ওয়েস্ট ইন্ডিজের বদলি ফিল্ডার ব্লাকউডের সরাসরি থ্রু’তে ইয়াসির শাহ যখন রান আউট হয়ে পাকিস্তানের নবম ব্যাটসম্যান হিসাবে সাজঘরে ফিরেন, তখন কিংস্টনে সিরিজের প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিনে পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে রান ছিল ৯ উইকেটে ৩৭৩ রান। এমতাবস্থায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে বৃষ্টি বিঘ্নিত টেস্টে ৮৭ রানে এগিয়ে পাকিস্তান। ক্রিজে তখনো সাবলীলভাবে ব্যাট করছিলেন অধিনায়ক মিসবাহ-উল হক। তার নামের পাশে ৬৮* রান। তাকে সঙ্গ দিতে শেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে ক্রিজে আসেন অভিষিক্ত মোহাম্মদ আব্বাস।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সাড়ে সাত ব্যাটিং গড়ে রান করা ব্যাটসম্যানকে নিয়ে নিজের একাদশ টেস্ট সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন মিসবাহ। অভিষিক্ত মোহাম্মদ আব্বাসের প্রতি আস্থা রেখে দেবেন্দ্র বিশুর করা ইনিংসের ১৩৮তম ওভারের শেষ বলে দুই রান নিয়ে ৯৯ রানে পৌঁছালেন ঠিকই, কিন্তু পরের ওভার যে শেষ ব্যাটসম্যান আব্বাসের মোকাবেলা করতে হবে সেটা হয়তো ভুলেই গেছেন। রস্টন চেজের করা ইনিংসের ১৩৯তম ওভারের প্রথম তিন বল কোনোমতে কাটিয়ে দিলেও চতুর্থ বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন। মোহাম্মদ আব্বাসের আউট হওয়ার ফলে মিসবাহ-উল হককে ৯৯* রানেই অপরাজিত থাকতে হয়।
কিছু কিছু রেকর্ড আছে অনাকাঙ্ক্ষিত। যার পাশে কেউই নিজের নাম দেখতে চাইবেন না। আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়া বোলারের নাম কি? উত্তরটা অনেকেরই জানা। তবে বোলারের কীর্তির কারণে নয়। ব্যাটসম্যান যুবরাজ সিংয়ের কারণে সবাই বলতে পারবে বোলারের নামটি স্টুয়ার্ট ব্রড। এমন আরো অনেক কীর্তি রয়েছে যার কীর্তিমানরা কীর্তি গড়ে হতাশায় ভুগেছেন।
মিসবাহ-উল হক উপমহাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৯৯* রানে অপরাজিত থাকার কীর্তি গড়লেন। যদি তাকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে এমন রেকর্ডের পাশে নিজের নাম দেখতে চাইবেন না। টেস্ট ক্রিকেটে এর আগে পাঁচজন ব্যাটসম্যান ৯৯* রানে অপরাজিত ছিলেন। জিওফ বয়কট, স্টিভ ওয়াহ, অ্যালেক্স টুডর, শন পোলক এবং অ্যান্ড্রু হল টেস্ট ক্রিকেটে ৯৯* রানে অপরাজিত ছিলেন। এরা কেউই উপমহাদেশের ক্রিকেটার নন। সর্বপ্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে ৯৯* রানে অপরাজিত থাকেন ইংলিশ ওপেনার জিওফ বয়কট। ঐ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩৫৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামে ইংল্যান্ড। জিওফ বয়কট একাই লড়াই চালিয়ে যান। ওপেনিং নেমে শেষ পর্যন্ত ৯৯* রানে অপরাজিত ছিলেন। ইংল্যান্ড ২১৫ রানে অল আউট হয়ে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ১৩৮ রানে পরাজিত হয়।
মিসবাহ-উল হক কিংস্টনে প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি করতে পারলে সবচেয়ে বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় চতুর্থ স্থানে চলে আসতেন। কিংস্টন টেস্ট শুরু হওয়ার সময় মিসবাহর বয়স ছিল ৪২ বছর ৩২৯ দিন। ইংল্যান্ডের ফ্রাঙ্ক উলি ৪২ বছর ৬১ দিন বয়সে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভ নোর্স ৪২ বছর ২৯১ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করেছিলেন। মিসবাহ সেঞ্চুরি পেলে এই দুজনকে টপকে যেতে পারতেন।
গত বছর লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ৪২ বছর ৪৭ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করে সবচেয়ে বয়স্ক অধিনায়ক হিসাবে লর্ডসে সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ড গড়েছিলেন মিসবাহ। লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সবচেয়ে বেশি বয়সে সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ডটি অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার ওরেন বার্ডস্লির দখলে। তিনি ৪৩ বছর ২০২ দিন বয়সে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৩* রানের ইনিংস খেলেছিলেন। মিসবাহ-উল হক ৪২ বছর ৪৭ দিন বয়সে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে সেঞ্চুরি হাঁকানোর ব্যাটসম্যানদের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছেন। ৪৬ বছর ৮২ দিন বয়সে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে সেঞ্চুরি হাঁকানো ব্যাটসম্যানদের তালিকায় শীর্ষে থাকা জ্যাক হবসের রেকর্ডটি ভাঙতে না পারলেও পরের টেস্টে আবারো চতুর্থ স্থানে উঠে আসার সুযোগ হাতছাড়া করেছেন মিসবাহ-উল হক।
ব্রিজটাউন টেস্টেও বুড়ো বয়সের ভেলকি দেখিয়ে যাচ্ছিলেন। বেশ সাবলীলভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন একাদশ টেস্ট সেঞ্চুরির দিকে। এবারও হলো না! এবার আর সতীর্থদের দোষে নয়। জেসন হোল্ডারের বল খেলবেন কি খেলবেন না সেটা ভাবতে ভাবতেই বল তার ব্যাটে চুমু খেয়ে দ্বিতীয় স্লিপে দাঁড়ানো হোপের তালুবন্দী হয়ে গেলে তার আর সেঞ্চুরি পূরণ করা হয়নি। সেই সাথে তার ২০১ বলে ৯টি চার এবং ২টি ছয়ের সাহায্যে করা ৯৯ রানের ইনিংসটির ইতি ঘটলো।
দু’বার সুযোগ ছিল নিজের শেষ টেস্ট সিরিজে সেঞ্চুরি করার। উল্টো তৃতীয়বারের মতো ৯৯ রানে আটকে গেলেন। হ্যাঁ, এটাও বিশ্বরেকর্ড। এই রেকর্ডের অংশীদার হতে চাইবেন না কেউই। কিংস্টন এবং ব্রিজটাউন টেস্ট ছাড়াও মিসবাহ-উল হক টেস্ট ক্রিকেটে আরো একবার ৯৯ রানে আউট হয়েছিলেন। ২০১১ সালে ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৯ রান করে ক্রিস মার্টিনের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন।
নিরানব্বইয়ে থেমে যাওয়ার আক্ষেপ
প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৯৯ রানে আউট হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ক্লেম হিল। ১৯০২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মেলবোর্ন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৯ রান করে বার্নসের বলে জোন্সের হাতে ক্যাচ দিয়ে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে ৯৯ রানে আউট হন তিনি। টাইমলেস টেস্টের প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ৩২.১ ওভারে ১১২ রান করে অল আউট হয়ে যায়। ক্লেম হিল তিন নাম্বারে ব্যাট করে করেছিলেন ১৫ রান। জবাবে ইংল্যান্ড ১৫.৪ ওভারে মাত্র ৬১ রানে গুটিয়ে যায়। ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসেও অস্ট্রেলিয়া ৪৮ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বসে। এই ইনিংসে ক্লেম হিল ব্যাট করেন সাত নাম্বারে এবং ৯৯ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯০২ সালের মেলবোর্নে টাইমলেস ম্যাচে ২২৯ রানের বড় জয় পায় অস্ট্রেলিয়া।
এখন পর্যন্ত ৭৯ জন ব্যাটসম্যান নব্বই বার নিরানব্বইতে এসে থেমে গেছেন। যার মধ্যে ৬ বার ব্যাটসম্যানরা অপরাজিত ছিলেন। মিসবাহ-উল হক একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসাবে তিনবার নিরানব্বইতে এসে থেমেছেন। এছাড়া মাইক স্মিথ, জিওফ বয়কট, গ্রেগ ব্লিউয়েট, সেলিম মালিক, রিচি রিচার্ডসন, জন রাইট, মাইক আথারটন, সৌরভ গাঙ্গুলী এবং সায়মন ক্যাটিচ দুইবার করে এক রানের আক্ষেপে পুড়েছেন।
আবার আসা যাক মিসবাহ-উল হক প্রসঙ্গে। মিসবাহ শুধুমাত্র টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি থেকে বঞ্চিত হন তা না! একদিনের ক্রিকেটেও বেশ কয়েকবার সেঞ্চুরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ক্রিকেটের এই ফরম্যাটে তো সেঞ্চুরির দেখাও মিলেনি তার। এই ফরম্যাটেও তার বিশ্বরেকর্ডটি সুযোগ পেলে দ্বিতীয়বার করতে চাইবেন না। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সেঞ্চুরি ছাড়া সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহক ব্যাটসম্যানটির নাম মিসবাহ-উল হক। ১৬২ ম্যাচের ১৪৯ ইনিংস ব্যাটিং করে ৪৩.৪০ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৫,১২২ রান। ৪২টি অর্ধশত রানের ইনিংস থাকলেও নেই কোনো সেঞ্চুরি।
সেঞ্চুরি ছাড়া সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকদের তালিকায় দ্বিতীয় নামটি তার স্বদেশী ওয়াসিম আকরামের। তিনি তার ক্যারিয়ারে খুব কম সময়ই সেঞ্চুরি হাঁকানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। ওডিআই ক্রিকেটে মিসবাহ-উল হক দুইবার নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছেছিলেন। এর মাঝে ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শতক হাঁকানোর সমূহ সম্ভাবনা ছিল। এবারও শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে সতীর্থদের আসা-যাওয়া দেখছিলেন। আর তীর্থের কাকের মতো রানের জন্য ভেতর ভেতর ছটফট করছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচটিতে পাকিস্তান ১৭০ রান করে। যার মধ্যে মিসবাহ-উল হক করেন ১২৭ বলে ৯৬* রান। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মোহাম্মদ ইরফান যখন আউট হন, তখনো ইনিংসের ১২ বল বাকি ছিল। ইরফান আরেকটি বল ঠেকিয়ে দিতে পারলেই হয়তো মিসবাহর নামের পাশে ওডিআই সেঞ্চুরি থাকতো।
এছাড়া ২০১১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৩* রানের ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়ে ছিলেন মিসবাহ। তার পরের তিনটি সর্বোচ্চ ওডিআই ইনিংসের সবকটি অপরাজিত ৮৩* রানের ইনিংস। ওডিআই ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন দু’বছর আগেই। টেস্ট ক্রিকেট থেকেও বিদায়ের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে বয়স্ক ক্রিকেটার হিসাবে সেঞ্চুরি হাঁকানোর জন্য আরো একটি টেস্ট ম্যাচ পাবেন মিসবাহ-উল হক।
তথ্যসূত্র
১. stats.espncricinfo.com/ci/engine/stats/index.html?class=1;filter=advanced;orderby=player;runsmax1=99;runsmin1=99;runsval1=runs;size=200;template=results;type=batting
২. espncricinfo.com/ci/content/player/41378.html
৩. espncricinfo.com/ci/engine/match/473922.html
৪. stats.espncricinfo.com/ci/content/records/282994.html
৫. espncricinfo.com/ci/engine/current/match/62461.html
৬. espncricinfo.com/ci/engine/current/match/63256.html
৭. stats.espncricinfo.com/wi/content/records/284205.html