দিদিয়ের দ্রগবার শেষ মৌসুমে চেলসিতে যোগ দিয়েছিলেন রোমেলু লুকাকু। দ্রগবা ছিলেন লুকাকুর শৈশবের তারকা। এখনো দুজনের সম্পর্ক আছে আগের মতোই। এবার বিশ্বকাপে লুকাকুর উত্থান নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বলেছেন সাবেক চেলসি তারকা দ্রগবা।
বিশ্বকাপে রোমেলু লুকাকু কী করছে, এটা যখন দেখি, খুব গর্ববোধ হয়।
রোমেলু এমন একজন মানুষ ও খেলোয়াড়, যার সাথে আমার বিশেষ একটা সম্পর্ক আছে। আমি ওকে সাত বছর ধরে চিনি। ও প্রথম যখন ১৮ বছর বয়সে, সেই ২০১১ সালে চেলসিতে এলো, সেই থেকে আমরা খুব ঘনিষ্ঠ।
ও আমার একজন ভালো বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। ও এমন একটা বাচ্চা, যাকে আমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো খুব ভালোবাসি। এমন একজন যাকে সবসময় সহায়তা করতে চেয়েছি।
আমি জানি, জীবনটা ওর জন্য সবসময় এমন সহজ ছিলো না। তবে রাশিয়াতে ওর খুব ভালো করার কারণ হলো, ও সারাটা ক্যারিয়ার জুড়ে নিজের এই চরিত্র দেখিয়ে এসেছে। যে পরিশ্রম এতদিন করেছে, সেটাই আজ ওকে এখানে নিয়ে এসেছে।
অবশ্যই বেলজিয়াম ওর জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করছে। আপনার পেছনে যদি এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইনা ও ড্রিয়েস মের্টেন্সের মতো খেলোয়াড় থাকে, তাহলে আপনি জানবেন, তারা আপনাকে যথেষ্ট খাবার জোগাবে।
কিন্তু বাকিটা তো ওর ওপর নির্ভর করে। আমি চেলসিতে এই ধরনের সার্ভিস পেয়েছি। আর সে সময় নিজেকে বলতাম, ”এখন যদি নিজে ভালো না খাও, সে দায় কেবলই তোমার।”
আমি এটা দিয়ে যা বোঝাতে চাইতাম, তা হলো, তোমার চারপাশে ভালো খেলোয়াড়রা থাকবে ভালো বল দেওয়ার জন্য। এরপর তুমি মিস করলে সেটা তোমার দোষ। আর রোমেলু এই মানসিকতারই ছেলে।
আমরা যেমনটা দেখছি, ও এখন মিস করছে না। এখন অবধি যে পাঁচটি শট করেছে, তাতে চারটি গোল করেছে। আমি এই ব্যাপারটা এভাবে বলতে চাই যে, একজন খেলোয়াড় হিসেবে সে একজন পারফেকশনিস্ট।
সে যেরকম প্রতিনিয়ত উন্নতি করার ইচ্ছা পোষণ করে, তাতে শেষ অবধি এরকম ভালো ফল আসবেই।
শুরুতে খুব কাঁচা ছিলো
আমি যখন ওকে প্রথম দেখি, তখন ও একেবারে ছোট্ট একটা ছেলে। তখনও ও অ্যান্ডারলেখটে (বেলজিয়ান ক্লাব) খেলে।
আমার বন্ধু ভিনসেন্ট কোম্পানি ওকে আমার সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিলো। রোমেলু আমাকে বললো, সে চেলসির খুব বড় ভক্ত। আমি নাকি তার আইডল। ওর একটা টি-শার্টের পেছনে আমার নাম লেখা আছে এবং ওদের বাসার দেয়ালে আমার পোস্টার আছে!
কয়েক বছর পর সেই ছেলেটি আমাদের সাথে চলে এলো, আমার পাশেই চেলসি ড্রেসিংরুমে বসে রইলো।
আমি ওকে সেই জায়গাটা দিয়েছিলাম। কারণ, ওই চেলসির পরবর্তী স্ট্রাইকার হতে যাচ্ছিলো। ফলে আমি চাচ্ছিলাম, ও যেন স্বস্তি বোধ করে। সেই সাথে আমার কাছ থেকে যেন এই খেলাটা ও খেলাটার চেতনা কিছুটা শিখতে পারে।
আমি ক্লাব সম্পর্কে তাকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম এবং আমার অভিজ্ঞতাটা বলেছিলাম। ও তো সেজন্যই ওখানে ছিলো।
একেবারে শুরু থেকে ও খুব পরিশ্রম করেছে। আমার মনে আছে, ও যখন প্রথম ক্লাবে এলো, তখন পুরো ট্রেনিং সেশন করতো না। ওরা (স্টাফরা) ওকে পাশের দিকে নিয়ে যেত এবং ওকে প্রথম টাচ, পাসিং- এসব শেখাতো।
ও যখন ছোট ছিলো, তখন একেবারে কাঁচা ছিলো। হ্যাঁ, সবসময়ের মতো শক্তিশালী ও শারীরিকভাবে দক্ষ ছিলো।
ও নিজেকে তৈরি করেছে। আমি যখন আজকে ও কেমন খেলোয়াড়, সেটা দেখি এবং সাত বছর আগের ওকে মনে করি, দেখতে পাই, অনেক অনেক পার্থক্য। আপনি যদি ওর খেলার বিভিন্ন অংশ বিচার করে দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন, প্রতিটা অংশের দারুণ মান এখন।
ও সবসময় উন্নতি করতে চায়
এটা ঠিক যে, চেলসিতে ও মানিয়ে নিতে পারলো না। কিন্তু আমরা এরপরও সবসময় পরস্পরের সংস্পর্শে রয়েছি। আমরা নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলতাম। আমার এটা খুব ভালো লাগে যে, ও বলে, আমি ওকে কিছুটা সহায়তা করতে পেরেছি।
ও সবসময় আমাকে কোনো না কোনো পরামর্শের জন্য বা কিভাবে ভিন্ন কিছু করবে, সেটা জানতে ফোন করে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, ওর আত্মবিশ্বাসে বিন্দুমাত্র ঘাটতি আছে। এর মানে, ও সবসময় উন্নতি করতে চায়।
তিউনিশিয়ার বিপক্ষে ও দুই গোল করার পর আমি টিভি শোতে বলছিলাম, ও যেভাবে দৌড় দেয়, যে বাঁক তৈরি করে এবং গোলের দিকে যাওয়ার সময় ওর যে পায়ের কাজ, এটা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি।
এটা দেখতে খুব ভালো লাগে। পানামার বিপক্ষে বেলজিয়ামের খেলার পর আমরা যখন কথা বলছিলাম, আমি ওকে বলছিলাম যে, ও যে সুযোগ পেয়েছে সেটাকে বাম পায়ে ওভাবে টাচ করা ছাড়া আর কী কী ওই সময়ে করতে পারতো!
রোমেলু ব্যাখ্যা করছিলো যে, ও ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আমি ওকে বললাম যে, তোমাকে সবসময় প্রথম টাচের ব্যাপারে আরো মনোযোগী হতে হবে। যাতে করে তুমি বলটাকে ডান পায়ে ভালো কন্ট্রোল করতে পারো এবং তারপর তুমি ডিফেন্ডারকে ওভাবে পরাস্ত করতে পারো।
সে আরেকবার ব্যাপারটা দেখলো। তারপর বললো, “ও ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস। তুমিই ঠিক বলেছ।”
এটা কেবলই একটা উদাহরণ যে, সে কতটা শিখতে চায়। এটা আপনি যখন শুনবেন, তখন বুঝবেন যে, সে অবশ্যই শীর্ষে পৌঁছাবে একদিন। সে এখনও ওখানে পৌঁছায়নি। কিন্তু প্রায় পৌঁছে গেছে বলা যায়।
মরিনহো বুঝেছে, ছেলেটা বড় হয়ে গেছে
আমি শুনেছি, রোমেলু নাকি বলেছে, আমার কাছ থেকে ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা শিখেছে, তা হলে জেতার জন্য আত্মনিবেদন। আর আমি মনে করি, খেলোয়াড় হিসেবে ওর সবচেয়ে বড় শক্তিই এখন এটা।
আমি সবসময় যেটা বলি, আপনি আপনার ৭০ শতাংশ সম্ভাবনার মতো হতে পারেন। তারপরও আপনাকে ১০০ শতাংশ দিতে হবে, তাহলেই হয়তো একটা খেলা জয়ের জন্য যথেষ্ট হতে পারে কেবল।
আপনার জীবন আচরণের অংশ হতে হবে। আমার কাছে নিজে ড্রেসিংরুমে থাকা আর ছেলেদের ভিড়ে থাকার মধ্যে সবসময় অনেক পার্থক্য মনে হয়। হাসি, ঠাট্টায় সময় কাটানো এবং মাঠে পা রাখার সময়ের পার্থক্য।
আমি তো বদলে যেতাম। আমার ধারণা যে যখন আমাকে দেখেছে, তখন সে অনেক কম বয়সী ছিলো। সে ওটাকে শ্রদ্ধা করেছে। এখন আমি সেই ব্যাপারটাই ওর মধ্যে দেখতে পাই। গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ও সেটা দেখিয়েছে।
আমি ইউনাইটেডের কোচ হোসে মরিনহোকে সেই চেলসির সময় থেকে চিনি। আমি এটা বুঝতে পারি যে, কিভাবে তিনি রোমেলুর সেরাটা ওল্ড ট্রাফোর্ডে বের করে এনেছেন।
রোমেলু এত ভালো করার বড় কারণ হলো সে কোচের বিশ্বাসটা পেয়েছে। সেই সাথে ও এমন একটা বয়সে পৌঁছেছে, যে সময়ে ও বুঝতে পারে যে, এই আস্থার প্রতিদান কীভাবে দিতে হবে।
লুকাকুর এই ফর্মে বেলজিয়ামের সম্ভাবনা আছে
আমি ওকে এখনও সবসময় চ্যালেঞ্জ করি। উদাহরণ হিসেবে বলি, ওকে আগামী মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ২৭ গোলের চেয়ে বেশি করতে হবে এবং এবার বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুটটাও জিততে হবে।
যদিও আমরা সবসময় খেলা নিয়েই কথা বলি, তা নয়। আমি মস্কোতে বেলজিয়ামের ট্রেনিং ক্যাম্পে ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন সিরিয়াস কিছু নিয়ে কথাই বলিনি।
আমি ওর সতীর্থ এডেন হ্যাজার্ড, ফেলাইনি এবং সহকারী কোচ থিয়েরি অঁরিকে ভালো করে চিনি। ওদের সাথে অনেক কিছু নিয়ে বা এমনি এমনি কথা বলাটাও আনন্দের ছিলো।
সেটা ছিলো বন্ধুদের মধ্যে স্বাভাবিক আলোচনা, খেলোয়াড়দের নিয়ে রসিকতা এবং সেই সময় আমরা আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়ার জয়ের ম্যাচটা দেখছিলাম।
এটা একটা বড় কারণ যে, আমি চাই ওরা টুর্নামেন্টে ভালো করুক। আর রোমেলু যে ফর্মে আছে, তাতে ওদের অবশ্যই ভালো সুযোগ আছে।
মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল বিবিসি ডট কমে