আজকের দুনিয়ায় ছুটছে সবাই, দৌড়াচ্ছে প্রাণপণ। আর তুমি যদি সেই দৌড়ে তাল মেলাতে ব্যর্থ হও অন্যদের সঙ্গে, পিছিয়ে পড়বে তাহলে। এগিয়ে যেতে হলে ছুটতে তোমাকে হবেই। দম ফেলার ফুরসত নেই। ছোটো, দৌড়াও, থেমো না একদম।
যাপিত জীবনের পথ পরিক্রমায় এই ছোটাছোটি ঠিক না বেঠিক, তা সমাজ পর্যবেক্ষকরা ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু ক্রিকেট মাঠে যে এটাই ঠিক, সেই জ্ঞানের জন্য ‘বিশেষজ্ঞ’ হওয়ার প্রয়োজন বিশেষ নেই। ক্রিকেট ক্লাসে সদ্য ভর্তি নেওয়া প্রথম শ্রেণির পেছনের বেঞ্চির ছাত্রটিও জানেন, দৌড়ই এখানে টিকে থাকার মূল। বাইশ গজের পুরোটা জুড়ে এই প্রান্ত থেকে সেই প্রান্ত দৌড় করে যেতে হয়। এই দৌড়ের খেলায় যার কাবিলিয়াত যত বেশি, তিনি বা সেই দলের জন্যেই তত বেশি বিজয়ের পুষ্পমাল্য বরাদ্দ থাকে।
ক্রিকেট রানের খেলা, ক্রিকেট দৌড়ের খেলা।
রানিং বিটুইন দ্য উইকেট
রানিং বিটুইন দ্য উইকেটের সহজ অর্থ ‘দুই উইকেটের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়’। অর্থাৎ, ক্রিকেট পিচের এই প্রান্ত থেকে সেই প্রান্ত দৌড়াতে হবে। না দৌড়েও ক্রিকেটে স্কোরবোর্ড সচল রাখা যায়, রান করা যায়। আপনি যদি ক্রিস গেইল হন, আন্দ্রে রাসেল হন, তাহলে দৌড়ঝাঁপ নিতান্তই ঐচ্ছিক মনে হবে আপনার। দুই-চারটে বল ঠেঙিয়ে মাঠের বাইরে পাঠানো গেলেই কর্ম সারা, তারপর কিছু বল পেট ভরে খান, সমস্যা নেই; ক্রিকেটের ভাষায় যাকে ‘ডট বল’ বলে। আধুনিক ক্রিকেটে এই ‘ডট বল’ কী পরিমাণ দলের বোঝা হতে পারে, তা অকল্পনীয়।
আপনার যদি গেইল-রাসেলের মতো পেশিশক্তি বা ম্যাক্সওয়েল-হার্দিকের মতো কবজির অমানুষিক জোর না থাকে, তাহলে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটই ভরসা। হার্দিক-ম্যাক্সওয়েল বা ডি ভিলিয়ার্সরাও কিন্তু রানিং বিটুইন দ্য উইকেটেও অসম্ভব ভালো। একদম সাম্প্রতিক একটা কেইস স্টাডি যদি করি আমরা, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হার্দিক পান্ডিয়ার ৭৬ বলে ৯২ রানের ইনিংসে মোটে ১টি ছয় ও ৭টি চার। তার মানে বাকি ৬৮ বল থেকে ৫৮ রান নিয়েছেন তিনি দৌড়ে। শতাংশের হিসাবে যা দাঁড়ায় ৮৫ শতাংশেরও বেশি। তার মানে, কোনো বাউন্ডারি ছাড়াই এই লোক আশি শতাংশেরও বেশি স্ট্রাইক রাখতে সক্ষম!
অথচ একসময় ‘রানিং বিটুইন দ্য উইকেট’ ছিল কিঞ্চিৎ অপমানকর। যারা স্ট্রোকমেকিংয়ে খুব একটা পারদর্শী নন, ফিল্ডার ফাঁকি দিয়ে সীমানা-দড়ি খুঁজে নিতে সমর্থ নন, তারাই বেছে নেন ‘টুক টুক সিঙ্গেল’। কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে থাকা মধ্যবিত্ত যেন তারা! ক্রিকেটের ভাষায় যদি বলা হয়, ‘মিডিওকার’ ব্যাটসম্যানদেরই সম্বল দৌড়ে দৌড়ে রান।
তবে সেই অবস্থা বদলে গেছে পুরোটাই। আজকের দুনিয়ায় সে-ই তত ভালো ব্যাটসম্যান, যে যত বেশি স্ট্রাইক রোটেট করতে পারেন, প্রান্ত বদলাতে পারেন।
উইকেটের দুইপাশ জুড়ে দৌড়ের যৌক্তিকতা
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সামান্যতম খবর রাখা ব্যক্তিমাত্রই জানেন, তামিম ইকবাল এই পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ ওপেনার। সাম্প্রতিককালে তার পরিসংখ্যানও বেশ ভালো, নিয়মিত রান করছেন, হৃষ্টপুষ্ট গড়ও লক্ষণীয়। অথচ কান পাতলেই শোনা যায় ‘তামিম হটাও’ স্লোগান। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নাকি আজকাল দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবাল ‘আর চলেন না’। এর কারণ কী?
কারণ হলো — তামিম ইকবাল রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে তেমন একটা পারদর্শী নন। আজকাল যেখানে টেস্ট ক্রিকেটেও ‘চুরি’ করে সিঙ্গেল নিতে চায় ক্রিকেটাররা, সুযোগ পেলেই ‘দুই’ নিতে চায়, সেখানে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তো রীতিমতো সিঙ্গেল-ডাবলসের জন্য তৎপর থাকা লাগে। এই সময়ে যিনি যত ভালো ব্যাটসম্যান হয়েছেন, তিনি তত বেশি উইকেটের দুইপাশ জুড়ে দৌড়-কর্মে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। আপনি যতই ‘ক্লিন হিটার’ হোন, পেশিশক্তি যতই থাক আপনার, কবজি বা মাসলে যত জোরই দেখান না কেন, রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে আপনাকে দক্ষ হতেই হবে।
কেন হতে হবে এমন? কী এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব? যৌক্তিকতাই বা কী? আসুন দেখা যাক।
আপনি যখন তৎপর হবেন রানের জন্য, দৌড় করবেন উইকেটের এই প্রান্ত থেকে সেই প্রান্তে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্কোরবোর্ড সচল থাকবে আপনার। স্কোরবোর্ড নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাতে হবে না আপনার। আপনি দেখবেন স্বচ্ছন্দ্যে ওভারপ্রতি আপনার প্রয়োজনীয় রান উঠে আসছে। প্রতিপক্ষের ফিল্ডাররা থাকবে চাপে, রান থামানোর উপায় না পেয়ে বোলার ভুল করবে, লুজ ডেলিভারি দেবে, বাউন্ডারি বের করা সহজ হবে আপনার জন্য। প্রতিপক্ষের অধিনায়কের নির্ভার হওয়ার উপায় থাকবে না, একের পর এক প্ল্যান বদলাতে হবে তার। ওভারে যখন কমপক্ষে চার-পাঁচবার প্রান্ত বদল হবে, স্কোরবোর্ডে যেমন কোনো চাপ অনুভূত হয় না, ঠিক তেমনি প্রচন্ড চাপে খেই হারিয়ে ফেলে ফিল্ডিং দল। বেড়ে যায় লুজ ডেলিভারির সংখ্যা, সহজ হয় বাউন্ডারি পাওয়া। তাছাড়া ব্যাটসম্যান সেট হতেও খুব কার্যকর রানিং বিটুইন দ্য উইকেট।
কেইস স্টাডি ০১
বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কা। রণগিরি ডাম্বুলা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। ২৫শে মার্চ, ২০১৭। সফররত বাংলাদেশ তিন ম্যাচের দ্বিপাক্ষিক সিরিজের প্রথমটিতে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি। পঞ্চম ওভারে সৌম্য সরকার আউট হয়ে গেলে ক্রিজে আসেন সাব্বির রহমান। সেই ম্যাচে তার প্রথম ছয়টি স্কোরিং শটই ছিল বাউন্ডারি। কুড়ি বলে করেছিলেন ২৪ রান। সাব্বির পরে ৫৪ রান করে বিদায় নেন, তার পিছু পিছু মুশফিকুর রহিমও আউট হয়ে গেলে ক্রিজে আসেন সাকিব আল হাসান। তিনি প্রথম ২৪ বল থেকে রান করেন কুড়ি, যেখানে একটিও চার ছিল না। সেই ম্যাচে সাকিব পঞ্চাশ পেরোনো পর্যন্ত বাউন্ডারি মেরেছিলেন মোটে একটি, আর সাব্বিরের ইনিংসে ছিল ১০টি চার। স্কোরকার্ড বলছে ১০ চারে সাব্বির ৫৬ বলে করেছিলেন ৫৪ রান, বিপরীতে সাকিব ৪ চার ও ১ ছয়ে আউট হওয়ার আগে জমা দিয়েছিলেন ৭১ বলে ৭২ রান। অর্থাৎ, সে ম্যাচে ৬৬ বলে ৫০ বা প্রায় ৮৩ শতাংশ রান সাকিব দৌড়ে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে সাব্বির বাকি ৪৬ বল থেকে ১৪ বা ২১ শতাংশের কিছু বেশি রান জমা দিয়েছিলেন বাউন্ডারি ছাড়াই। ফলে সাকিবের সময়ে তামিম-সাকিব জুটিকে যেরকম সাবলীল মনে হয়েছিল, সাব্বিরের সময়ে তামিম-সাব্বিরকে জুটিকে মনে হয়নি তা। সেবার সাব্বির আউটও হয়েছিলেন ঐ চাপে পড়ে, বাউন্ডারি বের করা না গেলে স্কোরবোর্ড সচল করা যাচ্ছে না, প্রতিপক্ষ তখন আটকে দিল বাউন্ডারির পথ; আপনি যেহেতু রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে স্বচ্ছন্দ্য নন, সুতরাং হাঁসফাঁস আপনি করবেনই।
এই হাঁসফাঁস বা অস্বস্তি থেকে বাঁচতে এবং স্কোরবোর্ড সহজেই সচল রাখতে রানিং বিটুইন দ্য উইকেট এত গুরুত্বপূর্ণ।
চেজিংয়ের অন্যতম মূলমন্ত্র
লক্ষ্যটা যত বড় চূড়াই হোক, আপনি যখন চেজ করবেন, ঝড়ের গতিতে চলে আপনার মস্তিষ্ক। প্রতিনিয়ত যোগ-বিয়োগ নানান সমীকরণ খেলা করে সেখানে। ওভারপ্রতি যদি শুরুতেই ছয়ের বেশি প্রয়োজন তখনও যেমন রানিং বিটুইন দ্য উইকেট অর্থবহ, ঠিক তেমনি আস্কিং রেট ছয়ের নিচে থাকলেও সমান গুরুত্ব বহন করে। প্রতি ওভারে চার-ছয় হাঁকানো যেমন সহজ নয়, তেমনি সিঙ্গেল বের করা বা প্রান্তবদলও সহজ নয়। তবে বাউন্ডারির ক্ষেত্রে যে ঝুঁকি থাকে, প্রান্তবদলে সে সম্ভাবনা কম। এবং বাউন্ডারি হাঁকানো যত কঠিন, প্রান্তবদল সহজ না হলেও তেমন কঠিন নয়। যদি কেউ শারীরিক ফিটনেস, বিচক্ষণতা ও স্কিলের সমন্বয়ে নিজেকে শাণিত করে নিতে পারে, তাহলে প্রান্তবদল আসলে খুব সহজ একটি বিজ্ঞান। কিন্তু এই সহজ বিজ্ঞানের সঙ্গে নিজেকে মানানসই করে নিতে হলে ব্যক্তির নিবেদন ও দক্ষতা বৃদ্ধির আন্তরিক আগ্রহ থাকা প্রয়োজন।
চেজিংয়ের অন্যতম কার্যকর একটি ধারা হলো প্রান্ত বদল। দেড়কে দুই, পৌনে একের মতো কিছু একটাকে এক, ফিল্ডারের ন্যানোসেকেন্ডের মিসফিল্ডের সুযোগে আরো একটি রান বাড়িয়ে নেওয়া, এইরকম ব্যাপারগুলো চেজিয়েং গুরুত্বপূর্ণ। প্রান্তবদলের ফলে প্রতিপক্ষের উপর যে চাপ সৃষ্টি করা হয়, যে পরিমাণ টেনশন দেয়া যায়, তা আর কোনোভাবে সম্ভব নয়। আমরা কয়েকটা কেইস স্টাডি করলে হয়তো আরো ভালোভাবে ব্যাপারটা বুঝতে পারবো।
কেইস স্টাডি ০২
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম স্মরণীয় দু’টি রান তাড়া আমরা আলোচনায় তুলতে পারি আজ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টন্টনে, ২০১৯ বিশ্বকাপ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেয়া ৩২২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশের সূচনা দারুণ হলেও টপাটপ ক’টি উইকেট হারিয়ে ৩ উইকেটে ১৩৩ রানে পরিণত হয় বাংলাদেশ। একপ্রান্তে তখন সাকিব আল হাসান আর অন্যপ্রান্তে লিটন দাস। দু’জনই রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে চমৎকার। পরের প্রায় দুই ঘন্টায় সাকিব-লিটন স্কোরবোর্ডে জুড়লেন ১৮৯ রান। সাকিবের ৯৯ বলে ১২৪ রানের ইনিংসে ১৬টি চার থাকলেও বাকি ৮৩ বল থেকে ৭২ শতাংশ হারে দৌড়ে রান নিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে লিটন দাস ‘মোনালিসা’ এঁকেছেন সত্যি, তবে ৬৭ শতাংশ হারে দৌড়ে রান করেছেন।
ফলে রান তাড়া অনেকটা সহজ হয়ে বসে। সন্দেহ নেই, তারা বাউন্ডারি মেরেছেন প্রচুর, তবে শুধুই বাউন্ডারির উপর ভর দিয়ে ইনিংস সাজাননি। সেখানে প্রান্তও বদল করেছেন বহুবার। ফলে জয়টা আরো বেশি সহজ ও নান্দনিক হয়েছে।
একইভাবে আরেকটি স্মরণীয় জয়ের আলাপ পাড়তে পারি আমরা। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে কার্ডিফে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০১৭। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক ঐতিহাসিক রান-চেজ। নিউ জিল্যান্ডের দেয়া ২৬৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশের টপ অর্ডার হাওয়া শুরুতেই; ৩৩ রানে নেই ৪ উইকেট। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও সাকিব আল হাসান ২২৪ রানের অবিস্মরণীয় এক পার্টনারশিপে পাড়ি দিলেন আপাত অসম্ভব মনে হওয়া এক দুর্লঙ্ঘ্য চূড়া, যেখানে দু’জনই প্রায় ষাট শতাংশ রান নিয়েছেন দৌড়ে; অর্থাৎ ১০ বলে ৬ রান। এটা স্ট্যান্ডার্ড না হলেও মন্দ নয়, এই হারে কেউ এগুলে অন্তত আশি স্ট্রাইকরেটে রান করতে পারেন বা পারবেন। যদিও সাকিব-রিয়াদ দু’জনই প্রায় একশোর কাছাকাছি স্ট্রাইকরেটে রান করেছিলেন সেবার। তবে প্রতি ১০ বলে ৭ বা সত্তর স্ট্রাইকরেটকে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে আদর্শ ভাবা যায়।
তাহলে বাকি বলগুলোতে বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারি দিয়ে অনায়াসে পুষিয়ে দেয়া যায় ঘাটতিটা।
রানিং বিটুইন দ্য উইকেটের কিছু মৌলিক ধারা
আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম আবশ্যক বনে যাওয়া এই অনুষঙ্গটিতে যারা ‘পাকা খেলোয়াড়’ হওয়ার অভিপ্রায় রাখেন, একান্ত আগ্রহ ও নিঃসীম মনসংযোগে ওস্তাদ হয়ে উঠতে চান, এখানটায় তাদের কিছু ব্যাপার মাথায় রাখা প্রয়োজন:
-
সঙ্গীকে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করা। অপর প্রান্তের সঙ্গী যখনই ‘কল’ দেবেন, তখনই সাড়া দেয়া — বিশেষ করে যেটা সঙ্গীর কল। দ্বিধা-সংশয় রাখা চলবে না কিছুতেই। হয় দৌড়াও, নয় দাঁড়াও।
-
ইয়েস, নো, ওয়েট। সাধারণত এই তিনটে পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। যদি রান হবে মনে হয়, তাহলে ‘ইয়েস’ নয়তো ‘নো’, আর যদি ফিল্ডারের অবস্থান বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে কয়েক সেকেন্ড দরকার পড়ে, তখন ‘ওয়েট’ — তার মানে, রান হতেও পারে এই যাত্রায়।
-
উইকেটের পেছনে মানে ব্যাটসম্যানের পেছনে বল গেলে তা সঙ্গীর কল, চোখ বন্ধ করে সাড়া দিতে হবে। আর যদি সামনের দিকে বল যায়, সেক্ষেত্রে সেটা ব্যাটসম্যান-কল; অন্য প্রান্তের সঙ্গী তখন নিশ্চিন্তে ব্যাটসম্যানের আহ্বানে সাড়া দেবেন।
-
প্রথম রানের বেলায় খুব দ্রুত ছুটতে হবে। দৌড়ের খেলায় দৌড়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কত দ্রুত ছোটা হচ্ছে, সেটার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। ছোটার গতি বাড়াতে ফিটনেস স্কিল নিয়ে কাজ করা যায়। যদি দুই-এক সেকেন্ডও গতি বাড়িয়ে নেয়া যায়, দিনশেষে দেখা যাবে ‘পার্থক্য’ গড়ে দিচ্ছে সেটাই।
-
ফিল্ডার-বিচার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। কোনো ফিল্ডারের গতি কেমন, নিশানা কেমন, সেটা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ক্ষিপ্রগতির ফিল্ডার আর কিঞ্চিৎ দুর্বল বা আলসে ফিল্ডার নিশ্চয় একই মানদণ্ডে বিচার হবে না!
কেইস স্টাডি ০৩
সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান হচ্ছেন ভিরাট কোহলি। তাকে বলা হয় চেজ-মাস্টার। আধুনিক ক্রিকেটের রান তাড়াকে অন্য উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন তিনি।
কেপটাউন, ২০১৮। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজের তৃতীয় ওডিআই ম্যাচে কোহলি করেন ১৫৯ বলে অপরাজিত ১৬০ রান, যেখানে তিনি দু’টি ছয় ও ১২টি চার মারেন; অর্থাৎ তিনি ঠিক একশো রান করেন দৌড়ে, শতাংশ হিসেবে প্রায় ৬৯ রান! বাউন্ডারি ছাড়াই রান সংগ্রহের ক্ষেত্রে এটা একদিনের ক্রিকেটে পঞ্চম সর্বোচ্চ। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ইউএইর বিপক্ষে গ্যারি কারেস্টেনের ১৮৮ রানের মধ্যে ১১২ রান ছিল বাউন্ডারি ছাড়াই, সেটাই তালিকায় সবচেয়ে উপরের দিকে আছে।
চেজিংয়ে অনেক অনেক কিংবদন্তির জন্ম দিয়েছেন কোহলি। তন্মধ্যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোবার্টে অপরাজিত ১৩৩ ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ঢাকার মিরপুরে ১৮৩ ইনিংস দু’টিকে আমরা আলোচনার জন্য রাখতে পারি। পৃথিবীর দুই প্রান্তে ভিন্ন দু’টি সিরিজে ভিন্ন দু’টি কন্ডিশন ও আবহে ভিন্ন দুই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মাত্র সপ্তাহ তিনেকে ব্যবধানে এই দুটি মাস্টারক্লাস বা রূপকথা লেখেন ভিরাট কোহলি।
হোবার্টে ভারতের টার্গেট ছিল ৩২১, ৪০ ওভারের মধ্যে করতে হবে তা। কোহলির গ্রেটনেসে ভর দিয়ে ভারত কুড়ি বল হাতে রেখেই উৎরে যায় সেই চ্যালেঞ্জ। ৮৬ বলে ১৩৩ রান করেন ‘কিং’ কোহলি। ১৬টি চার ও দুটি ছয় ছিল ইনিংসে। বাকি ৬৮ বল থেকে ৫৭ রান নিয়েছেন দৌড়ে, প্রায় ৮৩ শতাংশ! পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটাতে করেছিলেন ১৪৮ বলে ১৮৩ রান, ২২টি চার ও ১টি ছয়। ৩৩০ রানের লক্ষ্যে ‘শূন্য’ রানেই উইকেট হারানো ভারতকে একাই কক্ষপথে রেখেছিলেন কোহলি। ১২৫ বল থেকে ৮৯ বা ৭১ শতাংশ রান দৌড়ে নিয়েছিলেন সেবার।
প্রতিনিয়ত প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে ও স্কোরবোর্ড সচল রাখতে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটের বিকল্প নেই।
অবতরণিকা
আধুনিক সময়ের এই দ্রুতলয়ের ক্রিকেটে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে উন্নতির বিকল্প নেই। স্কিল, মানসিকতা ও শারীরিক ফিটনেস বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে তড়িৎ ছোটাছুটির প্রয়োজনীয়তাও। ভগ্নাংশের হেরফেরে বেঁচে যেতে পারে কেউ, অথবা ঘটে যেতে পারে সম্ভাবনাময় ইনিংসের অপমৃত্যু। নিজেকে আরো শাণিত, আরো ক্ষুরধার, আরো পরিণত, আরো ‘ভালো’ প্রমাণ করতে হলে প্রান্তবদলের এই বিজ্ঞানে মনোযোগ বাড়াতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে। ক্রমাগত অনুশীলন ও দীক্ষার মাধ্যমে পরিশীলিত ও ত্রুটিমুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে নিজেকে। তবেই ছোঁয়া যাবে শ্রেষ্ঠত্বের ঐ শিখর-উচ্চতা।