১
ম্যাচটা হচ্ছিলো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পেলের ব্রাজিলের। ১৯৭০ সালের সেই ইংল্যান্ড দলে তারকার কমতি ছিল না। ববি মুর, ববি চার্লটন, জিওফ হার্স্ট, গর্ডন ব্যাঙ্কস, ফ্রান্সিস লিদের সমন্বয়ে গড়া ইংল্যান্ড দলটি ছিল টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য ফেভারিট। ম্যাচের বয়স তখন সবেমাত্র ১০ মিনিট, গোলশূন্য অবস্থায় চলছে। ঠিক সেই সময় ডান উইংয়ে একটি হিসেব কষা পাস বাড়িয়ে দিলেন ব্রাজিলের অধিনায়ক রাইট ব্যাক কার্লোস আলবার্তো। জোয়ারজিনহো উপস্থিত ছিলেন সেখানে, বল নিয়েই গতিতে ছিটকে ফেললেন টেরি কুপারকে। ডি বক্সে ঢুকে শেষপর্যন্ত বলটা নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল হয়ে গেলো তার পক্ষে, লাইন দিয়ে বলটা বাইরে বেরিয়ে যায় যায় অবস্থা। ওদিকে কুপারকে কাভার করার জন্য ববি মুর এগিয়ে আসলেন, যার ফলে টোস্টাও এবং রিভেলিনো একেবারে ফাঁকা হয়ে যান। কিন্তু দুজনকেই বাদ দিয়ে পেলের উপর চোখ পড়লো তার। ছোট বক্সের মাঝামাঝি একটি ক্রস করেন তিনি।
সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকতে পারাটা একজন স্ট্রাইকারের প্রধান গুণ। পজিশনিং সেন্সের দিক থেকে পেলেও ছিলেন অনন্য। মূহুর্তেই নিজের পজিশনটাকে একেবারে পারফেক্ট বানিয়ে ফেলেন। মার্কে থাকা অ্যালান মুলারিকে হতভম্ব করে দিলেন স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে। কিছু বোঝার আগেই বামদিকে পোস্টের ফাঁকা অংশে হেড মারলেন পেলে। শূন্যে থাকা অবস্থাতেই বুঝে গেলেন, গোল হতে যাচ্ছে, চোখে মুখে লিড নেওয়ার আনন্দ ঝরে পড়ছে।
গোলকিপার ব্যাঙ্কস পোস্টের ডানদিকে থাকাতেই বা দিকটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে ব্যাঙ্কস যখন বুঝতে পারলেন যে, পেলে হেড করতে যাচ্ছেন, তখন তার হাতে আর বিন্দুমাত্র সময় নেই। সেই মূহুর্তে চিতা বাঘের মতো ক্ষিপ্র গতিতে ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ডান হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে ফ্লিক করে বলটাকে পাঠিয়ে দিলেন বারের বাইরে। উদযাপনরত পেলে হতভম্ব। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। নিশ্চিত গোলটা সেভ করে ফেললেন ব্যাঙ্কস। সেই সেভটাই ফুটবল বিশ্বে সর্বকালের সেরা সেভ নামে প্রচলিত। পেলের মার্কে থাকা মুলারি পরবর্তীতে বলেছিলেন, হেডটা হবার সাথে সাথেই পেলে ‘গোল’ বলে চিৎকার করেছিলেন। মাঠে উপস্থিত দর্শক এবং ধারাভাষ্যকাররাও গোল ভেবে উচ্ছ্বাস প্রায় আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ্কসের দক্ষতায় সবাই অবাক হয়ে যায়। সেই ম্যাচে আরো কিছু অসাধারণ সেভ করেন ব্যাঙ্কস। তবে শেষ মুহূর্তে ম্যাচের ৬৯ তম মিনিটে জোয়ারজিনহোর জোড়ালো শটে পরাস্ত হন। ম্যাচটা ইংল্যান্ড হেরে যায় ১-০ গোলে।
পৃথিবীতে ‘থ্যাঙ্কলেস জব’ নামে একটা কথা প্রচলিত আছে। ফুটবলে গোলকিপিংটা হচ্ছে তেমনই একটা কাজ। একজন স্ট্রাইকার সারা ম্যাচে ৫/৬ টা মিস করলেও যদি তার একটি গোলেও দল জিতে যায় তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দর্শকরা মিসগুলোকে মনে রাখে না। আর গোলকিপাররা পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত সব সেভ করে দিন শেষে একটি গোল খেলেও সবার মন খারাপ হয়। গোলকিপারকে তাই খুব সূক্ষ্ম হতে হয়। তবে ম্যাচটা হেরে গেলেও ব্যাঙ্কসকে কেউ দোষারোপ করেনি, সেভটির জন্যেই ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় এবং বরণীয় হয়ে রয়েছেন। এতটাই দুর্দান্ত ছিল সেই সেভ।
২
সর্বকালের সেরা গোলকিপারের নাম বললে চোখের সামনে লেভ ইয়াসিনের নামটাই ভেসে আসে। কিন্তু দ্বিতীয় সেরা অবশ্যই গর্ডন। IFFHS দ্বারা গত শতাব্দীর সেরা গোলকিপারের তালিকায় গর্ডনের অবস্থানও ছিল দুই নম্বরে।
অথচ অর্জনের তালিকা বলতে তেমন বেশি কিছুই নেই। ক্লাবের হয়ে অর্জন লেস্টার সিটির হয়ে ১৯৬৪ সালের লিগ কাপ আর স্টোক সিটির হয়ে ১৯৭২ সালের লিগ কাপ। ক্যারিয়ারে কখনোই লিগ শিরোপার ছোঁয়া পাননি গর্ডন। পাবেন কীভাবে? খেলতেন এমন কিছু দলে যারা লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দূরে থাক, সেরা দশে থাকতে পারলেও হয়তো খুশি থাকতো। গর্ডন থাকা অবস্থায় লেস্টার সিটি ১৯৬৩ মৌসুমে একবার লিগে চতুর্থ হয়। ১৯৬৭ সালে গর্ডনের বিদায়ের এক মৌসুম পরেই রেলিগেশনে পড়ে দ্বিতীয় বিভাগে নেমে আসে। লেস্টার সিটি তাদের মেজর কোনো শিরোপা জেতে ১৯৬৪ সালে গর্ডনের সময়েই।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তিনি লড়াই করেই গিয়েছেন। স্কুল পর্যায়ের বয়সভিত্তিক খেলায় মাত্র ২ ম্যাচ খেলেই তিনি বাদ পড়েন। বাদ পড়াটাই স্বাভাবিক ছিল, কেননা এই দুই ম্যাচে তিনি গোল হজম করেন ১৫টি। একপর্যায়ে ফুটবল ছেড়ে কয়লা খনিতে কাজ করা শুরু করছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার মাঠে ফেরত আসেন।
লেস্টার সিটিতেও প্রথম দিকে তিনি ছিলেন রিজার্ভ গোলকিপার। মাঝে মাঝে মূল গোলকিপারের অনুপস্থিতিতে দলে সুযোগ পেতেন, কিন্তু সেটাও সবসময় কাজে লাগাতে পারতেন না। ১৯৬০ সালে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৬ গোল হজম করেন গর্ডন। তবে তার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল একাগ্রতা। ট্রেনিংয়ে তিনি খুবই সিরিয়াস ছিলেন, সবসময় নিজের দুর্বলতা নিয়ে কাজ করতেন। একটা সময় দলের প্রথম পছন্দে পরিণত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি স্টোক সিটিতে চলে আসেন। সেখানেও লিগ কাপ জেতেন, যা কি না ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম। এই কাপ জেতার পথে সেমি ফাইনালের অতিরিক্ত সময়ে তিনি জিওফ হার্স্টের একটি পেনাল্টি সেভ করে দলকে ফাইনালে উঠতে সাহায্য করেন।
তবে ক্লাবের হয়ে সব অপূর্ণতা ঘুচে গিয়েছে ১৯৬৬ বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে। ঘরের মাঠে হওয়া বিশ্বকাপে ফাইনালে ওঠার পথে মাত্র ১টি গোল হজম করেছিলেন তিনি, সেটাও সেমিফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে। এর আগপর্যন্ত ৭২১ মিনিট সুরক্ষিত ছিল তার দুর্গ। ফাইনালে ২ গোল খেলেও ৪-২ গোলে জিতে যায় ইংল্যান্ড।
সেই বিশ্বকাপের অলস্টার দলে সুযোগ পান ব্যাঙ্কস। এছাড়া সেই টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপারও নির্বাচিত হন।
১৯৭০ সালের বিশ্বকাপটাও হয়তো ইংল্যান্ড জিততো। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪৯ মিনিটেই ২ গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলের পরাজয় তাদেরকে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে ফেলে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ম্যাচটাতে ইনজুরির জন্য গর্ডন ছিলেন না। সাইডলাইন থেকে বসে বসে দুঃখভরা চোখে দেখতে হয়েছে দলের হার। দলে থাকলে কি ইংল্যান্ড আরেকটু দূর পর্যন্ত যেতে পারতো? বলার উপায় নেই, তবে সম্ভাবনা অবশ্যই বেড়ে যেত।
দুই বিশ্বকাপে ৯টি ম্যাচ খেলে ৪টি গোল হজম করেছেন তিনি। বিশ্বকাপে ন্যূনতম ৮ ম্যাচ খেলেছেন এমন গোলিকপারের মাঝে তার গোল খাবার হারই সবচেয়ে কম। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে তিনি ৭৩টি ম্যাচ খেলেন এবং ৩৫টি ম্যাচেই গোলশূন্য থাকতে পেরেছেন। তার সময়ে ইংল্যান্ড মাত্র ৯টি খেলায় পরাজিত হয়। ইংল্যান্ড দলে তিনি ‘ইংল্যান্ডের ব্যাঙ্ক’ নামে পরিচিত, যা কি না তার ডাক নামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ইংল্যান্ডের গোলপোস্টে ব্যাঙ্কস এতটাই বিশ্বস্ত ছিলেন, যেমনটা মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করে।
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত টানা ছয়বার ফিফার বিচারে শ্রেষ্ঠ গোলকিপারের পুরস্কার পান তিনি।
৩
খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার থেকে অবসর নেন ১৯৭২ সালে। ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্যটা আরেকটু বাড়তে পারতো, বাঁধা দিয়েছে ইনজুরি। ১৯৭২ সালে একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় ডান চোখ নষ্ট হয়ে যায় গর্ডনের। এর কিছুদিন আগেই তিনি ইংল্যান্ডের বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন। এজন্য মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই ফুটবলের মূল ধারা থেকে বিদায় নেন। তবে এরপরেও কিছুদিন উত্তর আমেরিকার ফুটবল লিগে অল্প কিছু ম্যাচ খেলেছেন। ১৯৭১ এবং ১৯৭২ সালে তিনি ডেইলি এক্সপ্রেসের দ্বারা বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের পুরষ্কারেও ভূষিত হন।
মাঝে কিছুদিন কিছু ক্লাবের কোচ হিসেবেও কাজ করেছেন। এমনকি লেস্টার সিটি ক্লাবের নির্বাচক হিসেবেও ছিলেন। ২০০২ সালে স্টোক সিটির প্রেসিডেন্টও হন।
২০১৫ সালে তার কিডনিতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এর ১০ বছর আগেও একই রোগে তাকে একটা কিডনি হারাতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ৮১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বিশ্বকাপ তো অনেক গোলকিপারই জিতেছেন, বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপারের পুরষ্কারও প্রতি বিশ্বকাপে কেউ না কেউ জিতেছেন। তবে তাদের কয়জনকে মানুষ মনে রেখেছে? অথচ একটা সেভের মাধ্যমেই ফুটবল ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন গর্ডন।
অমর হবার জন্য খুব বেশি কিছু কি করার প্রয়োজন হয়?