যেকোনো কাজই প্রথমে শুরু করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি কাজ শুরু করার সময়েই অনেক কসরতের প্রয়োজন হতে পারে। অন্যান্য জায়গার মতো ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও শুরুটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাদেই আছে, ‘প্রভাত সারা দিনের পূর্বাভাস দেয়’।
উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানদের কাজ হচ্ছে শুরুর পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। দিনের শুরুতে উইকেটে আর্দ্রতা থাকতে পারে, তখন বোলিংয়েক রকম হয়। রান করার চাইতে টিকে থাকাটাই সেই মূহুর্তে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার শুধু টিকে থাকলেই চলবে না, দলের চাহিদা অনুযায়ী তাকে রানটাও করে যেতে হবে। শুরুর ব্যাটসম্যানের অবস্থা বুঝে পরের ব্যাটসম্যানরা উইকেট কিংবা পরিস্থিতি বোঝার কিছুটা সুযোগ পায়। কিন্তু উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানদের জন্য সেই সুযোগ নেই। এ কারণেই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানরা সাধারণত দলের সেরা ব্যাটসম্যানদের মাঝে একজন হয়ে থাকেন এবং অবশ্যই দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়।
অন্যদিকে একজন উদ্বোধনী বোলারের ভূমিকাও কিন্তু কম না। জড়তায় থাকা ব্যাটসম্যানদের শুরুতেই আউট করে ফেলতে পারলে দলের লাভ। আর যদি আউট করতে না পারে, তাহলে ব্যাটসম্যান সেট হয়ে গেলে পরের বোলাররাও সুবিধা কম করতে পারে। কাজেই একজন উদ্বোধনী বোলারও সাধারণ দলের অন্যতম সেরা এবং গুরুত্বপূর্ণ বোলার হন।
ক্রিকেটে একজন অলরাউন্ডারের ভূমিকা নিয়ে নতুনভাবে কিছু বলার নেই। অলরাউন্ডার দলের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং দলের জন্য সবদিক থেকে সম্ভাব্য সুযোগ বাড়িয়ে দেয়।
তবে কোনো খেলোয়াড় যদি এমন হন, যিনি কিনা দলের পক্ষে বোলিংয়ের সময় উদ্বোধনী বোলিং করছেন এবং ব্যাটিংয়ের সময় উদ্বোধনী ব্যাটিংও করছেন, তাহলে দলে তার গুরুত্বটা কেমন, সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন কয়েকজন খেলোয়াড়ের কীর্তি নিয়েই আজকের লেখায় আলোচনা করা হবে।
মজার বিষয় হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ম্যাচেই এমন একজন খেলোয়াড়কে খুঁজে পাওয়া যায়। অ্যালেন হিল নামের সেই ভদ্রলোক ইংল্যান্ডের পক্ষে প্রথম টেস্টে খেলেছিলেন, ওপেনিংয়ে বোলিংও করেছিলেন। তবে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করেছিলেন ৯ নম্বরে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার কোনো হাফ সেঞ্চুরিও না থাকাটা প্রমাণ করে যে, তিনি ব্যাটসম্যান হিসেবে খুব আহামরি ছিলেন না।
কিন্তু ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং ব্যর্থতা আর তার ৪৭ বলে ৩৫ রানের ইনিংসের জন্য ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট দ্বিতীয় ইনিংসেই তাকে ওপেনিংয়ে নামিয়ে দেয়। কিন্তু সেই ইনিংসে মাত্র দ্বিতীয় বলেই শূন্য রানে আউট হয়ে হিল প্রমাণ করেন, প্রথম ইনিংসে তার ব্যাটিংটা আসলে ‘ফ্লুক’ই ছিল!
এরপরেও আরও অনেক খেলোয়াড় এই কাজটি করেছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, আপাদমস্তক ব্যাটসম্যান হয়েও হয়তো কোনো বিশেষ কারণে একজন বোলিংয়ে ওপেন করেছেন। সুনীল গাভাস্কার সর্বকালের সেরা ওপেনার ব্যাটসম্যানদের খুব সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকবেন। সেই গাভাস্কারও ক্যারিয়ারে চারবার একই ম্যাচে একসাথে বোলিং এবং ব্যাটিংয়ের সূচনা করেছেন। তবে প্রথমবার তিনি শুধু এক ওভার বোলিং করেছিলেন।
আবার অনেক সময় কোনো বোলার হয়তোবা দিনের শেষ সময়টুকু কাটানোর জন্য ব্যাটিংয়ে নেমে গেছেন। কিন্তু তারা সবসময় এই কাজটা করতেন না। খুব কম খেলোয়াড়ই আছেন, যারা কিনা প্রায় সময়েই দলের প্রয়োজনে একই ম্যাচে দুটো কাজই করতেন।
মনোজ প্রভাকর
মনোজ প্রভাকর ছিলেন একজন ভারতীয় অলরাউন্ডার। ক্যারিয়ারে মাত্র ৩৯টি টেস্ট খেলেছিলেন তিনি, এর মাঝে ৬৮টি ইনিংসেই ওপেনিংয়ে বোলিং করেছেন। মজার বিষয় হচ্ছে, ওপেনিংয়ে ব্যাটিংও করেছেন ৩০টি ইনিংসে। দুটো কাজই একসাথে করেছেন এমন ম্যাচের সংখ্যা ২০টি। একজন খেলোয়াড়ের জন্য এটিই সবচেয়ে বেশি বার এই কীর্তি করার রেকর্ড।
এছাড়া প্রভাকর ওয়ানডে ম্যাচেও সবচেয়ে বেশিবার এই কীর্তিটি করেছেন। ক্যারিয়ারের ১৩০ ম্যাচের ১২৭ ইনিংসে বোলিং করেছেন, সবসময়েই ওপেনিংয়ে। ব্যাটিং করেছেন ৯৮টি ইনিংসে, এর মাঝে ৪৬টিতেই ওপেনিংয়ে নেমেছেন। দুটো কাজই এক সাথে করেছেন এমন ম্যাচের সংখ্যা ৪৪টি।
এম এল জয়সীমা
হায়দারাবাদের ক্রিকেটার জয়সীমা একজন স্বভাবজাত স্ট্রোকমেকার ছিলেন, সাথে পার্টটাইম অফ ব্রেক বোলিংটাও চালিয়ে নিতেন। ভারতের পক্ষে ৩৯ টেস্টে ৩টি সেঞ্চুরি করা এই ব্যাটসম্যানের ৯টি টেস্ট উইকেটও আছে। ভারতের হয়ে ১৪টি টেস্ট ম্যাচে তিনি একইসাথে ব্যাটিং আর বোলিংয়ে ওপেন করেছেন। অনেক হায়দারাবাদী ক্রিকেটারের অনুপ্রেরণা ছিলেন জয়সীমা, যার মাঝে অন্যতম হচ্ছেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, যিনি কিনা পরবর্তীতে ভারতের অধিনায়ক হয়েছিলেন।
মোহাম্মদ হাফিজ
বাঁহাতিদের বিপক্ষে বোলিংয়ে খুবই কার্যকর ছিলেন মোহাম্মদ হাফিজ। মূলত পাওয়ার প্লেতে বোলিং করে রান আটকানোর কাজটা করতেন তিনি। তবে একটা সময়ে বোলিং অ্যাকশনে সমস্যা হওয়ার কারণে বোলিংয়ে সাময়িক বিরতি দিতে হয়। ফেরত আসার পর আর সেভাবে বোলিংয়ে সফলতা আসেনি। ব্যাটিংয়ে টেস্ট আর ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই সেঞ্চুরি আছে তার। টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই সংস্করণেই একাধিকবার একই ম্যাচে ব্যাটিং আর বোলিংয়ে ওপেন করেছেন করেছেন হাফিজ।
নেইল জনসন
তিনি প্রথম ক্রিকেটার, যিনি কিনা বোলিংয়ে ওপেন করে ২ উইকেট পাওয়ার পর ব্যাটিংয়েও ওপেন করে ১৩২ রানের ইনিংস খেলেছেন। দল হেরে যাবার পরেও সব্যসাচী ভূমিকার কারণে ম্যান অব দি ম্যাচের পুরস্কার অর্জন করে নিয়েছেন তিনি সে ম্যাচে।
জিম্বাবুয়ের এই ক্রিকেটার ওয়ানডেতে মোট ২৫ বার এই কাজটি করেছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে যে, সেই সময়ের জিম্বাবুয়ের জন্য তিনি কতটা অপরিহার্য ছিলেন।
তিলকারত্নে দিলশান
শ্রীলঙ্কান এই হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান একটা সময় লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন। ১৩টি ওয়ানডেতে তিনি একই সাথে ব্যাটিং-বোলিং দুটোতেই ওপেন করেছেন। নেইল জনসনের পর তিনি দ্বিতীয় খেলোয়াড়, যিনি কিনা একই ম্যাচে বোলিং করে আবার সেঞ্চুরিও করেছেন। ১০ ওভারের বোলিং কোটা পূর্ণ করার পর এক ম্যাচে দিলশান সেঞ্চুরি করেন।
এই তালিকায় বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় নেই। মোহাম্মদ রফিক ক্যারিয়ারে আটবার ব্যাটিংয়ে ওপেন করেছেন, এর মাঝে কেনিয়ার বিপক্ষে ৭৭ রানের একটি ইনিংস খেলে দেশকে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ জয়ের স্বাদ পাইয়ে দেন, সাথে সাথে ম্যান অব দি ম্যাচও হন। আবার ওপেনিংয়ে একবার বোলিং করার কীর্তিও তার আছে। কিন্তু দুটো একসাথে কখনোই করা হয়নি তার।
তবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কযুক্ত একজন মানুষকে এই তালিকায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। লোকটি হাথুরুসিংহে, বাংলাদেশের সদ্য সাবেক কোচ। ক্যারিয়ারে দুটো ওয়ানডেতে তিনি এই কাজটি করেছিলেন। এছাড়া দুটো টেস্টেও তিনি এই কীর্তি করেন।
মূল ব্যাটসম্যানদের মাঝে ওয়ানডেতে মার্ক ওয়াহ এবং শেওয়াগের ব্যাটিং-বোলিংয়ে ওপেন করার কৃতিত্ব আছে। এছাড়া অলরাউন্ডারদের মাঝে কপিল দেব, ক্রিস কেয়ার্নস এবং ইয়ান বোথামের মতো অলরাউন্ডারদেরও এই কীর্তি রয়েছে।
ফিচার ইমেজ: YouTube