আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতক হাঁকানো যে কতটা সহজ, তা শচীন টেন্ডুলকারের চেয়ে আর কেউ বেশি জানেন না। তিনি যে শতকের শতক হাঁকিয়ে বসে আছেন! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকানো এই ব্যাটসম্যানও নব্বইয়ের ঘরে নড়বড়ে থাকতেন। সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকানোর পাশাপাশি তাই সবচেয়ে বেশিবার নব্বইয়ের ঘরে আউটও হয়েছেন তিনি। শচীন টেন্ডুলকার ওয়ানডে ক্রিকেটে ৫১টি শতক হাঁকিয়েছেন। সংখ্যাটি হতে পারতো ৬৯, যদি না তিনি ওয়ানডেতে ১৮ বার নব্বইয়ের ঘরে কাটা পরতেন। টেস্ট ক্রিকেটেও তিনি দশবার নব্বইয়ের ঘরে সাজঘরে ফিরেছিলেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমনও অনেক ব্যাটসম্যান আছেন যারা নব্বইতে এসে নড়বড়ে ব্যাটিং করতেন না, খুব স্বাচ্ছন্দ্যে তিন অংকের ঘরে পৌঁছে যেতেন। টেস্ট ক্রিকেটে শতভাগ সফলতার সাথে নব্বইয়ের ঘর পেরোনো উল্লেখযোগ্য কিছু ক্রিকেটারদেরকে দিয়েই সাজানো থাকছে আজকের লেখা।
ডন ব্র্যাডম্যান – ২৯টি শতক
ডন ব্র্যাডম্যান নিজের শেষ টেস্ট ইনিংসে মাত্র চার রান করতে পারলেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তার ব্যাটিং গড় দাঁড়াত ১০০। পুরো ক্যারিয়ারে রানের ফোয়ারা ছোটানো এই ব্যাটসম্যান নিজের শেষ টেস্ট ইনিংসে চার রান করতে না পারার আফসোস নিয়েই ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। সতীর্থের অভাবে ২৯৯ রানে অপরাজিত থেকে ট্রিপল সেঞ্চুরি মিস করার কারণেও আফসোস থাকতে পারে এই কিংবদন্তি ক্রিকেটারের। কিন্তু নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়ে কখনও আফসোস করতে হয়নি ডন ব্র্যাডম্যানের।
ডন ব্র্যাডম্যান টেস্ট ক্যারিয়ারে ২৯ বার নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছেছিলেন, যার সবক’টিকে তিনি শতকে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ১৩ ইনিংসে অর্ধশতক হাঁকালেও কখনও নব্বইয়ের ঘরে আউট হননি। শত রানের সবচেয়ে নিকটে আউট হয়েছিলেন ৮৯ রানে। ১৯৪৮ সালের ২৪শে জুন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডস টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যালেক বেডসারের বলে আউট হওয়ার আগে তিনি ৮৯ রান করেছিলেন। শত রানের কাছাকাছি এটিই তার সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ৫২ টেস্টে ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ে ৬,৯৯৬ রান করেছিলেন। ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে চার রানের জন্য ব্যাটিং গড় একশ’র ঘরে নিতে না পারার পাশাপাশি মাত্র চার রানের জন্য সাত হাজার রানের ক্লাবে নাম লেখাতে পারেননি ব্র্যাডম্যান। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে বোলারদেরকে তুলোধোনা করে ২৯টি শতক এবং ১৩টি অর্ধশতক হাঁকানো এই ব্যাটসম্যান তার ক্যারিয়ারে খুব সম্ভবত ঐ একবারই রেকর্ডের সামনে থেকে নড়বড়ে ব্যাটিং করেছিলেন।
গ্রেগ চ্যাপেল – ২৪টি শতক
ডন ব্র্যাডম্যান-পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। টেস্ট ক্রিকেটে তিনিই প্রথম অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান হিসাবে সাত হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেছিলেন। ডানহাতি এই টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান টেস্ট ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পর নিজের শেষ টেস্টেও শতক হাঁকিয়েছিলেন। মাঝখানে শতক হাঁকিয়েছিলেন আরও ২২টি। তিনি ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ৮৭টি টেস্টে ৫৩.৮৬ ব্যাটিং গড়ে ৭,১১০ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
গ্রেগ চ্যাপেল তার টেস্ট ক্যারিয়ারে ৫৫ বার পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এর মধ্যে ২৪ ইনিংসে শতক হাঁকিয়েছিলেন এবং অর্ধশতক হাঁকান ৩১টি। তবে তিনি কখনও নব্বইয়ের ঘরে আউট হননি। ২৫ বার নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছে ২৪টি শতক হাঁকিয়েছিলেন। আর বাকি একবার ৯৮ রানে অপরাজিত ছিলেন। ১৯৮০ সালের ৪ জানুয়ারি সিডনিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। জয়ের জন্য চতুর্থ ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে ২১৬ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ড। দলীয় ৫১ রানে দ্বিতীয় উইকেটের পতন ঘটলে চার নাম্বারে ব্যাট করতে নামেন গ্রেগ চ্যাপেল। দুর্দান্ত ব্যাটিং করে দলকে জয় এনে দিলেও তিনি তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করতে পারেননি। ৯৮ রানে অপরাজিত থেকে দলকে ছয় উইকেটের জয় পাইয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন।
মাইকেল ভন – ১৮টি শতক
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন ৮২টি টেস্ট ম্যাচের ১৪৭ ইনিংসে ব্যাট করে ৪১.৪৪ ব্যাটিং গড়ে ৫,৭১৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তার টেস্ট ক্যারিয়ারে কাকতালীয়ভাবে কয়েকটি মিল রয়েছে। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে নয় ইনিংসে অপরাজিত ছিলেন এবং টেস্টে নয়বার শূন্য রানে সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন। এছাড়া টেস্ট ক্রিকেটে তার শতকের সংখ্যা ১৮টি এবং অর্ধশতকের সংখ্যাও ১৮টি। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ১৮বার নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছে সবকয়টিকে শতকে রূপান্তরিত করেছিলেন।
মাইকেল ভন টেস্ট ক্রিকেটে কখনও নব্বইয়ের ঘরে আউট হননি, তা ঠিক। তবে নব্বই সংখ্যাটিতে তিনি ঠিকই নড়বড়ে ছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে তিনি দুইবার ১৯০-এর ঘরে আউট হয়েছিলেন, দুইবারই ভারতের বিপক্ষে একই সিরিজে। নটিংহ্যামে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ১৯৭ রানে আউট হওয়ার পর দ্য ওভালে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে ১৯৫ রান করে সাজঘরে ফিরেছিলেন তিনি। ভন টেস্ট ক্রিকেটে ১৮টি শতক হাঁকালেও কখনও দ্বিশতক হাঁকাতে পারেননি। ১৯৭ এবং ১৯৫ রানের ইনিংস ছাড়াও তিনি ১৮৩, ১৭৭, ১৬৬ ও ১৫৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। বেশ কয়েকবার ডাবল সেঞ্চুরির খুব কাছে গিয়ে ফিরে আসলেও কখনও নব্বইয়ের ঘরে আউট হননি।
স্যার ইয়ান বোথাম – ১৪টি শতক
ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা কয়েকজন অলরাউন্ডারের তালিকা করলে ইয়ান বোথামের নাম উপরের দিকেই থাকবে। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ৩৩.৫৪ ব্যাটিং গড়ে ৫,২০০ রান করার পাশাপাশি বল হাতে ২৮.৪০ বোলিং গড়ে ৩৮৩ উইকেট শিকার করেছিলেন। তিনি ম্যাচের যেকোনো মুহূর্তে একাই মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। টেস্ট ক্রিকেটে ২৭ বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট এবং চারবার ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করা এই ক্রিকেটার ব্যাট হাতেও লম্বা ইনিংস খেলার সামর্থ্য রাখতেন। টেস্ট ক্রিকেটে তার ১৪টি শতক সেই কথাই বলে।
ইয়ান বোথাম টেস্ট ক্রিকেটে ১৪ বার শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন। শতকও হাঁকিয়েছিলেন ১৪টি। ১৪টি শতকের বিপরীতে অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন ২২টি। কিন্তু কখনও নব্বইয়ের ঘরে সাজঘরে ফিরেননি। ১৪বার নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছে সবকয়টিকে শতকে রূপান্তরিত করেছিলেন। তিনি আশির ঘরেও খুব বেশিবার আউট হননি। টেস্টে ২২টি অর্ধশতকের মধ্যে মাত্র দুইবার আশির ঘরে আউট হয়েছিলেন তিনি।
কার্ল হুপার – ১৩টি শতক
ইয়ান বোথামের মতো কার্ল হুপারেরও টেস্ট ক্রিকেটে শতক এবং শূন্য রানের ইনিংসের সংখ্যা সমান। হুপার টেস্ট ক্রিকেটে ১৩টি শতক হাঁকানোর পাশাপাশি ১৩ বার শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকের দুর্দান্ত এই অলরাউন্ডার টেস্ট ক্রিকেটে ১৩টি শতক হাঁকিয়েছিলেন কখনও নব্বইতে কাটা না পড়ে। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ১৪ বার নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছে ১৩টি শতক হাঁকিয়েছিলেন। বাকি একবার ৯৪ রান করে অপরাজিত ছিলেন। ১৯৯৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে ২৮২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১২৪ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেখান থেকে অপরাজিত ৯৪ রানের ইনিংস খেলে দলকে তিন উইকেটের জয় এনে দিয়েছিলেন হুপার।
কার্ল হুপার টেস্ট ক্রিকেটে ২৭টি অর্ধশতক হাঁকালেও কখনো নব্বইয়ের ঘরে আউট হননি। কার্যকরী এই অলরাউন্ডার ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১০২টি টেস্টে ৩৬.৪৬ ব্যাটিং গড়ে ৫,৭৬২ রান করেছিলেন। এছাড়া বল হাতে ইনিংসে চারবার পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে ১১৪টি উইকেট শিকার করেছিলেন।
নব্বইয়ের ঘরে নড়বড়ে না থাকা ক্রিকেটারদের তালিকায় আরও কিছু নাম যোগ হতে পারতো। যেমন, পাকিস্তানের ইউনিস খান ৩৪ বার নব্বইয়ের ঘরে পৌছে মাত্র একবার শতক হাঁকাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এছাড়া ওয়ালি হ্যামন্ড ২৩ বার নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছে ২২টি শতক হাঁকিয়েছিলেন। মাত্র একবার শতক হাঁকাতে ব্যর্থ হওয়া ক্রিকেটারদের তালিকায় আরও বেশ কিছু পরিচিত মুখ রয়েছে। তাদের মধ্যে উপরের দিকে আছেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন (২২), ডেভিড ওয়ার্নার (২১), চেতেশ্বর পূজারা (১৮), মারাভান আতাপাত্তু (১৬)। বর্তমানে ক্রিকেট খেলছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে নড়বড়ে নব্বইতে আউট না হয়ে সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকিয়েছেন আসাদ শফিক (১২), তারপরের স্থানে থাকা দীনেশ চান্দিমাল এবং ডিন এলগারের শতকের সংখ্যা ১১টি।