Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইউরোপিয়ান ক্লাসিকো: রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বায়ার্ন মিউনিখ

ক্লাব ফুটবলের সফল দল কোনগুলো প্রশ্ন করলেই একেবারে সবার উপরেই থাকবে রিয়াল মাদ্রিদ আর বায়ার্ন মিউনিখের নাম। শুধু জার্মানি বা স্পেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না, বরং ইউরোপ ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে এই দুই ক্লাব। ইতিহাস কি বর্তমান, লস ব্লাঙ্কোস আর বাভারিয়ানদের সাথে টেক্কা দিতে পারে এরকম ক্লাব হাতেগোনা দু-একটাই আছে। আর এর পেছনের গল্পও কম আকর্ষণীয় নয়। ইউরোপের সর্বোচ্চ ক্লাব টুর্নামেন্ট, যাকে বলা হয় বিশ্বকাপের পরেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ শিরোপা, সেই “উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ”-এর ময়দানেই সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি হওয়া দুই দলের ম্যাচ রূপ নিয়েছে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। আর একেই বলা হয় “দ্য ইউরোপিয়ান ক্লাসিকো”, চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ইতিহাসের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

সোনালী প্রজন্ম

উভয় ক্লাবেরই রয়েছে দুইটি সোনালী প্রজন্ম যারা ফুটবল বিশ্বকে শাসন করেছে বেশ কিছু সময় ধরে। ষাটের দশকের শেষার্ধের পুরোটা সময় ধরেই নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। এর বছরখানেক পরেই আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে টানা তিনবার ইউরোপিয়ান কাপ জয় করে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে নতুন রাজত্বের সূচনা ঘটায় বায়ার্ন মিউনিখ।

রিয়াল মাদ্রিদ

রিয়াল মাদ্রিদের কালজয়ী প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যু যখন ক্লাবের হাল ধরেন, তখন ক্লাবের প্রায় বেহাল দশা। তার অভাবনীয় নেতৃত্ব আর প্রচেষ্টার জোরে আবারো স্পেনের বুক চিরে জেগে ওঠে ক্লাবটি। সারা বিশ্বের সেরা সেরা খেলোয়াড়দের, যেমন- আলফ্রেদো ডে স্টেফানো, রেমন্ড কোপা, মিগুয়েল মুনোজ, ফেরেঙ্ক পুস্কাস, ফ্রান্সিস্কো গেন্তোসহ অনেককে কিনে এনে দলকে নতুনরূপে সাজিয়ে তোলেন তিনি, গড়ে তোলেন এক অপ্রতিরোধ্য ক্লাবে।
এছাড়াও “কান্তেরা” তথা বর্তমানে “লা ফ্যাব্রিকা” নামে পরিচিত রিয়াল মাদ্রিদের যুব অ্যাকাডেমিও তার আমলে গড়ে ওঠে। টানা ৫বার ইউরোপিয়ান কাপ জয়ী রিয়াল মাদ্রিদের সেই ঐতিহাসিক দলের রেকর্ড আজও পর্যন্ত অক্ষত, অজেয়।

রিয়াল মাদ্রিদের অজেয় দল (১৯৫৯-৬০)

বায়ার্ন মিউনিখ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত শুকিয়ে আবার নিজরূপে আবির্ভূত হতে বেশ কিছু সময় লেগে যায় বাভারিয়ানদের। রিয়াল মাদ্রিদ যখন ইউরোপ জয় করায় মত্ত, তখন বায়ার্ন মিউনিখের ইয়ুথ ক্লাবে গড়ে উঠছে সেপ মাইয়ের, হান্স-ইয়র্গ শোয়ার্জেনব্যাক, উলি হোয়েনেস, কার্ল হেইঞ্জ হোমিনেগে আর ফ্রাঞ্জ ব্যাকেনবাওয়ের-এর মতো বিশ্ব মাতানো খেলোয়াড়েরা। এরপর ১৯৬৩ সালে জার্মানিতে প্রথম প্রোফেশনাল লীগ ‘বুন্দেসলিগা’ শুরু হওয়ার ৪ বছরের মাথায় প্রথম ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো ট্রফির মুকুট মাথায় পরে বাভারিয়ানরা, নামের পাশে লেখা হয় “কাপ উইনার্স কাপ” বিজয়ী। জার্মানিতে একের পর এক লীগ জয়ের পর ১৯৭৪ সালে ফ্রাঞ্জ ব্যাকেনবাওয়েরের নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান কাপ জয় করে বায়ার্ন মিউনিখ। পরপর তিন বছর টানা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতার পর গের্ট ম্যুলার আর ব্যাকেনবাওয়েরের প্রস্থানে শেষ হয় বাভারিয়ানদের সোনালী যুগ।

বায়ার্ন মিউনিখের ১৯৭৬ ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জয়ী দল

প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা

দুই ক্লাবের প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরুটা হয়েছিল একেবারে প্রথম ম্যাচেই, যখন জেইম নামের এক রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে খেলা চলাকালীন সময়েই পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে মাঠের ভেতর ঢুকে গিয়েছিলেন ম্যুলারকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে। সেমিফাইনালের পরের লেগেই মিউনিখের অলিম্পিক স্টেডিয়াম পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, কারণ পল ব্রেইটনার মাঠে নেমেছেন রিয়াল মাদ্রিদের সাদা জার্সি গায়ে, যিনি কিছুদিন আগেও বায়ার্নের লাল জার্সি রাঙিয়েছিলেন!

পল ব্রেইটনারের গোল; যে ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদ হারে ৯-১ গোলে

আশির দশকের শুরুতেই এক ফ্রেন্ডলি ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের উপর ঝড় বইয়ে দেয় বাভারিয়ানরা, উলি হোয়েনেসের হ্যাটট্রিকে রিয়াল মাদ্রিদ হারে ৯-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে! গোল করেছিলেন বিশ্বকাপের দুই ফাইনালে গোল করা পল ব্রেইটনারও, যিনি আবারও বাভারিয়ায় পদার্পন করেছিলেন।

চ্যাম্পিয়ন্স লীগে বায়ার্ন-রিয়ালের প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। রিয়াল মাদ্রিদ হোম ম্যাচে জিতেও সুবিধা করতে পারেনি, সেমিফাইনালের আগের লেগেই বিদ্ধস্ত হয়েছিল ৪-১ গোলে। সেই ম্যাচেই ঘটেছিল চরম এক ঘটনা, বায়ার্ন অধিনায়ক লোথার ম্যাথাউসের ফাউলের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আক্রমণ করে বসেন মাদ্রিদ খেলোয়াড় হুয়ানিতো। চেন্ডোর ধাক্কায় পড়ে যাওয়া ম্যাথাউসের কোমরে লাথি মেরে দ্বিতীয় লাথিটি মারেন সরাসরি চোয়ালে। তারপর আর কি? ইউরোপিয়ান ফুটবল থেকে হুয়ানিতো নিষিদ্ধ হন ৫ বছরের জন্য।

লোথার ম্যাথাউসকে লাথি মারার সময় হুয়ানিতো

পরের বছর ভাগ্য ঘুরে গেল, বার্নাব্যুতে বায়ার্নকে ২ গোলে হারানোই যথেষ্ট ছিল সেমিফাইনালে ওঠার জন্য। তবে ভাগ্য খারাপ ছিল দুই দলেরই, ফাইনালে হেরে গিয়ে শিরোপা খোয়াতে হয়েছিল পোর্তো আর পিএসভির কাছে।

লস গ্যালাক্টিকোস বনাম এফসি হলিউড

বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিংশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দীতে পা দিল দুই দল। যথারীতি বুন্দেসলিগা আর লা লিগায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে স্পেনের ভাইকিং আর বাভারিয়ার লাল সৈন্যরা। ১৩ বছর পর রিয়াল মাদ্রিদের সামনে আবারও লোথার ম্যাথাউসের বায়ার্ন। হিয়েরো, রাউল, মরিয়েন্তেসদের মাদ্রিদ এবারও ঠেকাতে পারেনি বায়ার্নকে, গ্রুপ পর্বের দুই ম্যাচেই ৪টি গোল করে গোল খেয়েও কোনোমতে কোয়ালিফাই করে তারা। তবে মাদ্রিদের দম একেবারে ফুরিয়ে যায়নি, টানা নকআউট রাউন্ড জিতে সেমিফাইনালে মুখোমুখি হল বায়ার্নের। নিকোলাস আনেলকার গোলে বায়ার্নকে ৩-২ গোলে হারিয়ে গন্তব্য ফাইনাল, প্যারিসের মাটিতে ভ্যালেন্সিয়াকে হারিয়ে ঘরে তোলে ৮ম চ্যাম্পিয়ন্স লীগ শিরোপা।

বায়ার্ন-রিয়াল মানেই শোধ-প্রতিশোধের গল্প। ঠিক পরের মৌসুমেই সেমিফাইনালে রিয়ালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ২৫ বছর পর চ্যাম্পিয়ন্স লীগ শিরোপার স্বাদ নিল বায়ার্ন, মাঝখানে ৩বার ফাইনাল হেরে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল খালি হাতে। ২০০১-০২ এর সেমিফাইনাল যেন দুই বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি, একই মাঠ, একই ফলাফল। জিদানের দুর্দান্ত ভলিতে বায়ার লেভারকুজেনকে হারিয়ে ট্রফি কেবিনেটে ৯ম চ্যাম্পিয়ন্স লীগ শিরোপা পুরে রাখল ভিসেন্তে দেল বস্কের শিষ্যরা।

বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ডেভিড বেকহামের ফ্রি-কিক

২০০৬-০৭ মৌসুমে রাউন্ড অফ ১৬-এ নতুন চ্যাম্পিয়ন্স লীগ রেকর্ড গড়ল বায়ার্ন মিউনিখ। সার্খিও রামোসের জুতো বাঁধার সুযোগে রয় ম্যাকায় গোল করলেন ১০:১২ সেকেন্ডে! এবং কিকঅফটাও করেছিল রিয়াল মাদ্রিদের রুড ভন নিস্টলরয়! শেষমেশ অ্যাওয়ে গোলের ব্যবধানে হেরে ইউসিএল থেকে ছিটকে পড়ে রয়্যাল ক্লাব।

১০:১২ সেকেন্ডে রয় ম্যাকায়-এর চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ইতিহাসের দ্রুততম গোল

ঐতিহাসিক ট্রেবল এবং লা ডেসিমা

২০১১-১২ মৌসুম। দুই দলই বেশ কিছু সময় ধরে তেমন সাফল্য পাচ্ছে না। বায়ার্নের লীগ রাইভাল বোরুশিয়া ডর্টমুন্ড এবং রিয়াল মাদ্রিদের লীগ রাইভাল বার্সেলোনা উভয় দলই থামিয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষের শিরোপা স্বপ্ন। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ সেমিফাইনালে মুখোমুখি লস ব্লাঙ্কোস আর ডি রোটেনরা। দুই দলই হোম ম্যাচে একে অপরকে ২-১ গোলে হারানোয় ম্যাচ গড়ায় টাই-ব্রেকারে। শেষ পর্যন্ত ম্যানুয়েল নয়্যারের পেনাল্টি ঠেকানোর কৃতিত্বে ফাইনালে উঠলেও টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচে চেলসির কাছে টাই-ব্রেকারে হেরে যায় বায়ার্ন।

তার পরের মৌসুমে ইউসিএল সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ জার্মানি ও স্পেনের সেরা ৪টি দল। বায়ার্নের লীগ রাইভাল ডর্টমুন্ডের প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদ। অপরদিকে রিয়াল মাদ্রিদের লীগ রাইভাল বার্সেলোনার প্রতিপক্ষ বায়ার্ন মিউনিখ। তবে শেষমেশ দুই জার্মান দল বায়ার্ন এবং ডর্টমুন্ডই ফাইনালে ওঠে। চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণী ফাইনাল ম্যাচে আরিয়েন রোবেনের শেষ মুহূর্তের গোলে ডর্টমুন্ডকে হারিয়ে এক ঐতিহাসিক ট্রেবল কাপ জেতে জার্মানির দক্ষিণ থেকে উড়ে আসা বাভারিয়ার সৈন্যরা।

লস গ্যালাক্টিকোসরা যেভাবে তাদের শেষ চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয় শেষ করেছিল, ঠিক সেভাবেই যেন লা ডেসিমা জয় করে রাজকীয় যোদ্ধারা। ১২ বছর আগে কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ এবং সেইবারই নবম চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয় করে লস ভাইকিংসরা। ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটল আবার, তবে এবারের অঙ্কটা কিছুটা বড়। সেমিফাইনালে দুই লেগ মিলিয়ে বায়ার্নকে ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করে তারা।

বায়ার্নের বিপক্ষে সার্খিও রামোসের গোল; আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় বায়ার্ন মিউনিখের ৪-০ গোলের হার

২০১৪ সালের ২৪শে মে। পর্তুগালের এস্তাদিও দা লুজ স্টেডিয়ামে রিয়াল মাদ্রিদ মুখোমুখি নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। ৩৬ মিনিটে অ্যাটলেটিকো গোল করে লিড নিয়ে নেয়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, সার্খিও রামোসের ঐতিহাসিক শেষ মুহুর্তের গোল ম্যাচটিকে টেনে নিয়ে যায় অতিরিক্ত সময়ে এবং তারপরেরটুকু শুধুই লা ডেসিমা জয়ের গল্প।

৪০ বছর আগের সেই ঘটনা যেন আবারো ঘটল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সাথে। সেবার ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল বায়ার্ন মিউনিখ। ম্যাচের নির্ধারিত সময় গোলশুন্য থাকায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১১৪ মিনিটে আরাগোনেসের গোল লা রোজাদের প্রথম ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। কিন্তু সার্খিও রামোসের শেষ মুহূর্তের গোল ঠিক যেইভাবে তাদের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করেছিল ঠিক একইভাবে বায়ার্ন ডিফেন্ডার হান্স ইয়র্গ শোয়ার্জেনব্যাক ১২০ মিনিটে গোল করে তাদের স্বপ্ন মাটিতে মিশিয়ে দেয়। তার সেই গোল ম্যাচটিকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায় রিপ্লে ম্যাচে এবং সেই ম্যাচে লাল-সাদা ডোরাকাটাদের ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করে ইউরোপিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়নদের খাতায় নাম লেখায় বায়ার্ন মিউনিখের নায়কেরা।

১৯৭৪ – শোয়ার্জেনব্যাকের ১২০ মিনিটের গোল; ২০১৪ – রামোসের ৯২:৪৮ মিনিটের গোল

আজ আবারও আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় মুখোমুখি হবে দুই দল, রচিত হবে নতুন কোনো ইতিহাস। কোয়ার্টার ফাইনাল পেরিয়ে সেমিফাইনালে পা রাখতে পারবে কে তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটুকু বলা যায় যে, অসাধারণ দুইটি ম্যাচ অপেক্ষা করছে “দ্য বিউটিফুল গেম”-এর ভক্তদের জন্য।

ফিচার ইমেজ- Pinterest

Related Articles