করোনা মহামারির জন্য ২০২০ সালের জন্য নির্ধারিত ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ (ইউরো) এক বছর পিছিয়েছে, যা শুরু হতে চলেছে আগামী ১১ জুন, শুক্রবার থেকে। ২০২১ সালে হলেও এটি পরিচিত হবে ইউরো ২০২০ নামেই। ইউরোর ১৬তম এই আসর শুরু হবে তুরস্ক বনাম ইতালির ম্যাচ দিয়ে। পুরো ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন ১১টি শহরের ১১টি স্টেডিয়ামে মোট ৫১টি ম্যাচ খেলা হবে। ১২ জুন ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচের মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে এবারের আয়োজনের।
ইউরোতে অংশগ্রহণকারী ২৪টি দলকে ৬টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। এ পর্বের আলোচনা গ্রুপ বি’র দলগুলো নিয়ে, যেখানে রয়েছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, এবং রাশিয়া। এই গ্রুপের দলগুলোর খেলা হবে কোপেনহেগেনের পার্কেন স্টেডিয়াম ও সেইন্ট পিটার্সবুর্গে স্টেডিয়ামে।
সাধারণত ২৩ জন নিয়ে দল ঘোষিত হলেও এবারে নতুন নিয়মানুযায়ী প্রতিটি দেশ ২৬ সদস্যের দল গঠন করেছে। স্কোয়াড, ম্যানেজার, তারকা খেলোয়াড়, ইউরোর অতীত ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে রইল বিস্তারিত আলোচনা।
বেলজিয়াম
সাবেক সোয়ান্সি,ওয়াইগান ও এভারটন কোচ রবার্তো মার্টিনেজ ২০১৬ সাল থেকে বেলজিয়াম জাতীয় ফুটবল দলের ম্যানেজার। ৪৭ বছর বয়সী এই স্প্যানিয়ার্ডের অধীনে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে তৃতীয় হয়ে শেষ করে বেলজিয়াম, যা বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত বেলজিয়ামের সেরা রেকর্ড।
সবচেয়ে বেশি ম্যাচ ইয়ান ভার্টেঙ্গন (১২৬) খেললেও বেলজিয়ামের তারকা খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে আগে আসবেন কেভিন ডি ব্রুইনা এবং অধিনায়ক এদেন আজার। ম্যানচেস্টার সিটির প্লেমেকার ডি ব্রুইনা এবারের ইউরো আসরেরই সেরা খেলোয়াড়দের একজন। ২০১৯-২০ মৌসুমের প্লেয়ার অফ দ্য সিজন নির্বাচিত হওয়া কেডিবিই দলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা। ২০২০-২১ মৌসুমে লিগে ২৫ ম্যাচে ৬ গোল ও ১২ অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। ম্যানচেস্টার সিটির সাথে জিতেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা, খেলেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালও।
কেডিবি, এদেন আজার, রোমেলো লুকাকু, ড্রিয়েস মার্টেনস, থিবো কোর্তোয়াদের নিয়ে গড়া এই দলটিকে ডাকা হচ্ছে বেলজিয়ামের ‘সোনালি প্রজন্ম’ বলে। রীতিমতো তারকায় ঠাসা এই দলটি। বহু বছরের আকাঙ্ক্ষিত মেজর কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা পেতে এবারে তারা বদ্ধপরিকর।
ইউরো কোয়ালিফাইং রাউন্ডে ১০টি ম্যাচের সবগুলোই জিতেছে বেলজিয়াম। গোল করেছে ৪০টি, বিপরীতে গোল হজম করেছে মাত্র তিনটি। তবে সবটাই মহামারীর আগে। এখন দলের ক্যাপ্টেন এদেন আজার ফর্ম ও আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগছেন, এক্সেল উইটসেল ইনজুরি কাটিয়ে লম্বা সময় পর দলে ফিরেছেন। কেডিবির খেলায়ও কিছুটা ক্লান্তির ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তার ওপর চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল ম্যাচের ইনজুরি কোচকে কিছুটা চিন্তায়ও ফেলে দিয়েছে। তবে রোমেলো লুকাকু এবং ইউরি টিয়েলম্যানস ভালো ফর্মে আছেন। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বেলজিয়ামের টপ স্কোরার লুকাকু, করেছেন সাতটি গোল। তাই গ্রুপপর্বের বাধা টপকাতে তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় রেড ডেভিলদের।
অতীত ইউরো ইতিহাস
এবারের আসরে ষষ্ঠবারের মত অংশ নিচ্ছে বেলজিয়াম। তারা প্রথম ইউরোতে অংশ নেয় ১৯৭২ সালে, সে বছর তৃতীয় হয় দেশটি। অবশ্য সেবারের ইউরোতে খেলেছিলই মাত্র চারটি দেশ, বেলজিয়াম ছিল আয়োজক।
এরপর বেলজিয়াম ইউরোতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ১৯৮০ সালে। ঐ বছর বেলজিয়াম ফাইনালেও পৌঁছেছিল, কিন্তু পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে শিরোপা জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের। ১৯৮৪ সালে গ্রুপপর্বেই বাদ পড়ে যায় বেলজিয়াম।
টানা তিনটি ইউরোর পর ২০০০ সালে আবারও ইউরোতে প্রত্যাবর্তন হয় বেলজিয়ামের। ১৯৭২ সালের মতো এ বছরেও আয়োজক ছিল দেশটি, নেদারল্যান্ডসের সাথে যৌথভাবে। ১৯৮৪ সালের মতো এবারেও গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে তারা। এরপর ইউরোতে ফেরত আসতে আসতে পেরিয়ে যায় আরো তিনটি টুর্নামেন্ট।
২০১৬ সালে চমৎকার একটি দল নিয়ে ইউরোতে অংশ নেয় বেলজিয়াম। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে ৩-১ গোলে হেরে সেবারও বিদায় নিতে হয় তাদের।
২০২০ সালের ইউরো টুর্নামেন্টের জন্য গড়া দলটি এককথায় দুর্ধর্ষ। আসরের অন্যতম সেরা দল বেলজিয়াম, টুর্নামেন্ট জয়ের জন্য ফেভারিট হিসেবে ভাবা হচ্ছে তাদেরই। সর্বশেষ প্রকাশিত ফিফা র্যাংকিং অনুযায়ী শীর্ষস্থানেও রয়েছে বেলজিয়াম।
ডেনমার্ক
ক্যাসপার হিউলম্যান্ড বর্তমানে ডেনমার্ক জাতীয় ফুটবল দলের ম্যানেজার। ৪৯ বছর বয়সী এই ড্যানিশ কোচ এর আগে দু’দফায় নর্ডসিল্যান্ডের কোচ ছিলেন, মাঝে মেইঞ্জের ড্রেসিংরুমও সামলেছেন অল্প কিছুদিনের জন্য। ২০১১-১২ সালে নর্ডসিল্যান্ডকে তাদের ইতিহাসের প্রথম ড্যানিশ সুপারলিগা শিরোপা জেতান ক্যাসপার।
২০১৯ সালের জুন মাসে ডেনমার্কের তৎকালীন কোচ এ্যাগে হ্যারেইডের পরবর্তী কোচ হিসেবে হিউলম্যান্ডের নাম ঘোষণা করা হয়। কথা ছিল, ২০২০ সালের ইউরো পর্যন্তই কোচ থাকবেন এ্যাগে, ইউরোতেও তিনিই কোচিং করাবেন ডেনমার্ককে। কিন্ত ইউরো এক বছর পেছানোয় ও তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে বিদায় নিতে হয়। ইউরোতে ডেনমার্ককে আর কোচিং করানো হয়নি তার।
২০২০ সাল থেকে ক্যাসপার ডেনমার্কের ডাগ-আউটে দাঁড়াচ্ছেন, ইউরোতে তিনিই সাজাবেন ডেনমার্কের ট্যাকটিক্স। খুব অল্প সময় দলের সাথে কাজ করেছেন, কিন্তু নিত্যনতুন পরিকল্পনার দলকে সাজান তিনি, ম্যাচ চলাকালীন ফরমেশন পরিবর্তন করতেও ভয় পান না। পজেশন ধরে রেখে অ্যাটাকিং ফুলব্যাকদের নিয়ে ম্যাচের পরিকল্পনা করেন তিনি সাধারণত।
ডেনমার্কের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে নামটি শুরুতেই বলতে হয়, তিনি অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন (১০৭)। যদিও টটেনহ্যাম থেকে ইন্টার মিলানে যাওয়ার পর থেকে নিজের ফর্ম নিয়ে বেশ ভুগছেন তিনি, তবুও জাতীয় দলের জন্য তিনি এক অপরিহার্য নাম। এরিকসেনের পায়ের জাদু ছাড়া ইউরোতে গ্রুপপর্ব পেরোনো অসম্ভবপ্রায় ব্যাপার ডেনমার্কের জন্য। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে ডেনমার্কের টপ স্কোরার এরিকসেন, পাঁচটি গোল করেছেন তিনি। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে আটটি ম্যাচের চারটিতে জয় ও চারটি ম্যাচ ড্র করেছে ডেনমার্ক।
ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনকে চান্স ক্রিয়েট করতে হবে সতীর্থদের জন্য, সাহায্য করার জন্য পাশে পাবেন টটেনহ্যামের মিডফিল্ডার পিয়েরে এমিলে হজবার্গ, ডর্টমুন্ডের মিডফিল্ডার টমাস ডেলানি, বার্সেলোনার ‘নাম্বার নাইন’ মার্টিন ব্র্যাথওয়েট, এবং আরবি লাইপজিগের নম্বর নাইন ইউসুফ পলসেনকে। ব্র্যাথওয়েট ও ইউসুফ পলসেন অবশ্য গোলখরায় ভুগেছেন এই মৌসুমে। ইউসুফ বুন্দেসলিগায় ২৭ ম্যাচে মাত্র ৫টি গোল ও ৪টি অ্যাসিস্ট এবং ব্র্যাথওয়েট লা লিগায় ২৯ ম্যাচে করতে পেরেছেন ২ গোল ও ২ অ্যাসিস্ট।
ফরোয়ার্ডদের ফর্মহীনতা চিন্তার কারণ হতে পারে ডেনমার্কের জন্য। তবে ড্যানিশদের গোলবারে দাঁড়াবেন লেস্টার সিটির গোলরক্ষক ক্যাসপার স্মাইকেল। ক্যাসপার ইপিএলে ৩৮টি ম্যাচের ১১টিতেই ক্লিনশিট রেখেছেন, দেশের হয়ে খেলা ৬৩ ম্যাচের ক্লিনশিট রেখেছেন ৩২টিতেই। ডেনমার্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় এই ‘সুপার স্টপার’।
ওহ, ডেনমার্কে আবার ‘লাকিচার্ম’ রয়েছেন একজন; ডিফেন্ডার জেনস স্ট্রেইগার লারসেন এখনও পর্যন্ত ডেনমার্কের হয়ে যে ক’টি ম্যাচ খেলেছেন, একটিতেও তারা হারেনি! জেনস লারসেন যে ৩৩টি ম্যাচে স্কোয়াডে ছিলেন, তার মধ্যে ২০টি ম্যাচই জিতেছে ডেনমার্ক এবং ১৩টি ম্যাচ ড্র হয়েছে। ডেনমার্কের এই লাকিচার্ম ইউরোতে কতটা লাকি প্রমাণিত হতে পারেন, তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।
অতীত ইতিহাস
এবার নবমবারের মতো ইউরোতে অংশ নিচ্ছে ডেনমার্ক। ডেনমার্কের প্রথম এবং দ্বিতীয়বার ইউরো টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের মাঝে প্রায় ২০ বছরের ব্যবধান, প্রথমবার ১৯৬৪ এবং দ্বিতীয়বার ১৯৮৪ সাল। প্রথমবারে চারটি দেশের ভেতর চার নম্বর, দ্বিতীয়বার অবশ্য সেমিফাইনালে পৌঁছায় ডেনমার্ক।
১৯৮৮ সালে গ্রুপপর্বেই বাদ পড়ে তারা। এরপর ১৯৯২ সালে জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে ইউরো শিরোপা জেতে ডেনমার্ক। বলা হয়ে থাকে, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের সবচেয়ে ‘সেনসেশনাল’ চ্যাম্পিয়ন ছিল তারাই।
কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা তারা ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৯৬ ও ২০০০ সালে পরপর দু’টি টুর্নামেন্টে গ্রুপপর্বেই বাদ পড়ে ডেনমার্ক। ২০০৪ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছালেও এরপর ২০০৮ সালে ইউরোতে খেলার জন্য কোয়ালিফাই করতে পারেনি ড্যানিশরা। ২০১২তে ইউরোতে আবার ফেরত আসে ডেনমার্ক, এবারও গ্রুপপর্বেই বাদ। ২০১৬তে আবারও ইউরোতে কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ।
এইভাবে আসা-যাওয়ার মধ্যেই এগিয়ে চলছে ডেনমার্কের ইউরো ইতিহাস। বর্তমানে ফিফা র্যাংকিংয়ে ১০ নম্বরে অবস্থান করছে ডেনমার্ক এবারের ইউরোতে ডেনমার্কের দৌড় কতদূর, সেটা তোলা থাকুক সময়ের হাতেই।
ফিনল্যান্ড
২০১৬ সালে হান্স ব্যাকে যখন ফিনল্যান্ডের কোচ, ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বছরটি কাটায় ফিনল্যান্ড। ১১ ম্যাচের ভেতর ৯টিতেই হার, দুটো ম্যাচ টেনেটুনে ড্র। হ্যান্স ব্যাকের পর মারক্কু কানের্ভা ফিনল্যান্ড জাতীয় দলের দায়িত্ব পান। ২০১৬ সালে হেড কোচ নিযুক্ত হওয়ার আগে টানা পাঁচ বছর অ্যাসিসট্যান্ট কোচ ছিলেন, আর তার আগে কেবল ফিনল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ ও এফসি ভাইকিংগিটকে কোচিং করিয়েছেন কিছুদিন।
ক্লাব লেভেলে কোচিং করানোর তেমন কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা কানের্ভার কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না ফিনিশদের। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কানের্ভার অধীনে ফিনল্যান্ড প্রায় প্রতি ম্যাচেই জিততে শুরু করলো। হাঙ্গেরি এবং গ্রিসকে হারিয়ে ন্যাশনস লিগে গ্রুপ-সি চ্যাম্পিয়ন হয় ফিনল্যান্ড। নিজেদের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো কোনো মেজর টুর্নামেন্ট (ইউরো ২০২০)-এর জন্য কোয়ালিফাই করে। এমনকি দলটি গত বছর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকেও হারায় একটি ম্যাচে!
৫৬ বছর বয়সী এই কোচের অধীনে ফিনল্যান্ডের সাফল্য পাওয়ার কারণ, এই দলের মূল খেলোয়াড়দের অনেকেই ২০০৯ সালে তার অধীনে অনূর্ধ্ব-২১ দলে খেলেছেন। তিনি এই খেলোয়াড়দের প্রায় এক দশক ধরে দেখেছেন, তাদের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতার জায়গাগুলো তিনি জানেন খুব ভালোভাবেই। কানের্ভার মতে, ফিনল্যান্ডের সাফল্যের মূল কারণ ‘টিম স্পিরিট’। দীর্ঘদিন ধরে একসাথে কাজ করার জন্যই কোচ ও খেলোয়াড়দের ভেতর চমৎকার বন্ডিং ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়েছে, যার ছাপ মাঠের খেলায় উপলব্ধি করতে পারেন দর্শকরাও। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে ১০টি ম্যাচের ৬টিতে জয় ও চারটি ম্যাচে পরাজিত হয়েছে ফিনল্যান্ড।
নরউইচ সিটি স্ট্রাইকার টিমু পুক্কি ফিনল্যান্ডের সেরা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। জাতীয় দলের হয়ে ৯০টি ম্যাচ খেলা ৩১ বছর বয়সী এই খেলোয়াড় দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ও বটে। মোট ৩০টি গোল করেছেন জাতীয় দলের জার্সিতে, কোয়ালিফাইং রাউন্ডে ফিনল্যান্ডের সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনিই; মোট গোল করেছেন ১০টি। এছাড়া টিমু পুক্কির অনবদ্য পারফরম্যান্সে এই মৌসুমে রেলিগেশন থেকে উঠে এসে প্রিমিয়ার খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে নরউইচ সিটি। চ্যাম্পিয়নশিপে ৪১ ম্যাচে ২৬ গোল করেন তিনি।
১০ বছর পরে গ্লেন কামারার রেঞ্জার্স জিতেছে স্কটিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। গ্লেন কামারা পরিচিত ফিনল্যান্ডের ‘মিডফিল্ড ইঞ্জিন’ হিসেবে। এছাড়া আছেন লুকাস রাদেকি, যিনি বুন্দেসলিগার সেরা গোলরক্ষকদের একজন। পুক্কি-কামারা ছাড়াও বেয়ার লেভারকুসেনের গোলরক্ষক লুকাস রাদেকি ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের একজন। ব্রেন্টফোর্ডের মার্কাস ফ্রসকেও নজরে রাখবে বিশ্ব; গত বছরের নভেম্বরে ফ্রান্সের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে গোল করেন তিনি, যে ম্যাচে বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা ২-০ গোলে হেরে যায়। এছাড়া ব্রেন্টফোর্ডের পক্ষে চ্যাম্পিয়নশিপ প্লে-অফের সেমিফাইনালে জয়সূচক গোলটিও আসে তার পা থেকেই। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল করার ক্ষমতাসম্পন্ন এই খেলোয়াড় ফিনল্যান্ডের ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারেন।
অতীত ইতিহাস
ফিনল্যান্ড এই প্রথমবারের মতো ইউরো খেলতে যাচ্ছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশটি ১৯৬০ ও ১৯৬৪ সালের ইউরোতে অংশগ্রহণ করেনি। এরপরের বার থেকে প্রত্যেক আসরের জন্য কোয়ালিফাই করার চেষ্টা করলেও কোয়ালিফাই করতে পারেনি। বর্তমান ফিফা র্যাংকিংয়ে ৫৪তে রয়েছে ফিনল্যান্ড।
রাশিয়া
সাবেক গোলকিপার চেরিসেশভ ২০১৬ সালে রাশিয়ার কোচ নিযুক্ত হন। ২০১৬ সালের ইউরোতে রাশিয়া গ্রুপের চার নম্বর দল হয়ে বাদ পড়লে এই ভাঙাচোরা দলকে ঠিক করার দায়িত্ব পান চেরিসেশভ। ৫৭ বছর বয়সী এই মানুষটি ইউএসএসআরের পতনের পর প্রথম রাশিয়ান কোচ হিসেবে রাশিয়াকে কোনো মেজর টুর্নামেন্টের নকআউট স্টেজে তুলেছিলেন ২০১৮ বিশ্বকাপের সময়। তার আগে ডাচম্যান গাস হিডিঙ্কের অধীনে ২০০৮ ইউরোতে শেষবারের মতো নকআউটে স্টেজে দেখা গিয়েছিল রাশানদের। বিশ্বকাপে রাউন্ড-অফ-সিক্সটিনে স্পেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছায় রাশিয়া। এবার তার সামনে অপেক্ষা করছে ইউরোর অগ্নিপরীক্ষা। শুরুটা অবশ্য বেশ ভালোই করেছেন, কোয়ালিফাইং রাউন্ডে ১০টি ম্যাচের আটটিই জিতেছে রাশানরা।
রাশিয়ান লিগে ডাইনামো মস্কো ও স্পার্টাক মস্কোর কোচ হয়েছিলেন তিনি, কিন্তু তেমন কিছু জিততে পারেননি। তবে লেজিয়া ওয়্যারশ’র কোচ থাকাকালীন ২০১৫-১৬ সালে পোলিশ লিগ এবং পোলিশ সুপার কাপ জিতেছিলেন।
রাশিয়ার তারকা খেলোয়াড়দের মধ্যে জেনিথের ৩২ বছর বয়সী আর্টেম জুবার নাম উল্লেখযোগ্য। বলা হয়ে থাকেন, রাশিয়ার অর্ধেক মানুষ তাকে ভালোবাসেন, বাকি অর্ধেক মানুষের কাছে তিনি চক্ষুশূল। বিশেষ করে স্পার্টাক মস্কোর ভক্তরা জুবাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবেন না জেনিথে যোগ দেওয়ার জন্য। জুবা নিজে বেশ বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব বটে, কিন্তু রাশিয়ান কাপ্তান দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়ও বটে; ৫১ ম্যাচে তার গোলসংখ্যা ২৯। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তিনিই রাশিয়ার সর্বোচ্চ গোলদাতা, গোল করেছেন নয়টি।
২৪ বছর বয়সী আলেক্সান্ডার গোলোভিন নিঃসন্দেহে রাশিয়ার সেরা খেলোয়াড়। মাঝমাঠ থেকে প্রচুর কী-পাস দেন এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। গোলোভিনের সেরা অস্ত্র তার গতি, তার গেম রিডিং ক্ষমতাও অবাক করার মতো। ঝড়ের গতিতে চিন্তা করতে পারেন, তার সাথে তাল মিলিয়ে পা চালান নিখুঁতভাবে। প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ছিঁড়েখুঁড়ে গোল করে বসেন কখনো ডান পায়ে, আবার কখনো বাম পায়ে। এই মোনাকো-ম্যান দেশের হয়ে ৩৬টি ম্যাচ খেলেছেন, গোল করেছেন ৫টি। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতাও ইউরোতে কাজে দেবে বেশ। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশেলে ভারসাম্যপূর্ণ দলই গড়েছে রাশিয়া।
অতীত ইতিহাস
১২তম বারের মতো ইউরোতে অংশ নিতে যাচ্ছে রাশিয়া। এর আগের ১১ বারের মধ্যে পাঁচবারই সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে, একবার সিআইএস হিসেবে, এবং বাকি পাঁচবার রাশিয়া হিসেবে টুর্নামেন্টে অংশ নেয় দেশটি। সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে ১৯৬০ সালের প্রথম ইউরো টুর্নামেন্টটি জিতেছিল রাশিয়া। ১৯৬৪, ১৯৭২ এবং ১৯৮৮ সালে তিনবারই ফাইনাল হারে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯২ সালের ইউরোতে রাশিয়া কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট (সিআইএস) হিসেবে অংশ নেয়, তবে গ্রুপপর্বের বেশি তারা যেতে পারেনি সেবার।
ইউরো ‘৯৬ আসরে প্রথমবারের মতো রাশিয়া স্বাধীন দেশ হিসেবে অংশ নেয়। সেবারেও দৌড় শেষ গ্রুপপর্বেই। ২০০০ সালে রাশিয়া ইউরোতে কোয়ালিফাই করতেই পারেনি। ২০০৪, ২০১২, ২০১৬ – প্রতিবারই একই চিত্র, গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ। রাশিয়ার ইউরোতে সেরা সাফল্য আসে ২০০৮ সালে, গাস হিডিংকের অধীনে সেমিফাইনাল খেলে রাশিয়া। অবশ্য স্পেনের কাছে ৩-০ গোলে হেরে ফাইনাল খেলার আশা শেষ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, স্পেনই সে বছর ইউরো জেতে।
২০১৮ সালে ঘরের মাঠে চমকপ্রদ পারফরম্যান্স করে রাশিয়া, এবারেও খেলা নিজেদের ঘরের মাঠেই। তাই নিজেদের দর্শকদের সামনে খেলার পুরো সুবিধা নিতে চাইবে রাশিয়া নিঃসন্দেহে। ২০১৮ বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তি ২০২০ ইউরোতে দেখার আশায় অপেক্ষা করবে রাশান ফুটবল ভক্তরা। তবে রাশিয়া ইউরোতে বরাবরই আন্ডারঅ্যাচিভার, তাই খুব বেশি উচ্চাশা না রাখাই হয়তো ভালো। দলটির বর্তমানে ফিফা র্যাংকিংয়ে অবস্থান ৩৮।
রবার্তো মার্টিনেজের তারকাভরা বেলজিয়াম দল নিঃসন্দেহে এই গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য সবচেয়ে ফেভারিট। সাবেক ইউরো চ্যাম্পিয়ন ডেনমার্কেরও চেষ্টা থাকবে এই ইউরোটা স্মরণীয় করে রাখার। ২০১৮ সালে নিজেদের মাঠে হওয়া বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট রাশিয়া তাদের দারুণ পারফরম্যান্স ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবে ইউরোতেও। ফিনল্যান্ড ভরসা রাখবে টিমু পুক্কির ওপর। নিজেদের মতো করে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত সব দলই, এবার মাঠের লড়াই দেখতে প্রস্তুত গোটা বিশ্ব।