বাংলাদেশের ক্রিকেটে হয়তো বা অনেক নক্ষত্র আসবে যাবে, অনেক বড় অর্জন আসবে। কিন্তু মাশরাফির মতো আর একজনও আসবে না, এটা নিশ্চিত। বাংলাদেশের ক্রিকেটে দিনবদলের গান যার হাত ধরে এসেছে, জাতীয় দলকে শক্ত অবস্থান এনে দেয়ার পেছনে যার সবচেয়ে বড় ভূমিকা, তাকে কখনো ভোলা যাবে না। ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে টেনে তোলার নেপথ্য কারিগর, যিনি বারবার ইনজুরিতে পড়েও বাইশ গজে ফিরে এসেছেন বীরদর্পে। নিজের চিরকাল পঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, ইনজুরির সাথে হয়নি যার কখনো কোনো আপোষ, তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক বিবর্তনের মহানায়ক ও কারিগর। মাশরাফি যেন বাংলাদেশেরই অর্জন। হ্যাঁ, বারবার পিছিয়ে পড়ে প্রচণ্ড গর্জনে তিনি যেভাবে এগিয়ে গেছেন, তা আর কে পেরেছে এ ভূখণ্ডে?
মাশরাফি অন্য সবার চাইতে আলাদা, এটাই সত্য। কেন? বাংলাদেশে মহানায়কের আসনে আসীন হওয়ার পিছনের ঘটনাচক্রগুলো আসুন দেখে নিই।
ভারতের সাথে প্রথম জয়: ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৪, ঢাকা
প্রথমে ব্যাটে নেমে ৮৮ রানে ৫ উইকেটের পতন, এরপর আফতাব আহমেদের অনবদ্য ৬৭ রানে ভর করে বাংলাদেশের সংগ্রহ ১৬৮ রান সাত উইকেটের বিনিময়ে। তখনও ২০০ না পেরোনোর শঙ্কা চোখ রাঙাচ্ছে। নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে উইকেটে আসেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। উইকেটে এসেই ম্যাশ দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের উদাহরণ স্থাপন করেন, টেলএন্ডারদের সাথে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৬১ রান যোগ করেন দলের স্কোরবোর্ডে। ম্যাশ ৩১ রানে অপরাজিত থেকে ২২৯ রানের সম্মানজনক স্কোর এনে দেন বাংলাদেশকে।
এরপর ভারতের ইনিংসের শুরুতেই, অর্থাৎ তৃতীয় বলে আঘাত হানেন তৎকালীন সময়ের বিস্ফোরক ব্যাটসম্যান শেবাগকে বোল্ড করে দেন ম্যাশ। সে সময় ১৪০ কি.মি গতিবেগের আশপাশে নিয়মিতই বল করতেন তিনি। এরপর সৌরভ গাঙ্গুলীকে এক অসাধারণ ক্যাচে তালুবন্দী করে প্যাভিলিয়নে ফেরান। নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ভারতকে প্রচুর চাপে রাখেন পুরো ম্যাচজুড়ে। ম্যাচ যখন ভারতের হাতে, তখন বোলিংয়ে আবার এসেই ব্রেক থ্রু দেন ম্যাশ, ধোনিকে প্যাভিলিয়নের পথ ধরান। এরপর বাংলাদেশের যখন ম্যাচ হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখনই মাশরাফি এক অসাধারণ ক্যাচ ধরে জহির খানকে আউট করে বাংলাদেশকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান। নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের ছাপ রেখে নয়, ওভারে ৩৬ রান দিয়ে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন। পুরো ম্যাচেই অসাধারণ ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ম্যাশ ভারতের বিপক্ষে পাওয়া প্রথম জয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পুরো ম্যাচে অনবদ্য ভূমিকার জন্য নির্বাচিত হন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ।
বিশ্বকাপে ভারতের সাথে ঐতিহাসিক জয়: মার্চ ১৭, ২০০৭, পোর্ট অব স্পেন
ম্যাচের আগে মাশরাফি কথার লড়াই জমিয়ে দেন এই বলে,
‘যদি উইকেটে কিছু থাকে আর আমরা টসে জিতে ওদেরকে ব্যাটে পাঠাতে পারি, তাহলে ভারতকে ধরে দিবানি।’
পুরো বিশ্বকাপে “ধরে দিবানি” হয়ে যায় বাংলাদেশের থিম স্লোগান! মাশরাফির কথামতোই বাংলাদেশ প্রথমে টস জিতে যায়, বোলিং নিয়ে নেয় উজ্জীবিত বাংলাদেশ। ‘ধরে দিবানি’ মন্ত্রদাতা ইনিংসের তৃতীয় ওভারেই ভারতের বিস্ফোরক ওপেনার শেবাগের স্ট্যাম্প উপড়ে দেন, এরপর সপ্তম ওভারে বোলিংয়ে এসে আবার রবিন উথাপ্পাকে আউট করে ভারতকে প্রচণ্ড চাপের মুখে ফেলে দেন। ভারত শুরুর চাপ আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মাশরাফির দুর্দান্ত বোলিংয়ের পর রফিক-রাজ্জাকের বোলিংয়ে ভারত একের পর এক উইকেট হারাতে শুরু করে। শুরুর মাশরাফি শেষে এসেও স্বমহিমায় ভাস্বর, ডেথে বোলিংয়ে এসে দুর্দান্ত বোলিংয়ে ভারতের টেল এন্ডার ছেঁটে দেন এবং ভারতকে ১৯২ রানে গুটিয়ে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন। এরপর তামিম, সাকিব, মুশফিকের সাহসী ব্যাটিংয়ে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ভারত বধ করে বাংলাদেশ। অনবদ্য বোলিংয়ে চার উইকেট অর্জনের জন্য মাশরাফি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন।
২০০৩ বিশ্বকাপের রানার্সআপ ভারত এ ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ফলশ্রুতিতে বিদায় নেয় গ্রুপপর্ব থেকেই। এ বধ বাংলাদেশের ইতিহাসে মহাকাব্য হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন, আর এ মহাকাব্যের প্রবাদপুরুষ হয়ে হয়তো মাশরাফিও আমাদের হৃদয়ের মানসপটে অনেকদিন থাকবেন।
ভারতের সাথে প্রথম টেস্ট ড্র – ২২ মে ২০০৭, চট্টগ্রাম
এবারের গল্প শুধুই মাশরাফির বীরত্বের; তবে বোলার হিসেবে না, ব্যাটসম্যান হিসেবে। প্রথম ইনিংসের গল্পটা ভারতের ব্যাটিং বীরত্বের, শচীন-গাঙ্গুলীর সেঞ্চুরিতে ভারত প্রথম ইনিংসে ৩৮৪ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের সেরা বোলার কে জানেন? চার উইকেট নিয়ে দলের সেরা বোলার মাশরাফি।
দ্বিতীয় দিনে মাত্র ২০ ওভার খেলা হয়েছিল বৃষ্টির কারণে। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচ তড়িঘড়ি করে শেষ করার জন্য তাড়াতাড়িই ভারত ইনিংস ডিক্লেয়ার করে। তাদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্যই হয়তো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে যান উইকেটে গিয়েই, আত্মহত্যা করতে শুরু করেন গণহারে। এক পর্যায়ে ১১২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফলোঅনের শঙ্কায় পড়ে বাংলাদেশ। উইকেটে আসেন মাশরাফি। শেষমেষ ১৪৮ রানে আট উইকেট নেই!
এরপরের গল্প মাশরাফির। যোগ্য সহযোগী হিসেবে পেয়ে যান শাহাদাত হোসেনকে। শাহাদাত হোসেন মাশরাফিকে সঙ্গ দেন নিখাদ ব্যাটসম্যানের মতো। তাকে পার্শ্বনায়ক বললেও ভুল হবে না। মাশরাফি শাহাদাতকে নিয়ে ৭৭ রানের ম্যাচ বাঁচানো এক অবিস্মরণীয় জুটি করে বাংলাদেশকে ফলো-অন থেকে বাঁচান। শুধু ফলো-অন থেকেই বাঁচাননি মাশরাফি, প্রকৃত অর্থেই ম্যাচ বাঁচিয়ে দেন তিনি।
মাশরাফি শেষ পর্যন্ত ৭৯ রানে আউট হন, বাংলাদেশের ইনিংসকে টেনে নিয়ে যান ২৩৮ রান অবধি। সবচেয়ে বড় কথা, মাশরাফির দৃঢ়তায় বাংলাদেশ চতুর্থ দিন কাটিয়ে দেয়, এবং ম্যাচ বাঁচানো নিশ্চিত হয়ে যায়।
পঞ্চম দিনে ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে ১০০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ইনিংস ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশকে ২৫০ রানের লক্ষ্য দেয়। মাশরাফি এই ইনিংসেও এক উইকেট সংগ্রহ করেন। জাভেদ ওমর ও হাবিবুল বাশারের অনবদ্য ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ দুই উইকেট হারিয়ে ১০৪ রান করলে দুই দলই ড্র মেনে নেয়।
ম্যাচ বাঁচানো অনবদ্য ৭৯ রান ও পাঁচ উইকেটের কারণে মাশরাফি ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হন। এই ড্র বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে জয়ের থেকে বড় না হলেও গুরুত্বের বিচারে খুব একটা পিছিয়েও থাকবে না।
দুর্ভাগ্যবশত ইনজুরির কারণে মাশরাফিকে টেস্টে খুব বেশি পাওয়া যায়নি, মাত্র ৩৬ টেস্টেই তার মতো অমিত প্রতিভাবান বোলারের টেস্ট ক্যারিয়ার কার্যত শেষ হয়ে যায়।
বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়া
ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন কে না দেখে!
২০০৯তে উইন্ডিজ সফরে পাওয়া চোট ও ২০১০-এ পাওয়া চোটের কারণে মাশরাফি প্রায় মাঠ থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন। প্রায় দেড় বছর খেলা থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও তিনি দলের সেরা বোলার ছিলেন।
২০১১ বিশ্বকাপ সামনে রেখে নিজেকে তৈরি করেছিলেন, এমনকি ফিটনেসেও যথেষ্ট উন্নতি করেছিলেন। কিন্তু ফিটনেসের দোহাই দিয়ে তৎকালীন টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচক কমিটি মাশরাফিকে বাদ দিয়ে দেয়। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ খেলতে না পারার বেদনা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। দেশবাসী সে প্রমাণ পেয়েছিলেন টেলিভিশনের পর্দায়, অঝোরে কেঁদেছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন
‘আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন আজ।’
চোট থেকে ফিরে বিশ্বকাপের দলে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে কী প্রচেষ্টাই না করেছিলেন! এরপরে সারা দেশে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়, মাশরাফিকে বিশ্বকাপ দলে নেয়ার জন্য সারা দেশে তীব্র প্রতিবাদ দেখা যায়।
২০১১ বিশ্বকাপে বাদ পড়া বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হয়ে থাকবে, কারণ সারা দেশের মানুষের চাওয়া ছিল মাশরাফি স্কোয়াডে থাকুন। স্কোয়াডে জায়গা না পাওয়ার কারণে সারা দেশে অনন্য জনপ্রিয়তা পান। গুঞ্জন ছিল, বোর্ডকর্তা ও কোচের সাথে দূরত্বের কারণে তিনি বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা পাননি।
অধিনায়কত্ব অর্জন ও অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠা
২০১২ সালে মাশরাফিকে বোর্ড আবার জাতীয় দলে ফেরান অস্ট্রেলিয়ার সাথে হোম সিরিজে। এরপর থেকেই তার বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অবিসংবাদিত নেতা হওয়ার গল্পের শুরু।
২০১২-১৪ বাংলাদেশের ক্রিকেট খুবই বাজে সময় অতিবাহিত করে, বিসিবি ক্রিকেট দলের টালমাটাল অবস্থা ঠিক করতে মাশরাফির হাতে অধিনায়কত্বের ব্যাটন তুলে দেয় ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে। এ সিরিজের মধ্য দিয়ে যেন বাংলাদেশ দলে নতুন এক প্রাণ সঞ্চার হয়। জিম্বাবুয়েকে ৫-০তে ‘বাংলাওয়াশ’ করে মাশরাফি তার প্রথম হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করেন শতভাগ সফলতার মাধ্যমে। এরপরের গল্প বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থানের, যার নেতৃত্বে মাশরাফি নামক দক্ষ নাবিক। দলের সবার মধ্যে নতুন প্রাণসঞ্চার, মাঠে ও ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের উজ্জীবিত করে সবার মধ্যে ভয়ডরহীন মানসিকতা এনে বাংলাদেশ দলের খোলনলচে বদলে দেন।
২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টি করেন মাশরাফির নেতৃত্বে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার সাথে সবচেয়ে কঠিন গ্রুপে পড়েও বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় মাশরাফির ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে; যা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সেরা অর্জন। এ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মাঠে পারফরম্যান্স আগের সব ইতিহাসকে ছাপিয়ে যায়। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচের কথা বলতে হয়।
মাহমুদউল্লাহর অসাধারণ সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ ২৭৫ রান সংগ্রহ করা সত্ত্বেও এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, ইংল্যান্ড জিতে যাবে সহজে। কিন্তু মাশরাফি হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। বোলিংয়ে এসে বাংলাদেশকে পরম আরাধ্য ব্রেক থ্রু এনে দেন হেলসকে আউট করে। এরপর বোলিং চেঞ্জ, ফিল্ড চেঞ্জে অসামান্য পারদর্শিতার স্বাক্ষর রাখেন পুরো ম্যাচে। ম্যাচের ক্রুশিয়াল মোমেন্টে জো রুটকে আউট করে বাংলাদেশের জয় প্রায় নিশ্চিত করে দেন। এরপর রুবেলের অসাধারণ বোলিং এবং বাংলাদেশের ইংল্যান্ড বধ!
নিউ জিল্যান্ডের সাথে প্রায় তো জিতেই যাচ্ছিল বাংলাদেশ। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের সাথে বিতর্কিত আম্পায়ারিং না হলে হয়তো বা বাংলাদেশ আরো বড় কিছু অর্জন করতো ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পরপরই বাংলাদেশে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আসে। মাশরাফির চমকপ্রদ নেতৃত্বে ও মুস্তাফিজে ভর করে বাংলাদেশ অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়ে টানা দুই সিরিজে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ হারিয়ে দেয়। এরপর মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাকিস্তানকেও ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে।
এরপরও অব্যাহত থাকে বাংলাদেশের জয়যাত্রা, যার জ্বলন্ত প্রমাণ ২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। গ্রুপ স্টেজে নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডকে ছাপিয়ে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। এটা আইসিসির যেকোনো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অর্জন। এছাড়া বাংলাদেশ মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৬ ও ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে রানারআপ হয়। শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়ে প্রথম অ্যাওয়ে সিরিজ জয়ও মাশরাফির নেতৃত্বে। ছয়টি বিপিএল আসরের মধ্যে চারবার মাশরাফি শিরোপা জিতেন অধিনায়ক হিসেবে। বাংলাদেশ আইসিসি ওডিআই র্যাঙ্কিংয়ে প্রথমবারের মতো ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেছে তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে। ক্যাপ্টেন হিসেবে মাশরাফির সবশেষ সিরিজ জিম্বাবুয়ে ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে, এবং শেষটাও শুরুর মতো জিম্বাবুয়েকে ৩-০তে বাংলাওয়াশ করার মাধ্যমে।
ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে মাশরাফি মাত্র পঞ্চম ব্যাক্তি, যিনি অধিনায়ক হিসেবে ১০০ উইকেট নিয়েছেন। শেষ ম্যাচ জেতার মাধ্যমে তিনি অধিনায়ক হিসেবে ৫০ ওয়ানডে জয়ের মাইলফলক স্পর্শ করেন মাত্র ৮৮ ম্যাচে। ম্যাচ জেতানোর হার প্রায় ৫৭ শতাংশ। ম্যাচ জেতানোর হারে মাশরাফি বিশ্বকাপজয়ী তিন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি (৫৫%), ইমরান খান (৫৪%), অর্জুনা রানাতুঙ্গা (৪৬%) এবং সৌরভ গাঙ্গুলীর (৫১%) চাইতে এগিয়ে আছেন।
এসব অর্জন হয়তো মাশরাফির বিশালতা প্রকাশ করতে পারবে না। উপরের অর্জনগুলো হয়তো বা মাঠের অর্জন। এ অর্জন হয়তো খাতা-কলমে থাকবে। কিন্তু মাশরাফি যুগের সবচেয়ে বড় অর্জন, মাশরাফি এক সুতোয় সবাইকে বেঁধে বাংলাদেশকে মাঠে ও মাঠের বাইরে প্রফেশনালিজম শিখিয়েছেন। মাশরাফির সবচেয়ে বড় অর্জন, বাংলাদেশ এখন আর কোনো ম্যাচ জয়ের জন্য একজনের উপর নির্ভরশীল থাকে না, সবাই অবদান রাখতে চায় বাংলাদেশের জয়ে। দুর্দম্য মানসিকতার সাথে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার আত্মবিশ্বাস রেখেই যাবেন তিনি, এমনই বিশ্বাস ভক্তদের।
মাশরাফি ও ইনজুরি
মাশরাফির কথা বললে ইনজুরির কথা বাদ দিলে মাশরাফিকে নিয়ে কথা বলা অপূর্ণ থেকে যাবে।
মাশরাফির সাথে ইনজুরির পরিচয় ঘটে তার নিজের ব্যাক্তিগত তৃতীয় টেস্টে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। হাঁটুর ইনজুরিতে বছরখানেক মাঠের বাইরে থাকেন। সর্বশেষ বড় ইনজুরিতে পড়েন ২০০৯ সালে উইন্ডিজ সফরে, যার কারণে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ মিস করেন। ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে ১১ বার ইনজুরিতে পড়েছেন মাশরাফি, যার মধ্যে বাঁ হাঁটুতে চারবার এবং ডান হাঁটুতে অপারেশন হয়েছে তিনবার। প্রায় সবগুলো অস্ত্রোপচারই হয়েছে অস্ট্রেলীয় শল্যচিকিৎসক ডেভিড ইয়ংয়ের কাছে। সর্বশেষ হাতে ১৪ সেলাই নিয়ে বিপিএলের কোয়ালিফাযার খেলেছেন, ধরেছেন এক হাতে ক্যাচ।
ক্যারিয়ারের শুরুতে ১৪০ কিমি গতির আশেপাশে বল করতেন, কিন্তু ইনজুরির কাছে তার মানসিকতা জয়ী হলেও গতিবেগ হার মানে। পৃথিবীর ক্রীড়া ইতিহাসে মাশরাফির মতো এমন ক্রীড়াবিদ খুঁজে পাওয়া ভার, যিনি বারবার ইনজুরিতে পড়েও মাঠে ফিরে এসেছেন সদর্পে, এবং ম্যাচ জিতিয়েছেন।
শেষ করবো কুসুমকুমারী দাশের আদর্শ ছেলে কবিতার লাইন দিয়ে,
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?’
মাশরাফির মতো ‘আদর্শ ছেলে’ এ দেশ খুব কমই পেয়েছে। মাশরাফির মতো ‘মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন’ আর ক’জনের আছে এ দেশে?
এদেশের বুকে হাজার হাজার মাশরাফি নেমে আসুক, সেটাই এখন প্রত্যাশা।