সাত নম্বরে কাকে চাই?
ইংল্যান্ডের সমর্থক হলে আপনার জন্য উত্তর করাটা সহজ। মঈন আলী জায়গাটা বিশ্বকাপ পর্যন্ত ধরে রাখবেন, অনেকটাই নিশ্চিত। তবে শতভাগ নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ, ক্রিকেটার যেহেতু, কোনো দৈব-দুর্ঘটনা ঘটে যেতে কতক্ষণ! ইংল্যান্ড তার জন্যে বিকল্পও তৈরি রেখেছে উইল জ্যাকসের রূপে। দলে মঈন আলীর ভূমিকা যেরকম, কোটা পূরণ করা বোলিংয়ের সঙ্গে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং, কাজটা তো উইল জ্যাকসও পারেন।
সমস্যা নেই, যদি আপনি পাকিস্তান, ভারত কিংবা অস্ট্রেলিয়ার সমর্থকও হন। সাত নম্বর পজিশনের ক্রিকেটারের কাছে তাদের চাওয়াটা মোটামুটি পরিষ্কারই হয়ে গেছে বিশ্বকাপের আড়াই মাস আগে এসে। যেহেতু টিম গেম, দলে সবার একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা বেঁধে দেওয়া আছে। কেউ ছিটকে গেলে, চোটে পড়লে, নির্বাচকদের হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানোর কারণ নেই। জাতীয় দলের আশেপাশে থাকা অন্য ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল ওই পজিশনের চাহিদা পুরণের সামর্থ্য আছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই চলছে।
কিন্তু, যত গণ্ডগোল বাঁধছে বাংলাদেশের সাত নম্বর বাছাই করতে এসে। এমনিতেই তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমদের শেষ বিশ্বকাপ বলে ‘কিছু একটা অর্জনের’ ফিসফাস বাতাসে কান পাতলেই টের পাওয়া যাচ্ছে। ওয়ানডে সুপার লিগের পয়েন্ট তালিকার তিনে থেকে শেষ করার কারণে প্রত্যাশার পাল্লাটা ভারী হয়েছে আরেকটু। তবে, প্রত্যাশার বেলুন চুপসে যেতে পারে যেকোনো দিনই। এখনো যে বিশ্বকাপের প্রথম পছন্দের একাদশই – নির্দিষ্ট করে বললে সাত নম্বরে কে খেলবেন – জানা হয়নি দলের।
খুব সরল-সোজা কিছু তথ্য-উপাত্ত টেনেই শুরু করা যাক। ২০১৯ বিশ্বকাপের পরে যে ৪৫ ওয়ানডে খেলেছে বাংলাদেশ, সেখানে সাত নম্বর পজিশনের জন্য ভাবা হয়েছে ১১ ক্রিকেটারকে। তাসকিন আহমেদ ব্যাটিং পাননি বলে আপনি সংখ্যাটা ১০-ও ধরতে পারেন। এর মধ্যে সুযোগটা আফিফ হোসেন আর মেহেদী হাসান মিরাজই পেয়েছেন বেশি। যে ৩৫ ইনিংসে ব্যাট ধরার সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশের ৭ নম্বর ব্যাটাররা, আফিফই ছিলেন এর ১৭ দিনে। ২৬.৮৫ গড় আর ৮৪.৬৮ স্ট্রাইক রেট বলছে, ভালো করতে পারেননি তিনি।
মেহেদী হাসান মিরাজ ভালো করছেন আট নম্বরে। ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জেতানোর কৃতিত্ব তো তিনিই পাবেন। কিন্তু, সাতে উঠে এলেই ব্যাটিংটা কেমন যেন গুবলেট পাকিয়ে যায় তারও। ৯ ইনিংস সাতে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে রান করেছেন ৮০ স্ট্রাইক রেটে, ব্যাটিং-গড় আফিফেরও অর্ধেক। মিরাজ বিশ্বকাপে খেলবেন, সেন্ট পারসেন্ট নিশ্চিত। কিন্তু, সাত নম্বরে যে নয়, নিশ্চিত এটাও।
কেন মিরাজ টিকতে পারলেন না সাতে উঠে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে আসছে ঘাপলাটা। বাংলাদেশ কোনো ছকেই ফেলতে পারেনি সাত নম্বর ব্যাটারের ভূমিকাকে।
২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকে খেলা ৪৫ ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ৭ নম্বর ব্যাটারকে ক্রিজে আসতে হয়েছে ৩৫ বার। এর মধ্যে: ২১-৩০ ওভারের মাঝে ৯ বার, ৩১-৪০ ওভারের মাঝে ১১ বার আর শেষ ১০ ওভারে ব্যাটিংয়ে নামতে হয়েছে ১০ বার। এমন নড়াচড়া করতে হচ্ছে বলে তিনি ঠিকই করতে পারছেন না, তার কাছে দল কোনদিন কী চাইবে।
কত ওভারে | কত বার |
০-১০ | ১ |
১১-২০ | ৪ |
২১-৩০ | ৯ |
৩১-৪০ | ১১ |
৪১-৫০ | ১০ |
ভেঙে বলা যাক। বিশ্বকাপটা যেহেতু ভারতে – অবশ্য শুধু ভারত বলে নয়, মোটামুটি ভূ-ভারতের সবখানেই – মাঝের ওভারগুলোতে স্পিনারদের দিয়ে আক্রমণের চেষ্টা থাকবে প্রতিপক্ষ অধিনায়কের। কেউ যদি তাই ইনিংসের ২১-৩০ ওভারের ফেজে নামেন, নিশ্চিত থাকা যেতে পারে, তার দিকে স্পিনাররাই ছুড়বেন সিংহভাগ ডেলিভারি। কত কম ঝুঁকি নিয়ে, বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে পারেন, স্পিনারদের সাবলীলভাবে খেলতে পারেন – ২১-৩০ ওভারের মাঝে কেউ ব্যাটিংয়ে নামলে প্রথমে ঘেঁটে দেখা হয় এই সামর্থ্যই।
পরের ১০ ওভারে ব্যাটিংয়ে নামতে হচ্ছে যাকে, তার কাছে চাওয়া থাকে খেলা লম্বা করার। ইনিংসের শেষ ১০ ওভার পর্যন্ত টিকে থাকার। মহেন্দ্র সিং ধোনি যে কাজটা খুব ভালো পারতেন। ৩০ ওভারের পরে নেমে শুরুটা রক্ষণাত্মকই করতেন, তবে আউট হতেন না। অপর প্রান্তের ব্যাটার যেহেতু জানতেন, ধোনি ধীরে খেললেও আউট হচ্ছে না, তিনি বোলারদের ওপর চড়াও হওয়ার সুযোগ পেতেন। ধোনি রুদ্রসংহার মূর্তি ধারণ করতেন ইনিংসের শেষ ভাগে।
আর ইনিংসের শেষ ১০ ওভারে কেউ ব্যাট হাতে নামলে তার জন্য ‘দেখে খেলা’, ‘টিকে থাকা’ শব্দগুলো অর্থহীন। তখন রান বাড়াতে হবে, বলে বলে আক্রমণে যেতে হবে, পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে ভালো হতে হবে। জোর সম্ভাবনা, মঈনকে ইংল্যান্ড ২০২৩ বিশ্বকাপে এই ভূমিকাতেই খেলাবে।
বুঝতেই পারছেন, এক ভূমিকার সঙ্গে অন্য ভূমিকার মিল যৎসামান্যই। এবং, ভূমিকার নড়চড় বেশি বলে এক দায়িত্ব পালন করা ক্রিকেটারের অন্য দায়িত্ব নিয়েও সফল হওয়ার সম্ভাবনা সীমিত। তাই, সাত নম্বরের ব্যাটারের কাছে একই সাথে ইনিংস মেরামত আর বিধ্বংসী ব্যাটিং চাইলে তো হবে না। টপ অর্ডার আর মিডল-অর্ডারকে একটা মঞ্চ তৈরি করে দিয়ে যেতে হবে, যেখানে এসে মিডল-অর্ডার পারফর্ম করতে পারবেন।
উদাহরণ দেখুন। পেসারদের বিপক্ষে মিরাজ বেশ ভালো, ২০২০ সাল থেকে হিসাব করলে পেসারদের বিপক্ষে তিনি রান করেছেন ৯৩.৪৫ স্ট্রাইক রেটে। আট নম্বরে যেদিন নামছেন, সেদিন তার ‘এন্ট্রি পয়েন্ট’ পিছিয়ে যাচ্ছে। পেসারদের বল পাচ্ছেন বেশি। তুলনামূলক ভালোও করছেন। কিন্তু, সাত নম্বরে উঠে এলেই স্পিনাররা ঘিরে ধরছেন তাকে। এই ধরনের বোলারদের বিপক্ষে রীতিমতো সংগ্রাম করেন তিনি – স্ট্রাইক রেট মাত্র ৬১.৯৭। ৪১-৫০ ওভারের মিরাজকে তাই ২১-৪০ ওভারে পাওয়া যাবে কী করে!
সাত নম্বরের ব্যাটারের কাছ থেকে সেরাটা পেতে চাইলে তাই আগে মেলাতে হবে টপ-অর্ডার এবং মিডল-অর্ডার ব্যাটিংয়ের ধাঁধা। কোনোদিন ২৫ ওভারে, কোনোদিন ৩৫ ওভারে আর কোনোদিন ১৩ বল বাকি থাকতে না নামিয়ে একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা যেন বেঁধে দেওয়া যায় সাতের ব্যাটারকে।
প্রথম ছয় ব্যাটারের ব্যাটিং সাত নম্বরের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে আরেকটা কারণেও। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর খেলা ৩৫ ইনিংসের মাঝে ১৮ বার বাংলাদেশ ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলছে স্কোরবোর্ডে রান ১৫০ তোলার আগেই। আর ২০০ রান তোলার আগেই সাত নম্বর ব্যাটারকে ক্রিজে আসতে হচ্ছে, এমন ঘটনা ঘটেছে ২৪ বার।
কত রানে | কত বার |
০-৫০ | ২ |
৫১-১০০ | ৬ |
১০১-১৫০ | ১০ |
১৫১-২০০ | ৬ |
২০১-২৫০ | ৪ |
২৫০+ | ৭ |
সমস্যা হতো না, যদি বাংলাদেশ ইংল্যান্ড কিংবা পাকিস্তানের মতো লাইনআপ পেত, যেখানে ১০ নম্বর ব্যাটারও অল্পবিস্তর ব্যাট ঘোরাতে পারেন। যেসব দলে ৫ উইকেট পড়া মানেই ইনিংস শেষের ভাবনা নয়, বরং নির্ভাবনায় নিজেকে প্রকাশ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে।
বাংলাদেশের অবস্থাটা তো মোটেই সেরকম নয়। মোস্তাফিজুর রহমান, শরিফুল ইসলাম, এবাদত হোসেন কিংবা হাসান মাহমুদের ব্যাটিং নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই মঙ্গল। তাসকিনকে মেরেকেটে মন্দের ভালো বলতেও কষ্ট। লেজের দুই জুটিতে ২০ রানও যোগ হবে, গড়ের দিকে তাকালে এই ভরসাও জাগে না।
এমনিতেই বাংলাদেশের টপ-অর্ডার ধরে খেলতে অভ্যস্ত। তামিম ইকবাল-লিটন দাসের ওপেনিং জুটি প্রথম পাওয়ারপ্লেতে রান তোলে সাড়ে ৪-এর আশেপাশে হারে। কিন্তু, ধীরে খেলেও যদি ইনিংস লম্বা না হয় তাদের, উইকেটে টিকে থেকে রান বাড়াতে ব্যর্থ হন তিন-চার-পাঁচ নম্বরও, ১৫০ রানের আশেপাশেই পড়ে যায় ৫ উইকেট, সেক্ষেত্রে সাত নম্বর ব্যাটার তো পড়ে যাচ্ছেন দোটানায়, ‘এখনও কি ধরে খেলে টেনেটুনে ২৪০-৫০ রানকেই লক্ষ্য বানাব? নাকি, মেরে-টেরে টার্গেট করব ২৮০-৯০ রান তুলতে? ম্যাচ জিততে যে স্কোরটা লাগবেই!’
সাত নম্বরের ভূমিকাটা এমনিতেই জটিল। নিখাঁদ ব্যাটার বা আদ্যন্ত বোলার – কাউকেই বিবেচনা করা হয় না এই পজিশনে। একটা ‘সেকেন্ডারি স্কিল’ থাকাটা অত্যাবশ্যক। সৌম্য সরকার যে হুট করে উঠে এলেন বিশ্বকাপগামী দলের সাত নম্বরের আলোচনাতে, সেটা ব্যাটার হিসেবে নয়, পেস বোলিংটা জানেন বলেই।
অফ স্পিনার হিসেবে মিরাজ যেহেতু আছেনই, কাজ চালাতে পারা লেগ স্পিনিং অলরাউন্ডারও বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নেই, ইনিংসের শেষ দিকে নেমে ২০-২৫ রানের ক্যামিও, সঙ্গে ছয়টা ভালো ওভার – এই বিবেচনায় বাংলাদেশ দলের থিংক ট্যাংক সাত নম্বরে ভাবতেই পারে সৌম্য সরকারের কথা। কিন্তু, সৌম্য যেদিন দলে জায়গা পাবেন সেদিন যে বাংলাদেশের প্রথম ছয় ব্যাটার অন্য কোনো প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে না তাকে, নামিয়ে দেবে না স্পিন খেলতে, কে বলতে পারছে!
সাত নম্বর মহাবিপদ সংকেতের প্রতিকার তো কেবল সাতেই আটকে নেই।