চলতি মৌসুমে সবচেয়ে বেশি কটুক্তি ও সমালোচনার কবলে পড়ে মৌসুম শুরু করেছিলো চেলসি। তার কারণও ছিলো প্রচুর। বোর্ডের সাথে ঝামেলায় মারিৎসিও সারির বিদায়, খেলোয়াড় কেনায় নিষেধাজ্ঞার কারণে নতুন খেলোয়াড় কিনতে না পারা, উপরন্তু একাদশের খেলোয়াড়দের ধরে রাখতে না পারা এবং নতুন কোচ হিসেবে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের আগমন সবকিছুই ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। চ্যাম্পিয়নশিপে ডার্বি কাউন্টির হয়ে ল্যাম্পার্ড দারুণ কাজ করলেও, প্রিমিয়ার লিগ আর চ্যাম্পিয়নশিপে কাজ করা এক বিষয় নয়। তারপর ল্যাম্পার্ড পাচ্ছেন না প্রয়োজনীয় খেলোয়াড়। তাই শুরুতে ল্যাম্পার্ডের শেষ দেখে ফেলেছিলেন অধিকাংশ ফুটবলবোদ্ধা। প্রায় সবাই ভবিষ্যদ্বাণী করেও ফেলেছিলেন, তাদের ক্লাব লিজেন্ড কোচ হিসেবে আধা মৌসুমও টিকতে পারবেন না। কিন্তু লিগে ১২টি ম্যাচ অতিবাহিত হবার পর, বর্তমান চেলসির অবস্থা দেখে তাদের বলা সেই মন্তব্যগুলো পাল্টাবে কী?
একদম শুরু, অথাৎ ল্যাম্পার্ডের প্রথম দিন থেকে শুরু করা যাক। সারির বদলে ল্যাম্পার্ড যখন স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে আসেন। তখন ব্লুজরা হারিয়েছে তাদের দলের সেরা খেলোয়াড়কে। হ্যাজার্ডকে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে বাধ্য হয়ে বিক্রি করার পর তারা একাদশের ডিফেন্ডার ডেভিড লুইজকে ছেড়ে দিয়েছে আর্সেনালের কাছে। গ্যারি কাহিলও স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ ছেড়ে গেছেন। ওদিকে আক্রমণভাগের একমাত্র স্ট্রাইকার গঞ্জালো হিগুয়াইনও লোন চুক্তি শেষ করে ফিরে গেছেন পুরনো ক্লাবে। তখন ক্লাবে একমাত্র স্ট্রাইকার বলতে অলিভিয়ে জিরুড। দলের সেরা খেলোয়াড় হারানোর পরপর একাদশের খেলোয়াড়ও হারানো কতটা বিপদজনক তা ক্লাব ও ল্যাম্পার্ডও জানতেন। কিন্তু তাদের হাত যে বাঁধা। সুযোগ না থাকায় তাই কোনো খেলোয়াড় কেনা গেলো না। ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচের চুক্তি আগে করা ছিলো। আর সুযোগ ছিলো মাতেও কোভাসিচকে পাকাপাকিভাবে কিনে নেয়ার। তাই মৌসুম শুরুতে নতুন খেলোয়াড় হিসেবে দলে যোগ দিলেন একমাত্র পুলিসিচ।
ঠিক এ সময়ই কোচ হিসেবে নিজের ক্লাবে ফিরলেন ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড। চেলসি তার চাহিদামতো খেলোয়াড় দিতে পারবে না, এটা তিনি দলের দায়িত্ব নেবার আগেই বুঝেছিলেন। তাই তাকে নজর দিতে হলো লোনে থাকা চেলসির অসংখ্য অবহেলিত তরুণ তুর্কিদের উপর।
ডার্বি কাউন্টিতে থাকা সময়ে তিনি অ্যাস্টন ভিলায় চেলসি থেকে লোনে থাকা স্ট্রাইকার ট্যামি আব্রাহামকে দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। তার মাথায় ছিলো গত মৌসুমে ৩৭ ম্যাচে ২৫ গোলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। তাই যখন স্ট্রাইকার খরা চলে, ট্যামিকে চাপিয়ে দিলেন চেলসির অভিশপ্ত ‘৯’ নম্বর জার্সি। মারিৎসিও সারির সময়ে ইংল্যান্ডের অন্যতম বিস্ময় বালক ক্যালাম হার্ডসন অডোই ছিলেন উপেক্ষিত। ল্যাম্পার্ড এসে তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে দলে রাখলেন। একই কাজ করলেন রুবেন লফটাস- চিকের সাথেও। যখন ডার্বির কোচ ছিলেন, তখন চেলসি থেকে লোনে সে ক্লাবে খেলতেন ম্যাসন মাউন্ট ও ফিকায়ো তোমরি। তাদের তো দলে স্থায়ী করলেনই উপরন্তু রক্ষণে ব্যবহারের জন্য লোন থেকে ফিরিয়ে আনলেন ফরাসি ডিফেন্ডার কার্ট জুমাকেও। লক্ষ্যণীয়, ল্যাম্পার্ড যাদের ফিরিয়ে আনলেন সবাই ১৯ থেকে ২৩ বছর বয়সী। যদিও লোন থেকে দলে এ মৌসুমের জন্য স্থায়ী করা হয়েছে মিসি বাৎশুয়াইকে। যিনি চেলসিতে আসার পরে কখনও দলে স্থায়ী হতে পারেননি।
কোনোমতে দল সাজানোর পর এবার মাঠে ফেরার পালা। প্রীতি ম্যাচ বাদ দিয়ে ল্যাম্পার্ডের চেলসি যুগ শুরু হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে। কান্তে বেঞ্চে, রুডিগার ইনজুরিতে আর দলের প্রথম পছন্দের লেফট-ব্যাক মার্কাস আলোন্সো তার ফুটবল দর্শনের সাথে মানানসই না বলে তাকে উপেক্ষা করে নামালেন এমারসন পালমেইরিকে। কিন্তু আনকোরা চেলসি যে প্রথম ম্যাচ থেকে লড়াই শুরু করবে, এমনটা হয়তো ল্যাম্পার্ড নিজেও ভাবেননি। তাই ওল্ড ট্রাফোর্ডে ৪-০ গোলের হারও তাকে ভাবায়নি। কারণ ল্যাম্পার্ড এই দলকে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে সময় দিতে চেয়েছিলেন। আর সন্ধানে ছিলেন কোন ফর্মেশন ও ট্যাকটিক্স এই নতুনদের জন্য আদর্শ!
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ল্যাম্পার্ড ব্যবহার করেছিলেন ৪-২-৩-১ ফর্মেশন, যেখানে একমাত্র স্ট্রাইকার ট্যামি আব্রাহাম। দুই উইংয়ে ছিলেন রস বাকরেলি ও পেদ্রো। একদম নাম্বার টেন ভূমিকায় ম্যাসন মাউন্ট থাকার পর ডাবল পিভট রোলে ছিলেন জর্জিনহো ও কোভাসিচ। উয়েফা সুপার কাপে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে মধ্যমাঠে কান্তে ফেরার পর ল্যাম্পার্ড বদলে ৪-৩-৩ রোলে স্থানান্তরিত করলেন, যে ম্যাচে প্রথম থেকে ছিলেন না দলের অধিকাংশ প্রথম পছন্দের খেলোয়াড়রা। কিন্তু লিভারপুলের সামনে তারা পাল্লা দিয়ে লড়াই করেছিলো। শুধুমাত্র ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে শেষ রক্ষা হয়নি।
চ্যাম্পিয়নশিপে ল্যাম্পার্ডের ক্লাব সাফল্য পেয়েছিলো তার তরুণ খেলোয়াড় নির্ভরতার উপর ভর করে। প্রিমিয়ার লিগে অত্যন্ত জঘন্য একটি শুরু পরও ল্যাম্পার্ড তার সিদ্ধান্তে অটুট থাকলেন। পরের ম্যাচে লেস্টার সিটির বিপক্ষে ড্র। নরউইচের মাঠে হারতে হারতে কোনোমতে জিতে গেলেন। এরপর আবার শেফিল্ডের সাথে ড্র। কিন্তু ফর্ম হারিয়ে ধুঁকতে থাকা উলফহ্যাম্পটনের বিপক্ষে তার দল শুরু করলো গোলবন্যা। ল্যাম্পার্ড ও তার একাদশ এই পাঁচ গোল দিয়ে প্রথমবার স্থায়ী আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো। কিন্তু সময়টা বড় অস্থির। অ্যাকাডেমি খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া নতুন এ দল ভেঙে পড়লো ভ্যালেন্সিয়া ও লিভারপুলের বিপক্ষে। কিন্তু ভেঙে পড়েননি ল্যাম্পার্ড।
ঐ দুই হারের পর থেকে দলের চিত্র বদলে গেলো। ল্যাম্পার্ডের আক্রমণাত্মক কৌশলের কারণে ট্যামি, মাউন্টরা গোল পাচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু রক্ষণ হয়ে উঠেছিলো বড্ড নড়বড়ে। কিন্তু ল্যাম্পার্ডের পুরনো মন্ত্র। গোল হজম করলেও গোল করে ম্যাচে ফিরতে হবে। এই ধারণা নিয়েই চেলসি ফিরেছে স্বরূপে। কিন্তু আদতে চেলসির রক্ষণ এখনও মজবুত নয়। কেপাকে গোলবারের নিচে ব্লুজদের রক্ষণভাগ সামলানোর দায়িত্ব আপাতত কার্ট জুমা ও তোমরির। রুডিগার এখনও ইনজুরি থেকে ফিরতে পারেননি, আর কালেভেদ্রে মাঠে নামেন ক্রিটেনসেন। রাইট-ব্যাকে আজপিলিকুয়েতা ও লেফট-ব্যাকে আলোন্সোর বদলে এমারসন। কারণ ল্যাম্পার্ডের ট্যাকটিক্সে দরকার একজন রক্ষাণাত্মক ফুল-ব্যাক, যেখানে আলোন্সো তেমন কার্যকর নয়। কিন্তু এরা কেউই ভরসাযোগ্য ডিফেন্ডার নন। কার্ট জুমা অত্যন্ত প্রতিভাবান খেলোয়াড় হলেও তার ভুল করার প্রবণতা অনেক বেশি। তোমরি একদমই আনকোরা। আর আজপিলিকুয়েতার আগ্রহ রক্ষণ থেকে আক্রমণেই বেশি। তাই চাইলেও রক্ষণ দুর্গ গড়া আপাতত সম্ভব হচ্ছে না চেলসি বসের।
কিন্তু গোল হজম করেও কীভাবে ম্যাচে ফেরা যায় সেটা ল্যাম্পার্ড ভালোই জানেন। কারণ তার হাতে থাকা প্রতিটি মিডফিল্ডার ও আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় স্বাধীনভাবে খেলতে পেরেছে। আর ল্যাম্পার্ডও একই খেলোয়াড় টানা না ব্যবহার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করছেন, যাতে প্রত্যেকে নিজস্ব ছন্দে মাঠে পারফর্ম করতে পারে।
লিভারপুলের বিপক্ষে হারের পর ২০১৭ সালের পর প্রথমবার প্রিমিয়ার লিগে টানা ছয় ম্যাচে জয় পেয়েছে ব্লুজরা। মাঝে চ্যাম্পিয়নস লিগে লিঁল ও আয়াক্সের বিপক্ষেও হতাশ করেনি। তার অর্থ হলো, চ্যাম্পিয়নস লিগে আয়াক্স ও কারাবো কাপের ম্যাচ বাদে সবকয়টি ম্যাচ জিতেছে চেলসি। আর ক্লিনশিট হারালেও সাউথহ্যাম্পটন ও বোর্নমাউথের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে তারা। চেলসি খেলেছেও দ্রুতগতির আক্রমণাত্মক নান্দনিক ফুটবল।
চেলসির এ আকস্মিক ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে রহস্য কী? যদি তার উত্তর হয় ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, তবে ল্যাম্পার্ড জানাবেন সব কৃত্বিত্ব তার শিষ্যদের। যদিও তা সত্য। চেলসির বর্তমান দলে চারজন প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লিগে খেলছেন, দুজন আগে দলে থাকলেও অনিয়মিত। কিন্তু ল্যাম্পার্ডের ফুটবল কৌশলের পর তারাও যে এভাবে প্রতিভা ছড়াবেন, তা কে ভাবতে পেরেছিলো!
বর্তমান চেলসির মধ্যমাঠে জর্জিনহো ও কান্তে যেন চীনের প্রাচীর। তারা একাই চেলসির মধ্যমাঠ শাসন করেন। কান্তে বা জর্জিনহোর ইনজুরিতেও চিন্তা নেই কোভাসিচ বা বাকরেলি মজুদ আছেন। এছাড়াও ৪-৩-৩ ফর্মেশনে মাউন্ট এসে যোগ দেন। তখন আবার ট্যাকটিক্স বদলে যায়। কিন্তু ল্যাম্পার্ডের ট্যাকটিক্সে মাউন্ট একদম নিখুঁত প্লে-মেকার। গোলবারের নিচে থাকা ট্যামি আব্রাহমের সাথে যেন তার টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ। আবার গোল করতেও ওস্তাদ। উইলিয়ান বা পেদ্রো সেভাবে সবসময় সহযোগিতা না করতে পারলেও ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে আসা উইঙ্গার ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিক। আর মধ্যমাঠের সাথে আক্রমণভাগের যে রসায়ন গড়ে তুলেছেন ল্যাম্পার্ড, আক্রমণ থামায় কার সাধ্যি!
চেলসির নান্দনিক ফুটবলের উদাহরণের অন্যতম সেরা নমুনা স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে ক্রিস্টাল প্যালেসের ম্যাচ। ম্যাচের প্রথম থেকেই ক্রিস্টাল প্যালেসকে চেপে ধরে ব্লুজরা। শুধু তাদের আক্রমণত্রয়ী নয়, পুলিসিচ, ট্যামি আর উইলিয়ানের পাশাপাশি ম্যাসন মাউন্টকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে ক্রিস্টাল প্যালেসকে। কিন্তু প্রথমার্ধে একাধিক আক্রমণের পরও গোল পায়নি একমাত্র ক্রিস্টাল প্যালেসের গোলরক্ষক ভিসেন্তে গাইতার জন্য। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে গোল করতে সক্ষম হয় তারা। কারণ ল্যাম্পার্ড লেগে থাকতে জানেন, অল্পতে মনোবল হারানোর মতো মানুষ তিনি নন। আর তার এই মনোবল শক্তি তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন তার শিষ্যদের মাঝে।
রক্ষণে দুর্বলতার পাশাপাশি চেলসির আরেকটি দুর্বলতা আছে যা এখনও সুপ্তাবস্থায় বিদ্যমান। গত মাসে চেলসির অধিকাংশ ম্যাচ ছিল মধ্যম সারির দলের বিপক্ষে। তাই প্রতিপক্ষের কৌশলের ফাঁদে পড়তে হয়নি তাদের। কিন্তু যখনই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা লিভারপুলের বিপক্ষে মাঠে নেমেছে তারা, তখনই দল অভিজ্ঞতা দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে। তবে এই দুর্বলতা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সময় ও পারফর্মেন্সই তা ঠিক করে দেবে।
প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে মাসের সেরা নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র তিনজন। স্টুয়ার্ট পিয়ার্স, গ্যারেথ সাউথগেটের পর অন্যজন হলেন ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড। গত মাসের সেরা কোচ নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। আর দলও খেলেছে বড় দলের মতোই। দুর্বলতার সময়ই দ্রুত পার হয়ে হাতছানি দিচ্ছে নতুন সাফল্যের আভাস। তাই ল্যাম্পার্ডের প্রয়োজন ধৈর্য, স্থিরতা ও হার না মানা মানসিকতা।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘খেলাধুলা’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ