ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যেহেতু হিসেব-নিকেশ, তাই সবার প্রথমে ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডেই নজর দেওয়া যাক। ক্রিকেটবিশ্বের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট ওডিআই বিশ্বকাপের সর্বশেষ আসর বসেছিল ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের মাটিতে। ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ওডিআই বিশ্বকাপের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়েছে ‘থ্রি লায়ন্স’। কিন্তু ইতিহাস তৈরির দিনে ক্রিকেট নিয়ে বেশ উদাসীন ছিলেন ইংলিশরা। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি, ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালও ইংল্যান্ডের জনসাধারণের মধ্যে খুব বেশি উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারেনি।
ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো সম্প্রচার করেছে ‘চ্যানেল ফোর’ ও ‘স্কাই স্পোর্টস’। ২০০৫ সাল থেকে ইংল্যান্ডের সকল ম্যাচ সম্প্রচার করে আসছে স্কাই স্পোর্টস। কিন্তু এবার বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে ইংল্যান্ডের সকল ম্যাচ সম্প্রচারের সত্ত্ব পায় চ্যানেল ফোর। স্কাই স্পোর্টসের পে-সার্ভিসের বিপরীতে চ্যানেল ফোরে খেলা দেখার সু্বিধা ছিল পুরোপুরি ফ্রি। কিন্তু তাতেও ইংলিশরা ক্রিকেটের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি।
ফাইনালে ইংল্যান্ড বনাম নিউ জিল্যান্ডের ম্যাচটিতে পুরো ম্যাচজুড়ে চ্যানেল ফোরের গড় দর্শক ছিল ৪.৫ মিলিয়ন। তবে ফাইনালের সুপার ওভারে দর্শকসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় আট মিলিয়নে। একই দিনে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল উইম্বলডনের ফাইনাল। রজার ফেদেরার ও নোভাক জোকোভিচের সেই রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের সাক্ষী হয়েছিলেন প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন ইংলিশ। যদিও এই ম্যাচে তাদের দেশের কোনো খেলোয়াড় প্রতিনিধিত্ব করছিলেন না। তবু উইম্বলডন ফাইনাল নিয়ে ইংল্যান্ডের ক্রীড়াপ্রেমীদের আগ্রহের কোনো কমতি ছিল না।
তবে ক্রিকেট শুধুমাত্র উইম্বলডনের কাছে হারেনি৷ সেদিন ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ ফাইনালের চেয়ে বেশি দর্শক ছিল ‘ব্রিটিশ গ্র্যান্ড পিক্স’ ও ‘বিবিসি ওয়ান’ এর। বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন ইংল্যান্ডে বিবিসি ওয়ান অনুষ্ঠানের গড় টিভি দর্শক ছিল ৬ মিলিয়ন৷ অন্যদিকে, গ্র্যান্ড পিক্সের সম্প্রচারের জন্য বিকালের দিকে বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচটি চ্যানেল ফোর থেকে ‘মোর ফোর’ চ্যানেলে সরিয়ে নেওয়া হয়, যার ফলে টিভি দর্শক বেশ কমে যায়। তবে এই পরিসংখ্যানে অনলাইন সম্প্রচার এবং বিভিন্ন হোটেল বা কোনো পাবে বসে খেলা দেখা দর্শকদের বিবেচনা করা হয়নি।
ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কমেছে ভারতেও
ভারতের মানুষের কাছে ক্রিকেট যেন এক বিশেষ ধর্ম, যার আরাধনা প্রায় সবাই করেন। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মার্কেটও ভারত। একইসাথে, আইসিসির সর্বোচ্চ আয়ের উৎসও আমাদের প্রতিবেশী এই দেশটি। কিন্তু আজকাল অনেক ভারতীয়কেই ক্রিকেট আর টানে না। বিশেষ করে, ২০১৪ সাল থেকে ভারতে ‘ইন্ডিয়ান সুপার লিগ’ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকেই ফুটবলের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।
ভারতের ফুটবলের জনপ্রিয়তা কত দ্রুত বাড়ছে, সেটি গত বছরের ফুটবল বিশ্বকাপের একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখে নেওয়া যাক। রাশিয়া বিশ্বকাপকে ঘিরে ভারতে উত্তেজনা ছিল অনেক বেশি। শহরের বার থেকে শুরু করে গ্রামের চায়ের দোকানগুলোতেও ছিল উপচে পড়া ভীড়। গত বছর ফুটবল বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো সম্প্রচারের দায়িত্বে ছিল সনি পিকচার্স নেটওয়ার্ক। তাদের মতে, ব্রাজিল বিশ্বকাপের তুলনায় রাশিয়া বিশ্বকাপে ভারতে টিভি দর্শক প্রায় ১২৫ শতাংশ বেশি ছিল, সংখ্যার হিসেবে যা প্রায় ১৯২.৭ মিলিয়ন।
ভারত ফুটবল বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখছে, যার জন্য তাদের ফুটবল ফেডারেশন বেশ তোড়জোড় শুরু করেছে। সাফল্যের দেখাও মিলেছে। ফিফা র্যাঙ্কিংয়েও ভারতের বেশ উন্নতি ঘটেছে। তারা বর্তমানে র্যাঙ্কিংয়ের ১০৩তম দল। সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবলে ভারতের এই সাফল্য ক্রিকেটের জোয়ার কিছুটা হ্রাস করেছে। ভারতের অনেক স্কুলে এখন ক্রিকেট ছেড়ে ফুটবলের চর্চা অধিক মাত্রায় হচ্ছে।
ভারতের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। মাঝবয়সী এবং বৃদ্ধ ভারতীয়রা ক্লাসিক ক্রিকেট দেখতে পছন্দ করতেন। শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা অবসর নেওয়ার পর মাঝবয়সীদের কাছে ক্রিকেটের আবেদন অনেকটাই কমে গেছে, যার প্রভাব ভারতের সামগ্রিক ক্রিকেট বাজারের উপরে পড়েছে।
বর্তমানে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে উপমহাদেশের মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে, যার ফলে ৮ ঘণ্টা ব্যয় করে এখন ওডিআই ম্যাচ দেখার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। এছাড়া তরুণ যারা রয়েছেন, তাদের বিনোদনের জন্য নানা রকমের ব্যবস্থা রয়েছে। এসব কারণে এখনকার ভারতীয় তরুণরাও ধীরে ধীরে ক্রিকেটবিমুখ হয়ে উঠছে। এসবের বাইরেও ভারতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার কমার কারণ হলো, অন্যান্য খেলাগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি। ফুটবল, হকি, টেনিস, কাবাডি ও ব্যাডমিন্টনের জনপ্রিয়তা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যার ফলে ভারতে প্রতিনিয়ত ক্রিকেটপ্রেমীর সংখ্যা কমছে।
বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কতটুকু?
আইসিসি দাবি করে থাকে, বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ফুটবলের পরই ক্রিকেটের অবস্থান। কিন্তু এটি আইসিসির চরম এক মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়৷ সত্যিকার অর্থে, জনপ্রিয়তার দিক থেকে ফুটবলের পরের অবস্থানেই রয়েছে বাস্কেটবল। শুধুমাত্র ইংল্যান্ডে প্রতি সপ্তাহে যতগুলো বাস্কেটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, ক্রিকেট তার তুলনায় অনেক কম। বাস্কেটবলের জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকায় নয়, অস্ট্রেলিয়া-চীন-ভারতেও বেশ জনপ্রিয়।
‘নিয়েলসন স্পোর্টস’ নামে একটি মার্কেটিং এজেন্সি বিশ্বের জনপ্রিয় খেলাগুলো নিয়ে মাঠ পর্যায়ে একটি জরিপ করেছিল। তাদের সেই জরিপে ক্রিকেটের অবস্থান ১৪তম। যারা জরিপে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মাত্র ১৯ শতাংশ বলেছেন, তারা ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহী বা খুবই আগ্রহী। বিপরীতে ফুটবল ও বাস্কেটবলের কথা বলেছেন যথাক্রমে ৪৬ ও ৩৬ শতাংশ। যদিও এই জরিপটি ক্রিকেটপ্রধান দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে করা হয়নি।
নিয়েলসন স্পোর্টসের জরিপে ক্রিকেট ১৪তম অবস্থান গ্রহণ করলেও সত্যিকার অর্থে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা এত কম নয়। তবে বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট ও সদস্যসংখ্যার হিসেবে ক্রিকেটের অবস্থান একেবারেই সুবিধাজনক নয়। জনপ্রিয়তার দিক থেকে রাগবি বিশ্বকাপেরও পরে ক্রিকেট। আবার সদস্যাসংখ্যার দিক থেকে আইসিসির অবস্থান চতুর্থ। রাগবি ইউনিয়নের সদস্যসংখ্যা আইসিসির চেয়ে মাত্র দুই কম।
জনসংখ্যার হিসেবে ক্রিকেটের ভক্তসংখ্যা অনেক বেশি। শুধুমাত্র উপমহাদেশেই ২০০ কোটির বেশি মানুষ ক্রিকেট দেখেন। কিন্তু একটি খেলার জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র গুটিকতক দেশের জনসংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নয়, যেখানে এক ভারতেরই জনসংখ্যা ১৩০ কোটির অধিক। একটি খেলার জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হলো, কতটি দেশ এই খেলায় অংশগ্রহণ করছে, সদস্য দেশগুলোতে প্রভাব কেমন, বিশ্বজুড়ে কেমন আলোচনা হয়, সেসব। এই সবগুলো সূচকেই ক্রিকেটের অবস্থান শক্তপোক্ত নয়। আইসিসির সদস্য সংখ্যা ১০৫টি হলেও বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে মাত্র ১০-১২টি দেশ। এ থেকেই বোঝা যায়, বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার মতো পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন দল সৃষ্টি পারেনি আইসিসি।
ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কেন বাড়ছে না?
অলিম্পিকে ক্রিকেটকে অন্তুর্ভুক্ত না করা জনপ্রিয়তা না বাড়ার অন্যতম কারণ। অলিম্পিকে ক্রিকেট থাকা মানেই বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশের সামনে এই খেলাকে তুলে ধরার সুযোগ। একই সাথে পদকের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার দেশগুলো ক্রিকেটকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করবে। আর যখন এই দেশগুলো যখন ক্রিকেটের দিকে নজর দেবে, তখন ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা দ্রুতগতিতে বাড়বে। কিন্তু আইসিসি ক্রিকেটকে অলিম্পিকে যুক্ত করার বিষয়ে আগ্রহী নয়, বলতে গেলে বেশ উদাসীন। অবশ্য এর পেছনে বড় কারণ ভারত। তারা চায় না, ক্রিকেট অলিম্পিকে যুক্ত হোক।
বিশ্বজুড়ে ফুটবলের আধিপত্যের বড় কারণ হলো, সহজ নিয়ম। এছাড়া ফুটবলের উপকরণগুলো সহজলভ্য ও সুলভ মূল্যের, সেই হিসেবে ক্রিকেট যোজন যোজন দূরে। কারণ ক্রিকেটের জটিল নিয়ম, সেই সাথে একসাথে অনেকগুলো উপকরণ। ধনী গরিব সকলেই ফুটবল খেলার সামর্থ্য রাখেন, কিন্তু ক্রিকেটে সেটা সম্ভব নয়। ক্রিকেট খেলার জন্য বেশ অর্থও ব্যয় করতে হয়, যা গরিব দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য বিলাসিতা।
বর্তমান সময়ে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই ব্যস্ত, যার কারণে খেলাধুলার প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে গেছে। ২০১৫ সালে মাইক্রোসফটের করা এক জরিপ বলছে, খেলাধুলার প্রতি একজন মানুষ গড়ে মাত্র ৮ সেকেন্ড মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন, ২০০০ সালে যা ছিল ১২ সেকেন্ড। মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য অনেক ক্রীড়াসংস্থা পেশাদার ম্যাচগুলোর সময় কমিয়ে আনছে। ক্রিকেটেও সংক্ষিপ্ত ফরম্যাট চালু হয়েছে, কিন্তু একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দেখতে ৩ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়। সেই সময় কি একজন মানুষের আদৌ আছে?
ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কীভাবে বাড়ানো সম্ভব?
১৯৯৪ বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হিসেবে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নাম ঘোষণা করা হয়, অনেকের চোখে ফিফার এই সিদ্ধান্ত ছিল ভুল ও বিতর্কিত৷ কেননা, তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে ফুটবল তখন মৃত্যুপথযাত্রী। ফুটবলের জনপ্রিয়তা নেই বললেই চলে। সেখান থেকে ফুটবল থেকে মানুষের পছন্দের তালিকায় আনার জন্য বড় কোনো চমকের প্রয়োজন ছিল। আর সে উদ্দেশ্যেই সেখানে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ শুধুমাত্র উত্তর আমেরিকা নয়, পুরো বিশ্বেই ফুটবলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
এই উদাহরণ দেওয়ার পেছনে একটি কারণ আছে। ফুটবল যেখানে জনপ্রিয় নয়, ফিফা সেখানে বিশ্বকাপ আয়োজন করে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছে৷ বিপরীতে, আইসিসি ঘুরেফিরে তিন-চারটি দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করে থাকে, যার ফলে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন হচ্ছে না। বিশ্বের অনেক মানুষ ক্রিকেট সম্পর্কে জানতেও পারছে না। আইসিসি চাইলে ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের অন্য কোনো দেশেও বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারে৷ পর্যটকের জন্য যেকোনো দেশ সে অনুমতি প্রদান করবে। প্রয়োজন কেবল কিছু অবকাঠামো। সেই বাধা টপকে যদি আইসিসি একবার বৃত্তের বাইরে বিশ্বকাপ আয়োজন করে, তাহলেই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে।
শুধুমাত্র প্রথম সারির দলগুলোর মধ্যে স্বাগতিক ও অ্যাওয়ে ভিত্তিতে সিরিজ আয়োজন না করে তৃতীয় কোনো দেশেও সিরিজ আয়োজন করা যেতে পারে। যেমন, হংকং কিংবা চীনে, অথবা নেদারল্যান্ডে অনায়াসে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সিরিজ আয়োজন করা যেতে পারে। এতে দুই দল আর্থিকভাবে কম লাভবান হলেও আইসিসির জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে। এছাড়া, ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক দলগুলোও বিভিন্ন দেশ সফর করতে পারে। যেমন, ইউরোপের বিভিন্ন ফুটবল ক্লাব প্রাক-মৌসুমে বিভিন্ন দেশ সফর করে থাকে। একই কাজ আইপিএল, বিপিএল অথবা বিগ ব্যাশের দলগুলো করতে পারে।
ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ হলো, অলিম্পিকে অন্তুর্ভুক্তি। আইসিসি যদি সদিচ্ছার সাথে চেষ্টা করে, তাহলে ক্রিকেটকে অলিম্পিকে সংযুক্ত করা সম্ভব। ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য অলিম্পিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটি সম্ভব হলে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইসিসির আয়ের উৎস বাড়বে।
ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কি হুমকির মুখে?
ক্রিকেটের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। এর মধ্যে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। আইসিসিও ভারতের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কিন্তু কখনো যদি ভারতীয়রা ক্রিকেটের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? যদি এই আশঙ্কা সত্যি হয়, তাহলে ক্রিকেট অর্থনীতি একেবারে হুমকির মুখে পড়ে যাবে। ভারত যেভাবে ফুটবলের পেছনে উঠেপড়ে লেগেছে, তাতে করে খুব শীঘ্রই হয়তো বিশ্বকাপে জায়গা করে নেবে। আর সেটা হলে ভারতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামবে। ছোট হয়ে আসবে ক্রিকেটের মার্কেট, কমে যাবে আয়ের উৎস। যার প্রভাব পুরো ক্রিকেটবিশ্বেই পড়বে।
ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে ক্রিকেট বিমুখতার মূল কারণ তাদের ব্যস্ততা। তাদের তুলনায় উপমহাদেশের মানুষের ব্যস্ততা কম। সে কারণে এই অঞ্চলে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বেশি। কিন্তু দিন দিন উপমহাদেশে মানুষের ব্যস্ততা যেভাবে বাড়ছে, এতে একদিন এই অঞ্চলেও ক্রিকেট দেখার মানুষ থাকবে কি না, সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাই আগে থেকেই আইসিসির সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের গুরুত্ব কতটুকু?
আইসিসির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির দিক থেকে সবার উপরে রয়েছে বাংলাদেশ। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিগত দুই দশকে ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর দিকে আলোকপাত করলেই এই সত্য প্রতীয়মান হবে। উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ক্রিকেট নব্বইয়ের দশক থেকেই জনপ্রিয়৷ সেখানে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির বিষয়টি তাই তেমন আলোচ্য নয়। বরং কতটুকু হ্রাস হচ্ছে, সেটাই দেখার বিষয়।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পথচলা প্রায় ১৯ বছরের। তবে বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেছনে বড় অবদান রেখেছে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ এবং ২০১৩ সালের নিউ জিল্যান্ড সিরিজ। কিউইদের দেশের মাটিতে দেশের হোয়াইটওয়াশ করার পর বিশ্বে যেমন টাইগারা নিজেদের জানান দিতে থাকে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর সেই দৃশ্যপট আরো বদলে যায়। দেশের পরিচয়ের বড় এক মাধ্যম হয়ে ওঠে ক্রিকেট।
ক্রিকেটের এই জনপ্রিয়তার কারণে দেশে বড় এক মার্কেট তৈরি হয়েছে। কর্পোরেট হাউসগুলো তাদের প্রচারণার জন্য ক্রিকেটকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে৷ সেই সাথে আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, যার ফলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যাচের সম্প্রচারসত্ত্ব কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। যদি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা, নিজ দেশে আধিপত্য ও অর্থনীতিকে বিবেচনা করা হয়, তাহলে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য তাহলে বাংলাদেশ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? পাকিস্তানে ক্রিকেট জনপ্রিয়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু দেশের মাটিতে ম্যাচ আয়োজন করতে না পারায় পিসিবির আয়-রোজগার বেশ কমে গেছে। অন্যদিকে, যদি ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কথা বিবেচনা করা হয়, তাহলে সেখানে ক্রিকেট ক্রমেই তার মার্কেট হারাচ্ছে। কেননা, এই দু’টি দেশে ক্রিকেটের বাইরেও আরো অনেক জনপ্রিয় খেলা রয়েছে, যেমন ফুটবল ও রাগবি। নিউ জিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও রাগবি অনেক জনপ্রিয়। আর শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা কম, তাই মার্কেটও ছোট।
আইসিসি যদি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার অধঃপতন হ্রাস করতে চায় এবং আয় বৃদ্ধি করতে চায়, তাহলে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে ক্রিকেটকে আরো জনপ্রিয় করার জন্য বিসিবির সাথে সম্মিলিতভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা৷ ভারতে ফুটবলের উত্থান ঘটলেও বাংলাদেশের ফুটবল মৃতপ্রায়। ফুটবলের জনপ্রিয়তা রয়েছে, কিন্তু ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষে আগামী এক বা দুই দশকে ক্রিকেটকে পেছনে ফেলা দুষ্কর। তাই বাংলাদেশে ক্রিকেট আরো দুই থেকে তিন দশক একক আধিপত্য চালিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। তাই ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশ হবে আইসিসির ট্রাম্পকার্ড। এখন দেখার বিষয়, আইসিসি সেটা কতটুকু উপলব্ধি করতে পারে।