উয়েফা তাদের বর্ষসেরা ১০ জন খেলোয়াড়ের নাম ঘোষণা করলেও প্রথম তিনে কারা থাকছেন তা অজানাই রেখে দিয়েছে। তবে এটা প্রমাণিত যে, সেরা তিনে নেই লিওনেল মেসি। চতুর্থ স্থানেও নেই তিনি, ৫৫ পয়েন্ট নিয়ে ৫ম স্থানে এবার ঠাঁই হয়েছে তার। উয়েফা বর্ষসেরার তালিকা শেষ তিনে লিওনেল মেসির নামটি না থাকা অদ্ভুত হলেও অবাক হবার মতো কোনো ঘটনা কিন্তু নয়। এর আগেও মেসি ছাড়াই উয়েফা বর্ষসেরা পুরস্কারের সেরা তিনজনের নাম ঘোষণা করেছে।
এবারও তার সেরা তিনে না থাকার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। রোনালদো, মদ্রিচ বা সালাহ যা করেছেন, মেসি পুরো মৌসুমে দারুণ উজ্জীবিত থাকলেও তাদের স্তরে যেতে পারেননি। প্রতি বছর পরিচিত নাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ছাড়াও মদ্রিচ ও সালাহ থাকার কারণে অনেক সমর্থকের এবার আগ্রহ বেশি এ পুরস্কার নিয়ে। তাই আজ উয়েফার বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের নাম ঘোষণার আগে, কে উয়েফা বর্ষসেরার খেতাব জেতার দৌড়ে এগিয়ে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
প্রথমে, মোহাম্মদ সালাহ। মিশরীয় এ উইংগার রোমা থেকে লিভারপুলে এসেছিলেন গত মৌসুমেই। কিন্তু প্রথম মৌসুমেই তিনি এভাবে জ্বলে উঠবেন, তা কে জানতো! তিনি কোনো তারকা খেলোয়াড় নন, অন্তত গত মৌসুমে ছিলেন না। কিন্তু পুরো বিশ্বের কাছে তিনি তার নাম পরিচিত করেছেন মাঠের পারফর্মেন্স দিয়ে। প্রিমিয়ার লিগে গোলের রেকর্ড ভেঙে এক মৌসুমের ৩৬ ম্যাচে তিনি করেছেন ৩২ গোল ও ১০ অ্যাসিস্ট। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছিলো তার দল লিভারপুল। লিভারপুলকে ফাইনালে ওঠাতেও সালাহ যথেষ্ট সহায়তা করেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৩ ম্যাচে ১০ গোল ও ৪ অ্যাসিস্ট আছে তার নামের পাশে। আফ্রিকা কাপ অফ ন্যাশন্সের ফাইনালেও নিয়ে গিয়েছিলেন তার দেশ মিশরকে। কিন্তু এরপরও তিনি মদ্রিচ ও রোনালদোর থেকে এক ধাপ পিছিয়ে থাকবেন।
কোনো বর্ষসেরা পুরস্কারের ঘোষণার সময় একজন খেলোয়াড়ের ঐ মৌসুমের একক সফলতাকে সেভাবে দেখা হয় না। সালাহ গোল করেছেন, প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, তার দলও ভালো খেলেছে, কিন্তু মৌসুম শেষে কোনো ট্রফি জিততে পারেনি লিভারপুল। তাই দারুণ একটি মৌসুম পার করার পরও সালাহর ঝুলি ট্রফিশূন্য। আর কোনো খেলোয়াড়ের একক সফলতা ও দলের ট্রফির পরিমাণ যদি ওজন করা হয়, তবে ট্রফি সংখ্যাই এগিয়ে থাকবে। মোহাম্মদ সালাহর সেই শিরোপার ওজন নেই, যেটা মৌসুম শেষে মদ্রিচ ও রোনালদোর আছে। তাই বাকি দুজন থেকে আপাতদৃষ্টিতে উয়েফা বর্ষসেরা পুরস্কারের দৌড়ে মোহাম্মদ সালাহ কিছুটা পিছিয়ে থাকবেন। যদিও সেরা খেলোয়াড়ের মুকুট মুখ্য নয়, উয়েফা বর্ষসেরা তালিকায় সেরা তিনে নাম থাকাই তার ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় সফলতা।
সালাহকে সরিয়ে মদ্রিচ ও রোনালদোকে নিয়ে ভাবলে বোঝা সম্ভব, তাদের ভেতর যুদ্ধটা বেশ শক্তই হবে। কারণ একই ক্লাবের সদস্য হবার কারণে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গেছে। তাই মদ্রিচ ও রোনালদোকে নিয়ে আলোচনার পূর্বে তাদের গত মৌসুমের পরিসংখ্যান এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন রোনালদো। চ্যাম্পিয়নস লিগে করেছেন সর্বোচ্চ ১৫ গোল। ক্লাবের হয়ে গত মৌসুমে জিতেছেন ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপও। এছাড়াও রাশিয়া বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচে ৪ গোল, লা লিগায় ২৭ ম্যাচে ২৬ গোল ও ৫ অ্যাসিস্ট আছে। এমনকি পর্তুগালের হয়েও দারুণ ফর্মে ছিলেন তিনি।
বিপরীতে মদ্রিচও জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। তিনি মধ্যমাঠের খেলোয়াড়, তাই গোলের হিসাব করার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। যদিও তার বড় সাফল্য বিশ্বকাপ। ক্রোয়েশিয়ার জার্সিতে বিশ্বকাপে দারুণ খেলেছিলেন তিনি। ৭ ম্যাচে ২ গোল ও ১টি অ্যাসিস্টের পাশাপাশি ক্রোয়েশিয়াকে বিশ্বকাপ ফাইনাল তোলার পেছনে তার ভূমিকা অসামান্য। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছেন তিনিই।
তাই রোনালদো ও মদ্রিচের তুলনায় গেলে গত বিশ্বকাপের বছরের হিসাব নিকাশও সামনে চলে আসে। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে একক দক্ষতায় আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছিলেন লিওনেল মেসি। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিলো রিয়াল মাদ্রিদ এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় হবার পরও লিওনেল মেসি কিন্তু সেবার উয়েফা সেরার পুরস্কার ঘরে তুলতে পারেননি। এক উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা ও সেখানে নজরকাড়া ব্যক্তিগত সাফল্যের উপর ভর করে ঠিকই ইউরোপ সেরা হয়েছিলেন রোনালদো। তবে সেই বছরের ঘটনা থেকে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। রোনালদো জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। মদ্রিচও মেসির মতোই, কিন্তু নিজ দক্ষতায় তার দলকে বিশ্বকাপ ফাইনালে তুলেছেন ও সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। তবে পার্থক্য হলো- মদ্রিচও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা ক্লাবের সদস্য।
তাই ইউরোপ সেরার ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে সেই চ্যাম্পিয়নস লিগের কথাই চলে আসছে। মদ্রিচ রিয়াল মাদ্রিদের মধ্যমাঠের খেলোয়াড়। গোলের সুযোগ তৈরি ও মধ্যমাঠের কাজগুলো করাই তার দায়িত্ব। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে গত মৌসুমে খুব একটা অ্যাসিস্ট তিনি পাননি। তাছাড়া মধ্যমাঠের কারুকাজ খুব নিপুণ না হলে তা পুরস্কারের আসরে তেমন নজরে আসে না, যেখানে অন্য একজন অতিমানবীয় পারফর্মেন্সের পাশাপাশি গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন।
পুরো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মৌসুমে রোনালদো ১৫টি গোল করেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগের একটি মৌসুমে ১৫ গোল কিন্তু সচারচর স্বাভাবিক ঘটনা নয়। তাছাড়া এই ১৫ গোলের উপর ভর করেই রিয়াল মাদ্রিদ শিরোপা জেতার কাছে দ্রুত পৌঁছে গেছে। তাই অপ্রিয় হলেও সত্য, মদ্রিচের একটি মাত্র গোলের পাশাপাশি মধ্যমাঠের অবদান ও রোনালদোর অতিমানবীয় পারফর্মেন্স একই পাল্লায় মাপা সম্ভব না। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এখানে একধাপ এগিয়ে থাকবেন লুকা মদ্রিচের তুলনায়।
উয়েফা এ পুরস্কার দেওয়া শুরু করার পর থেকে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জিতেছেন ৫ বার। মিডফিল্ডার হয়ে এ পর্যন্ত একবারই এ পুরস্কার জিতেছেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। যদিও সেই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিলো চেলসি। কিন্তু ইনিয়েস্তা ছিলেন ইউরোজয়ী দলের সদস্য। আর স্পেনের জেতার পেছনের নায়ক ছিলেন এই আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। বার্সেলোনা চ্যাম্পিয়নস লিগে তেমন সুবিধা না করতে পারলেও বাকি সব লিগ ও প্রতিযোগিতায় আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা পার করছিলেন তার ক্যারিয়ারের রঙিন সময়। তাই সে বছরের ইউরোপ সেরার খেতাব তার প্রাপ্য ছিলো।
এর পরের মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখ বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর উয়েফার বর্ষসেরার পুরস্কার জেতেন ফ্রাঙ্ক রিবেরি। তাই শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় নয়, জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা জেতাও উয়েফার কাছে প্রাধান্য পায়। কিন্তু লুকা মদ্রিচের কাছে আছে শুধুমাত্র চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা ক্লাবে থাকার কৃতিত্ব। আর রোনালদো? চ্যাম্পিয়নস লিগ রিয়াল মাদ্রিদকে পাইয়ে দিতে করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ১৫ গোল!
হয়তো লুকা মদ্রিচের ইউরোপ সেরার পুরস্কার প্রাপ্য। কিন্তু তার জন্য রোনালদোকে টক্কর দিয়ে প্রথম হওয়া কিছুটা দুস্করই। তবে ইউরোপ সেরার মুকুট মদ্রিচ যদি জিতে যান, সেখানেও অবাক হবার অবকাশ থাকবে না। কারণ ৮০ জন ইউরোপিয়ান কোচ আর ৫০ জন সাংবাদিকের চিন্তা-ভাবনা তো আর বোঝা সম্ভব নয়। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের বিগত বছরগুলোর রেকর্ড ও মূল্যায়নের মাত্রা দেখে এটা ধারণা করা যায় যে, “চ্যাম্পিয়নস লিগের সেরা যিনি, ইউরোপও সেরা তিনি” নীতি মেনে এবারের ইউরোপ সেরার নাম ঘোষণা করার সম্ভাবনাই বেশি।
ফিচার ইমেজ: Metrotvonline.com