২০১১ সাল থেকে টেনিস কোর্টে একের পর এক ঝড় তুলে চলেছেন সার্বিয়ান এক যুবক, নাম তার নোভাক জোকোভিচ। ১৯৮৭ সালের ২২ মে সার্বিয়ার বেলগ্রেডের অতি সাধারণ এক পরিবারে তার জন্ম। বাবা স্রাডান ও মা ডায়না সেখানে একটি ফাস্ট ফুড পার্লার চালাতেন। বাবার ছিল ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা। খেলতেনও বেশ ভাল। নোভাকের বাবা সাদান চাইতেন, ছেলেকে নিজের মতো ফুটবলারই বানাবেন। কিন্তু মাত্র ছ’বছর বয়সে ছেলের টেনিস র্যাকেট ধরার নিখুঁত কায়দা দেখে এবং টেনিসের প্রতি ভালবাসা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি।
নোভাকের টেনিসে উৎসাহ দেখে ১৯৯৩ সালে মাত্র ছ’বছর বয়সে তারা তাকে সে দেশের সেরা টেনিস একাডেমিতে নিয়ে যান। এই একাডেমি থেকেই বেরিয়েছিলেন মনিকা সেলেসের মতো বিখ্যাত তারকা। সেই একাডেমির কোচ ছিলেন প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ান টেনিস কিংবদন্তি জেলেনা জেনসিক। ৬ বছর পর্যন্ত জেলেনা জোকোভিচকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। টেনিসের প্রতি জোকোভিচের একাগ্রতা তার কোচকেও মুগ্ধ করেছিল। এক সাক্ষাৎকারে জেলেনা বলেছিলেন, “নোভাক শুধু পরিশ্রমী নয়, অসাধারণ প্রতিভাবানও।”
এই সময় যুগোস্লাভিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের আঁচ লাগে সার্বিয়ার মতো প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলোতে। এই গৃহযুদ্ধের সময় সার্বিয়ার বেলগ্রেডে ব্যাপক বোমাবর্ষণ হয়। জোকোভিচ এবং তার পরিবারকে এই বোমা হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রায় তিন মাস বাড়ির বেসমেন্টেই বেশির ভাগ সময় লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। এই যুদ্ধ জোকোভিচের জীবনে খুব প্রভাব ফেলে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “যুদ্ধের কষ্ট তাকে টেনিস খেলার প্রতি আত্মনিবেদন করতে এবং খেলা চালিয়ে যাওয়ার প্রতি আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করে। ” যুদ্ধের কয়েক বছর পর জেলেনার পরামর্শেই ১৩ বছর বয়সে জোকোভিচকে নিয়ে যাওয়া হয় জার্মানির মিউনিখে অবস্থিত পিলিক একাডেমিতে। এই একাডেমির কোচের দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত কোচ নিকোলা পিলিক। পিলিকও মন্তব্য করেন, “এভাবে খেললে ও বিশ্বসেরা হবেই।”
২০০১ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জোকোভিচের আন্তর্জাতিক টেনিস কোর্টে অভিষেক ঘটে। অভিষেকেই তার ইউরোপ জয়যাত্রা শুরু। ট্রিপল ক্রাউন, অর্থাৎ সিঙ্গেলস, ডাবলস ও টিম কম্পিটিশনে ইউরোপ সেরার খেতাব পায় সার্বিয়ার সেই কিশোর। তারপর বিশ্ব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের একটি দলগত প্রতিযোগিতায় রৌপ্য পদক জিতে নেন । মাত্র ১৬ বছর বয়সে পাঁচটি আইটিএফ টুর্নামেন্ট জেতার কৃতিত্ব অর্জন করেন জোকোভিচ। বিশ্বের জুনিয়র টেনিস খেলোয়াড় র্যাঙ্কিংয়ে তার অবস্থান হয় ৪০তম।
জোকোভিচের এই জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে। পেশাদারি টেনিস জীবনের শুরু ২০০৩ সালে। ২০০৪ এ বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত এটিপি (অ্যাসোসিয়েশন অফ টেনিস প্রফেশনালস) চ্যালেঞ্জার টুর্নামেন্টে জোকোভিচ একজন কোয়ালিফায়ার হিসেবে শুরু করেন এবং সেখানে জয়লাভ করেন। পরের বছর তিনি উইম্বলডনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেন এবং সেখানে তৃতীয় রাউন্ডে পৌঁছান এবং র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ১০০ জনের তালিকায় উঠে আসেন।
২০০৭ সালের ফরাসি ওপেন ও উইম্বলডনের সেমিফাইনালে পৌঁছান। এরপর মন্ট্রিয়লের দ্বিতীয় মাস্টার্স শিরোপা জিতে নেন শীর্ষস্থানীয় ৩ খেলোয়াড় রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও অ্যান্ডি রডিককে পরাজিত করে। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে সার্বিয়ার হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং একক টেনিসে ব্রোঞ্জ পদক জিতেন। প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম জেতেন ২০০৮ এ, অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে, পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র একটি সেট হারেন তিনি। এরপর নানা মাস্টার্স খেতাবসহ গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের একের পর এক রেকর্ড গড়েন তিনি। ২০১০ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সার্বিয়ান জাতীয় দলের হয়ে ডেভিস কাপ ট্রফি জিতে নেন।
২০১১ সাল ছিল তার স্বপ্নের বছর। বছরের শুরু থেকেই যেন স্বপ্নের উড়ানে সওয়ার হয়েছিলেন নোভাক জোকোভিচ। বয়স তখন তার চব্বিশ। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হন। তারপর একে একে দুবাই ওপেন, ইন্ডিয়ান ওয়েলস মাস্টার্স, মায়ামি মাস্টার্স, ইউএস ওপেন, সার্বিয়া ওপেন, মাদ্রিদ ওপেন, রোম মাস্টার্স এবং অবশেষে উইম্বলডন খেতাবটিও নিজের করে নেন। এক বছরে চারটি গ্র্যান্ড স্লাম জেতারও বিরল কৃতিত্ব অর্জন করলেন তিনি। বিশ্বের অল্প কয়েকজন টেনিস তারকারই এই কৃতিত্ব আছে। ২০১১ সালে জোকোভিচ একটানা ৪৩ ম্যাচে জয়লাভ করেন, যা ছিল কোনো টেনিস খেলোয়াড়ের জন্য এক অনন্য রেকর্ড। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে প্রথমবারের মতো এক নম্বর স্থানটি অধিকার করে নেন তিনি। ২০০১ সালে যে ছেলেটির আন্তর্জাতিক টেনিস ক্যারিয়ার শুরু, মাত্র দশ বছরের মাথায় সেই ছেলেটিই টেনিস বিশ্বে শুরু করে দিল নয়া রাজত্ব, ‘জোকার-রাজত্ব’। সার্কিটে অন্য সুপারস্টারদের নকল করার প্রবণতার জন্য এই খেতাব জুটেছে জোকোভিচের।
এসবই তো সাফল্যের খতিয়ান। যে নোভাক ২০০৬ ফরাসি ওপেন ও ২০০৭ উইম্বলডন সেমিফাইনালে মাঝপথে আনফিট হয়ে কোর্ট ছেড়েছিলেন, ২০১০ এ ১৯টি টুর্নামেন্টে খেলে মাত্র দুটোতে চ্যাম্পিয়ন, সেই তিনিই কী করে ফিরে এলেন এই বিধ্বংসী ফর্ম নিয়ে? উত্তরটা বিস্ময়কর, খাদ্যাভ্যাস পাল্টে। ২০১১ সালের শুরুর দিকে জোকোভিচের ট্রেইনার আবিষ্কার করেন, ময়দার লেই জাতীয় খাবারে জোকেভিচের অ্যালার্জি আছে। যে কারণে লম্বা ম্যাচ খেলার সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় বারবার খেই হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। তাই ময়দার খাবার বর্জন আর সুগার ফ্রি খাবার খাওয়া শুরু করতেই সমস্যা উধাও! তারপরই শুরু নোভাক জোকোভিচের স্বপ্নের জয়যাত্রা।
এখন চূড়ান্ত ফর্মে থাকা জোকোভিচের খেলার প্রধান শক্তি শটে প্রচন্ড গতি, অসাধারণ গ্রাউন্ড স্ট্রোক, ভয়ঙ্কর সার্ভিস, বিশেষ করে দুর্দান্ত স্লাইস সার্ভিস। এর সঙ্গে যোগ করা যায় তার চমৎকার অল কোর্ট কভারিং, বরফের মতো ঠান্ডা হার না মানা মানসিকতা আর চূড়ান্ত ফিটনেস। এই ফিটনেস আনতে গিয়ে কম পরিশ্রম করেননি জোকোভিচ। সম্পূর্ণ গ্লুটেন ফ্রি খাওয়া-দাওয়া করেন, কোচ বিখ্যাত প্রাক্তন খেলোয়াড় বরিস বেকারের নির্দেশে প্র্যাকটিস এবং ওয়ার্কআউট করেন। ফলে মেদহীন, চোটহীন শরীরে ফর্মের দিক দিয়ে এখন তিনি অপ্রতিরোধ্য।
২০১১ -২০১৩ সাল পর্যন্ত পরপর তিন বছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন সিঙ্গেলসের শিরোপা জেতেন। ২০১২ এর উইম্বলডনের সেমিফাইনালে এসে রজার ফেদেরারের কাছে হেরে যান। ২০১৩ সালের উইম্বলডনের ফাইনালে এন্ডি মারের কাছে হেরে যান। ইউএস ওপেনে ফাইনালে উঠলেও হেরে যান রাফায়েল নাদালের কাছে।
২০১৪ সালে জোকোভিচ সাতবারের চ্যাম্পিয়ন রজার ফেদেরারকে হারিয়ে তার দ্বিতীয় উইম্বলডন শিরোপা জিতে নেন। এটি ছিল তার সপ্তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোনাম। ২০১৪ সালের ইউএস ওপেনে জোকোভিচ অ্যান্ডি মারেকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে পৌঁছান, কিন্তু সেমিফাইনালে জাপানের কেই নিশিকোরির কাছে পরাজিত হন।
২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক ম্যাচে এন্ডি মারেকে পরাজিত করে পঞ্চমবারের মতো এবং ক্যারিয়ারের অষ্টম গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা জয় করেন। ঐ বছরেই ফরাসি ওপেনে নয়বারের চ্যাম্পিয়ন রাফায়েল নাদালকে পরাজিত করে ফাইনালে উঠলেও স্ট্যান ওয়ারিঙ্কার কাছে পরাজিত হয়ে শিরোপা হাতছাড়া করেন।
২০১৭ পযন্ত তার টেনিস ক্যারিয়ারে জোকোভিচ ৬৮টি বিভিন্ন টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতেন, যার মধ্যে ১২ বার গ্র্যান্ড স্লাম খেতাব রয়েছে। এই ১২ বার গ্র্যান্ড স্লামের মধ্যে উইম্বলডন জিতেছেন ৩ বার, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ৬ বার, ইউএস ওপেন ২ বার এবং ফ্রেঞ্চ ওপেন ১ বার।
টেনিস সার্কিটে গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান তার কথাকে সমর্থনও করে। তার তিন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও অ্যান্ডি মারের সঙ্গে তার ম্যাচের সাক্ষাতে জোকোভিচের জয় ও পরাজয়ের হিসেব যথাক্রমে ২৩-২২, ২৬-২৪ এবং ২৫-১১। অর্থাৎ সবার থেকে তিনি এগিয়ে। এবারের ফ্রেঞ্চ ওপেনে হারের পর অ্যান্ডি মারে তাই হতাশ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “কোর্টে ও তো ভুলই করে না। আর ওর যা ফর্ম ওকে হারানোই মুশকিল।”
এগিয়ে তিনি আরো অনেক বিষয়ে। সহ-খেলোয়াড়দের চমৎকার অনুকরণ করেন তিনি, তাই সার্কিটে তাকে ‘জোকার’ নামে ডাকা হয়। ভাষা শেখাতেও তিনি মাস্টার। মাতৃভাষা সার্বিয়ান ছাড়া জানেন ইংরেজি, জার্মান ও ইতালীয় ভাষা। জোকোভিচের আগ্রহ আছে আরো অনেক বিষয়ে। স্কি এবং ফুটবল জোকোভিচের অন্য দুই প্রিয় খেলা। এসি মিলান তার প্রিয় ক্লাব, খেতে ভালবাসেন পিৎজা, ক্ল্যাসিকাল গানেরও ভক্ত তিনি।
মন্টি কার্লোয় থাকেন নোভাক। সঙ্গে আছেন একসময়ে তার স্কুল জীবনের বান্ধবী, বর্তমানে স্ত্রী জেলেনা ও দুই বছরের পুত্র স্তেফান। যখন সার্কিটে খেলেন না, তখন ছেলের সঙ্গে খেলাই তার প্রধান কাজ। বর্তমানে ইনজুরি থেকে কবে তার টেনিস কোর্টে প্রত্যাবর্তন হবে সেই অপেক্ষায় সারা টেনিস বিশ্ব ও তার ভক্তকূল।
ফিচার ইমেজ- Sky Sports