছনে যাওয়ার নিয়ম নেই। আগেরবারও আমরা এই মসজিদে নামাজ পড়ছি সবাই, ক্রাইস্টচার্চে যখন খেলা হয়েছে। আল্লাহ নিজ হাতে আজ (১৫ মার্চ) আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। গতকাল (১৪ মার্চ) রিয়াদ ভাই বলতেছিলো, কাল (১৫ মার্চ) তো জুম্মার নামাজ। লাঞ্চ কি নামাজ পড়ে এসে করবি, নাকি লাঞ্চ করে মসজিদ যাবি। আমরা বলছিলাম, অনুশীলন যেহেতু পরে, তাহলে নামাজ পড়ে এসেই লাঞ্চ করবো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা, আজ লাঞ্চ করেই মসজিদে গেছি। তাই বেঁচে গেছি।

আসলে আমরা সবাই আজ (১৫ মার্চ) ওই মহিলার কারণে বেঁচে গেছি। মহিলাই আমাদেরকে বলছে, সামনে না যেতে। নাহয় আমরা আরও এগিয়ে যেতাম। কারণ, প্রথম যে মহিলাকে শুয়ে থাকতে আমি দেখছি, আমি মনে করছি এটা নিউ জিল্যান্ড, এখানে আর কী হবে। হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। মহিলা বলার কারণেই আমরা সামনে যাইনি। মহিলার গাড়িতে গুলি লাগছিলো।’

বিদেশ সফরে নিরাপত্তাহীন টাইগাররা

পুরো সফরেই নিরাপত্তাকর্মী ছিল না বাংলাদেশ দলের সাথে; Image Credit: CNN

কোনো দল বাংলাদেশে সফরে আসলেই নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সর্বোচ্চ অতিথিদের সৎকারের পাশাপাশি তাদের জান-মালের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকে বাংলাদেশ। অথচ নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে একজনও নিরাপত্তাকর্মী ছিল না! গোটা সফর জুড়েই বাংলাদেশ দলের সঙ্গে কোনো নিরাপত্তাকর্মী দেয়নি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড। টিম বাসে ছিল না কোনো লিয়াজোঁ অফিসারও, যা নিয়ে ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মাঝে।

সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশের এক ক্রিকেটার বলেছেন,

‘আমাদের দেশে আমরা কত নিরাপত্তা দেই বিদেশি দলগুলোকে। যারাই যায়, বাসের কাছেই কেউ যেতে পারে না। বিশ্বাস করেন, পুরো সফরে আমাদের সাথে একটা সিকিউরিটিও ছিল না। এটা কীভাবে হয় বলেন। একটা বিদেশি দল হিসেবে ন্যূনতম সিকিউরিটি পাবো না আমরা!’

দৃশ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখেনি বিসিবি

নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে দৃশ্যমান কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিসিবির সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন,

‘এটা দুঃখজনক যে, দৃশ্যমান কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমরা দেখিনি। আমরা জানি না, তাদের সিকিউরিটি সিস্টেমটা কী। কিন্তু যখন দুই দেশের সিরিজ বিষয়ক সমঝোতা চুক্তি হয়, তখন কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের নিরাপত্তার কথা বলা হয়। কিন্তু একেকটা দেশের নিরাপত্তার মান নির্ধারণ করা হয় নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়নের মাধ্যমে। আমাদের দেশে যখন কোনো দল আসে, তখন কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে, এবং সে অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এর সাথে সফরকারী দল যদি আরো কিছু যোগ করার প্রয়োজন মনে করে, তাহলে তারা তাদের স্থানীয় হাইকমিশনের সহায়তায় সেটা করে। এটাই হলো সাধারণ অনুশীলন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের মতো দলের সাথে এ রকম করা হয়। এছাড়া উপমহাদেশের দলগুলোর জন্য এরকম হয় না। তবে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এরকম হয়ে থাকতে পারে।’

বিদেশ সফরে জাতীয় দলের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন বিসিবি পরিচালক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন। অগ্রবর্তী দল পাঠাতে হবে। তাদের রিপোর্টে নিরাপত্তা আয়োজন নিয়ে অবহিত হওয়ার পর সবকিছুতে সন্তুষ্ট হলেই দল পাঠানোর কথা বলছেন সুজন।

সংবাদপত্রে ক্রাইস্টচার্চ হামলা নিয়ে শিরোনাম; Image Credit: The Straits Times

তিনি বলেছেন,

‘এখানে যখন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ড আসে তখন পুরো সিকিউরিটি দল আসে। আমাদের হোটেল চেক করে, রাস্তাঘাট দেখে। কোন রাস্তা দিয়ে বাস আসবে এবং কোন দিক দিয়ে হোটেলে যাবে, প্রত্যেকটা জিনিস দেখে। এমনকি প্রত্যেকটা ভেন্যুতেই যায়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশেরও এমন করা উচিত। কারণ ওরাও আন্তর্জাতিক দল, আমরাও আন্তর্জাতিক দল।’

জাতীয় দলের এই সাবেক অধিনায়কের মতে, ভবিষ্যতে ক্রিকেটারদের ইনজুরির চিকিৎসার মতোই নিরাপত্তার বিষয়ে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ দল যেখানেই সফরে যাক না কেন। সুজন বলেছেন,

‘আমরা যেমন ওদের ইনজুরি কাটানোর জন্য কাজ করি, ভালো জায়গায় ট্রিটমেন্টে পাঠাই, তেমন নিরাপত্তার বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এবং শক্তভাবে এই নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা উচিত। সেটা আমরা যেখানেই পাঠাই, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া যেখানেই হোক।’

নিউজিল্যান্ড সফরজুড়েই বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সের খাতায় ছিল রাজ্যের হতাশা। সফরে মাঠের ক্রিকেটে ঠিকই ব্ল্যাক ক্যাপসদের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু জীবনের কাছে ২২ গজের লড়াই, রোমাঞ্চ সবই নস্যি! সেই জীবনই গত ১৫ মার্চ ক্রাইস্টচার্চে বিপন্ন হতে যাচ্ছিলো। স্রেফ কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সেই বর্বর হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে ফেরেন তামিম-মুশফিকরা।

আল-নূর মসজিদের সন্ত্রাসী হামলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, নিউ জিল্যান্ডে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটিয়েছে বাংলাদেশ দল। এটুকু এখন নিশ্চিত, বিসিবিকে ভবিষ্যতে যেকোনো সফরে দলের খেলা, রেজাল্ট, পারফরম্যান্সের মতোই ক্রিকেটারদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

 

This article is in Bangla language. It is about the Christchurch terrorist attack, which was described by Mominul Haque, one of the witnesses of such a horrible experience. This article also contains several quotes regarding this issue from Nizam Uddin Chowdhury (CEO, BCB) and Khaled Mahmud Sujon.

Featured Image: AFP

Related Articles

Exit mobile version