প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের স্মৃতি রোমন্থন করে এখনও রোমাঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের সেই সুখস্মৃতিকে সঙ্গে নিয়েই ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনাল খেলে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। হাঁটি হাঁটি পা পা করে সময় পেরিয়েছে আরও অনেকটা। বাংলাদেশ এবার ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত। আগেরবারের চেয়েও শক্তিশালী দল হওয়ায় পুরনো অর্জন কোয়ার্টার ফাইনাল পার করে সেমিফাইনালের আশা বাংলাদেশ করতেই পারে। অধিনায়ক মাশরাফিও সেভাবেই এগোতে চান। তবে জোর করে কিছুই নয়। যেহেতু এবার বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে নতুন নিয়মে, তাই আশা কিংবা দুর্ভাগ্য, দুটোরই সম্ভাবনা বেশি।
দল কী ভাবছে, তার চেয়েও বড় কথা, অধিনায়ক কীভাবে দলকে নিয়ে ভাবছেন। এই মুহূর্তে দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মাশরাফি। ২০১১ বিশ্বকাপ খেলতে পারলে এটা হতে পারতো তার পঞ্চম বিশ্বকাপের মাঠে নামা। সেটা যেহেতু হয়নি, তাই নিজের চতুর্থ ও শেষ বিশ্বকাপে মাশরাফি নিজের জন্য হলেও কিছু করতে চাইবেন সেটাও স্বাভাবিক। অবশ্য দলের আরেক জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম বলেই দিয়েছেন, মাশরাফির জন্য হলেও এবারের বিশ্বকাপে তারা ভালো করতে চান।
মাশরাফির আশা কিংবা ভয়, যেটাই বলা হোক না কেন, দুটোই নতুন নিয়মকে ঘিরে। সেমিফাইনালে জায়গা করে নিতে পারলে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকছে, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে মাশরাফি বলেছেন,
‘ইমপসিবল কোনো কিছুই না। অবশ্যই পসিবল। তবে কঠিন, অনেক কঠিন । এর আগে ওয়ার্ল্ডকাপ যেরকম ছিল, গ্রুপ স্টেজে একটা বড় দল হারালে পারলে যেটা হতো, তাদের কামব্যাক করা কঠিন হয়ে যেত। লিমিটেড ম্যাচ ছিল। এবার নয়টা ম্যাচ। যারা প্রত্যাশা করছে সেমিফাইনাল খেলবে, তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর অনেক সুযোগ থাকবে। আমাদেরকে ওই জায়গাটা খেয়াল রাখতে হবে।’
নিজের শেষ বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ আসতেই বললেন,
‘আমার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। ভালো হলে সবাই খুশি হবে। আমারও ভালো লাগবে। বাড়তি আমি কখনো নিতে চাই না। যেটা নিয়ে চিন্তা করা যে শেষ বিশ্বকাপ খেলছি, এখানে ভালো কিছু করে আসা। আমি সবসময় ভাগ্যে বিশ্বাসী। পুরো দলের ভাগ্যে যেটা আছে, সেটাই হবে। মেহনত করতে হবে। কষ্ট করতে হবে। সেটা করার জন্য আমরা প্রস্তুত কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দল টুর্নামেন্টে সেরা দল নিয়েও বিশ্বকাপ জেতেনি। সেরা দল আবার অনেক সময় সেমিফাইনালেও ওঠেনি। আমাদের ওপরে এরকম কোনো চাপ নেই যে আমাদেরকে বিশ্বকাপ জিতে আসতেই হবে, কিংবা আমাদের সেমিফাইনালে উঠতে হবে। আমরা ভালো খেলার জন্য মুখিয়ে আছি।’
মাশরাফি যেভাবেই বলুন না কেন, বাংলাদেশের লক্ষ্য এবার অন্ততপক্ষে সেমিফাইনাল, সেটা একরকম নিশ্চিত। সেমিফাইনালে গেলে আরেকটা ম্যাচ, সেভাবেই এগোনোর পরিকল্পনা দেশসেরা এই অধিনায়কের। তবে সবকিছু নির্দিষ্ট দিনের পারফরম্যান্স, নির্দিষ্ট দিনের অবস্থা আর ভাগ্যের উপর নির্ভর করছে বলেই মনে করেন তিনি।
এ নিয়ে বললেন,
‘এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমাদের সেমিফাইনালে যাওয়াটা খুব বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে যেটা বলতাম যে, সেমিফাইনাল গেলে একটা একটা ম্যাচ। এখনো তাই বলতে হচ্ছে। সেমিফাইনালে যদি যেতে পারি, অনেক বড় অর্জন হবে। কারণ এবারের ফরম্যাট সেই ‘৯২ সালের মতো, খুবই কঠিন ব্যাপার কিন্তু। সেমিফাইনালে যাওয়া অনেক বড় অর্জন। আমরা অনেকবার সেমিফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়ে হেরেছি। আগে সেমিফাইনালটায় যদি যাই, তাহলে বড় অর্জন হবে। তারপর ওই পার্টিকুলার দিনে ভালো খেলা গুরুত্বপূর্ণ।’
নতুন নিয়মে খেলতে যাওয়া, অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেলে দারুণ একটি দল, সেমিফাইনালের লক্ষ্য আর ভাগ্য; সবকিছু মেনেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ দল। কিন্তু এত কিছুর পরও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার সামর্থ্য বাংলাদেশের কতটুকু আছে?
উত্তরটা দিয়েছেন দলের অধিনায়ক নিজেই। তার মতে, বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের অভিজ্ঞতা কিংবা সামর্থ্য দুটোই বাংলাদেশের আছে, নেই টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ বের করে আনার অভিজ্ঞতা। তিন এশিয়া কাপের ফাইনাল, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল ম্যাচগুলো এক্ষেত্রে মাশরাফির কথার প্রমাণ দেবে।
মাশরাফি বলেন,
‘সব দলেরই ভাল খারাপ যাবে। কিন্তু যেন পরের দিনই আবার ফিরে আসা যায়। কারণ যেটা চলে যাবে, সেটা তো আর ফিরে আনা সম্ভব হবে না। বেশিরভাগ ম্যাচেই ভালো করা, কিংবা জেতার ক্ষেত্রে এই ভালো আর খারাপ থেকে ফিরে আসার অভ্যাসটা থাকতে হবে। আমার বিশ্বাস যে আমাদের সবারই এটা প্রয়োজন। এটা নিয়ে আমরা আলোচনাও করেছি। এটা আসলে মানসিক ব্যাপার। আর বিশ্বকাপ জেতার কথা যেটা বললেন, অবশ্যই আছে। আবার কিছু নেতিবাচক ব্যাপারও আছে। হয়তো বা শেষ এশিয়া কাপ জিতলে এই ধরণের টুর্নামেন্ট কীভাবে জিততে হয়, তার অভ্যাস হতো। এই অভ্যাস থাকা খুব জরুরী। এর আগে সেমিফাইনাল হয়েছে, বা কোয়ার্টার ফাইনাল আছে। ফাইনালেও এশিয়া কাপে উঠে জিততে পারিনি তিনবার। যে মানসিক চাপ থাকে, তখন হয়তো একটা দুইটা উইকেট ধ্বসে পড়েছে, ওই চাপটা ধরতে পারবো। বড় টুর্নামেন্ট জিতলে পরে এই চাপ হ্যান্ডেল করা সহজ হয়। খুব কঠিন, কিন্তু অসম্ভব বলবো না।’
বিশ্বকাপে বোলিং আর ব্যাটিং, দুই ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ। যেহেতু ইংল্যান্ডের কন্ডিশন পেস সহায়ক, কিন্তু বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে সেখানকার উইকেট ব্যাটসম্যানদের হয়ে কথা বলবে, তাই মাশরাফিকে ভাবতে হচ্ছে একটু অন্যভাবে। প্রতিটি ম্যাচ ধরে ধরে এগোতে পারলে নিজেদের জন্যেও চ্যালেঞ্জগুলো পার করতে সহজ হবে বলে তার ভাবনা।
মাশরাফির ভাষায়,
‘আমার কাছে দুইটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। একটা হলো, শুরুর দিকে উইকেট না দেওয়া। যদি আমরা আগে ব্যাটিং করি, দুইটা উইকেট যদি পড়ে যায়, আমরা চাপে পড়ে যাবো। দুই নম্বর বিষয় হলো, আগে বোলিং করলে দ্রুত উইকেট নেওয়া। আমার মনে হয়, ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে এই দু’টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হবে। আর একটা বিষয় হলো, ৪৩ ওভারের পর বোলিং ও ব্যাটিং দুইটা জায়গা ঠিক রাখতে হবে। মিডল পার্টে আমরা ভালো করছি। আমরা যদি এই দুইটা বিষয় ঠিক রাখতে পারি, তাহলে ইনশাল্লাহ আমরা অনেকগুলো ম্যাচ জিততে পারবো।’
ফুটবলের মতো ক্রিকেটেও মাঠের বাইরের অনেক কিছুতে খেলোয়াড়দের সামলে রাখতে হয়। যেগুলোর সরাসরি প্রভাব পড়ে নিজেদের পারফরম্যান্সে। পশ্চিমা দেশগুলোর এক রকম সমস্যা, বাংলাদেশের মতো এশিয়া মহাদেশের দলগুলোর অন্যরকম সমস্যা। এক্ষেত্রে মাঠের বাইরে বাংলাদেশ দলের প্রধান শত্রু হতে পারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। পারফরম্যান্স খারাপ কিংবা ভালো, প্রত্যাশার চাপে নুয়ে পড়া সমর্থকরা সমালোচনায় একটুকুও যে ছাড় দেবে না, তা একরকম নিশ্চিত। মাশরাফির মতে, এগুলো ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত বিষয়। তবে তার পরামর্শ, যতটা দূরে থাকা যায়, ততটাই ভালো। বিশেষ করে যারা প্রভাবিত হতে পারে, তাদেরকেই দূরে থাকার পরামর্শ এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের।
মাশরাফি এ প্রসঙ্গে বললেন,
‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের ভালো কিংবা খারাপ ক্রিকেট খেলতে কখনো হেল্প করবে না। বিশেষভাবে আমাদের (বাংলাদেশের) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমার কাছে মনে হয়, এটার দিকে নজর না রাখাই ভালো হবে। এটা আবার যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো আমিও আছি। কিন্তু এটা আমাকে ইফেক্ট করে না। আমি জানি, সাকিবকেও করে না। অন্য কাউকে করতে পারে। যাকে করে, সেটা তার বুঝতে হবে। এটার জন্য টিম রুলস জারি করার কিছু নেই। এটা ব্যক্তিগত বিষয়। যেহেতু সমস্যা তৈরি করে, এটার থেকে দূরে থাকতে পারলে ভালো। দুইটা মাস টোটাল মনোযোগ বিশ্বকাপকেন্দ্রিক থাকাই ভালো। এটা আমাদের দল ও দেশের জন্যই ভালো হবে।’