কোহলি ‘মানুষ’ হওয়ার আগে…

এমন অবিশ্বাস্য-অকল্পনীয়-অভূতপূর্ব দৃশ্যের জন্ম তিনি আগেও দিয়েছেন। কখনো ক্রিস ওকসের বলে। আরেকটু নিচের বল হলে তাকে ফ্লিক বলা চলে, আরেকটু ঘোরালে পুল; কিন্তু ফ্লিক-পুলের মাঝামাঝি তিনি কী যেন করলেন, বলটা আছড়ে পড়ল পুনে’র ভরা গ্যালারিতে। কখনো বা আবার কোরি অ্যান্ডারসনের বলে — আসুরিক শক্তিতে ব্যাট চালানোর উদ্দেশ্য ছিল না, লেংথটা বুঝে নিয়ে ব্যাটটা পেতে দিয়েছিলেন কেবল, সেই বলটার গন্তব্যও সীমানার ওপারে। চোখ কচলে দেখতে হলো, ‘এ-ও কি হয়? এমনও হতে পারে?’

কিন্তু এবারে যা হচ্ছে, তার সঙ্গে আগের দৃশ্যগুলোর ফারাক আসমান আর জমিন। ওই বিস্ময়কর দৃশ্যগুলো যদি অভিভূত করে থাকে তো এবারে জন্ম হচ্ছে বিস্ময়ে বিমূঢ় দশা। আইপিএলে ৯ ইনিংস হয়ে গেছে, তাতে ১৬ গড়ে বিরাট রান করেছেন ১২৮! ফিফটি তো দূর অস্ত, দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতেই হিমশিম খাচ্ছেন যেন। মাঝে দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে ১২ রানের ইনিংসটা (সেটাও ১৪ বলে!) বাদ দিলে সর্বশেষ পাঁচ ইনিংসে তার হিসাব-পত্র এমন: ১, ০, ০, ৯!

কী হলে, কী হবে? Image credit: BCCI

রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে সর্বশেষ ইনিংসের স্মৃতিটা তো দগদগে ঘা হয়ে জ্বলার কথা এখনো। ওয়ান ডাউনে নেমে এর আগে টানা দুই শূন্য, বায়ু পরিবর্তনের তো আর সুযোগ নেই এখন, ব্যাটিং-অর্ডার ওলট-পালট করলে রান ফিরতে পারে ব্যাটে আশায় নেমেছিলেন ওপেনিংয়ে। প্রতিপক্ষ লক্ষ্য দিয়েছিল মাত্র ১৪৫ রানের, ক্রিজে ১০ ওভার পড়ে থাকলেও কেউ কিছু বলত না, উল্টো আরসিবির জয়ের রাস্তাটা হয়ে যেত বিজলিবাতি মোড়ানো মহাসড়ক। কিন্তু বিরাট যা খেললেন, তাতে অবিশ্বাসের বালিতে মুখ গুজতে হলো ফের। বিরাট কোহলি, ক্রিজে ১০ বল কাটিয়েছেন, ৯ রান করেছেন, কিন্তু মাঝ ব্যাটে বল ঠুকতে পারেননি একবারও। করোনা-উত্তর পৃথিবী অনেক নতুনত্ব নিয়েই ধরা দিয়েছে। ঘুম ভেঙে উঠে দাঁত ঘষার মতো করে সেঞ্চুরি করতেন যে ভদ্রলোক, এই পৃথিবী ১১২ ইনিংস সেঞ্চুরিবিহীন কাটিয়ে দিতে দেখছে তাকে। কিন্তু আস্ত একটা ইনিংস খেলে ফেলবেন কোহলি, দুটো চার হাঁকাবেন, তবুও ব্যাটের সুইট স্পটের ধারেকাছে ঘেঁষবে না বল, এমন ঘোর কলিকালও দেখতে হবে!

রান না করার চেয়েও বড় গোলকধাঁধা জন্ম দিচ্ছে তার রান করতে না পারার ধরন। সেঞ্চুরি পাচ্ছেন না গুঞ্জনটা প্রথম চাউর হলো যখন, বিশ্লেষকেরা আতশকাচের তলায় আনলেন পায়ের অবস্থানের গলদ। নাসের হুসেইন ২০১৬ সাল বলেছিলেন, কভার ড্রাইভ খেলতে হলে বটম হ্যান্ডটা সফট হওয়া লাগে। তবে কোহলি জিনিয়াস, শক্ত বটম হ্যান্ডের ব্যাটার হওয়া সত্ত্বেও কী অবলীলায় কাভার ড্রাইভ খেলছে! কোহলির সেই জিনিয়াস-সত্ত্বাটাও আজ প্রশ্নের মুখে, কভার ড্রাইভ খেলতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দিচ্ছেন বা কট বিহাইন্ড হচ্ছেন, এমন উদাহরণ তো বেশ কয়েকটাই পাওয়া যাবে ইদানিং।

আর এখনকার কোহলি তো প্রতিদিনই আউট হওয়ার নতুন নতুন উপায় আবিষ্কার করছেন। এ নিয়েও রসিকতায় সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অনুশীলনে ঘাম ঝরাচ্ছেন, এমন কিছু ছবি নিজের টুইটার পেজে দিয়ে কোহলি লিখেছিলেন, ‘Keep ticking small boxes everyday’। এ নিয়েই কোনো এক নেটিজেন যেন মিম বানালেন: নন-স্ট্রাইক প্রান্তে রানআউট – টিক। স্ট্রাইক প্রান্তে রানআউট – টিক। উইকেটকিপারকে ক্যাচ – টিক। পয়েন্টে ক্যাচ – টিক। স্কয়ার লেগে ক্যাচ – টিক। এলবিডব্লিউ – টিক।

অনলাইনে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। Image credit: Twitter

এত সব দেখে-টেখে বিশ্লেষকেরা পৌঁছে যাচ্ছেন একটামাত্র সিদ্ধান্তেই — কোহলির সমস্যাটা ক্রিকেটীয় নয়, মানসিক। কোহলির এখন বিরতি দরকার। জাতীয় দলে তার প্রাক্তন গুরু রবি শাস্ত্রীও কোরাস ধরেছেন সবার সঙ্গে, ক্রিকেটটা কোহলির ভেতরে এত বেশি পরিমাণে জ্বাল দেওয়া হয়েছে যে, এখন আর নতুন কোনো জ্বালানি জমা নেই ভাঁড়ার ঘরে। ক্রিকেট থেকে বিরতি নেওয়ার অধিকার যদি কারও থেকে থাকে, তো সেই মানুষটার নাম কোহলি।

কিন্তু বিদগ্ধজনেরা বললেই কী সব ছেড়েছুঁড়ে দেওয়া যায় নাকি? সাবেক ক্রিকেটারদের প্রতি কোহলি ঈর্ষার চোখে তাকাতেই পারেন এ কারণে। অঞ্জলি টেন্ডুলকার তো এখনো বলেন, খারাপ খেলে এলে কিংবা দল হেরে গেলে বাড়ি ফিরে এমনই গুটিসুটি মেরে বসে থাকতেন শচীন যে ছেলেমেয়েরাও তার কাছে যাওয়ার সাহস করত না। সৌরভ গাঙ্গুলির উদাহরণটাও মনে করে দেখুন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সহস্রাব্দের এপাশে-ওপাশে দুই সিরিজে রান করতে পারলেন না, শর্ট বলের বিপক্ষে তার দুর্বলতা পড়া গেল খোলা বইয়ের মতো। পরের অস্ট্রেলিয়া সফরের ছয় মাস আগেই তিনি উড়ে গেলেন ডাউন আন্ডারে, এসসিজির নেটে গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে খাটলেন সবার অগোচরে। গ্যাবায় তার সেই ঐতিহাসিক সেঞ্চুরিটা এলো এরপরই।

সৌরভ গাঙ্গুলী ও গ্রেগ চ্যাপেল। Image credit: Getty Images

 

তবে খাটবেন কী, কোহলির তো দম ফেলারই ফুরসৎ নেই। ২০২১ সালে খেলেছেন ১১ টেস্ট, ১০ টি-টোয়েন্টি আর ৩ ওয়ানডে। সঙ্গে যোগ করুন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে ১৪ ম্যাচ। আগেকার পৃথিবীও নেই যে ম্যাচের আগের রাতে উড়ে গিয়েও নেমে পড়া যায় মাঠে। সব দেশেই বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয় এখন, আইপিএলের সময়টায় তো কমপক্ষে দুই মাসের জন্য আটকা পড়তে হয় জৈব-সুরক্ষা বলয়ে।

অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন, কিন্তু এখনো আরসিবির আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকার নাম বিরাট কোহলিই। আজ বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং তো কাল ফ্র‍্যাঞ্চাইজির প্রমোশন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের বিবাহোত্তর সংবর্ধনাতেও মুখ না দেখালেই নয়। বেঙ্গালুরুর দলটার সূত্রে তো এমন খবরও বাতাসে ভাসে, ২০১৮ আইপিএলে আরসিবির টিম অ্যানালিস্টদের সাথে নাকি একবারও বসার সুযোগ পাননি কোহলি। এরপরও মৌসুমটা তিনি শেষ করেছিলেন ১৩৯ স্ট্রাইক রেটে ৫৩০ রান করে। বয়স বেড়েছে, সেই হ্যান্ড-আই কো-অর্ডিনেশন কমেছে, মাসল মেমোরিটাও আজ ক্ষয়িষ্ণু। ‘If you get tangled up, just tango on’ — দুঃসময় পেরোনোর ‘আল পাচিনো-নীতি’ মেনেও লাভ হয়নি। কোহলিকে বোধহয় ক্লান্তির কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে।

ব্যাটিং নিয়ে ভাবার সময় কই! মুখ দেখাতে হচ্ছে হাজারটা অনুষ্ঠানে। Image credit: Anushka Sharma

সবার দাবি মেনে কোহলি যদি বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবতেও বসেন, তখনও কি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুব সহজ কাজ হবে তার জন্য? তিনি না সেই কোহলি, চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়ানোটাকেই যিনি বানিয়ে ফেলেছেন চরিত্র। কঠিন সব রান তাড়া করে গোটা পৃথিবীকে জানিয়েছেন, পরিস্থিতি যত কঠিন, কোহলিকে টলানো তত শক্ত। সেই কোহলি আর টিকতে পারছেন না চাপের মুখে, মঞ্চ ছাড়তে চাইছেন, হেরে যাচ্ছেন, অনুরাগীরা-আগামী প্রজন্ম কী বার্তা পাবে এতে?

ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের সাথে ভক্ত-সমর্থকদের সম্পর্কটা বড় অদ্ভুত। চোখের সামনেই ক্রীড়াজগতে এলো এক ছোঁকড়া, কিছু ইনিংস খেলল কি গোল করল, হুট করেই তাকে বসিয়ে দেওয়া হলো তারকা-মহাতারকার আসনে। আরেকটু কীর্তিমান হতেই তিনি হয়ে গেলেন দেবতা। সঙ্গে ভক্তদের সঙ্গে বাঁধা পড়লেন এক অলিখিত চুক্তিতে, কখনো হারে যাবে না।

লিওনেল মেসির যে কারণে টানা তিন ফাইনাল হারের হতাশাতেও অবসর নেওয়া মানা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭০ সেঞ্চুরি আর ২৩ হাজারের বেশি রান করার চেয়েও কোহলির কাছে কঠিন মনে হয়, সাময়িক বিশ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। কে জানে, শুনতে শুনতে তাদের মনেও বিশ্বাস জন্মে গেছে কি না, তারা ‘মানুষ নন, দেবতা।’

কোথায় গেলেন সেই কোহলি! Image credit: ESPNCricinfo

 

কোহলি সাময়িক সময়ের জন্য ক্রিকেট থেকে দূরে সরলেই বোধহয় মেনে নেওয়া হবে, হরহামেশা এমনই সব কীর্তি গড়েছেন, তাতে তিনি ‘মানুষ না দেবতা’, ভ্রম জেগেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও মনুষ্য প্রজাতিরই একজন। আর্কাইভ ঘাঁটলে হাজারো সব রেকর্ড পাওয়া যাবে তার নামের পাশে, খুঁজলে অনুরাগী মিলবে অ্যান্টার্কটিকাতেও; কিন্তু তিনিও তো রক্ত-মাংসে, হাড়গোড়ে গড়া একজন মানুষই।

আর পরবর্তী প্রজন্ম কী বার্তা পাবে প্রশ্ন করছেন? কোহলি না হয় মানুষ হয়েই ধরা দিলেন অবশেষে। কিন্তু মানুষটির অতিমানবীয় ক্ষমতার প্রমাণ তো এর আগেই দেওয়া সারা! 

This article is in Bangla language. This article is on Virat Kohli's recent bad-patch. Necessary hyperlinks and images are attached inside.

Featured image © BCCI

Related Articles

Exit mobile version