আবাহনী লিমিটেডের হয়ে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) কী খেলাটাই না দেখিয়েছিলেন হনুমা বিহারী। প্রাইম দোলেশ্বরের বিপক্ষে ৩৬ বলে ৭টি চার আর ২টি ছক্কার মারে ৬৬ রান তুলেছিলেন। সুপার লিগের সেই ম্যাচ যারা দেখেছেন, অনেক দিন মনে থাকবে ভারতীয় এই ব্যাটসম্যানের কথা। সেই হনুমা বিহারী জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন। ভারতের মূল দলে জায়গা পাওয়ার পর নিজেকে নিয়ে গর্ব করতেই পারেন তিনি।
২৪ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার নিজের অন্ধ্র প্রদেশের ১৯ বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছেন। সর্বশেষ মান্যব প্রসাদ ভারতের টেস্ট দলে অন্ধ্র প্রদেশ থেকে ডাক পেয়েছিলেন। এখন তিনি জাতীয় দলের নির্বাচন কমিটির প্রধান। সেই মান্যবের পর এই হনুমা। তাকে বলা হচ্ছে নতুন ভিভিএস লক্ষ্মণ। হায়দ্রাবাদের এই বাসিন্দাকে নিয়ে সবচেয়ে বড় সনদ দিয়েছেন তার কোচ জন মনোজ। তিনি জানিয়েছেন, হনুমাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সঠিকভাবে সুযোগ করে দেওয়া হলে তিনি হবেন পরবর্তী লক্ষ্মণ।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাকে দলে নেওয়ার মূল কারণ বিহারী ইংলিশ ঘরোয়া লিগে খেলার কারণে মাঠের অবস্থা তার পরিচিত। সেখানে তার পরিসংখ্যানও চোখে পড়ার মতো। মজার ব্যাপার হলো, মাসখানেক আগেও বিহারী জানিয়েছিলেন, এখনই নিজেকে জাতীয় দলের টেস্ট স্কোয়াডের যোগ্য হিসেবে দেখছেন না।
কিন্তু ঘটলো তার উল্টো। জাতীয় দলের নিয়মিত ক্রিকেটারদের ব্যর্থতা তাকে সুযোগ করে দিল দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার। তবে এই ডাক পাওয়ার পর জায়গাটা ধরে রাখা যে সহজ হবে না, সেটা টের পাচ্ছেন এই তরুণ ক্রিকেটার। ইংল্যান্ড সিরিজের শেষ দুই টেস্টে তার নাম আসার পর তিনি বলেছিলেন,
“সত্য বলতে, ভারতীয় দলের দিকে যদি আপনি তাকান। তাহলে বুঝবেন, এই জায়গায় ডাক পাওয়াটাও কঠিন, আর সুযোগ হারানোও অনেক সহজ।”
তিনি আরও বলেছিলেন,
“তবে একটি ব্যাপার আছে। আপনি যদি সুযোগ পেয়ে যান, তাহলে অবশ্যই সুযোগটা নিতে হবে। এটাই একমাত্র ব্যাপার যেটা নিয়ে আমি ভাবছি। আমি জানি সুযোগ আসবে, কিন্তু আমাকে তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সুযোগ নিতে হবে, সফল হতে হবে।”
আলোচিত হনুমা এখন পর্যন্ত ৬৩টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে সংগ্রহ করেছেন ৫,১৪২ রান। রয়েছে ১৫টি সেঞ্চুরি ও ২৪টি হাফ সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ রানের ইনিংস অপরাজিত ৩০২। লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন ৫৬টি। মোট রান ২,২৬৮। সেঞ্চুরি পেয়েছেন ৪টি, হাফ সেঞ্চুরি ১৩টি। এছাড়া ২০ ওভারের টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১,০৯৭ রানের পাশাপাশি ৪টি হাফ সেঞ্চুরি তুলেছেন।
বল হাতেও তোপ দাগার মতো ক্ষমতা আছে হনুমা বিহারীর। ডানহাতি এই অফস্পিনার এখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিয়েছেন ১৯ উইকেট। লিস্ট ‘এ’ ও টি-টোয়েন্টিতে যথাক্রমে ১২ ও ২১ উইকেট নিয়েছেন।
ভিভিএস লক্ষ্মণের সঙ্গে হনুমাকে তুলনা করার মূল কারণ তার ব্যাটিংয়ের ধরণ। ভারতীয় টেস্ট ব্যাটিং ‘জায়ান্ট’ লক্ষ্মণের মতো হনুমাও উইকেটে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাট করতে পছন্দ করেন। সে কারণেই সীমিত ওভারের চেয়ে লম্বা পরিসরের ক্রিকেটে অধিক কার্যকরী তিনি। মজার ব্যাপার হলো, দুজনেই হায়দ্রাবাদের।
লক্ষ্মণের সঙ্গে তুলনা প্রসঙ্গে হনুমা বলেছেন,
“হায়দ্রাবাদ ক্রিকেটের পাশাপাশি ভারতীয় ক্রিকেটে তিনি একজন কিংবদন্তি। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, তার সঙ্গে কয়েকটি ম্যাচ (ঘরোয়া) আমি খেলতে পেরেছি। তিনি এককথায় অসাধারণ। সাহায্য ও পরামর্শ করতে পছন্দ করেন। আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ দলে তাকে মেন্টর হিসেবে পেয়েছি। সেই সময় টি-টোয়েন্টি নিয়ে বেশি আলোচনা হতো। লক্ষণ স্যার সবসময় আমাকে বলতেন অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে ব্যাট করতে এবং নিজের খেলার প্রতি বিশ্বাস রাখতে।”
একনজরে হনুমা বিহারী
হনুমা বিহারী জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার আগেই কেবল প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিজেকে ‘এলিট লিস্ট’ এ নিয়ে গেছেন। সমসাময়িক সব ক্রিকেটারের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সবার উপরে রয়েছেন বিহারী। ৫৯.৪৫ গড় নিয়ে পেছনে ফেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথকেও। এই মুহূর্তে জাতীয় দল থেকে নিষিদ্ধ স্মিথের গড় ৫৭.২৭।
যেভাবে নির্বাচকদের নজরে এলেন হনুমা
সর্বপ্রথম জুনে জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে আসেন হনুমা বিহারী। সেই সময়ে ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে সফরের জন্য চারজন নতুন ক্রিকেটারকে ৫০ ওভারের ও চারদিনের ম্যাচের জন্য ভারত ‘এ’ দলে নেওয়া হয়। সেই সিরিজে জায়গা পেয়েছিলেন হনুমা। শুধু তা-ই নয়, তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে উইন্ডিজ ‘এ’ দলের বিপক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহ করেছিলেন। ছিল ১৪৭ রানের একটি ইনিংস। সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলের বিপক্ষে ব্যাঙ্গালোরে ১৪৮ রানের জয়সূচক ম্যাচ খেলেন হনুমা বিহারী। সর্বশেষ পাঁচটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে হনুমার দুটি হাফ সেঞ্চুরি ও একটি সেঞ্চুরি রয়েছে।
আইপিএল ও ভারত ‘এ’ দল
হনুমা ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) খুব বেশি নিয়মিত ছিলেন না। সর্বশেষ ২০১৫ সালে খেলেছেন। সর্বশেষ মৌসুমগুলোতে তিনি হয় ইংল্যান্ডে ঘরোয়া লিগ খেলেছেন, কখনোবা বাংলাদেশের প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগগুলোতে খেলেছেন। ২০১৪ ও ২০১৫; দুই মৌসুম হনুমা বিহারী খেলেছেন এসেক্সের ফার্স্ট ডিভিশন লিগে হটন সিসির হয়ে। সেখানে তিনি ছয়টি সেঞ্চুরি পান। খেলেছেন শ্রীলঙ্কায়, অন্ধরা দলের হয়ে।
হুনুমা বিহারীর সামর্থ্য
ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ ও ‘এ’ দলের বোলিং কোচ সানাথ কুমার অন্ধ্র প্রদেশেরও কোচ। তাই খুব কাছ থেকে তিনি হুনুমার বেড়ে ওঠা দেখেছেন।
তরুণ এই ক্রিকেটারকে নিয়ে সানাথ বলেছেন,
“উইকেটের দুইদিকেই তার সমান সামর্থ্য রয়েছে। আর ব্যাক ফুটে তার অগাধ ভরসা, সেটা পারেও ভালো। ভালো লেংথে আসা বলগুলোর সঠিক ব্যবহার হনুমা জানে। এটা তাকে আরও বেশি শট খেলার জন্য সময় দেয়। লেংথ সে আসলেও খুব ভালো বোঝে।”
তিনি আরও বলেন,
“সুইং নিয়ে কিভাবে শরীরের খুব কাছ থেকে সোজা খেলা যায়, কঠিন কন্ডিশনে কিভাবে মানিয়ে নিতে হয়; সবকিছু নিয়ে খেটেছেন তিনি। তার শৃঙ্খলা তাকে রান সংগ্রহের পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। হ্যাঁ, অনেক দিক থেকে হয়তো অনেক ক্রিকেটার তাকে ছাড়িয়ে যাবেন, রানের দিক থেকেও ছাড়িয়ে যাবেন। কিন্তু মান নিয়ে যদি কথা হয়, হনুমা থাকবেন সবার উপরে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না বলে মনে হবে। তারপরও সেখানে তার স্ট্রাইক রেট প্রতিনিয়ত উপরের দিকে উঠছে।”
ঘরোয়া লিগে ২০১৭-১৮ মৌসুমে হনুমা বিহারীর আদ্যোপান্ত
রঞ্জি ট্রফিতে ৯৪.০০ গড়ে মোট ৭৫২ রান তুলে ২০১৭-১৮ মৌসুম শেষ করেছেন হনুমা বিহারী। সঙ্গে ছিল ৩০২ রানের অপরাজিত একটি ইনিংস। ওড়িশার বিপক্ষে ওই ইনিংসটি ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি। এছাড়া মার্চে ইরানি কাপে ১৮৩ রানের ইনিংস খেলেছেন। সেটা ছিল উমেশ যাদব, রাজনিশ গুরবানিদের মতো শক্তিশালী পেস আক্রমণের সামনে।
ব্যাটিংয়ে লোয়ার অর্ডারের ব্যাটসম্যান নিয়েও কিভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, এই মৌসুমে তা প্রমাণ করেছেন হনুমা। সাত নম্বরে নেমে জয়ন্ত যাদবের সঙ্গে গড়েছেন ২১৬ রানের জুটি।
‘জুনিয় লেভেল’ ক্রিকেটে হনুমা বিহারী
২০১২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী ভারত দলে ছিলেন হনুমা। শুরুতে অবশ্য ডাক পাননি, মান্নান ভোরার ইনজুরিতে কপাল খুলে যায় তার। তারপরই আইপিএলে ডাক পান তিনি। খেলেন সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে। অফস্পিন বোলিং করেন। আইপিএলে তাকে বল করতে বলা হলে উইকেট নেন টি-টোয়েন্টির বাঘা ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইলের!
ফিচার ইমেজ – ICC Cricket