শততম টেস্টে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়

মেহেদি হাসান মিরাজ যখন তারচেয়ে বয়সে দ্বিগুণ শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক রঙ্গনা হেরাথের বলে সুইপ করে ২ রান নিলেন তখনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন ইতিহাস রচিত হয়ে যায়। উত্তেজনাকর ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে তাদের নিজেদের মাটিতে টেস্ট হারানোর গৌরব অর্জন করলো বাংলাদেশ। এই ম্যাচের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে ১৮ বারের মোকাবেলায় প্রথম জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। শততম টেস্টকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ম্যাচের শুরু থেকেই আত্মপ্রত্যয় ছিল বাংলাদেশ। যার ফলাফলও হাতেনাতে পেল টাইগাররা। শ্রীলঙ্কাকে ৪ উইকেটে হারিয়ে নিজেদের শততম টেস্ট ৯ম জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।

জয়সূচক রান নেওয়ার সময় উদযাপন করছেন মেহেদি হাসান মিরাজ এবং মুশফিকুর রহিম; Image Source: espncricinfo

অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর চতুর্থ দল হিসাবে নিজেদের শততম টেস্টে জয় তুলে নিলেন বাংলাদেশ। সেই সাথে জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডের পর চতুর্থ দেশ হিসাবে শ্রীলঙ্কাকে টেস্ট ক্রিকেটে পরাজিত করলেন মুশফিকের শিষ্যরা।

ভারত, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়ে নিজেদের শততম টেস্টে হারের স্বাদ পেয়েছিল, একমাত্র দল হিসাবে শততম টেস্ট ড্র করে নিউজিল্যান্ড। যেখানে ভারত নিজেদের প্রথম ১০০ ম্যাচে বিদেশের মাটিতে জয়ের মুখ দেখেনি, সেখানে বাংলাদেশের ৯ জয়ের ৪টিই এসেছে বিদেশের মাটিতে। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে কলোম্বোর পি সারা ওভালে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার দেওয়া ১৯১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই হোঁচট খেয়ে যায় বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার মাটিতে ৫ম দিনের পিচে হেরাথের বিপক্ষে ১৯১ রানের পুঁজি যে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ তা মধ্যাহ্ন বিরতির আগেই টের পায় বাংলাদেশ। পরপর দুই বলে সৌম্য সরকার (১০) এবং ইমরুল কায়েসকে (০) প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে অভিজ্ঞ হেরাথ ইঙ্গিত দেন ম্যাচটা টানটান উত্তেজনাকর হতে যাচ্ছে।

মধ্যাহ্ন বিরতির পর তাড়াহুড়ো না করে সাব্বির রহমানকে সাথে নিয়ে রানের চাকা সচল রাখেন তামিম ইকবাল। এই দুইজন তৃতীয় উইকেট জুটিতে যোগ করে ১০৯ রান, টেস্ট ক্রিকেটের চতুর্থ ইনিংসে ৭ম বারের মতো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা যেকোনো উইকেট জুটিতে শত রানের জুটি গড়লো। এই দুইজনের ব্যাটে চড়ে বাংলাদেশ জয়ের সুভাস পাচ্ছিলো চা-বিরতির আগেই। কিন্তু দুর্দান্ত খেলতে থাকা তামিম ইকবাল ব্যক্তিগত ৮২ রান এবং দলীয় ১৩১ রানের মাথায় দিলরুয়ান পেরেরাকে সামনে এসে মারতে গিয়ে ঠিকমতো ব্যাটে বলে করতে না পেরে চান্দিমালের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান।

টেস্ট ক্রিকেটের ৫ম দিনের পিচে ব্যাট করা সবচেয়ে কঠিন, কিন্তু তামিম ইকবাল আত্মবিশ্বাসের সাথে স্পিনারদেরকে ফ্রন্ট ফুটে এসে মোকাবেলা করেছেন। তার ব্যাটিংয়ের ধরণ ধারাভাষ্য কক্ষ হতে শুরু করে সবাইকেই মুগ্ধ করেছে।

৫ম দিনের পিচে অনবদ্য ইনিংস খেলার পথে রিভার্স সুইপ করছেন তামিম ইকবাল; Image Source: espncricinfo

আউট হওয়ার আগে কাজের কাজ ঠিকই করে যান তামিম ইকবাল। তার ১২৫ বলে ৭ চার এবং ১ ছয়ে সাজানো ৮২ রানের ইনিংসটি মুগ্ধ করেছে ক্রিকেট বিশ্বকে, কিন্তু তামিম মাত্র ১ রানের জন্য আফসোস করতেই পারেন। কারণ মাত্র ১ রানের জন্য প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দশ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারলেন না। থামতে হলে ৯,৯৯৯ রানে। তামিমের বিদায়ের কিছুক্ষণ পরেই ৪১ রানে ব্যাট করা সাব্বির রহমান সুইপ শট খেলতে গিয়ে পেরেরার বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পরেন তিনি।

দলের দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান সাকিব আল হাসান এবং মুশফিকুর রহিম চা-বিরতি পর্যন্ত দেখেশুনে কাটিয়ে দেন। চা-বিরতির পর জয় থেকে মাত্র ২৯ রান দূরে থাকতে পেরেরার তৃতীয় শিকারে পরিণত হন প্রথম ইনিংসে শতক হাঁকানো সাকিব আল হাসান। ৪৩ বলে লড়াকু ১৫ রান করে পেরেরা বলে বোল্ড হয়ে ফিরে যান তিনি। তার বিদায়ের পর ম্যাচ জয়ের গুরুদায়িত্ব অধিনায়ক মুশফিকের কাঁধে চেপেছিল। অভিষিক্ত মোসাদ্দেককে নিয়ে সেই পথেই হাটছিলেন কাপ্তান মুশফিক, কিন্তু জয় থেকে মাত্র ২৪ রান দূরে থাকতে আম্পায়ার এস রাবি বিতর্কিতভাবে মুশফিককে দিয়ে দেন। পুরো ম্যাচ জুড়েই দুই আম্পায়ার আলিম দার এবং এস রাবির সিদ্ধান্ত ছিল বিতর্কিত। এই টেস্টে তাদের ১০টি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়।

মুশফিকের রিভিউ সফল হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের জয় পাওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। তরুণ তুর্কি মোসাদ্দেককে নিয়ে ২৭ রান যোগ করেন তিনি। জয় থেকে মাত্র ২ রান দূরে থাকতে হেরাথের বলে মোসাদ্দেক আউট হলেও দলকে রেখে যান জয়ের দ্বারপ্রান্তে। মিরাজ ২ রান নিয়ে বাংলাদেশকে ৪ উইকেটের জয় এনে দেন। মুশফিকুর রাহিম শেষপর্যন্ত ২২* রানে অপরাজিত ছিলেন।

এর আগে কলোম্বোর পি সারা ওভালে বাংলাদেশের শততম টেস্ট ম্যাচে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ম্যাচের প্রথম সেশন থেকেই শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের চাপে রাখেন মিরাজ, মুস্তাফিজরা। মাত্র ৭০ রানের মধ্যেই তুলে নেন ৪ উইকেট। শ্রীলঙ্কা ধারাবাহিকভাবে উইকেট হারাতে থাকলেও একপ্রান্ত আগলে রেখে খেলতে থাকেন দিনেশ চান্দিমাল। মাটি কামড়ে থেকে ৩০০ বলে করেন ১৩৮ রান। তার শতকের উপর ভর করে শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংসে ৩৩৮ রান সংগ্রহ করে। জবাবে বাংলাদেশের দুই ওপেনার জবাবটা ভালোভাবেই দেয়, উদ্বোধনি উইকেট জুটিতে তামিম-সৌম্য যোগ করেন ৯৫ রান। তামিম ৪৯ রান করে হেরাথের বলে এবং সৌম্য টানা তৃতীয় অর্ধশতক করে (৬১) সান্দাকানের বলে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে যান।

কলোম্বো টেস্টের প্রথম ইনিংসে শতক হাঁকানোর ব্যাট উঁচিয়ে দর্শকদের অভিনন্দনে জবাব দিচ্ছেন দিনেশ চান্দিমাল; Image Source: espncricinfo

দ্বিতীয় দিনের শেষ সেশনের শেষ ১৫ মিনিট ভুলে যেতে চাইবে বাংলাদেশ। ১৯২ রানে ২ উইকেট থেকে ১৯৮ রান তুলতেই হারিয়ে বসেন ৫ উইকেট। সেই সাথে সাকিব দিনের শেষভাগেও এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়ে  করা ৮ বলে ১৮* রানের ইনিংসটি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। কিন্ত তৃতীয় দিনটা ছিল শুধুমাত্র বাংলাদেশের। সাকিবের অনবদ্য শতক (১১৬) এবং মুশফিক (৫২), মোসাদ্দেকের (৭৫) অর্ধশতকে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে সংগ্রহ করে ৪৬৭ রান। তৃতীয় দিন সাকিব তার স্বাভাবিক ব্যাটিং স্টাইল থেকে বের হয়ে দেখেশুনে খেলেন, যার সুবাদে নিজের ৫ম শতকের পাশাপাশি দলের বড় সংগ্রহও নিশ্চিত করেন তিনি।

সাকিব আল হাসানের শতক পূর্ণ হওয়ার পর তাকে জড়িয়ে ধরছেন অভিষিক্ত মোসাদ্দেক; Image Source: espncricinfo

জবাবে ১২৯ রানে পিছিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালো করলেও নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে শ্রীলঙ্কা। একপ্রান্ত আগলে রেখে দিমুথ কারুণারত্নে করেন ১২৬ রান। শেষদিকে পেরেরার ৫০ রান এবং লাকমালের ৪২ রানের উপর ভর করে বাংলাদেশকে ১৯১ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দেয় স্বাগতিকরা। সাকিব আল হাসান ৪ উইকেট এবং মুস্তাফিজুর রহমান ৩ উইকেট শিকার করে শ্রীলঙ্কাকে রানের পাহাড়ে চড়তে দেননি।

দ্বিতীয় ইনিংসে একাই লড়ে যান ওপেনার দিমুথ কারুণারত্নে; Image Source: espncricinfo

কলোম্বোর ঐতিহাসিক টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৪৯ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে অনবদ্য ৮২ রান করে টেস্ট ক্রিকেটে তৃতীয়বারের মতো ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন তামিম ইকবাল। এছাড়া সিরিজে ১৬২ রান এবং ৯ উইকেট শিকার করে চতুর্থবারের টেস্ট ক্রিকেটে সিরিজ সেরার পুরস্কার নিজের করে নেন সাকিব আল হাসান। একমাত্র বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসাবে একের অধিক সিরিজ সেরার পুরস্কার জিতলেন তিনি। নিজেদের শততম টেস্টে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এই জয়ে “জয় বাংলা” কাপ শ্রীলঙ্কার সাথে ভাগাভাগি করে নিলো বাংলাদেশ।

জয় বাংলা কাপ হাতে দুই অধিনায়ক; Image Source: espncricinfo

দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশকে ২৫৯ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। প্রথম টেস্ট হারার পর একাদশ নিয়ে বেশ কয়েকটি গুঞ্জন শুনা গিয়েছিল। টেস্ট ক্রিকেটে অফফর্মের জন্য রিয়াদকে ওডি’আই এবং টি-টুয়েন্টিতে বাদ দিতে চেয়েছেন স্বয়ং কোচ। এইসব বিষয় নিয়েও ক্রিকেট প্রাঙ্গণে উত্তাপ ছিল। যা ছাপিয়ে গিয়েছিল শততম টেস্টের উত্তেজনাকেও। শেষ পর্যন্ত রিয়াদ, মমিনুলদের বাদ দিয়েই শততম টেস্ট খেলতে নামেন বাংলাদেশ। সব আলোচনা, সমালোচনাকে ছাপিয়ে দেশকে ভাসিয়েছে জয়ের আনন্দে। বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে গতবছর ইংল্যান্ডের মতো পরাশক্তিকে হারিয়ে এবং শ্রীলঙ্কাকে নিজেদের মাটিতে টেস্ট হারিয়ে ক্রিকেটবিশ্বকে জানান দিচ্ছে, শুধুমাত্র লিমিটেড ওভারের ক্রিকেটেই নয়। সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটেও উন্নতি করছে।

 

This article is in Bengali language. It is about the historic win by Bangladesh in their 100th Test match. They created history as they secured a four wicket win against Sri Lanka.  For references please check the hyperlinks inside the article.

Featured image: espncricinfo

Related Articles

Exit mobile version