মাশরাফি বিন মুর্তজা বরাবরই সাকিব আল হাসানের প্রশংসা করেন। টেস্ট স্ট্যাটাসের ১৮ বছর পার হলেও, এখনও বাংলাদেশ নিজেদেরকে পুরোপুরি সেরা হিসেবে ‘দাখিল’ করতে পারেনি। তাহলে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের কী আছে আসলে? মাশরাফি সব জায়গায় গর্ব করে বলেন, “আমাদের একজন সাকিব আল হাসান আছে, যা তোমাদের নেই।”
শুরুটা ফুটবল দিয়ে করেছিলেন সাকিব। বাবাও চাইতেন তার ছেলে ফুটবলার হোক। কিন্তু সাকিব বনে গেলেন ক্রিকেটার। শুধু তা-ই নয়, সাকিব আল হাসানকে বলা হয় বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন। সেই বিজ্ঞাপনের মার্কেটিংয়ের কাজটাও ভালোই করে যাচ্ছেন সাকিব। বাংলাদেশের ছেলে হয়ে কেবল জাতীয় দলেই নয়, বিদেশি লিগগুলোতে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন সমানে। তার অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সে চোখ ধাঁধাচ্ছে সমর্থকদের, ঘাম ঝরছে প্রতিপক্ষের।
সাকিব মানে যেন বাড়তি কিছু। মাঠের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডও তাকে ‘সাকিবীয়’ করতে আরও বেশি সাহায্য করেছে। বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার তিনি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসেও তিনি অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। লাল-সবুজ জার্সিতে খেলেছেন ৫১ টেস্ট, ১৮৫ ওয়ানডে আর ৬৬ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। এগুলোর মধ্যে দিয়েই দেশের হয়ে তিনি অর্জন করেছেন সেরার খেতাব। টেস্টে দেশের পক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান (৩৫৯৪), ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (৫২৪৩ রান) ও টি-টোয়েন্টিতেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২৬৫ রান এসেছে সাকিবের ব্যাট থেকে।
বল হাতেও শীর্ষ পর্যায়ে সাকিব। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে নিয়েছেন সবচেয়ে বেশি ১৮৮ উইকেট। ওয়ানডেতে মাশরাফি বিন মুর্তজার পরেই অবস্থান তার। নিয়েছেন ২৩৫ উইকেট। টি-টোয়েন্টিতে সাকিবই উইকেট শিকারের দিক থেকে শীর্ষে। নিয়েছেন ৭৭ উইকেট।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট অধিনায়ক সাকিব। আপাতত লক্ষ্য উইন্ডিজ সিরিজে। সেখানে তার অধীনেই দুটি টেস্ট ও তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ দল। নিজের ক্যারিয়ার, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ; সবকিছু নিয়েই স্বচ্ছ ধারণা রাখেন সাকিব। অধিনায়ক হিসেবে নিজের সর্বোচ্চ লক্ষ্য বিশ্বকাপ জয়। সেভাবেই স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশ দলকে নিয়ে। সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে নিজের ক্যারিয়ার, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) ৮ বছরের সফর; সবকিছু নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সেটিই পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
২০০৬ সালে অভিষেককের পর এখন বাংলাদেশ দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য সদস্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের ১২ বছরের ক্যারিয়ারকে কিভাবে বর্ণনা করবেন?
সাকিব আল হাসান– অনেক বড় ব্যাপার আসলে। আমি এত দূর এসে অনেক কিছু শিখেছি। সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, আমি সফলতা ও ব্যর্থতা একইসঙ্গে দেখেছি। আমি মনে করি একই সঙ্গে এই দুটি ব্যাপার দেখতে পারাটা আমাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সাফল্য এনে দিয়েছে। আমি ভাগ্যবান যে আমাকে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আশা করি, আমি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারবো।
অলরাউন্ডার হিসেবে, কাউকে অনুসরণ করেন?
সাকিব আল হাসান– সত্যি বলতে, একেবারেই না। আমি খেয়াল করে দেখেছি, এখন অনেক অলরাউন্ডার খেলছে। অনেক বড় মাপের অলরাউন্ডারের সঙ্গে ও বিপক্ষে খেলার সুযোগ আমার হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে আমি কাউকে কখনই অনুসরণ করিনি। তার চেয়ে আমি নিজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের দিকে মনোযোগ দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমি সবসময় নতুন উপায় খোঁজার চেষ্টা করি যে আরও বেশি কিভাবে মাঠে ভালো করা যায়, দলকে সাহায্য করা যায়।
বাংলাদেশ বনাম ভারতের ক্রিকেটীয় পুনঃজাগরণ কিভাবে দেখেন? বাংলাদেশ এই সময়ে কতটা উন্নতি করেছে বলে মনে হয়?
সাকিব আল হাসান-দুই দলের মধ্যে ক্রিকেটীয় একটা রেনেসাঁ তৈরি হয়েছে, এটা দেখে ভালো লাগে। এটা চলতে থাকুক, অবশ্যই কোনোরকম অভদ্রতা ছাড়া হতে হবে। আমি জানি, দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে অনেক কিছু হয়। কিন্তু খেলোয়াড়রা এগুলো নিয়ে কখনই আলোচনা করে না। আমরা সবসময় খুব ভালো বন্ধু। আইপিএলে আমরা একে অপরের সঙ্গে খেলি। আমাদের মধ্যে কোনো শত্রুতা নেই।
এই মুহূর্তে অনেক স্পিনার ভালো করছে। মেহেদী হাসান মিরাজ, কুলদ্বীপ যাদব কিংবা রশিদ খান। বিশ্ব ক্রিকেটের একজন অন্যতম সেরা স্পিনার হিসেবে স্পিনারদের ভালো করার এই প্রতিযোগিতাকে কিভাবে দেখেন?
সাকিব আল হাসান- এগুলো দেখা, অনুধাবন করা আনন্দের ব্যাপার। শেন ওয়ার্ন, অনিল কুম্বলে কিংবা মুত্তিয়া মুরালিধরনের মতো স্পিনাররা যখন অবসর নিলেন; তখন মনে করা হচ্ছিলো, স্পিন বোলিংয়ের যে আর্ট সেটা সঙ্কটের মুখে পড়বে। কিংবদন্তিরা যেভাবে মাঠে প্রতিপক্ষকে স্পিন বোলিংয়ে ডমিনেট করতো, সেটা আসলে খুব একটা দেখাও যেতো না। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার যে, মিরাজ, কুলদ্বীপ, রশিদ, ঈশ সোধী, মিশেল স্যান্টনার, আকিলা ধনঞ্জয়ার মতো তরুণরা ভালো করছে। স্পিনারদের সুদিন ফিরছে, আবারও নবজাগরণ ঘটছে এগুলো অনেক ভালো খবর আমাদের জন্য।
ইদানিং দেখা যায়, রিস্ট স্পিনারদের সামনে খুব ভুগছে ব্যাটসম্যানরা। এ নিয়ে কী বলবেন?
সাকিব আল হাসান- সবাই এ ধরনের স্পিনারদের বিপক্ষে খেলতে পারে না। যেকোনো ধরনের উইকেটে তারা বলকে টার্ন করাতে পারে তারা। যেকোনো সারফেসে বাড়তি বাউন্স করাতে পারে। এসব কারণেই ব্যাটসম্যানদের জন্য তাদেরকে খেলা কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু আপনি তাদেরকে যত খেলবেন, ব্যাপারটা আয়ত্বে আনতে সুবিধা হবে। আমি এটুকুও নিশ্চিত যে ব্যাটসম্যানরা খুব দ্রুত সেটা আয়ত্বে আনতেও পারবে।
আপনি যখন সানরাইজার্স হায়দরাবাদে খেলেছেন, তখন রশিদ খান আপনার সতীর্থ ছিল। একজন স্পিনার হিসেবে সে কতটা চিত্তাকর্ষক?
সাকিব আল হাসান- রশিদ খান অনেকদিন ধরে ভালো করছে। নিজের দলে এমন একজন বোলার থাকা মানে বাড়তি সুবিধা। আর কুইকার খেলতে গিয়ে ব্যাটসম্যানরা খুব বিপদে পড়ে। সে ব্যাটসম্যানদের কাছে অনেকটা রহস্যের মতো। রশিদ অনেক মেধাবী বোলার। সে আপনার ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারে।
আপনি আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের (আইপিএল) হয়ে ৭ বছর খেলেছেন। এবার খেলেছেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে। আইপিএল নিয়ে আপনার লক্ষ্য কী?
সাকিব আল হাসান- আমরা কেকেআরকে দুবার শিরোপা এনে দিয়েছি। ৭ বছরে কেকেআরের সঙ্গে মনে রাখার মতো অনেক স্মৃতি আমার আছে। এগুলো অবশ্যই আমাকে স্মৃতিকাতর করে। কিন্তু আইপিএল এমন একটা জায়গা যেখানে এসব দলে থাকা বা না থাকার ব্যাপারটি কখনোই আপনার নিজের হাতে নির্ভর করে না। আমাদেরকে তাই সামনে এগোতেই হয়। আমি আশাবাদী, সানরাইজার্সেও হয়তো মনে রাখার মতো অনেক কিছু হবে, হয়েছেও। আর যদি বলেন আমার লক্ষ্য কী, তাহলে বলবো যে দলেই খেলি না কেন ব্যাট-বলে দলের হয়ে সবসময় নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করা।
একদিন বাংলাদেশ দল বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করবে, এ ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী? সেক্ষেত্রে রোডম্যাপটা কিরকম হতে পারে?
সাকিব আল হাসান- আমার কাছে মনে হয়, এই মুহূর্তে আমরা সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অনেক ভালো করছি। আমরা আরও যত বেশি ম্যাচ খেলবো, তত বেশি আত্মবিশ্বাস পাবো। টেস্ট ক্রিকেটে, আমরা এখনও আমাদের আশানুরূপ অবস্থায় আসতে পারিনি। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের সেই যোগ্যতা আছে, নিজেদের প্রতি সেই বিশ্বাস আছে। কেবল আমাদের যেটা করতে হবে, তা হলো মাঠের পারফরম্যান্সে সেটা বাস্তবায়ন করা। সেটা করতে পারলেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো বলে মনে করি।
ফিচার ইমেজ- Getty Image