কাজটা খুব কঠিন, সবাই পারে না। সারা বছর ক্লাবে ভালো খেললেও জাতীয় দলের সাথে বিশ্বকাপে এসে অনেক ভালো খেলোয়াড়েরাও নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেন না। ক্লাবের হয়ে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময়টা একজন খেলোয়াড় অনেক বেশি পান। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে সেই সময়টা স্বাভাবিকভাবেই পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এত বাধা-বিপত্তি থাকার পর কোনো খেলোয়াড়ের দল যদি শক্তিমত্তার দিক থেকে কিছুটা দুর্বল হয়, তাহলে তার পক্ষে দল নিয়ে বেশি দূর এগোনোটা আরো বেশি কষ্টকর।
তবে ইতিহাসে কিছু কিছু খেলোয়াড় আছেন, যারা নিজেদের শক্তি ও দুর্বলতাকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করেন এবং দলকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। বুলগেরিয়ার রিস্টো স্টোইচকভ ছিলেন তেমনই একজন স্পেশাল খেলোয়াড়। কাজটা তিনি করেছিলেন ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে।
কেমন পারফরম্যান্স করেছিলেন স্টোইচকভ?
বুলগেরিয়াকে নিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তবে কেবলমাত্র এই একটা তথ্য দিয়ে স্টোইচকভের পারফরম্যান্সের গুরুত্বটা পুরোপুরি বোঝা যাবে না। সেটা বুঝতে চাইলে আরেকটু বিশ্লেষণ করতে হবে। সেটাই একটু করা যাক।
১.
পারফরম্যান্স জানার আগে বুলগেরিয়ার বিশ্বকাপ ইতিহাসটিও একটু জানা প্রয়োজন। ১৯৩০-৫৮ সাল পর্যন্ত তারা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ১৯৬২-৭৪ পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে বাদ পড়ে তারা। ১৯৭৮ আর ১৯৮২ সালে আবার কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়। ‘৮৬-তে কোয়ালিফাই করে দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত যায়, তবে ‘৯০-তে আবারও কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়।
‘৯৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে বুলগেরিয়ার গ্রুপে ছিল ৬টি দল, সেখান থেকে বিশ্বকাপে সুযোগ পাবে কেবল ১টি দল। গ্রুপে সুইডেন আর ফ্রান্স থাকার কারণে বুলগেরিয়ার বাদ পড়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। কিন্তু এরিক ক্যান্টোনার ফ্রান্সকে টপকে মাত্র ১ পয়েন্টের ব্যবধানে মূল পর্বে জায়গা করে নেয় বুলগেরিয়া। বুলগেরিয়ার পক্ষে বাছাইপর্বে সর্বোচ্চ গোল (৫টি) করেন স্টোইচকভ।
সেই বুলগেরিয়াকে নিয়ে ১৯৯৪ বিশ্বকাপে খুব বেশি আশা কারো থাকার কথা ছিল না। তার উপর তারা পড়েছিল সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার গ্রুপে। প্রথম ম্যাচে সুপার ঈগল নাইজেরিয়ার কাছে ২-০ গোলে হেরে যাওয়ার পর গ্রুপ পর্বই তাদের সীমানা মনে হচ্ছিল। কিন্তু গ্রীসকে ৪-০ গোলে হারিয়ে আশাটা বাঁচিয়ে রাখে তারা, ম্যাচে ২টি গোল করেন স্টোইচকভ। শেষ ম্যাচে ম্যারাডোনাকে হারিয়ে মনোবল ভাঙা আর্জেন্টিনাকে ২-০ গোলে হারায় বুলগেরিয়া। এই ম্যাচেও স্টোইচকভ ১ গোল করেন।
দ্বিতীয় পর্বে মেক্সিকোকে হারায় তারা টাইব্রেকারে। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে ড্র হওয়া সেই ম্যাচেও দলের পক্ষে ১টি গোল করেন স্টোইচকভ। কোয়ার্টারে তারা মুখোমুখি হয় আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির। জার্মানি সেই বিশ্বকাপে একটা দুর্ধর্ষ দল। আগের তিন বিশ্বকাপেই ফাইনাল খেলেছে, সর্বশেষ আসরের চ্যাম্পিয়ন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে টানা চতুর্থবারের মতো ফাইনাল খেলার পথেই ছিল তারা।
ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন জার্মানির ম্যাথিউস। কিন্তু সবাইকে অবাক করে ৭৫ আর ৭৮ মিনিটে ২ গোল করে জিতে যায় বুলগেরিয়া। প্রথম গোলটি করেন স্টোইচকভ, সেটাও ফ্রি কিক থেকে। সেই গোলের পরই বুলগেরিয়া উজ্জীবিত হয়ে উঠে। সেমিতেও স্টোইচকভ ১টি গোল করেন, তবে ব্যাজিও ম্যাজিকের কাছে হেরে যান।
৬ গোল করে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার পান, এবং সেই বিশ্বকাপের ব্রোঞ্জ বুট জিতে তৃতীয় সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। এছাড়া সেই বিশ্বকাপের অলস্টার দলেও জায়গা পান।
‘৯৮ বিশ্বকাপেও স্টোইচকভ খেলেন এবং দলকে বিশ্বকাপে নিয়ে যান। তবে এবার গ্রুপ থেকেই বিদায় নেয় বুলগেরিয়া। স্টোইচকভের বিদায়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে আর কোয়ালিফাই করতে পারেনি বুলগেরিয়া। কোন দলকে কোন পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন তিনি, একবার ভাবুন তাহলে!
২.
কেবল বিশ্বকাপেই নয়, ইউরোতেও স্টোইচকভের চেষ্টা ছিল অনবদ্য।
ইউরো ১৯৯৬ এর বাছাইপর্বে ১০ ম্যাচে ১০টি গোল করে বাছাইপর্বের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন স্টোইচকভ। তবে এরপরও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানি। গ্রুপ রানার্সআপ হিসেবে মূল পর্বে খেলার সুযোগ পায় বুলগেরিয়া।
ইউরো ১৯৯৬ মূল পর্বে বুলগেরিয়ার গ্রুপে ছিল ফ্রান্স, স্পেন আর রোমানিয়া। স্পেনের সাথে ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে বুলগেরিয়ার পক্ষে গোলটি করেন স্টোইচকভ। রোমানিয়াকে ১-০ গোলে হারানো ম্যাচের গোলটিও তারই করা। ফ্রান্সের সাথে শেষ ম্যাচে ড্র করলেই পরের পর্বে ওঠার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই ম্যাচে বুলগেরিয়া ৩-১ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে। সেই ম্যাচেও বুলগেরিয়ার পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন স্টোইচকভ।
টুর্নামেন্টে বুলগেরিয়ার ৩টি গোলের সবকয়টিই স্টোইচকভের পা থেকে আসে, এবং টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি। এছাড়া সেই টুর্নামেন্টের অলস্টার একাদশেও জায়গা পান তিনি।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ ইউরোর আগের ৯টি আসরের একটিতেও বুলগেরিয়া মূল পর্বে সুযোগ পায়নি। পরবর্তীতেও কেবলমাত্র আর একটি আসরে (ইউরো ২০০৪) সুযোগ পায়।
৩.
জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ সফলতা না পেলেও ক্লাবের হয়ে প্রায় পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই মাঠ মাতিয়েছেন তিনি। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে উজ্জ্বলতা ছড়ান বুলগেরিয়ান ক্লাব সিএসকেএ সোফিয়াতে। সেখানে ৫ মৌসুম খেলে লিগ জেতেন তিনবার। এই সময়ে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন দুইবার। বুলগেরিয়ান কাপ জেতেন চারবার, এবং সুপার কাপ জেতেন একবার। এছাড়া ৭ গোল করে উয়েফা উইনার্স কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন একবার(১৯৮৯)।
এই পারফরম্যান্সের কারণে ইউরোপের শীর্ষ লিগের ক্লাবগুলোর নজরে পড়েন তিনি এবং বার্সেলোনাতে চলে যান। এখানে তিনি ক্রুইফের ‘ড্রিম টিম’-এর অংশ হয়ে বার্সেলোনার সফলতায় সাহায্য করেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত টানা চারটি লা লিগা শিরোপা জেতার পাশাপাশি ১৯৯২ সালের ইউরোপিয়ান কাপও (বর্তমানে চ্যাম্পিয়নস লিগ) জেতেন। এছাড়া দুইবার ইউরোপিয়ান সুপার কাপ, ১ বার কোপা দেল রে এবং ১ বার উয়েফা উইনার্স কাপের শিরোপা জেতেন।
এই সময়টাতে তিনি দুইবার (১৯৯২, ১৯৯৪) ফিফা বর্ষসেরার রানার্সআপ হন, এবং ১৯৯৪ সালে ব্যালন ডি’অর পান।
৪.
মূলত স্ট্রাইকার হিসেবে খেললেও সৃষ্টিশীলতা থাকার কারণে তাকে দলের প্রয়োজনে কখনো কখনো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলতে হয়েছে। কিছুটা সময় সাহায্যকারী স্ট্রাইকারের ভূমিকাতেও তাকে দেখা গিয়েছে। ফ্রি কিক এবং পেনাল্টিতে খুবই দক্ষ ছিলেন, একই সাথে ক্রস আর পাসিংয়েও ভালো ছিলেন। একটাই সমস্যা ছিল, তিনি খেলার মাঠে নিজের মেজাজটা মাঝে মাঝেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন না। প্রায়ই প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়, এমনকি রেফারিদের সাথেও বিবাদে জড়িয়ে পড়তেন।
১৯৮৫ সালে বুলগেরিয়ান কাপের ফাইনালে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের সাথে মারামারিতে জড়িয়ে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হন স্টোইচকভ। পরবর্তীতে অবশ্য শাস্তিটা কমিয়ে ১ বছরে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়।
অবশ্য এই আক্রমণাত্মক মনোভাবের জন্যেই ক্রুয়েফের বার্সালোনা দলে তার জায়গা হয়। ক্রুয়েফের একটা বক্তব্য থেকেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়,
‘বার্সেলোনাতে আমরা আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে চেয়েছি। এজন্য দলে আক্রমণাত্মক মনোভাবের খেলোয়াড়ের প্রয়োজন ছিল। তারকা খেলোয়াড়রা যদি আক্রমণাত্মক না হয়, তাহলে একটা আক্রমণাত্মক দল কি গড়ে উঠতে পারে? অসম্ভব।’
তবে এই আক্রমণাত্মক মনোভাবের জন্য মাঝে মাঝে কিছু বাজে কাজও করে ফেলেছেন। ২০১৫-১৬ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদ আর অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ। স্টোইচকভ সমর্থন করেছিলেন অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদকে। সমস্যা সেটা ছিল না, সমস্যা হচ্ছে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের জার্সি হাতে ইন্টারনেটে ছবি দেওয়ার পাশাপাশি যে কাজটা করেছিলেন, সেটাতে বিতর্কের যথেষ্ট রসদ মজুদ ছিল। কী করেছিলেন? পায়ের তলায় রেখেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি।
তবে বিতর্কিত কাজগুলো বাদ দিলে একজন ফুটবলার হিসেবে তাকে যথাযোগ্য সম্মানটা দিতেই হবে। একমাত্র ফুটবলার হিসেবে ইউরোপ এবং এশিয়ান সংস্করণের কাপ উইনার্স কাপ জেতার কৃতিত্বের অধিকারী স্টোইচকভকে ২০০৪ সালে বুলগেরিয়ার বিগত ৫০ বছরের সেরা ফুটবলার হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
এরপর চলে গিয়েছে ১৫টি বছর। এখন পর্যন্ত স্টোইচকভকে টপকে যাবে, এমন কোনো খেলোয়াড়ের আগমন বুলগেরিয়াতে হয়নি, অচিরেই কেউ আসবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।