২০১২ সালের আগ পর্যন্ত ফ্রি-কিক থেকে যার গোল ছিল মাত্র চারটি, গত এক যুগে ফ্রি-কিক থেকে তিনিই জালে বল জড়িয়েছেন ৬০ বার। আর শুধু গোলসংখ্যা দিয়েই কি লিওনেল মেসির ফ্রি-কিককে বিশ্লেষণ করা যায়? ড্রিবলিং, পাসিং, শুটিংয়ের মতো ফ্রি-কিককেও রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা। আর্জেন্টিনা, বার্সেলোনা, পিএসজির মতো মেজর লিগ সকারের দল ইন্টার মায়ামিতে গিয়েও এখন ফ্রি-কিকের গোলে ম্যাচ জেতাচ্ছেন, বাঁচাচ্ছেন মেসি।
৬২টা ফ্রি-কিক গোল ঝুলিতে নিয়ে আমেরিকায় পা রেখেছিলেন মেসি, ৪ ম্যাচ খেলতে না খেলতেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৬৪-তে। আর দুটো গোলেরই সময়টা খেয়াল করুন, ক্রুজ আজুলের বিপক্ষে ৯৪তম মিনিট, এফসি ডালাসের বিপক্ষে ৮৫তম মিনিট। প্রথমটা ছিল ম্যাচজয়ী গোল, অপরটা ম্যাচ বাঁচানোর। এমএলএসে এই অসাধারণ শুরুর পরও মেসির পা রয়েছে মাটিতেই, বরাবরের মতোই।
“আমি শুধু গোল করার চেষ্টা করেছি, চেষ্টা করেছি বলটাকে পোস্টে রাখার, যে চেষ্টা আমি সবসময়েই করি। আমার সৌভাগ্য যে বলটা পোস্টের ভেতরেই গিয়েছিল, আর গোলরক্ষকও বলের নাগাল পাননি।”
-লিওনেল মেসি
আর ফ্রি-কিক টেকার হিসেবে লিওনেল মেসি যে নিজেকে ঠিক কোন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেটা বোঝার জন্য একটা ছোট্ট পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। বার্সেলোনার সাথে মেসির বিচ্ছেদের পর লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং ইউরোপা লিগ মিলিয়ে স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাবটি পেয়েছে মোট ২৮টা ডিরেক্ট ফ্রি-কিক। মেম্ফিস ডিপাই, রবার্ট লেওয়ানডস্কি, ওসমান ডেম্বেলে, রাফিনহা ডিয়াজ, আনসু ফাতি, মার্কোস আলোনসোরা এই সুযোগগুলোর একটিকেও জালে পাঠাতে পারেননি। অপরদিকে, একই সময়ে আর্জেন্টিনা আর পিএসজির হয়ে ফ্রি-কিকে নিজেকে আরো শাণিত করেছেন মেসি। এক সময়ের আনাড়ি লিওনেল মেসির এই ফ্রি-কিকে পারদর্শী হয়ে ওঠার খুঁটিনাটিগুলোই বিশ্লেষণ করেছে দ্য অ্যাথলেটিক।
বলা হয়, কোনো বিষয়কে শিল্প হয়ে ওঠার জন্য নাকি মোট সাতটা ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ভারসাম্য বা ব্যালান্স, বৈসাদৃশ্য বা কন্ট্রাস্ট, জোর বা এম্ফ্যাসিস, চলন বা মুভমেন্ট, ছাঁচ বা প্যাটার্ন, ছন্দ বা রিদম, এবং বৈচিত্র্য বা ভ্যারাইটি। এই সবগুলো বিষয়ই দারুণভাবে পাওয়া যায় লিওনেল মেসির ফ্রি-কিকগুলোতে। ধারাভাষ্যকার রে হাডসন তো আর এমনি এমনি তাঁকে মোজার্টের সাথে তুলনা করেননি!
টেকনিক
“ফ্রি-কিক নেওয়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট ধরণে অভ্যস্ত হতে হয়, আর ঐ ধরণের মধ্যে থেকেই নিজের সেরাটা বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হয়।”
-লিওনেল মেসি (২০১৮)
এমনিতে লিওনেল মেসির টেকনিক নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ফ্রি-কিকটাই যেন ব্যতিক্রম। পুরো ক্যারিয়ারে বারবার ফ্রি-কিকের টেকনিকে পরিবর্তন এনেছেন মেসি। বার্সেলোনার হয়ে মেসির যখন অভিষেক, মেরুন-নীলদের সবচেয়ে বড় তারকা তখন রোনালদিনহো। স্বাভাবিকভাবেই ফ্রি-কিক নেওয়ার দায়িত্বটাও ছিল এই ব্রাজিলিয়ানের কাঁধেই। রোনালদিনহোর বিদায়ের পর মেসি হয়ে ওঠেননি প্রথম পছন্দ, বার্সার মাঝমাঠের মায়োস্ত্রো জাভি তখনও মেসির চেয়ে ভালো ফ্রি-কিক নিতেন। প্রথম পছন্দের ফ্রি-কিক টেকার হিসেবে মেসি যতদিনে ম্যাচপ্রতি গড়ে একটি করে ডিরেক্ট ফ্রি-কিক নেওয়ার সুযোগ পেলেন, ততদিনে যীশু খ্রিষ্টের জন্মের পর ২০১১ বছর কেটে গেছে।
“গত কয়েক বছরে ফ্রি-কিক নেওয়ার ক্ষেত্রে আমি প্রথমে গোলকিপারের অবস্থান লক্ষ্য করি। মানবদেয়ালের অবস্থান কোথায়, আমি শট নেওয়ার আগেই গোলকিপার নড়াচড়া করলেন কি না, এই ব্যাপারগুলো আমি খেয়াল করার চেষ্টা করি। ট্রেনিংয়েও আমি এগুলো অনুশীলন করি, এবং ধীরে ধীরে নিজের উন্নতিও লক্ষ্য করছি।”
-লিওনেল মেসি (২০১৯)
বায়োমেকানিক্সের দিক থেকেও মেসির টেকনিকটা আলোচনার দাবি রাখে। প্রায় একই অ্যাকশনে নেওয়া মেসির ফ্রি-কিকের বৈচিত্র্যটাই ঘোল খাইয়ে দেয় প্রতিপক্ষের গোলরক্ষকদের। পোস্টের ঠিক কোন জায়গাকে পাখির চোখ করছেন মেসি, আর সেই শটটা নেওয়ার ধরণই বা কেমন হবে, গোলরক্ষকদের জন্য সেটা আন্দাজ করা অত্যন্ত দুরূহ।
“ফ্রি-কিক নেওয়ার সময়ে লিওনেল মেসির কোমর সাধারণত ডান দিকে হেলে থাকে, এর মাধ্যমে তিনি তার বাম পায়ে আরো ভালোভাবে শট নিতে পারেন। শট নেওয়ার সময়ে এবং ফলো থ্রুতে মেসি তার দেহের ভরটা নিয়ে যান ডান পায়ের পাতার বাইরের অংশে, বিশেষ করে গোড়ালির ওপরে। এই ব্যাপারটাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পরিভাষায় ‘ইনভার্শন স্প্রেইন’ বা ‘বিপরীত মচকানো’ বলা হয়। ফলো থ্রুতে মেসির ডান গোড়ালির ওপর যে ভরটা পড়ে, তাতে তার গোড়ালি মচকে যাওয়ার কথা, কিন্তু নিয়মিত ট্রেনিং করে মেসি নিজের শরীরকে এমনভাবে প্রস্তুত করেছেন যে তাকে এমন কোন ইনজুরিতে পড়তে হয় না।”
-ডাঃ রাজপাল ব্রার, ক্রীড়াবিজ্ঞানী
উপরের ছবিতে, ২০১৯ সালে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে মেসির ফ্রি-কিকে ঠিক তেমনটাই দেখা যায়।
গত কয়েক বছরে ফ্রি-কিকে লিওনেল মেসির কাছাকাছি যদি কেউ নিজেকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়ে থাকেন, তাহলে সেই তালিকায় সবার ওপরের নামটা নিঃসন্দেহে জেমস ওয়ার্ড-প্রাউস। ২০১৯ থেকে আজ অবধি ফ্রি-কিকে মেসি গোল করেছেন ২০টি, একই ব্যপ্তিতে ওয়ার্ড-প্রাউসের গোল চারটি কম। তবে সেই ওয়ার্ড-প্রাউসের সাথে মেসির ফ্রি-কিকের টেকনিকে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়। উপরের ছবিতে ফ্রি-কিক নিতে দেখা যাচ্ছে প্রিমিয়ার লিগের পরিচিত মুখ ওয়ার্ড-প্রাউসকে।
এবার আসা যাক মেসি আর ওয়ার্ড-প্রাউসের ফ্রি-কিকের টেকনিকের তুলনাতে। মেসি স্বাভাবিকভাবে একটু ছোট রান আপ নেন, ওয়ার্ড-প্রাউসের তুলনায় দুই বা তিন কদম কম। শট নেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়ার্ড-প্রাউসের ‘স্ট্রাইকিং লেগ’ বা ডান পা যতটা ওপরে ওঠে, মেসির বাঁ পা তত ওপরে ওঠে না। দুজনের শটে সঞ্চারিত বেগও সমান নয়, কেননা ওয়ার্ড-প্রাউসের মতো অতটা জোর দিয়ে ফ্রি-কিক নেন না লিওনেল মেসি।
দু’জনের ফলো থ্রুতেও রয়েছে ভিন্নতা। শট নেওয়ার পরে মেসির তুলনায় একটু বেশি কুঁজো হতে দেখা যায় ওয়ার্ড-প্রাউসকে। অপর দিকে ক্যারিয়ারের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ফ্রি-কিক নেওয়ার পর মেসির শরীরের ওপরের অংশ কম ঝুঁকেছে।
আবার শট নেওয়ার ক্ষেত্রে মেসির ডান পা মাটি থেকে ওপরে ওঠেই না, বরং ফলো থ্রুতে একটু ডানে সরে তার বাম পা-কে জায়গা করে দেয়। কিন্তু ওয়ার্ড-প্রাউসের বাম পা ঠিকই মাটি থেকে ওপরে উঠে যায়, ফলো থ্রুতে তিনি অবতরণ করেন তাঁর ‘স্ট্রাইকিং লেগ’ বা ডান পায়ের ওপর।
ট্রেডমার্ক
‘দ্য লিওনেল মেসি জোন’।
বক্সের আশেপাশে মেসির দল ফ্রি-কিক পেলেই ধারাভাষ্যকরদের কণ্ঠে এই শব্দবন্ধটা শোনা যায়। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, গোলপোস্ট হতে মোটামুটি ২৪ গজ দূরে, সামান্য ডান দিকে। আর এই ক্ষেত্রে মেসি কোন কাজটা পছন্দ করেন, সেটা তো সবাই জানেনই।
“সত্যি বলতে, মানবদেয়ালের ওপর দিয়ে বলকে পোস্টে পাঠাতেই বেশি ভালো লাগে আমার।”
-লিওনেল মেসি (২০১৬)
এই কাজটাই মেসি তার পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে করে এসেছেন। তার জীবনের দ্বিতীয় ফ্রি-কিক গোল, যেটা এসেছিল ২০০৯ সালে ডায়নামো কিয়েভের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে, ম্যাচের ৮৬তম মিনিটে, সেই গোলটাও ছিল ঠিক এভাবেই। বলে রাখা ভালো, সেই গোলটিই ছিল মেসির ক্যারিয়ারের শততম গোল।
শুধু ডায়নামো কিয়েভের বিরুদ্ধে ঐ গোলই নয়, ঐ একই জায়গা থেকে অনেকবারই লক্ষ্যভেদ করেছেন মেসি। কখনো সরাসরি গোলরক্ষককে বোকা বানিয়েছেন, কখনো পোস্টে লেগে বল জড়িয়েছে জালে। আবার পোস্টে লেগে বলের লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার ঘটনাও একেবারে কম নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে মোটামুটি একটা বিষয় সাধারণ, বলকে বাতাসে বাঁক খাইয়ে গোলরক্ষক থেকে দূরে নিয়ে যান মেসি, অসহায় ওই গোলরক্ষকের নাগালের বাইরে দিয়ে বল জড়িয়ে যায় জালে।
দ্যা অ্যাথলেটিক-এর গোলরক্ষণ-বিশ্লেষক ম্যাট পিজড্রোস্কি জানাচ্ছেন নিখুঁত পরিসংখ্যানটা। ইউরোপের লিগ ম্যাচগুলোতে ৪৫২টা অ্যাটেম্পট নিয়ে মোট ৪১ বার লক্ষ্যভেদ করেছেন মেসি, অন্যান্য যেকোনো খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ২২-এর আশেপাশে থাকবে বলেই পরিসংখ্যানের আলোকে আশা করা যায়।
উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে লা লিগার চারটি ভিন্ন ম্যাচে মোটামুটি একই জায়গা থেকে ফ্রি-কিকে মেসির লক্ষ্যভেদের ছবি। প্রতিটি ফ্রি-কিকই পোস্টে গেছে মানবদেয়ালের ওপর দিয়ে, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আঘাত হেনেছে ওপরের ডান কোণে, এবং অবশ্যই, কোন ক্ষেত্রেই গোলরক্ষক বলকে ছুঁতেও পারেননি।
‘ট্রেডমার্ক’ ফ্রি-কিক থেকে একই ম্যাচে মেসির দুটো গোলও রয়েছে। ২০১৯ সালে ক্যাম্প ন্যুতে সেল্টা ভিগোর বিরুদ্ধে।
তিন মিনিটের ব্যবধানে একই ভঙ্গিতে দুই অর্ধে দুটো গোল করেছিলেন লিওনেল মেসি।
ঐ একই ভঙ্গিতে মেসি পেয়ে যান প্যারিস সেইন্ট-জার্মেই’র হয়ে তার প্রথম গোলটাও। ২০২২-এ নিঁসের গোলরক্ষক ক্যাসপার স্মাইকেলকে পরাস্ত করেন মেসি।
৬৪তম ফ্রি-কিক গোলটাও এসেছিল প্রায় একই ভাবে, যদিও এক্ষেত্রে ফ্রি-কিকের অবস্থানটা অন্যগুলোর তুলনায় বেশ ডানদিকে ছিল। বাকিটা বলছেন এফসি ডালাসের কোচ নিকো এস্তেভেজই।
“বক্সের আশেপাশের এমন জায়গায় তাঁর ফ্রি-কিক অন্য খেলোয়াড়দের পেনাল্টির সমান।”
নিকো এস্তেভেজ, কোচ, এফসি ডালাস
প্রায় একই জায়গা থেকে মেসি গোল পেয়েছিলেন ২০১৪ বিশ্বকাপে, নাইজেরিয়ার বিপক্ষে। একই রকম দুটো গোলও তিনি পেয়েছিলেন ২০১২ সালে, একটা লা লিগায় রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে, অপরটি প্যারাগুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে।
ফ্রি-কিক স্পটটা যদি পোস্টের ২৪ গজের মধ্যে থাকে…
ফ্রি-কিক স্পটটা বক্সের বেশি কাছে হলে, অনেক ফ্রি-কিক টেকারের জন্যই সেটা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও সেই অনেকের মধ্যে লিওনেল মেসি নেই, কারণ তার তূণে বৈচিত্র্যময় অস্ত্রের অভাব নেই।
তার প্রথম এবং মূল অস্ত্রের নাম, ড্রপ শট। হঠাৎ করে নিচু হয়ে যাওয়া শটের সাথে মারাত্মক সাইডস্পিন, এমন বলে হাত ছোঁয়ানোই যেকোন গোলরক্ষকের জন্য প্রায় দুঃসাধ্য। দৃশ্যমান সাদৃশ্যের কারণে চাইলে অবশ্য পানেনকা ফ্রি-কিকও বলা যেতে পারে একে। ২০১০ সালে আলমেরিয়ার বিপক্ষে মেসি তাঁর প্রথম পানেনকা ফ্রি-কিক গোল করেন, সব ধরনের ফ্রি-কিক মিলিয়ে যা তৃতীয়।
তবে বয়সের সাথে সাথে এই ফ্রি-কিকের টেকনিকে মেসি বদল এনেছেন। ২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসভির বিপক্ষে, এবং ২০১৯-এ লা লিগায় এসপানিওলের বিপক্ষে সেটা ভালোভাবেই লক্ষ্যণীয়। এসপানিওলের গোলরক্ষক দিয়েগো লোপেজ পাশাপাশি গোললাইনে গিয়ে ফ্রি-কিক আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন ডিফেন্ডার ভিক্টর সানচেজও। সফল তো হতেই পারেননি, উল্টো বলের সাথে নিজেরাও জড়িয়ে গিয়েছিলেন জালে।
ম্যাচের ৭১তম মিনিটে এই গোল করেই ডেডলক ভেঙ্গেছিলেন মেসি।
২০১৫ এর উয়েফা সুপার কাপে মেসির ফ্রি-কিকটা এসেছিল এভাবেই, এবং সবচেয়ে নিখুঁতভাবে। গোলরক্ষকক বেতো ডাইভ দিয়েও আটকাতে পারেননি, মেসির শটের ঘূর্ণনে পরাস্ত হতে হয়েছিল তাঁকে।
তবে মেসি যে শুধু তার ড্রপ শট বা অন্যান্য কৌশল দিয়ে মানবদেয়াল আর গোলরক্ষককে পরাভূত করেন, এমন না। বুদ্ধির খেলাতেও তিনি অতুলনীয়। লাফিয়ে ওঠা মানবদেয়ালের নিচের ফাঁকা জায়গা দিয়েও মেসির গোল রয়েছে। ২০১২ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে, এবং ২০১৮ সালে লা লিগায় আলাভেসের বিরুদ্ধে এভাবে গোল পেয়েছেন মেসি। উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয়টি ছিল বার্সেলোনার ৬০০০তম লা লিগা গোল। লা লিগায় জিরোনার বিপক্ষে ২০১৮ সালে, এবং প্রীতি ম্যাচে জ্যামাইকার বিরুদ্ধে ২০২২ সালেও এভাবেই প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়েছিলেন মেসি।
আর মেসির এই কৌশল আটকানোর জন্যই এখন মানবদেয়ালের পেছনে অতিরিক্ত একজন খেলোয়াড়কে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।
ফ্রি-কিক স্পটটা যদি পোস্টের ২৪ গজের বাইরে থাকে…
“মেসি ঠিক সেই জায়গাতেই বলটা মেরেছে, যেখানে আলিসন পৌঁছাতে পারতো না। গতি আর বাঁকের মিশেলে একেবারে নিখুঁত ছিল ফ্রি-কিকটা।”
-জর্ডান হেন্ডারসন, সাবেক অধিনায়ক, লিভারপুল ফুটবল ক্লাব
চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে লিভারপুলের বিরুদ্ধে মেসির ঐ অবিশ্বাস্য ফ্রি-কিকের কথা কে-ই বা ভুলতে পারে! মেসির ক্যারিয়ারের ৬০০তম গোলটা হয়তো এর চেয়ে সুন্দর হতেও পারতো না।
“অন্য সব ফ্রি-কিক যেভাবে নিই, এটাও সেভাবেই নিতে চেয়েছিলাম। হ্যাঁ, এইটা বক্সের বেশ বাইরে ছিল, তবে আমিও বেশ জোরের সাথেই শট নিয়েছিলাম।”
-লিওনেল মেসি
মানবদেয়ালের ওপর দিয়ে বল পাঠানোর পাশাপাশি ডাইভ দেওয়া গোলরক্ষককে পরাস্ত করার জন্য গতির সাথে বেশ ভালো রকমের বাঁকের প্রয়োজন হয় এসব ফ্রি-কিকে। আর মেসির জন্য তো সেটা ডালভাত!
২০১২ সালে স্প্যানিশ সুপার কাপে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে একই রকম ফ্রি-কিক নিয়ে পরাস্ত করেছিলেন গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াসকে। ২০১১ সালেও এমন একটা গোল রয়েছে মেসির, দেপোর্তিভো লা করুনিয়ার বিপক্ষে।
এরপরই একটা মোটামুটি দীর্ঘ বিরতি। ২০১৮ সালে শেষ হলো সেই বিরতি, রিয়াল সোসিয়েদাদের বিপক্ষে প্রায় ত্রিশ গজ দূর থেকে গোল করেন লিওনেল।
তবে খুব সম্প্রতি এই একই ধাঁচের গোল করতে আবারও দেখা গেছে মেসিকে।
ইন্টার মায়ামির হয়ে অভিষেকের ম্যাচে ক্রুজ আজুলের বিপক্ষে যে গোলটা করেছিলেন মেসি, সোসিয়েদাদের বিপক্ষে গোলের মতো না হলেও, সেটাকে মোটামুটি দূরপাল্লার বলা যেতে পারে।
গোলরক্ষকের অবস্থান যদি বামে হয়…
“আমি চেষ্টা করি আমার ফ্রি-কিকে একটু বৈচিত্র্য নিয়ে আসার, যেন গোলরক্ষকেরা আগে থেকে আন্দাজ করতে না পারেন, আমার শট নেওয়ার আগ পর্যন্ত যেন তিনি দ্বিধান্বিত থাকেন।”
-লিওনেল মেসি
দ্য অ্যাথলেটিক-এর বিশ্লেষক পিজড্রোস্কির বিশ্লেষণ বলছে, ফ্রি-কিক বৈচিত্র্য দিয়ে মেসি যেমন পোস্টের ওপরের কোণা খুঁজে নেন, একই ভাবে গোলরক্ষককে দারুণভাবে দুইবার ধোঁকাও দেন।
২০১৭ সালে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে মেসির ফ্রি-কিকটাই এর উদাহরণ।
উপরের ছবিতে যেমনটা দেখা যাচ্ছে, গোলরক্ষকের প্রাথমিক ধারণা ছিল মেসি হয়তো মানবদেয়ালের ওপর দিয়ে লাল চিহ্নিত গতিপথে তার ফ্রি-কিক মারবেন। কিন্তু মেসি শটটা নিয়েছিলেন বিপরীত কোণায়, হলুদ চিহ্নিত গতিপথে। ফলাফল, গোল!
“মেসির ফ্রি-কিকের বৈচিত্র্য আর অননুমানযোগ্যতাই তাকে আরো বেশি বিপজ্জনক করে তোলে”
-সার্জিও আসেনহো, সাবেক গোলরক্ষক, ভিয়ারিয়াল
তবে মেসির এই ধরনের ফ্রি-কিকের ক্ষেত্রে তার নিজের কৌশলের সাথে তাঁর সতীর্থদের সাহায্যও থাকে কিছুটা। প্রতিপক্ষের মানবদেয়ালের পাশাপাশি তাঁর সতীর্থরা নিজেরাও একটা ছোটখাট দেয়াল তৈরি করে গোলরক্ষকের দৃষ্টিকে আটকে দিতে চান, একই সাথে মেসিকে সাহায্য করেন গোলের পথ খুঁজে নিতে। সার্জিও বুসকেটস বরাবরই এই দেয়ালে অবস্থান করে মেসিকে সাহায্য করেন।
উপরের ছবিতে, ২০১৮ সালে লা লিগায় লাস পালমাসের বিপক্ষে গোল করছেন মেসি।
গ্রানাডার বিপক্ষে ২০২১ সালেও একই ভাবে গোল পেয়েছিলেন মেসি।
২০১৯ সালে রিয়াল বেটিসের খেলোয়াড়দেরও বোকা বানিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগে আয়াক্সের বিপক্ষে ও অ্যাটলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে ২০১৪ সালেও এভাবে গোল সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন মেসি।
গোলরক্ষকের অবস্থান যদি ডানে হয়…
ফুটবলপ্রেমীদের নিশ্চয়ই অজানা নয়, বছরের সবচেয়ে সুন্দর গোলের জন্য দেওয়া হয় পুসকাস অ্যাওয়ার্ড। এই পুরস্কারের ইতিহাসে একবারই কোনো ফ্রি-কিক গোল মনোনয়ন পেয়েছিল, সেটা ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে মেসির গোল।
লিওনেল মেসি বাঁয়ে মারবেন (লাল চিহ্নিত পথে), এমনটা আন্দাজ করে সেদিকে মানবদেয়াল রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গোলরক্ষক ব্রাড গুজান, নিজে সরে দাঁড়িয়েছিলেন ডান দিকে। কিন্তু লিওনেল মেসি শট নিয়েছিলেন ডানে, হলুদ চিহ্নিত গতিপথে। হতভম্ব গোলরক্ষক শুধুই চেয়ে চেয়ে দেখলেন, বলটা ওদিকে আলিঙ্গণ করলো জালকে।
২০১৫ সালে উয়েফা সুপার কাপে সেভিয়ার বিপক্ষেও একই ভাবে গোল করেছিলেন মেসি, প্রায় একই গোল পেয়েছিলেন ২০১৭ সালে কোপা দেল রেতে, অ্যাটলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে।
২০২১ কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালেও প্রায় একই ভাবে গোল এসেছিল মেসির জাদুকরী বাঁ পা থেকে, তবে এই ক্ষেত্রে ফ্রি-কিক স্পটটা ছিল বক্সের আরেকটু কাছে। তাতে ইকুয়েডরের গোলরক্ষক হার্নান গালিন্দেজকে পরাস্ত করা যেন আরো সহজই হয়েছে মেসির জন্য।
প্যারিসে মেসির সময়টা খুব ভালো কাটেনি, স্বীকার করেছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু তবুও, সময়ে সময়ে নিজের ঝলক দেখাতে ভোলেননি তিনি। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে লিলের বিপক্ষে ম্যাচের ৯৫তম মিনিটে একটা অসাধারণ ফ্রি-কিক গোল করেন মেসি। গোলরক্ষক লুকাস মোটামুটি মাঝেই অবস্থান করছিলেন, হয়তো আশা করেছিলেন নিচের ছবির লাল চিহ্নিত পথে মেসির শটটা খুব সহজেই আটকে দেবেন তিনি। কিন্তু মেসি শট নিয়েছিলেন হলুদ চিহ্নিত পথে, ফলাফল, পিএসজির কষ্টার্জিত জয়!
বর্তমানে খেলছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে ফ্রি-কিক থেকে মেসির গোলই সর্বোচ্চ, ৬৪টি, সর্বকালের সর্বোচ্চ জুনিনহো থেকে যা ১৩টি কম। তবে আপাতদৃষ্টিতে জুনিনহো তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও, ডেভিড বেকহ্যাম (৬৫) আর রোনালদিনহো (৬৬)-এর কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলছেন তিনি। কে জানে, হয়তো আগামী ম্যাচেই বেকহামকে ছুঁয়ে ফেলবেন মেসি!
আর তাতে যে বেকহাম খুশিই হবেন, সেটা বোধ হয় আর না বললেও চলছে!
[ব্যবহৃত সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান ১১ আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত]