বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান কে? উত্তরটি অনেকেই জানেন। ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান এবং প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে অভিষেক ম্যাচেই শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান ডেনিস অ্যামিস বিশ্বকাপেও প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে শতক হাঁকিয়েছিলেন। তবে প্রশ্নের উত্তর যতটা সহজ ভাবা হয়, ততটা সহজ নয়। বেশ কয়েকটা সমীকরণ মিলানোর পর ডেনিস অ্যামিসকেই বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসাবে নির্ধারণ করা হয়।
বিশ্বকাপের প্রথম আসর মাঠে গড়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ জুন। ঐদিনে বিশ্বকাপের মোট চারটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চার ম্যাচের মধ্যে ইংল্যান্ড এবং নিউ জিল্যান্ডের ম্যাচও ছিল। দুই দলেরই একজন করে ব্যাটসম্যান শতক হাঁকিয়েছিলেন বিশ্বকাপের উদ্বোধনী দিনে। ইংল্যান্ডের হয়ে ডেনিস অ্যামিস এবং নিউ জিল্যান্ডের হয়ে গ্লেন টার্নার শতক হাঁকিয়েছিলেন। দুইজনই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করেছিলেন এবং দুইজনই ছিলেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান।
ডেনিস অ্যামিস এবং গ্লেন টার্নারের মধ্যে কে আগে এক’শ রান করেছিলেন, তা নির্ধারণ করা হয়েছিল ম্যাচের সময় এবং ওভার দেখে। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো ছিল ৬০ ওভারের। তখন স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো এবং বেলা ১টায় ইনিংসের মাঝপথেই মধ্যাহ্ন বিরতিতে যেত দুই দল।
ভারত বনাম ইংল্যান্ডের ম্যাচে যখন মধ্যাহ্ন বিরতি দেওয়া হয়, তখন ইংল্যান্ডের ইনিংসের ৩৫ ওভার খেলা সম্পূর্ণ হয়েছিল। এই ৩৫ ওভারে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ডেনিস অ্যামিসের ব্যাট থেকে এসেছিল ৯৮ রান। অন্যদিকে, নিউ জিল্যান্ড বনাম পূর্ব আফ্রিকা যখন মধ্যাহ্ন বিরতিতে যায়, তখন ব্ল্যাক ক্যাপসদের ইনিংসের ৪০ ওভার খেলা হয়েছিল এবং গ্লেন টার্নার ৮০ রানে অপরাজিত ছিলেন। মধ্যাহ্ন বিরতির পর খেলা শুরু হলে ৩৭তম ওভারে ডেনিস অ্যামিস শতক পূর্ণ করেন এবং ৫১তম ওভারে সাজঘরে ফেরেন। তখনকার ম্যাচগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণ খুব বেশি না হলেও এটা বলা যায় যে, বিশ্বকাপে গ্লেন টার্নার শতক হাঁকানোর আগেই ডেনিস অ্যামিস শতক হাঁকিয়েছিলেন।
ডেনিস অ্যামিস
‘অভিষেক’ শব্দটার সাথে অ্যামিসের সখ্যতা বেশ পুরানো। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে পারেননি তিনি। ওয়ানডে ক্রিকেটে তার অভিষেক ঘটে ওয়ানডে ইতিহাসের দ্বিতীয় ম্যাচে। ১৯৭২ সালের ২৪ আগস্ট ম্যানচেস্টারে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড। ৫৫ ওভারের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে আট উইকেটে ২২২ রান সংগ্রহ করেছিল। জবাবে ডেনিস অ্যামিসের দুর্দান্ত শতকের উপর ভর করে ইংল্যান্ড ৩৫ বল এবং ছয় উইকেট হাতে রেখেই জয় তুলে নিয়েছিল।
ডেনিস অ্যামিস ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম শতক হাঁকিয়ে ১০৩ রান করেন। তিনি ১৩৪ বলে নয়টি চারের মারে তার ইনিংসটিকে সাজান। বিশ্বকাপেও প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে শতক হাঁকানোর কীর্তি গড়েছিলেন তিনি। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী দিনে ভারতের বিপক্ষে লর্ডসে প্রথমে ব্যাট করে চার উইকেটে ৩৩৪ রান সংগ্রহ করেছিল ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ১৩৭ রান করেছিলেন ডেনিস অ্যামিস। মদনলালের বলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরার আগে ১৪৭ বলে ১৮টি চারের মারে ১৩৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
জবাবে ভারত পুরো ৬০ ওভার ব্যাট করলেও তিন উইকেটে ১৩২ রানের বেশি তুলতে পারেনি। এই ম্যাচেই সুনীল গাভাস্কার ৩৬ রানের কচ্ছপগতির বিখ্যাত ইনিংসটি খেলেছিলেন। তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাট করে ১৭৪ বলে মাত্র একটি চারের মারে অপরাজিত ৩৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।
প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে ওয়ানডেতে এবং বিশ্বকাপে শতক হাঁকানো ডেনিস অ্যামিস খুব বেশি আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ খেলেননি। পাঁচ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে মোট ১৮ ম্যাচ খেলে চারটি শতক এবং একটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৭.৭২ ব্যাটিং গড়ে ৮৫৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। সীমিত সংখ্যক ওয়ানডে ম্যাচ খেলা অ্যামিস ওয়ানডে ক্রিকেটের বহু প্রথমের সাথে নিজের নাম পাকাপাকিভাবে লিখে রেখেছেন। তিনি ওয়ানডে ক্রিকেটে খুব বেশি ম্যাচ না খেললেও প্রায় এক যুগের টেস্ট ক্যারিয়ারে ৫০টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। ৫০ ম্যাচে ১১টি শতক এবং সমান সংখ্যক অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৪৬.৩০ ব্যাটিং গড়ে ৩,৬১২ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
গ্লেন টার্নার
ডেনিস অ্যামিসের মতো বিশ্বকাপের প্রথম দিনের প্রথম ইনিংসে শতক হাঁকিয়েছিলেন নিউ জিল্যান্ডের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান গ্লেন টার্নার। তবে সময়ের হিসাবে ডেনিস অ্যামিস এগিয়ে থাকার কারণে বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসাবে তার নামই রেকর্ডের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। গ্লেন টার্নার প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসাবে নিজের নাম লেখাতে না পারলেও বিশ্বকাপে এবং ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে ১৫০ রানের ইনিংস খেলার রেকর্ড গড়েছিলেন বিশ্বকাপের প্রথম দিনেই।
বিশ্বকাপের প্রথম দিনে এজবাস্টনে পূর্ব আফ্রিকার মুখোমুখি হয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। ম্যাচে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ৩০৯ রান সংগ্রহ করেছিল নিউ জিল্যান্ড। দলের ৩০৯ রানের মধ্যে অধিনায়ক গ্লেন টার্নারের একারই ছিল ১৭১* রান। তিনি ব্যাট ক্যারি করে ২০১ বলে ১৬টি চার এবং দু’টি ছয়ের মারে অপরাজিত ১৭১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তার অনবদ্য শতকের উপর ভর করেই বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ১৮১ রানের বিশাল ব্যবধানে জয় পেয়েছিল নিউ জিল্যান্ড।
দলের হয়ে এককভাবে অবদান রাখার ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। তাই তো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সম্পূর্ণ ইনিংসে দলের মোট রানের সর্বোচ্চ শতাংশ রান তোলার রেকর্ডটি তারই দখলে। ১৯৭৭ সালে উস্টারশায়ার কাউন্টিতে একটি ম্যাচে ১৬৯ রানে সবক’টি উইকেট হারিয়েছিল। এই ১৬৯ রানের মধ্যে ৮৩.৪৩% অর্থাৎ ১৪১* রান করেছিলেন গ্লেন টার্নার।
পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে গ্লেন টার্নার ১৭১* রানের অনবদ্য ইনিংস খেলতে মোট ২০১ বল মোকাবেলা করেছিলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যাটসম্যান, যিনি এক ইনিংসে দুই শতাধিক বল মোকাবেলা। সবচেয়ে বেশি বল মোকাবেলা করা ইনিংসগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানেও তার নাম রয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে খেলার এক ম্যাচ পর ভারতের বিপক্ষে ১৭৭ বলে অপরাজিত ১১৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
তার খেলা অপরাজিত ১৭১ রানের ইনিংসটি ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে কপিল দেব ১৭৫ রানের ইনিংস খেলার আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস হিসাবে সবার উপরে ছিল। ১৯৮৩ সালে কপিল দেব তাকে টপকে গেলেও কোনো নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানের তাকে টপকাতে সময় লেগেছিল ৩০ বছরেরও বেশি সময়। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে লু ভিনসেন্ট ১৭২ রানের ইনিংস খেলে ব্ল্যাক ক্যাপসদের হয়ে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েছিলেন।
গ্লেন টার্নারও খুব বেশি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। তিনি ৪১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে তিনটি শতক এবং নয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৭.০০ ব্যাটিং গড়ে ১,৫৯৮ রান সংগ্রহ করেছিলেন। কাকতালীয়ভাবে তিনি টেস্ট ক্রিকেটেও ৪১ ম্যাচ খেলেছিলেন। টেস্টে ৪১ ম্যাচে সাতটি শতক এবং ১৪টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৪.৬৪ ব্যাটিং গড়ে ২,৯৯১ রান করেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটেও বেশ সফল ছিলেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শতকের শতক হাঁকানো ক্রিকেটারদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় তার নামটিও রয়েছে। তিনি ৪৫৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ১০৩টি শতক হাঁকিয়েছিলেন।
ডেনিস অ্যামিস এবং গ্লেন টার্নার, দুইজনই সেসময়কার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন। ডেনিস অ্যামিসের কাছে অল্প সময়ের জন্য বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের খেতাব হারালেও বিশ্বকাপে প্রথম দেড়’শ রানের ইনিংস খেলার রেকর্ডটি নিজের করে নিয়েছিলেন গ্লেন টার্নার।