১৯৭১ সাল থেকে ২০২০ সাল – মাঝের এই ৪৯ বছরের একদিনের ক্রিকেট ইতিহাসে ম্যাচ হয়েছে ৪,২৫৫টি। ফলাফল এসেছে ৪,০৬৯টি ম্যাচে, পরিত্যক্ত হয়েছে ১৪৮ ম্যাচ, টাই হওয়া ম্যাচের সংখ্যা ৩৮। আর ক্রিকেটের ‘তিন মোড়ল’-খ্যাত অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং ভারতের পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে বোঝা যায়, সবচেয়ে বেশি ৯৮৭টি ম্যাচ খেলেছে ভারত। ভারতীয়দের ৫১৩ জয়ের বিপরীতে তারা ম্যাচ হেরেছে ৪২৪টি, জয়ের হার ৫৪.৭০%। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯৪৯টি ম্যাচ খেলেছে অস্ট্রেলিয়া, যেখানে অজিদের ৫৭৫ জয়ের বিপরীতে হার আছে ৩৩১টি। বাকি ম্যাচগুলো ড্র এবং পরিত্যক্ত হয়েছে, জয়ের হার ৬৩.৩৩%। ইংলিশদের ৭৪৬ ম্যাচের বিপরীতে জয় আছে ৩৭৫টি। ৫২.৮৫% ম্যাচ জিতেছে ইংলিশরা।
কিন্তু, প্রশ্ন যখন ওঠে কোনো ম্যাচের অমরত্বের, আপনি-আমি মনে রেখেছি কয়টিই বা ম্যাচ!
আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু এরকম মনে রাখার মতো তিনটি ওয়ানডে ম্যাচ। স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান তাড়া করা তিনটি ম্যাচের দিকে নজর দেওয়া যাক।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ – ইংল্যান্ড, বার্বাডোস ২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংলিশরা পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এসেছিল। সিরিজের প্রথম ম্যাচ বার্বাডোজের কিংস্টন ওভালে। টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন জেসন হোল্ডার। অধিনায়কের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, সেটি প্রমাণ করতে সময় নিলো না ব্যাটসম্যানরা। দলীয় ৩৮ রানে জন ক্যাম্পবেল আউট হলেও ক্যারিবীয় দানব ক্রিস গেইল আর শাই হোপ ইংলিশ বোলারদের ভালোই জবাব দিচ্ছিলেন। দলীয় ১৬৯ রানের সময় বেন স্টোকসের বলে শাই হোপ আদিল রশিদের হাতে ক্যাচ দিলে ভাঙে ১৩১ রানের জোট। উইকেটে এসে থিতু হতে পারেননি শিমরন হেটমায়ার।
ক্রিস ওকসের বলে আউট হবার আগে করেছেন ২০ রান। এরপর রানের খাতা খোলার আগেই সাজঘরে ফিরে গেছেন উইকেটরক্ষক নিকোলাস পুরান। তখন একপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ইংলিশ বোলারদের কচুকাটা করছেন গেইল। শুরু থেকেই এদিন খুনে মেজাজে ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল, স্টোকসের বলে বোল্ড হবার আগে খেললেন ১২৯ বলে ১৩৫ রানের ‘দানবীয়’ ইনিংস। ভাবছেন, ১০৪ স্ট্রাইকরেটের এই ইনিংস কী করে দানবীয় হয়? তবে জেনে রাখা ভালো, সে ইনিংসে মাত্র তিনটি চারের বিপরীতে ছক্কা হাঁকিয়েছেন ১২টি!
শেষদিকে ডোয়াইন ব্রাভোর ৩০ বলে ৪০ এবং অ্যাশলি নার্সের ৮ বলে ২৫ রানের ক্যামিওতে নির্ধারিত ৫০ ওভারে আট উইকেটে ৩৬০ রানের পাহাড়সম পুঁজি পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্টোকস এবং আদিল রশিদ উভয়েই নেন তিনটি করে উইকেট।
জবাব দিতে নেমে শুরু থেকেই ক্যারিবীয় বোলারদের উপর চড়াও হন দুই ইংলিশ ওপেনার জেসন রয় এবং জনি বেয়ারস্টো। উদ্বোধনী জুটিতে মাত্র ১০.৫ ওভারে তারা দু’জনে তোলেন ৯১ রান। এরপর বেয়ারস্টো ফিরে গেলে জো রুট এসে জেসন রয়ের সাথে তাণ্ডবলীলায় যোগ দেন। এই দু’জনের তাণ্ডবে বেসামাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং লাইনআপ। সেঞ্চুরি তুলে নেন দু’জনই।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় উইকেট জুটিতে রান আসে যথাক্রমে ১১৪ এবং ১১৬। মূলত এখানেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শেষদিকে ইয়োন মরগানের ঝড়ো ৫১ বলে ৬৫ আর স্টোকসের স্থিতধী ২০ রানের উপর ভর করে ৬ উইকেট হাতে রেখে ৮ বল বাকি থাকতেই পাহাড়সম এই লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলে ইংলিশরা। মাত্র ৮৫ বলে ১২৩ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলা জেসন রয় ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন।
অস্ট্রেলিয়া – দক্ষিণ আফ্রিকা, ডারবান ২০১৬
২০১৬ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ আয়োজন করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সিরিজের প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়ানডেতে প্রোটিয়াদের কাছে পাত্তাই পায়নি সফরকারীরা। ডারবানে তৃতীয় ওয়ানডে তাই অস্ট্রেলিয়ার জন্য ছিল সিরিজ বাঁচানোর লড়াই। দিবারাত্রির ম্যাচে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় স্টিভেন স্মিথের দল।
দুই ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার এবং অ্যারন ফিঞ্চের উড়ন্ত সূচনা। উদ্বোধনী জুটিতে মাত্র ১৩ ওভারে তারা বোর্ডে তোলে ১১০ রান। ৫৩ করে ফিঞ্চ আউট হলেও স্মিথ – ওয়ার্নার মিলে রীতিমতো তাণ্ডব চালান প্রোটিয়া বোলারদের উপর। সেঞ্চুরি তুলে নেন দু’জনই। এরপর উইকেটে যে ব্যাটসম্যানই এসেছে, সে-ই ঝড় তুলেছে। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৩৭১ রানের পাহাড়সম পুঁজি পায় অজিরা।
জবাব দিতে নেমে শুরু থেকেই চালিয়ে খেকে ডু প্লেসির দল। ওভারপ্রতি প্রায় আট করে রান তোলে। বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলছিলেন প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানরা। তবে দলীয় ২১৭ রানের সময় পাঁচ উইকেট পড়ে গেলে কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। উইকেটে স্বীকৃত ব্যাটসম্যান কেবল ডেভিড মিলার। জিততে তখনও দরকার ১৫৫ রান।
ঠিক এই সময়টায়ই রূদ্রমূর্তি ধারণ করলেন ‘কিলার মিলার’। সেদিন অজি বোলারদের উপর রীতিমতো স্টিম রোলার চালান মিলার। তাকে ভাল সঙ্গ দেন আন্দ্রে ফেলুকায়ো। শেষ পর্যন্ত মিলারের খুনে মেজাজে খেলা ৭৯ বলে ১১৮ রানের দানবীয় ইনিংসের উপর ভর করে চার বল বাকি থাকতে লক্ষ্যে পৌছায় স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যান অফ দ্য ম্যাচও ওই মিলারই।
অস্ট্রেলিয়া – দক্ষিণ আফ্রিকা, জোহানেসবার্গ ২০০৬
২০০৬ সালের ১২ মার্চ। অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ২-২ সমতা। পঞ্চম ওয়ানডে তাই সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচ।
টসে জিতে ব্যাটিংয়ে রিকি পন্টিংয়ের মাইটি অজি। শুরু থেকেই প্রোটিয়া পেসারদের উপর চড়াও হতে থাকেন অজি ব্যাটসম্যানরা। উদ্বোধনী জুটিতে মাত্র ১৬ ওভারে ১০০ ছুঁই ছুঁই। এরপর ওভার যত বেড়েছে, সাথে সাথে রানরেটের গ্রাফ তত ঊর্ধমুখী হয়েছে। উইকেটে ব্যাটসম্যান বদলেছে, ব্যাটিংয়ের ধরন বদলায়নি। ওয়ান-ডাউনে নেমে অধিনায়ক রিকি পন্টিং দিশেহারা করে দিয়েছেন মাখায়া এনটিনি, অ্যান্ড্রু হল, ভ্যান ডার ওয়াথকে।
৪৭.১ ওভারে পন্টিং যখন আউট হন ততক্ষণে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে এই ম্যাচ। ওয়ানডেতে প্রথমবারের মতো চারশ পেরোনো স্কোর দেখ ক্রিকেট বিশ্ব। আউট হবার আগে পন্টিং খেলেছেন ১০৫ বলে ১৬৪ রানের অতিমানবীয় এক ইনিংস। শেষ দিকে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের ১৩ বলেন ২৭ রানের ক্যামিওতে ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংগ্রহ দাঁড় করায় অজিরা। চার উইকেটের ৪৩৪ রান বোর্ডে তোলে রিকি পন্টিংয়ের দল।
জিততে হলে হিমালয়ের চূঁড়া স্পর্শ করতে হবে প্রোটিয়াদের। রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়তে হবে। ব্রেট লি, স্টুয়ার্ট ক্লার্ক, নাথান ব্র্যাকেনদের তুলোধুনো করতে হবে। এই সমীকরণগুলো মাথায় নিয়ে প্রায় অসম্ভবটা সম্ভব করতে নেমেছিলেন গ্রায়েম স্মিথ, হার্শেল গিবস, জ্যাক কালিসরা।
ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতেই ধাক্কা খায় স্বাগতিকরা। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই ব্রাকেনের বলে বোল্ড বোটা ডিপেনার। এরপরের গল্পটা স্মিথ এবং গিবসের। অজি পেসারদের উপর এই দু’জন মিলে তাণ্ডবলীলা চালান, যে তাণ্ডবে ছাড়খার অজি বোলিং লাইনআপ। তিন রানে এক উইকেট থেকে দুই উইকেট ১৯০ বানিয়ে ফেলেন। ওভার তখন মাত্র ২২!
৫৫ বলে ৯০ করে স্মিথ আউট হলেও গিবসের ছড়ি ঘুরানো তখনও থামেনি। ২৯৯ রানের মাথায় আফ্রিকার চতুর্থ উইকেটের পতন ঘটে। ডেঞ্জারম্যান গিবস ফিরে যান ১১১ বলে ১৭৫ করে। জিততে তখনও দরকার ১০৯ বলে ১৩৫ রান। উইকেটে থিতু হতে পারেননি জ্যাক ক্যালিস জাস্টিন কেম্প কেউই। রইলেন কেবল মার্ক বাউচার, আরেক প্রান্তে ভ্যান ডার ওয়াথ। ১৮ বলে তিন ছয়ে ৩৫ করা ভ্যান ডার ওয়াথ প্রোটিয়াদের আশা জাগাচ্ছিলেন। ৩৯৯ রানের সময় ব্র্যাকেনের বলে পন্টিংয়ের হাতে ক্যাচ দিয়ে সে আশায় গুড়ে বালি।
সাত নাম্বার উইকেটের পতন, লক্ষ্যে পৌছাতে দরকার আরো ৩৫ রান।
উত্তেজনার পারদ ঠাসা ম্যাচের নাটকের শেষ দৃশ্য তখনও বাকি।
দলীয় ৪২৩ রানে প্রোটিয়াদের অষ্টম উইকেটের পতন। শেষ দশ বলে দরকার ১২ রান। পেণ্ডুলামের মতো ম্যাচের ভাগ্য তখন দুলছে। গ্যালারিতে পিনপতন নীরবতা। শেষ ওভারে জয়ের সমীকরণ মিলাতে প্রোটিয়াদের দরকার সাত রান। অজিদের দরকার দুই উইকেট। বোলিং প্রান্তে ব্রেট লি স্ট্রাইকে মার্ক বাউচার, নন স্ট্রাইকে অ্যান্ড্রু হল। ব্রেট লি’র প্রথম বলে সিঙ্গেল নিয়ে প্রান্ত বদল করেন বাউচার। ওভারের পরের গুড লেন্থের ডেলিভেরি মিড উইকেট দিয়ে সীমানা ছাড়া করেন হল। চার বলে দরকার তিন। ওভারের তৃতীয় বলে মিড অনের উপর দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে ক্লার্কের হাতে ধরা পরেন।
উইকেটে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আসেন মাখায়া এনটিনি। ওভারের চতুর্থ বলে ঠাণ্ডা মাথায় থার্ডম্যানে ঠেলে সিঙ্গেল নেন। স্কোর লেভেল।
ওভারের পঞ্চম বল, আবারও ব্রেট লি’র গুড লেন্থের ডেলিভারি, পড়তে মোটেও ভুল করেননি বাউচার। মিড অনের উপর দিয়ে সীমানা ছাড়া!
‘It’s all over, SA win with a wicket and a ball to spare- well played SA, a miracle!’
ক্রিকইনফোও তখন লিখেছিল,
‘সর্বকালের সেরা ম্যাচটা দক্ষিণ আফ্রিকাই জিতেছে।’
উল্লেখ্য, ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান তারা করে জয়ের রেকর্ড ‘চোকার’ তকমা পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার ঝুলিতে। মজার ব্যাপার হলো, দু’টি ম্যাচেই পরাজিত দলের নাম অস্ট্রেলিয়া। হ্যাঁ, পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ‘মাইটি’ অজি, রিকি পন্টিং-অ্যাডাম গিলক্রিস্ট-গ্লেন ম্যাকগ্রাদের অস্ট্রেলিয়া দু’টি ম্যাচেই পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল! আর তৃতীয় সর্বোচ্চ রান তারা করে জিতেছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। এখানে বিপক্ষ দল সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম তিন আসরেই ফাইনাল খেলে দু’টিতেই যারা শিরোপা জিতেছিল।
এটাই তো গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। নিজেদের দিনে যেকোনো দল মাঠের ক্রিকেটে সেরাটা দিয়ে ম্যাচ বের করে আনতে পারে। নেভিল কার্ডাসের ভাষায় যাকে বলে,
‘পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা!’