স্লাতান ইব্রাহিমোভিচ তখন একদম নবাগত। খেলছেন দারুণ। তরুণ এই সুইডিশের দিকে চোখ পড়লো দক্ষ জহুরি আর্সেনাল ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গারের। তরুণ ফুটবলারদের গড়ে তোলায় ওয়েঙ্গারের জুড়ি মেলা ভার। যেকোনো তরুণ ফুটবলারেরই ইচ্ছে থাকে এমন একজনের হাতে তার ক্যারিয়ারের পথ রচিত হোক। ইব্রাহিমোভিচও সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এলেন লন্ডনে। ওয়েঙ্গার বললেন তাকে পরখ করা হবে, তাই তিনি যেন ‘অডিশন’-এর জন্য প্রস্তুত হন। তখন মোটামুটি অজ্ঞাতকুলশীল ইব্রা ওয়েঙ্গারের মুখের উপর বলে দেন, “স্লাতান কখনো ‘অডিশন’ দেয় না!”
এরই নাম স্লাতান ইব্রাহিমোভিচ। ফুটবল বিশ্বে অতি-পরিচিত এক নাম। ২০০০ সালের পরে যেসব স্ট্রাইকার মাঠ কাঁপিয়েছেন তাদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য। ইব্রার জীবন নিয়ে রোর বাংলায় পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। আজকে দেখে নেয়া যাক মাঠের বাইরে মাইক্রোফোনের সামনের ইব্রাহিমোভিচকে।
ইব্রা স্টাইল
ইব্রার খেলার ধরন নিয়ে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, তার খেলা কোন ধাঁচের? সুইডিশ নাকি যুগোস্লাভিয়ান? ইব্রা সপাটে উত্তর দেন, “আমি যে স্টাইলে খেলি এর আলাদা নামই হওয়া উচিত, ইব্রা স্টাইল!”
ক্যারেওর জন্য করুণা
জন ক্যারেও ইব্রাকে নিয়ে একবার বলেছিলেন, বল পায়ে ইব্রার অধিকাংশ কারিকুরিই ভিত্তিহীন, কোনো কাজে আসে না। ইব্রা সহজে ছেড়ে দেননি। এমন এক জবাব দিলেন, যাতে বেচারা ক্যারেওর জন্য করুণাই হবে! ইব্রা বলেন, “ক্যারেও বল পায়ে যা করে, আমি তা একটা কমলালেবু দিয়েই করতে পারি!”
স্তেফানেকে হট ডগ কিনতে পাঠানো
লিভারপুলের বিপক্ষে এক ম্যাচে লিভারপুল ডিফেন্ডার স্তেফানেকে ইনসাইড-আউটে দারুণভাবে ছিটকে ফেলেন ইব্রা। ম্যাচের পর এ নিয়ে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন, “আমি প্রথম বামে গেলাম, সে-ও গেল। এরপর আমি ডানে গেলাম, সে-ও গেল। এরপর আমি যখন আবার বামে গেলাম, ও তখন হটডগ কিনতে দোকানে গেল!”
ইব্রার চেয়ে বড় উপহার আর কী?
ইব্রার সাথে তার বান্ধবীর বাগদানের পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তার প্রেয়সীকে তিনি কী উপহার দিয়েছেন? ইব্রা জবাব দেন, “কী? উপহার? সে ইব্রাকে পেয়েছে, এর চেয়ে বড় উপহার আর কী হতে পারে?”
ইব্রা যখন ফুটবল ঈশ্বর!
২০১৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের একপর্যায়ে সুইডেনের সাথে পর্তুগালের প্লে-অফ খেলা হয়। যেকোনো একটি দল যাবে বিশ্বকাপে। সে সময় ইব্রাকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন, “কে জিতবে এই লড়াইয়ে?”
ইব্রা বলেন, “ঈশ্বর জানেন।”
সাংবাদিক পাল্টা বলেন, “ঈশ্বরকে কোথায় পাব?”
ইব্রাও ঝটপট বলে দেন, “আপনি তাঁর সাথেই কথা বলছেন!”
ভ্যান ডার ভার্টকে চোখা জবাব
ভ্যান ডার ভার্ট ইব্রারই সতীর্থ ছিলেন আয়াক্সে। জাতীয় দলের হয়ে এক ম্যাচে দুই ক্লাব সতীর্থ একে অপরের বিরুদ্ধে খেলছিলেন। সে ম্যাচে ভার্ট ইনজুরিতে পড়েন আর সেই ট্যাকেলের সময় ইব্রাও তাঁর গায়ে লেগে ছিলেন। ম্যাচ শেষে ভার্ট বলেন যে, ইব্রা নাকি ইচ্ছা করেই ট্যাকেল করেছেব তাঁকে। ইব্রা রাগ সামলাতে পারেননি। তিনি প্রেসে এসে বলেন, “ইব্রা যদি চাইত তবে সোজা হাড় ভেঙে দিত!”
ভীতি সঞ্চার করতে ডাকনাম লাগে না!
ইব্রা তখন পিএসজিতে। ফরাসি লিগে পিএসজির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তখন মোনাকো। মোনাকোতে খেলেন আরেক মাঠকাঁপানো স্ট্রাইকার রাদামেল ফ্যালকাও, যার ডাক নাম ‘এল তাইগ্রে’ বা ‘বাঘ’। ইব্রা এ নিয়ে প্রেসে নাম না করে ফ্যালকাওকে বিঁধেন দারুণভাবে। বলেন, “আমাকে ভয় পাওয়ার জন্য আমার কোনো ডাকনামের দরকার হয় না, শুধু আমার খেলা দেখলেই হবে, এমনিই ভয় চলে আসবে।”
ইব্রা ছাড়া বিশ্বকাপই যে মূল্যহীন!
২০১৪ বিশ্বকাপের প্লে অফ থেকে সুইডেন বাদ পড়ে যায়। ইব্রাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে সপাটে বলে দেন , “বিশ্বকাপ? যে বিশ্বকাপে ইব্রা নেই, তা দেখার যোগ্য না, তাই এ নিয়ে অপেক্ষার কিছু নেই।” এমন আচরণ তাঁর প্রথম নয়। ২০১২ সালে সুইডেন ইউরো থেকে বাদ পড়লে সাংবাদিকরা ম্যাচের পর তাঁকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলে দেন, “জানি না, আমি শুধু জানি আমি এখন ছুটিতে যাবো!”
বেকহ্যামের প্লে-লিস্ট
ডেভিড বেকহ্যাম তাঁর ক্যারিয়ারের শেষলগ্নে কিছুদিন পিএসজিতে খেলেন, তখন ইব্রাও পিএসজিতে। বেকহ্যামের অজান্তে ইব্রা তার গানের প্লে-লিস্টে ঢোকেন। এরপর বলেন, “আমি তাঁর প্লে-লিস্ট হাতড়াচ্ছিলাম, দেখলাম সেখানে প্রচুর জাস্টিন বিবার, সেলেনা গোমেজদের গান। আসলে জেনে ভালো লাগলো যে, বেকহ্যামের মতো এত ক্লাসিক একজন মানুষেরও যে সব কিছুতে ভালো রুচি নেই!”
ফ্রেঞ্চ লিগকে অবজ্ঞা
ইব্রা যখন পিএসজিতে যোগ দেন, তখন পিএসজি কেবল পেট্রোডলার বিনিয়োগে পসার পেতে শুরু করেছে। ইব্রা যোগ দেওয়ার পর ফ্রান্সের সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলেন ফ্রেঞ্চ লিগ কেমন তা নিয়ে। উত্তরটা তাঁদের অপ্রত্যাশিত ছিল। ইব্রা বলেন, “আমি আসলে ফ্রেঞ্চ লিগের বাকি দলগুলো নিয়ে এত বেশি জানি না যে তাঁরা কেমন। তবে এটা নিশ্চিত যে, তারা জানে আমি কে? এবং এটাও জানে যে, ইব্রা আসছেন!”
রুনিকে আমন্ত্রণ ও হুঙ্কার
একবার গুজব রটে যায় যে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকা ওয়েইন রুনি ক্লাব ছাড়ছেন এবং পিএসজি তাকে নিতে আগ্রহী। তখন ইব্রা পিএসজিতে। ইব্রা বলেন, “আমি অবশ্যই চাই রুনি প্যারিসে আসুক, ও দারুণ ফুটবলার, আমিও ওর সাথে খেলতে চাই। তবে ওরও একটা ব্যাপার মাথায় রাখা উচিত যে, পিএসজিতে এমন একজন খেলেন যে, তাঁর চেয়েও সুন্দর গোল করে!”
ব্যালন ডি অর ও ইব্রা
২০১৪ সালের ব্যালন ডি অর জেতেন রোনালদো যেটা ইব্রা এত সহজে মেনে নিতে পারেন নি। তিনি বলেন, “রোনালদো ব্যালন জিততে পারেন তবে আমি জানি আমিই সেরা!”
ভিডিও গেমেও ইব্রা হওয়া যাবে না
ইব্রার করা বহু গোলই অসাধারণের চেয়েও কিছু বেশি। এটিকে ভিত্তি করেই তিনি বলেছিলেন, “আপনি চাইলেই আমার মতো গোল করতে পারবেন না, এমনকি ভিডিও গেমেও না। যদিও আজকালকার গেমগুলো প্রায় বাস্তবের মতোই, তবুও আপনি চাইলেই আমার মতো খেলতে পারবেন না গেমেও।”
গার্দিওলার সাথে তার চরম বৈরিতা
গার্দিওলা বার্সা লিজেন্ড স্যামুয়েল এতোকে বেঁচে দিয়ে তাকে নিয়ে আসেন বার্সায়, মৌসুমের প্রথম ভাগ দারুণ চলছিল ইব্রার জন্য। কিন্তু সেই মৌসুমের দ্বিতীয়ভাগে পেপ তাঁর ট্যাকটিক্সে পরিবর্তন আনেন যেটা ইব্রার কাছে ভালো লাগে নি, এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করার পর থেকে পেপ আর তাঁর সাথে কথা বলেন নি। সেই থেকে তাঁদের দা-কুমড়ো সম্পর্ক। পেপকে ইব্রা সরাসরিই বলেন ‘সবচেয়ে অপরিপক্ব কোচ’। একবার বলেছিলেন, “বার্সায় একবার পেপ তাঁর দর্শন বলা শুরু করলেন, আমি শুনতেই পারছিলাম না। কেমনে শুনব? কি সব চোখের জল, ঘাম, রক্তটক্ত এসব নিয়ে বলছিলেন, কি জঘন্য!” তিনি আরো বলেন, “বার্সায় আমার প্রায়ই স্কুলছাত্রদের মতো লাগতো নিজেকে। কোচ না করে দেন ট্রেনিং এ দামী গাড়ি নিয়ে আনতে। বাকি কেউই আনেনি, আমি আমার সেরা গাড়িটা নিয়েই এসেছিলাম আর সবাইকে দেখিয়েই পার্ক করছিলাম।” ইব্রা বার্সা খেলোয়াড়দের ঠারেঠোরেই বলেন ‘স্কুলবয়’, তাঁদের কোচের আদেশের প্রতি আনুগত্য দেখে। পেপকে একবার ইব্রা মাঠে সরাসরিই বলেছিলেন, “আপনি জাহান্নামে যান!” সে অনেক কথা, এই পেপ গার্দিওলাকে নিয়ে ইব্রার আত্মজীবনীতে গোটা একটা অধ্যায় রয়েছে!
ডেনমার্ককে অবসরে পাঠানো
২০১৬ ইউরোতে খেলার জন্য ডেনমার্কের সাথে এক প্লে-অফ ম্যাচে মুখোমুখি হয় সুইডেন। পুরো ডেনিশ মিডিয়ায় বলা হচ্ছিল এই ম্যাচ হারলেই ইব্রা অবসরে চলে যাবেন। ডেনমার্কের সাথে সেই ম্যাচে ইব্রা জোড়া গোল করে তাঁদের ছিটকে দেন। প্রেসে এসে বলেন, “তাঁরা আমাকে অবসরে পাঠানোর কথা ভাবছিলো, এখন আমি গোটা ডেনমার্ককেই অবসরে পাঠিয়ে দিলাম!”
সেরা সুন্দরীর সাথে দেখা হওয়া নিয়ে
ইব্রাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তার দেখা সেরা সুন্দরী কে? তিনি উত্তর দেন, “এখনো পাইনি, যদি পাই সাথে সাথে ডেটে নিয়ে যাব। আর কে আমার সাথে যেতে না করবে!”
সাংবাদিক-বিতর্ক
এক ভুয়া খবরের উপর ভিত্তি করে এক নারী সাংবাদিক ইব্রাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি সমকামী কিনা। ইব্রা খুব একটা শালীন উত্তর দেননি, বলেছিলেন, “তোমার বোনকে পাঠিয়ে দিও আর পরে বাকিটা দেখিয়ে দেব!” এমনই ঘটনা হয়েছিল আরেকবার যখন এক পুরুষ সাংবাদিক ইব্রাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তার মুখে আঁচড়ের দাগ কেন? ইব্রা রেগে গিয়ে বলেন, “আমি জানি না, এটা তোমার বঊকে জিজ্ঞাসা করতে হবে!” দুটো বক্তব্যই মিডিয়ায় দারুণ আলোড়ন ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।
বাড়ি না পেলে রাগে হোটেলই কিনে নেবেন!
পিএসজিতে যোগ দেওয়ার পর ইব্রা প্যারিসে এক প্রাসাদোপম হোটেলে থাকছিলেন, সেই সাথে বাড়ির খোঁজও চলছিল, কিন্তু পাচ্ছিলেন না। সে নিয়ে বলেছিলেন, “আমি আপাতত একটি হোটেলে আছি ও বাড়ির সন্ধান করছি। বাড়ি না পেলে ভাবছি হোটেলটাই কিনে নেব!”
ইব্রার অটোগ্রাফের মূল্য!
ইব্রাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সুইডিশ নারী ফুটবলারদের বেতন কত হওয়া উচিত। তিনি জবাব দেন, “আমার অটোগ্রাফওয়ালা একটি বাইসাইকেল দিন, এতেই হবে!”
ইব্রা টাওয়ার!
পিএসজিতে ইব্রার চুক্তির তখন শেষ দিক, সবাই ধারণাই করে নিয়েছেন যে ইব্রা ক্লাব ছাড়বেন। তিনি থাকবেন কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “থাকতে পারি তবে আইফেল টাওয়ারের জায়গায় আমার একটা ভাস্কর্য বসাতে হবে।”
প্যারিস জয়ী ইব্রা
পিএসজি ছাড়ার সময় সদর্পে বলে যান, “আমি রাজার মতো এসেছিলাম, কিংবদন্তির মতো ছাড়ছি।” খুব একটা ভুল বলেননি, ক্লাব ছাড়ার আগে হয়েছেন পিএসজির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ইব্রা থাকাকালীন পিএসজি টানা চারটা লিগ জিতলেও তিনি ছেড়ে যাওয়ার মৌসুমেই পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম লিগ হারের স্বাদ পায় পিএসজি।
রেড ওয়াইন ইব্রা
ইব্রা বলেছিলেন, “আমি রেড ওয়াইনের মতো, যত বয়স্ক হচ্ছি তত শাণ বাড়ছে।” খুব একটা ভুল বলেননি, মধ্য ত্রিশের ইব্রা যখন ইংলিশ লিগে খেলতে আসেন, সবাই ভেবেছিল মারাত্মক শারীরিক এই লিগে তাঁর হয়ত আগের সেই ফর্ম থাকবে না। সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে প্রথম মৌসুমেই করেন ২৮ গোল সেই পয়ত্রিশ বছর বয়সেও!
ইব্রাহিমোভিচের কোনো কোনো কথা আপনাকে হাসাবে, কোনোটা মনে হবে দম্ভতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু যে জিনিসটা মানতেই হবে, তা হলো তার ধারাবাহিক পারফর্মেন্স। তার মুখ যেভাবে চলে, পা সেভাবে না চললে বর্তমানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক ‘ট্রল সংস্কৃতিতে’ তাকে নিয়মিত পিষ্ট হতে হতো। কিন্তু তার ফুটবল অশোভন দাম্ভিকতাকে বারবার ছাপিয়ে গেছে। জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, মাঠ কী মাইক্রোফোন, উভয় জায়গাতেই এক অগাধ বিনোদনের নাম!