স্কটিশ বিলি ব্রেমনারের লীডস ইউনাইটেড তখন দুর্দান্ত ফুটবল খেলছে৷ ততদিনে তিনি ক্লাব ছেড়েছেন, ফুটবল ছেড়েছেন। কিন্তু ইয়র্কশায়ারের ছোট্ট এক স্বর্ণকেশী বালক জোনাথন তখন লীডস ইউনাইটেডে খেলার স্বপ্ন নিয়ে নিয়মিত ক্লাবে প্র্যাকটিস করছে। একদিন সেও ব্রেমনারের মতো লীডসে খেলবে৷ দিনকাল তাদের ভালোই যাচ্ছিল। বাবা খেলেছেন ‘থ্রি লায়ন্স’দের হয়ে ক্রিকেটে, ছেলে হবে ফুটবলার। সবকিছুই ঠিক, এর মাঝেই হঠাৎ জোনাথনের মা জ্যানেটের ধরা পড়লো মরণব্যাধি ক্যান্সার। সব এলোমেলো হয়ে গেল তাদের পরিবারের।
৫ জানুয়ারী ১৯৯৮, ইয়র্কশায়ারের অন্য আর ১০টি স্কুল দিনের মতো আজও স্কুল থেকে ছোট বোন বেকিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো ৮ বছরের জোনাথন। কিন্তু বাড়ি ঢুকে যা দেখতে হলো, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না জোনাথন এবং বেকি। নিজের বাবা, সাবেক ইংলিশ উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান, ইয়র্কশায়ারকে দুই দশক ধরে ব্যাট হাতে বহু ম্যাচ জেতানো ডেভিড বেয়ারস্টো জীবনযুদ্ধে হার মেনেছেন, আত্মহনন করেছেন। বাড়িতে ঢুকে বাবার ঝুলন্ত নিথর দেহটাই দেখতে হলো তাদের। তাদের বাবার বয়স তখন মাত্র ৪৭। অতিরিক্ত মদ্যপান করে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন ডেভিড, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। অগত্যা, বেছে নিলেন এই উপায়।
মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত জ্যানেট এবং তার সন্তানদের। কারণ, তার প্রিয়তমা স্ত্রী জ্যানেটের ক্যান্সারের ব্যয় বহন, ৩ সন্তানের খরচাদি আর টানতে না পেরে সব কিছু থেকে দূরে থাকতে আত্মাহুতি দেন সদা হাস্যোজ্জ্বল এই ভদ্রলোক। এর আগে মানসিক অবসাদে ভুগে, অতিরিক্ত মদ্যপ অবস্থায় ড্রাইভিং করে কারাগারেও যেতে হয়েছিল ডেভিডকে। ইংলিশদের হয়ে খেলেছেন ৪ টেস্ট, ২১ ওয়ানডে। ইয়র্কশায়ারের হয়ে উইকেটের পেছনে ছিলেন ২০ বছর। খেলা ছাড়ার পর কমেন্ট্রিও দিয়েছেন রেডিওতে।
৬ জানুয়ারী ১৯৯৮, জোনাথনের মা জ্যানেটের জন্মদিন। বাবা থাকলে হয়তো এই জন্মদিনের মর্মার্থটা সেদিন অন্যরকমই হতো, সেটা বলাই যায়। কিন্তু মায়ের পাশে বাবা নেই, ৩ সন্তানের সাথেই সাদামাটা একটা দিন কাটালেন শোকার্ত জ্যানেট। ৭ জানুয়ারী ১৯৯৮, এই দিনটি ছিল ডেভিড বেয়ারস্টো এবং জ্যানেট বেয়ারস্টোর বিবাহবার্ষিকী। তাদের ১৮তম বিবাহবার্ষিকীর মাত্র ২ দিন আগেই পরলোকগমন করেন ডেভিড। ১৮ বছর আগের এই দিনের স্মৃতি জ্যানেটের হাহাকার আরো বাড়িয়ে দেয়।
বাবা চলে গেলেন, মা ক্যান্সার আক্রান্ত। অ্যান্ড্রু, জোনাথন, বেকি তখন অসহায়। কিন্তু তাদের পাশে ছিলেন তাদের পিতামহ। তিনি ক্রিকেট ব্যাট তুলে দিলেন জোনাথন এবং তার ভাইকে, একাডেমিতে ভর্তিও করালেন। তাদের মায়ের সকল চিকিৎসা তো একাই করালেন। ক্যান্সারও আরোগ্য লাভ করলো জ্যানেটের। ২০০৫ অ্যাশেজ জয়ী ফ্লিনটফ তখন জাতীয় বীর। ফ্লিনটফকে দেখে আরো বেশী অনুপ্রাণিত হলেন জোনাথান।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১, কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে স্বপ্ন পূরণ জোনাথনের। ‘থ্রি লায়ন্স’দের ২২৩তম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে অভিষেক হলো জোনাথন মার্ক বেয়ারস্টো’র, প্রতিপক্ষ ভারত। সপ্তাহ না ঘুরতেই হয়ে গেলো টি-টোয়েন্টি অভিষেক। ২৩ সেপ্টেম্বর কেনিংটন ওভালে ৫৬তম ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে।
১৭ মে ২০১২, আরো একটি স্বপ্নপূরণ। প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে সাদা পোশাকের এই ক্রিকেটে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার। আর সে যদি হয় কোনো টেস্টখেলুড়ে ক্রিকেটারের তনয়, তাহলে তো কথাই নেই! বাবা ছিলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান, তাই ছেলেও সেইভাবেই ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। লর্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬৫২তম ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে অভিষেক হয় জনির। জোনাথান মার্ক বেয়ারস্টো নামটা এখন জনি বেয়ারস্টোতে রূপ নিয়েছে।
৩ জানুয়ারী ২০১৬। এই জানুয়ারী মাসটা জনির জীবনে অনেক কিছুই দিয়েছে, নিয়েছেও ঢের। বাবা ডেভিডের মৃত্যু, মায়ের জন্মদিন, মা-বাবার বিবাহবার্ষিকী, জনিদের পরিবারের বদলে যাওয়া, হাল ধরা – সবই এই মাসের সাথেই যেন জড়িত৷ সেদিন ৩ জানুয়ারী, দু’দিন পরই জনির বাবার ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। এক মাস আগেই আরেক অভিভাবক, অর্থাৎ পিতামহকে হারিয়েছেন৷ তবু দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে এসেছেন৷ আগের দিনের ৩৯* নিয়ে ব্যাট শুরু করেছিলেন জনি। দিনের প্রথম সেশনে তুলে নিলেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। জনি তখন আকাশপানে চেয়ে কাঁদছেন। তার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত। আকাশের দিকে তাকিয়ে স্মরণ করলেন গত হয়ে যাওয়া বাবা এবং দাদাকে। সেঞ্চুরি উৎসর্গ করলেন তাদের৷ গ্যালারিতে মা জ্যানেট আর বোন বেকি কেউই চোখের জল সামলাতে পারলেন না।
ভেজা চোখ দুটো নিয়েই জনি আবার ব্যাট করলেন৷ সেদিন আনন্দের কান্নার দিন, সেদিন প্রোটিয়া বোলাররা তাকে থামাতে পারেনি৷ শেষ পর্যন্ত তার প্রথম দেড়শতাধিক রানের মাইলফলকে পৌঁছানোর পর অধিনায়ক কুক ইনিংস ঘোষণা করেন। সে ম্যাচ এবং সে সিরিজ জোনাথনের দলই জিতেছিল।
দলের নিয়মিত উইকেটরক্ষক জস বাটলারের কারণে ওয়ানডে দলে থিতু হতে পারছিলেন না জনি৷ তাছাড়া ব্যাটিং অর্ডারেও উপরের দিকে ধুমধাড়াক্কা ব্যাটসম্যানের ছড়াছড়ি, ওয়ানডে দলে যেন জায়গাই পাচ্ছিলেন না জনি। কিন্তু সমীকরণ বদলে দিলো ২০১৫ বিশ্বকাপ, এরপরই যে খোলনলচে বদলে গেল ইংল্যান্ডের ক্রিকেট!
ওয়ানডেতে পরিবর্তিত ইংল্যান্ডের ক্রিকেট কালচারের সাথে মিলিয়ে নিয়ে দলে জায়গাটা পাকাপোক্ত করেছেন ধুমধাড়াক্কা আর মারকাটারি ব্যাটিং দিয়ে, সাথে বড় ইনিংস খেলার অভ্যেসটা তার হাতে তুলে দিল নিয়মিত ওপেনারের চাবিটাও৷ সেই সাথে নতুন মিশনও সেট করলেন, দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ তাদের চাই-ই চাই। সেই সাথে জনিরও প্রথম বিশ্বকাপ। স্বপ্নটাও একটু বেশিই ছিল তার।
১১ জুলাই ২০১৯, জোনাথন এবং তার ইংল্যান্ড সেদিন পরেছিল বিশ্বসেরার মুকুট। ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ম্যাচের ক্লাইম্যাক্সে স্টোকস বীরত্বে চতুর্থবারের চেষ্টায় চ্যাম্পিয়ন হলো ক্রিকেটের জনকেরা। এর আগের তিন ফাইনালের হারগুলো ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে। এবার প্রতিপক্ষ পরিবর্তন হয়েছে, ক্রিকেটের কত কী নিয়মকানুন পরিবর্তন হয়েছে, ইংল্যান্ডের ক্রিকেট কালচার পরিবর্তন হয়েছে, সাথে পরিবর্তন হয়েছে ভাগ্যটাও। এখন তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, জোনাথন বেয়ারস্টোও সেই দলের একজন!
ব্যাট হাতে পুরো বিশ্বকাপজুড়েই তিনি ছিলেন অসাধারণ। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে দলের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক ছিলেন তিনি। ১১ ইনিংসে ৪৮.৩৬ গড়ে রান করেছিলেন ৫৩২, সর্বোচ্চ ১১১; সেখানে ২ শতকের পাশাপাশি ২ অর্ধশতক। স্ট্রাইকরেটটাও খারাপ নয়, ৯২.৮৪। আর ফিল্ডিংয়ে বল তালুবন্দীও করেছেন ৯ বার৷ সব মিলিয়ে, লেটার মার্ক তিনি অনায়াসেই পাবেন তার এই পারফরম্যান্সের জন্য।
বাবার জন্মসাল ১৯৫১, তার সাথে মিলিয়ে নিজের জার্সি নাম্বার দিয়েছেন ৫১। প্রতিবারই জার্সি গায়ে দেওয়ার আগে কিংবা মাঠে সব সময়ই বাবাকে সাথেই রাখেন এভাবে। হয়তো বা এটাই বলেন, “বাবা তুমি আমার সাথেই আছো।”
সবাইকে অনুপ্রেরণার জন্য রবার্ট ব্রুসদের কাছে যেতে হয় না। জোনাথন বেয়ারস্টোরাও সফলতার অনেক নজির স্থাপন করেছেন। কাঠখড় পুড়িয়ে, নিজেকে কীভাবে বজ্রাঘাত থেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়, তাই শেখান জোনাথনরা৷ জোনাথন মার্ক বেয়ারস্টো, আপনার আগ্রাসী ক্রিকেট আর অধ্যবসায়ী জীবন দুটোই আমাদের জন্য পাওয়া হয়ে রইলো।