ঘড়ির কাঁটায় ঠিক আটটা। দলের পূর্ণাঙ্গ কিট পরে পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে সাক্ষাৎকার দিতে এসেছেন জশুয়া কিমিখ। মাঠে যেরকম আক্রমণ এবং রক্ষণভাগে চমৎকার ভারসাম্য ধরে রেখে খেলেন, ব্যক্তিজীবনেও সময়ের সদ্ব্যবহারে সচেতন। কী মাঠ, কী মাঠের বাইরে, সদাসর্বদাই সবজায়গায় ভারসাম্য রেখে চলেছেন তিনি।
“আমার লক্ষ্য ইউরো জেতা” – ২৬ বছর বয়সী কিমিখের চোখেমুখে দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ স্পষ্ট।”আমি কোনো টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার আগে কখনো বলি না ‘দেখি গ্রুপপর্ব পার হতে পারি কি না।’ কিন্তু নিঃসন্দেহে গ্রুপপর্বের বাধা পেরোনোটাই যে কারো প্রথম লক্ষ্য থাকে। আমরা খুবই কঠিন কিছু প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলতে যাচ্ছি প্রথম রাউন্ডেই, প্রত্যেকটা ম্যাচই ফাইনাল ম্যাচের মতো কঠিন। কোনো কিছুরই কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
এ পর্যায়ে এসে আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন, কিমিখ আসলে কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতেই পছন্দ করেন। গত দুই বা তিন মৌসুম ধরে কিমিখ ‘পৃথিবীর সেরা নাম্বার সিক্স’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। অন্তত কিমিখের সাবেক ক্লাব সতীর্থ জাভি মার্টিনেজ এবং আরো অনেকেই এই মত দেন। কিমিখ এমন একজন খেলোয়াড় যিনি বল, খেলার মাঠের স্পেস এবং ম্যাচের ছন্দ-গতি নিয়ন্ত্রণ করেন।
কিন্তু শুধু ফুটবলিং স্কিলই যে তাকে ভিড়ের মধ্যে অনন্য করে তুলেছে, তা নয়। অগ্নিবৎ ব্যক্তিত্ব এবং খেলার মাঠে নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন – এই দুটো জিনিস মিলিয়ে নিজের ভেতর ধারাবাহিকভাবে শিরোপা জেতার ইচ্ছা জিইয়ে রাখা – এরকম ইতিবাচক মানসিকতাও তাকে আর দশজনের থেকে আলাদা করে তোলে।
এই রোটওয়েলারকে (কিমিখের বাড়ি এবং কিমিখের প্লেস্টাইল) বলতে পারেন ১৭৭ সেন্টিমিটার তথা ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার এক ফুটবল মেশিন, দুর্দমনীয় ইচ্ছাশক্তি এবং ট্রফি জেতার অফুরন্ত কামনা যার জ্বালানীস্বরূপ কাজ করে। কিমিখ বলেন,
“আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন, মাঠে আমাদের সবার মানসিকতা একই রকম, আর তা হলো আমরা প্রত্যেকটা ম্যাচ জিততে চাই। আমরা প্রত্যেকটা ম্যাচ জিততে পারি, আমরা যেরকমই খেলি না কেন।”
তবে এই ধরনের মানসিকতা ক্লাব পর্যায়ে লালনপালন বা চর্চা করা যতটা সহজ, জাতীয় দলের জন্য ততটাই কঠিন। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা নানা দেশের নানা ক্লাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন, বছরে মাত্র অল্প কয়েক মাসই তারা একসাথে কাটানোর, অনুশীলনের বা খেলার সুযোগ পান। আরো বড় অস্বস্তিকর ব্যাপার হলো, ২০২০ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী এবং ২০-২১ মৌসুমের বুন্দেসলিগা চ্যাম্পিয়ন ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ যেরকম দুরন্তপনা নিয়ে খেলেছে, জোয়াখিম লো’র এই জার্মানি দলে সেই উপাদানটি অনুপস্থিত। লো’র জার্মানিকে দেখে ঠিক মনে হয় না যে এই দলটি উড়তে থাকা যেকোনো দলকে মাটিতে নামিয়ে আনতে পারবে। তবুও কিমিখ অনমনীয়, তার কথায় ইউরো ট্রফি উঁচিয়ে তোলার স্বপ্ন একেবারে অতিলৌকিক কিছু না।
“বায়ার্নে সবসময় আমাদের লক্ষ্য থাকে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। তারপরও আমরা প্রত্যেকটা ম্যাচ নিয়ে আলাদা করে ভাবি”, কিমিখ ব্যাখ্যা করে বলেন, “জাতীয় দলেও ব্যাপারটা এরকম হওয়া উচিত আসলে। প্রথম ম্যাচ খেলার আগেই শিরোপা জেতা নিয়ে অযথা বেশি কথা বলে আদতে লাভ নেই কোনো। কিন্তু মূল লক্ষ্য থেকে কখনো সরে আসে যাবে না, সেটি যেন দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে না যায়। আপনি অনেক বড় কোনো স্বপ্ন দেখতে পারেন এবং একই সাথে সেই স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখতে প্রতিটি ছোট ছোট পদক্ষেপে মনঃসংযোগ করতে পারেন। এই দুটো পরস্পরবিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক।”
পাঁচ বছর হলো কিমিখ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে খেলছেন। এরই মধ্যে একটি টুর্নামেন্ট কখন কীভাবে কোন অপ্রত্যাশিত দিকে মোড় নিতে পারে, তিনি তা স্বচক্ষে দেখেছেন।
২০১৬ ইউরোর কথাই বলা যাক। কিমিখ তখন একেবারে নবীন একজন খেলোয়াড়। জার্মানি মোটের ওপর বেশ ভালোই খেলেছিল সেবার, কিন্তু আয়োজক ফরাসিদের কাছে সেমিফাইনালে হেরে গিয়ে বেজার মুখে বাড়ি ফিরতে হয়। বারো মাস পর, ঝকঝকে চেহারার একদল তরুণ নিয়ে দল গড়ে রুশদেশে হওয়া “বিশ্বকাপের পোশাকি মহড়া” হিসেবে পরিচিত কনফেডারেশন কাপে অংশ নিতে পাঠিয়েছিল জার্মানি; কিমিখ এই এক বছরেই দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের একজন হয়ে উঠেছিলেন। এরও ১২ মাস বাদে এলো বিশ্বকাপ, যেখানে গ্রুপপর্বে বাদ পড়ে যায় জার্মানি।
কোনো টুর্নামেন্টের একটি দলের ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার মন্দ দিক আছে। একটি নির্দিষ্ট টুর্নামেন্টে একটি নির্দিষ্ট দলের সাফল্য ব্যর্থতা নির্ণয় করাটা খুব কঠিন,কারণ দুইয়ের মাঝে সীমাটা খুবই সূক্ষ্ম। পরপর তিন তিনটি টুর্নামেন্টে তিনরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে কিমিখের। তিনটি টুর্নামেন্ট থেকে নিশ্চয়ই শিখেছেন অনেক কিছুই, অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধও হয়েছেন নিঃসন্দেহে। ইউরো ২০২০ জার্মানির জন্য কেমন হতে পারে? ২০১৭ সালের মতো, নাকি ২০১৮ সালের মতো?
কিমিখ দু সেকেন্ড একটু চুপ করে রইলেন।
“আমি আজ পর্যন্ত যা শিখেছি, তা হলো ফুটবলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দল হিসেবে খেলতে পারা। সবরকম ফুটবলীয় আলাপ-আলোচনা একপাশে সরিয়ে রেখে যদি বলি, ২০১৮ সালে বিশ্বকাপে যে জিনিসটির শূন্যতা ছিল আমাদের ভেতর, তা হলো দলগতভাবে খেলতে না পারা; আমরা দল হিসেবে পারফরম্যান্স করতে পারিনি। একটি সফল দলের সদস্যদের ভেতর যে রসায়ন থাকে, যে বোঝাপড়া থাকে, যে বিশ্বাস থাকে পরস্পরের প্রতি, অতীতে জার্মানির বিভিন্ন প্রজন্মের বিভিন্ন দল বিভিন্ন টুর্নামেন্টে যার প্রতিফলন দেখিয়েছে মাঠে, আমরা তা পারিনি।”
দুটো অসম বয়সী দল (প্রবীণ এবং তরুণ) এবং কিছু উপদল (নিয়মিত এবং অনিয়মিত খেলোয়াড়) নিয়ে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প করেছিলেন জোয়াখিম লো সেবারও ২০১৪ বিশ্বকাপের মতোই। এই স্কোয়াডকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একেবারে অপ্রত্যাশিত জায়গায় গিয়েছিলেন ক্যাম্প করতে। মস্কো শহর ছাড়িয়ে আরো দূরে, একেবারে সোভিয়েত যুগের এক হোটেলে উঠেছিল জার্মান দল। অথচ ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের সময় প্রস্তুতি নিতে জার্মানি দল ছিল ক্যাম্পো বাহিয়ার চমৎকার, বিলাসবহুল এক হোটেলে। পরিবেশ যে মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলে, তা কারো অস্বীকার করার কথা নয়। এবারের ক্যাম্পিংয়ের জায়গাটা যেন জার্মানদের মুড আরো বিগড়ে দিয়েছিল।
“আমরা কখনো কল্পনাও করিনি যে মেক্সিকো, সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া – এদের সাথে এক গ্রুপে পড়ার পর চারটি দলের ভেতর চার নম্বর হয়ে বিদায় নেব।” অকপটে স্বীকারোক্তি দেন কিমিখ, “আত্মবিশ্বাস কখন যেন অহংকারে বদলে যেতে শুরু করেছিল। সবাই যেন নকআউট পর্বের ম্যাচ নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল, অথচ আমরা গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলোই খেলিনি তখনও।”
কনফেডারেশনস কাপে নিরীক্ষামূলক দল পাঠিয়েছিল জার্মানি। ‘আন্ডারডগ’ তকমা নিয়েই টুর্নামেন্ট খেলতে যায় তারা এবং শিরোপাও জিতে আসে।
“আপনি খেয়াল করে দেখে থাকবেন হয়তো, কনফেডারেশনস কাপের ম্যাচগুলোয় প্রত্যেকে একে অপরের হয়ে লড়েছে, দৌড়েছে, খেলেছে।” স্মৃতি হাতড়ে বলে যান কিমিখ, “ফুটবলীয় মাপকাঠিতে এই দলটি কিন্তু ২০১৬ সালের দলটির মতো এত ভালো ছিল না। কিন্তু তাও ফলাফল আমাদের পক্ষে গিয়েছিল।”
কোনো টুর্নামেন্ট চলাকালীন একটি দলের অভ্যন্তরীণ অনেক ব্যাপারই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, শেষ ম্যাচে খেলা একাদশই যে পরের ম্যাচে খেলবে, এরকমটা তাই জোর দিয়ে বলা যায় না। মাঠে খেলা যাতে পরিকল্পনামাফিক এগোয়, সেজন্য কিছুটা ভাগ্যের সহায়তাও দরকার পড়ে। আর দরকার পড়ে দল হিসেবে খেলা। ইউরো হোক বা বিশ্বকাপ, সব দলের সব খেলোয়াড়দের ভেতরেই প্রতিভা থাকে,স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। কিন্তু খুব দলই দলের খেলোয়াড়দের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যগুলো কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনা করতে পারে, সেইমতো খেলতে ও জিততে পারে।
এই গ্রীষ্মে জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ‘ওয়ার্কিং হলিডে’ ধারণাটিকে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। এই ‘ওয়ার্কিং হলিডে’ কনসেপ্ট ২০১৪ বিশ্বকাপে খুব কাজে লেগেছিল। এর মাধ্যমে দলের সদস্যদের ভেতর ঐক্যবোধ তৈরি হয়। ব্রাজিল বিশ্বকাপে জার্মানির সাফল্যের মূল বীজ ছিল এই দলীয় ঐক্যবোধই।
এ বছরও বরাবরের মতোই বায়ার্ন মিউনিখের খেলোয়াড়দের প্রাধান্য থাকছে দলে। কিমিখ ছাড়াও টমাস মুলার, নিকলাস শ্যুল, সার্জ ন্যাব্রি, ম্যানুয়াল নয়্যার, জামাল মুসিয়ালা, লিওন গোরেৎজকা খেলবেন। কিমিখের মতে, এতে করে বায়ার্ন খেলোয়াড়দের ওপর দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে, সামনে থেকে তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।
“বায়ার্ন খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের লক্ষ্য হলো জাতীয় দলের মেরুদণ্ড হিসেবে খেলে যাওয়া। কিন্তু এটাও লক্ষ্য থাকবে, যাতে দলের ভেতর উপদল তৈরি হয়ে না যায়। যদি শুধু বায়ার্ন মিউনিখের খেলোয়াড়রাই নিজেরা নিজেরাই হ্যাংআউট করেন, তাহলে অন্য ক্লাবের খেলোয়াড়দের সাথে মানসিক দূরত্ব তৈরি হবে। দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় যাতে নিজেদের সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করাও আমাদেরই দায়িত্ব।”
তবে কিমিখ যদি দেখেন যে দলের খেলার মান কমে যাচ্ছে, তিনি মোটেই চুপ করে বসে থাকবেন না বলে জানিয়ে দেন,
“আমাদের নিজেদের প্রতি নিজেদেরও কিছু দায়বদ্ধতা আছে। আপনি দলের নেতৃস্থানীয় খেলোয়াড় হন বা না হন, সবাইকেই নিশ্চিত করতে হবে আমরা নিজেরা ও নিজেদের সতীর্থরা প্রত্যেকেই নিজেদের সেরাটা দিচ্ছি।”
এই সাক্ষাৎকার দেওয়ার কয়দিন পর জার্মান দৈনিকগুলোয় খবর ছাপা হয়, জার্মানি-ডেনমার্ক প্রীতি ম্যাচ ১-১ গোলে ড্র হওয়ার পর কিমিখ লেরয় সানের সাথে যথেষ্ট চেঁচামেচি করেছেন, কারণ লেরয় সানে সেদিন মাঠে মন দিয়ে খেলেননি।
‘ডাই মানশাফট’দের এখন ব্যাক-টু-দ্য-বেসিক নীতি অবলম্বন করতে হবে। রাশিয়া বিশ্বকাপের পর অনেককিছুই পালটে গিয়েছে। বড় টুর্নামেন্টে জার্মানির সাফল্য নিয়ে সংশয় বরাবরই থাকে,কিন্তু গত তিন বছর ধরে খেলায় যে পরিমাণ ঔদাসীন্য লক্ষ্য করা গিয়েছে এবং কিছু খেলোয়াড় জাতীয় দলের জার্সিতে যেরকম ফর্মহীনতায় ভুগছেন, এইবারের ইউরোতে জার্মানি কতদূর যেতে পারবে, তা নিয়ে ভক্ত-সমর্থকরা সত্যিই দুঃশ্চিন্তায় ভুগছেন। গ্রুপ এফ-এ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স এবং বর্তমান ইউরো চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল। গ্রুপ অফ ডেথের তকমা দিয়েছেন অনেকেই এই গ্রুপটিকে।
“এবারে আর যাই হোক,প্রতিপক্ষকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই কারো সামনে”,কিমিখ মৃদু হেসে বলেন। “আমি যদি জার্মান সমর্থক হতাম,আমিও হয়ত চিন্তিত থাকতাম এত কঠিন গ্রুপে পড়ার পর। ২০১৮ সাল থেকে আমাদের খেলায় কোনো ধারাবাহিকতা নেই। বিশ্বকাপের পর অল্প সময় ভালো গিয়েছিল যখন ন্যাশনস লিগ থেকে আমরা রেলিগেটেড হয়ে গেলাম, কিন্তু চলনসই ফুটবল খেলতে পেরেছিলাম। ইউরো কোয়ালিফায়ারের ম্যাচগুলোয় সেই তুলনায় আরো ভালো খেলেছি আমরা। এরপর কোভিডের কারণে খেলায় ছেদ পড়ল গত বছরে, আর আমরা আগের ছন্দটা হারিয়ে ফেললাম। খুব বাজে কিছু রেজাল্ট এলো, স্পেনের কাছে ৬-০ এবং নর্থ মেসিডোনিয়ার কাছে ২-১ গোলে হারতে হলো।
এই মুহূর্তে টুর্নামেন্টে আমাদের অবস্থান কী, বলা মুশকিল। আমাদের দল কারো থেকে পিছিয়ে নেই। ভালো ভালো খেলোয়াড় রয়েছে আমাদের – কিন্তু আমরা একসাথে মাঠে অনেকদিন ভালো খেলি না। অনেক খেলোয়াড়ই ইনজুরি বা কোভিডের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ খেলতে পারেনি। ফলে পরিস্থিতি আরো চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কোয়াডে কার যে কী ভূমিকা, এখনো সবাই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না। একটি দল যখন জিততে থাকে নিয়মিত, সেই দলের খেলোয়াড়দের ভেতর একটা মজবুত বন্ধন তৈরি হয়। আমাদের দলে এই জিনিসটি অনেকদিন ধরেই নেই। আমি নিশ্চিত, আগামী সপ্তাহে ট্রেইনিংয়ে আমরা একসাথে যে সময়টা কাটাবো, তাতে করে দলের সবাই একে অন্যের আরো কাছাকাছি আসবে। এটিই আমাদের আসন্ন দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
দলীয় সংহতি ছাড়া, জার্মানি ট্যাকটিক্যাল কালেক্টিভ হিসেবে খুব ভালো পারফরম্যান্স দিতে পারবে না। কিমিখ জোর দিয়ে বারবার এই একই কথা বলেছেন। কিন্তু তারপরেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা বাকি রয়ে যায়, এই ট্যাকটিক্সে কিমিখের ভূমিকা ঠিক কী হবে? কোথায় খেলবেন জশুয়া কিমিখ?
জোয়াখিম লো’র পুনর্বিন্যাসিত একটি ফর্মেশনে ডেনমার্ক এবং লাটভিয়ার বিপরীতে জার্মানিকে সনাতনী ৩-৪-৩ পদ্ধতিতে খেলতে দেখা গেছে; এবং তার সাথে অবধারিতভাবেই উইংয়ে দ্বিতীয় আরেকজন দক্ষ খেলোয়াড়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই পজিশনে কিমিখ কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেন। অন্তত লাটভিয়ার বিপক্ষে তাকে এই অবস্থানে খেলতে দেখা গিয়েছে; সম্ভাবনা খুবই প্রবল ফ্রান্সের বিপক্ষেও তাকে এই অবস্থানেই খেলতে দেখা যাবে। কিমিখের অলরাউন্ড ক্লাস এবং ডাইনামিজম উইংয়ে নিঃসন্দেহে ধার বাড়াবে। কিন্তু এর জন্য জার্মানিকে চড়া মূল্য চোকাতে হতে পারে। টনি ক্রুস এবং গুন্দোয়ান, যারা ডিফেন্সিভ কাজগুলো করেন না, তাদের কাজ হবে দলকে মাঝমাঠ থেকে অ্যাটাক বিল্ডআপে সাহায্য করা ফ্রান্স এবং পর্তুগালের বিপক্ষে। এর আগে শেষ যখন কিমিখবিহীন মিডফিল্ডে জার্মানি ক্রুস – গুন্ডোগান জুটি খেলতে নেমেছিল, সেবারে স্পেনের কাছে হাফ ডজন গোল খেতে হয়েছিল জার্মানদের।
একজন কিমিখ জার্মানির জন্য বোধহয় যথেষ্ট হবে না।
(ইতোমধ্যেই গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলো হয়ে গেছে। জোয়াখিম লো প্রতিটা ম্যাচেই জার্মানিকে খেলিয়েছেন ৩-৪-২-১ ফরমেশনে।)
কিমিখকে ঘিরে এসব ধাঁধাঁ, ২০১৪ বিশ্বকাপে ফিলিপ লামকে নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কেরই পুনরাবৃত্তি যেন – তবে উলটো রকমের। লাম মিডফিল্ডে খেলেছিলেন প্রথম চার ম্যাচ, কারণ লো বাস্তিয়ান শোয়ানস্টাইগার এবং সামি খেদিরার ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তবে এবারে কিমিখ ডানপাশে খেলতে পারেন, কারণ উইংব্যাক বা ফুলব্যাক হিসেবে লো’র দলে আর কোনো নির্ভরযোগ্য কোনো খেলোয়াড় নেই।
কিমিখ নিজে অবশ্য সেন্ট্রাল রোলেই খেলতে চান, তার ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে তিনি যেভাবে খেলেন সাধারণত। তবে বেনজামিন পাভার্ড যখন ইনজুরিতে পড়লেন, তখন তাকে বাধ্য হয়ে রাইটব্যাক হিসেবে খেলতে হয়েছে।
“আসলে আমি কোথায় খেলব, তা দিনশেষে কোচের ওপর নির্ভর করবে”, গত সপ্তাহেই জার্মান দৈনিক বিল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “যদি কোচের মনে হয় আমাকে রাইটব্যাক হিসেবে খেলাতে চান, সেখানে আমাকে প্রয়োজন, দলের স্বার্থে আমি রাইটব্যাক হিসেবেই খেলব।”
এই প্রসঙ্গ নিয়ে আগামী বেশ কয়েকদিন চায়ের কাপে ঝড় উঠবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। তবে কিমিখ দলকে যেকোনো পজিশন থেকে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।
“আমাদের একসাথে লড়তে হবে”, কিমিখ আবারও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, “জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারা এক বিশেষ সম্মান, মানুষকে আমরা দেখাতে চাই আমরা তাদের সম্মান করি, গুরুত্ব দিই। আমাদের জন্য জাতীয় দলের হয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা গর্বের বিষয়। এমনভাবে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই আমরা, যাতে করে সকলে জাতীয় দলের জন্যই আমাদের দেশকে চেনে। ”
নিন্দুকদের মুখে ছাই ঢেলে দিয়ে এই জার্মানি যদি কিছু জিততে চায়, তবে জশুয়া কিমিখকে কাজে লাগাতে হবে জোয়াখিম লো’কে। কেবল তাতেই পাশার দান পালটে গেলেও যেতে পারে।