২০০৩ সালে রিয়াল মাদ্রিদের অন্যতম সফল ম্যানেজার দেল বস্ককে বরখাস্ত করা হয়। দীর্ঘদিন সাফল্যহীনতায় ভোগা রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্যের পালে হাওয়া লাগার নেতৃত্বে তো তিনিই ছিলেন। তার বরখাস্ত হওয়াটাকে তাই অবিচার হিসেবেই যেন গণ্য করলেন ফুটবল বিধাতা। শুরু হলো রিয়াল মাদ্রিদের অন্ধকার সময়। জিদান, রোনালদো নাজারিও, ডেভিড ব্যাকহামদের মতো গ্যালাকটিকোদের নিয়ে গড়া রিয়াল মাদ্রিদকে ম্লান লাগতে শুরু করলো। টানা ছয় বছর চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজারা ফিরে এলো শেষ ১৬’র দরজা থেকে। ২০০৩-১০ সাল, এই ৭ বছরে রিয়াল মাদ্রিদের উল্লেখ করার মতো সাফল্য বলতে কেবলই ২টি লা লিগা ট্রফি জয়। অথচ এই ক্লাব সবসময়ই ছিল ফুটবলের সব উঠতি তারকায় ঠাসা। গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ক্লাব তকমা পাওয়া দলটি কি তাহলে অতীত গৌরব আর ফিরে পাবে না?
বারংবার ব্যর্থতায় খাবি খাওয়া, হতাশায় নিমজ্জিত রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্বে এলেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান দশকটি শুরু হলো আরো একটি গ্যালাকটিক দল গঠনের মাধ্যমে। কাকা, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, জাবি আলোনসো, ডি মারিয়া, ওজিল আর খেদিরাদের দলে ভিড়িয়ে শক্তিশালী এক দল গড়ে তোলে রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু সাফল্য অধরাই থেকে যায়। ২০১১ তে কোপা দেল রে আর পরের বছর লা লিগা জয় করলেও রিয়াল মাদ্রিদ মরিয়া ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের জন্য। কিন্তু সেটি তো হলোই না বরং ২০১২-১৩ মৌসুম কাটলো ট্রফিবিহীনভাবে। আর এতেই বরখাস্ত হলেন কোচ মোরিনহো।
অবশেষে দীর্ঘ ১২ বছর পর রিয়াল মাদ্রিদের আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য এলো কার্লো আনচেলত্তির হাত ধরে। ২০১৪ সালে রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়লাভ করলো সার্জিও রামোসের অতিরিক্ত সময়ের এক বিস্ময়কর গোলে। দলটি যেন তাদের অক্সিজেন ফিরে পায় এই জয়ের মাধ্যমে। সে মৌসুমে কোপা দেল রে ট্রফিটাও নিজেদের করে নিল। কিন্তু এরপরই আবার ছন্দপতন। পরের সিজনে ট্রফিহীন থেকে চাকরি হারান আনচেলত্তি। খেই হারানো মাদ্রিদের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আরো ভজঘট পাকালেন রাফা বেনিতেজ। ফলে রিয়ালের ডাগআউটে এক সিজন পূর্ণ করার আগেই চাকরিচ্যুত হন তিনি। এরপর বাকিটা ইতিহাস। রিয়ালের কোচ হয়ে ডাগআউটে আসেন এই ক্লাবেরই একজন সাবেক কিংবদন্তি খেলোয়াড় জিনেদিন জিদান। তার হাত ধরে রিয়াল মাদ্রিদ পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতে, জেতে একটি লা লিগা ট্রফিও। রিয়াল মাদ্রিদ যখন কিয়েভে লিভারপুলকে হারিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা জিতে নিলো, তখন মাদ্রিদের এই অভিজাত ক্লাবটির অতীত ইতিহাস আর গৌরবের গল্পগাঁথায় চোখ বুলালে মন্দ হয় না।
স্প্যানিশ রাজধানী মাদ্রিদে ফুটবলের আগমন ঘটে ১৮৮৭ সালে। একদল শিক্ষার্থী মিলে স্কাই নামক একটি ফুটবল ক্লাবের উদ্বোধন করে, যা ধীরে ধীরে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ক্লাবটি কিছুকাল পর ‘ফুট-বল ডি মাদ্রিদ’ এবং ‘মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাব’ নামে দ্বিধাবিভক্ত হয়। প্রথমটি দ্বিতীয়টির কাছে ধোপে টিকতে পারেনি। ১৯০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের বোর্ড গঠন করা হয়, যেখানে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নাম লেখান হুয়ান পেদ্রোস। তখন হয়তো কারো ধারণা ছিল না যে এই ক্লাবটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্লাব হিসেবে নাম লেখাবে। তবে শুরু থেকেই ক্লাবটি তার আধিপত্য বিস্তারের ইঙ্গিত দেয়। চোখ জুড়ানো ফুটবলের সাথে টানা চারটি কোপা দেল রে ট্রফি জিতে মন জয় করে নেয় সবার।
রিয়াল মাদ্রিদ সিএফ, পুরো নাম রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব ফুটবল। সংক্ষেপে আমরা রিয়াল মাদ্রিদ বলে থাকি। এই ‘রিয়াল’ হচ্ছে একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘রয়্যাল’ বা রাজকীয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, আক্ষরিক অর্থে রাজকীয় এই দলের নামের সাথে ‘রিয়াল’ শব্দটি প্রথমে ছিল না। ১৯২০ সালে স্পেনের রাজা ত্রয়োদশ আলফনসো ভালোবেসে এই ক্লাবকে ‘রিয়াল’ উপাধি দেন। এই উপাধিই ক্লাবের নামের একটি অংশ হয়ে ওঠে। আর রাজকীয় উপাধির সাথে ক্লাবের লোগোতেও যুক্ত হয় রাজকীয় মুকুট। তবে, ১৯৩১ সালে স্প্যানিশ রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হবার পর নামের এই শব্দটি এবং লোগোর মুকুট, দুটোই রিয়াল মাদ্রিদ ত্যাগ করেছিল। তখন দলটির নাম হয় ‘মাদ্রিদ সিএফ’। ৪০ এর দশকে গৃহযুদ্ধে হেরে গিয়ে রিপাবলিকান সরকারে পতন হলে ‘রিয়াল’ শব্দের সাথে সাথে লোগোর মুকুটটি পুনঃস্থাপিত হয়।
এরপর এলো সান্তিয়াগো বার্নাব্যু যুগ। উঁহু, রিয়াল মাদ্রিদের হোম গ্রাউন্ডের কথা বলা হচ্ছে না, বলছি রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক খেলোয়াড়, অধিনায়ক, ডিরেক্টর, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এবং ইতিহাসের সফল প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর কথা। ১৯২৭ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেয়া এই ফুটবলার রিয়ালের হয়ে ৫১ ম্যাচে করেছেন ৪২ গোল। তবে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন তার অবসর পরবর্তী কাজের জন্যই। ১৯৪৩ সালে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট হয়ে আসেন, তখন গৃহযুদ্ধের প্রভাবে রিয়াল মাদ্রিদের হযবরল অবস্থা। ঘরোয়া মাঠ স্তাদিও ক্যামার্টিন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া এই মাঠটি এমনিতেও রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের জন্য ছিল অপ্রতুল। তাই দায়িত্ব নিয়েই বার্নাব্যু প্রথম যে কাজটি শুরু করেন, তা হচ্ছে দলের জন্য একটি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ।
১৯৪৭ সালে রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান হোম গ্রাউন্ড সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর কাজ সমাপ্ত হয়। শুরু রিয়াল মাদ্রিদের গৌরবময় ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়। রিয়াল মাদ্রিদকে বিশ্বসেরা করে তুলতে তিনি নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করলেন। তিনিই প্রথম বিদেশি খেলোয়াড় কিনে একটি সত্যিকারের বহুজাতিক তারকাবহুল দল গড়ে তোলেন। আলফ্রেড ডি স্টেফানো, ফেরেংক পুসকাস, ফ্রান্সিসকো জেনটো, মিগুয়েল মুনজো, হেক্টর রিয়ালদের মতো তারকাখচিত দল তৈরি করেন বার্নাব্যু। ফলাফল? ১৯৫৬-৬০ সাল পর্যন্ত টানা ৫টি ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগ) জয় করে রিয়াল মাদ্রিদ। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত টানা ৩৫ বছর রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা বার্নাব্যু ক্লাবটিকে দিয়েছেন ৬টি ইউরোপিয়ান কাপ, ১৬টি লা লিগা সহ ৭১ টি শিরোপা। নিঃসন্দেহে রিয়াল মাদ্রিদকে ইউরোপে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে বার্নাব্যুর অবদান সবচেয়ে বেশি।
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর বিদায়ের পর রিয়াল মাদ্রিদ তার যোগ্য উত্তরসূরী পাবে কিনা, তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। শেষতক ক্লাবের ট্রেজারার লুইস ডি কার্লোস দাঁড়িয়ে গেলেন নির্বাচনে। আর বিশ্বস্ত কাঁধ পেয়ে রিয়াল মাদ্রিদ তার দায়িত্ব সঁপে দিল সে কাঁধেই। কার্লোসের পরিচালনায় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও যায় রিয়াল। দীর্ঘদিন ইউরোপিয়ান কাপ জিততে না পারা রিয়াল পৌঁছে যায় ১৯৮১ সালের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে। প্রতিপক্ষ লিভারপুলের তুলনায় রিয়াল মাদ্রিদ কাগজে কলমে এগিয়েই ছিল তাদের দাপুটে ফর্ম আর অতীত ঐতিহ্যের ভারে। কিন্তু সব সমীকরণ উল্টে দিয়ে লেফট ব্যাক অ্যালান কেনেডির একমাত্র গোল রিয়ালকে শিরোর দ্বারপ্রান্ত থেকে রিক্তহস্তে ফিরিয়ে দেয় লিভারপুল। লুইস ডি কার্লোসের আমলে রিয়ালের সাফল্য বলতে দুটি লা লিগা আর দুটি কোপা দেল রে ট্রফি জয়। কিন্তু ইউরোপের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগীতায় সাফল্য না এলে যে রিয়াল মাদ্রিদ তাকে সাফল্যই মনে করে না! এ সময় দু বছর মেয়াদে রিয়ালের ডাগআউটে ছিলেন সাবেক রিয়াল কিংবদন্তি আলফ্রেড ডি স্টেফানো।
পরপর দু’বার লুইস ডি কার্লোসের কাছে প্রেসিডেন্ট ভোটের দৌড়ে হেরে যাওয়া র্যামন মুন্ডোজই হলেন কার্লোস পরবর্তী রিয়াল মাদ্রিদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আর তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে এসেই ঘরোয়া লীগে অ-ধারাবাহিক রিয়াল মাদ্রিদকে ধারাবাহিক করে তোলেন। ১৯৮৫-৮৬ মৌসুম থেকে শুরু করে ১৯৮৯০-৯০ মৌসুম পর্যন্ত টানা পাঁচটি লা লিগা শিরোপা ঘরে তোলে রিয়াল। জেতে দুটি কোপা দেল রে ও। ‘লা কুইন্টা ডেল বুইটার’ তথা রিয়ালের একাডেমিতে বড় হওয়া পাঁচজন খেলোয়াড়ই ছিলেন রিয়ালের এই আধিপত্যের সূচনাকারী। তবে এই আধিপত্যও তো রিয়ালের নিকট তেতো, যদি না আসে ইউরোপিয়ান শিরোপা! এর মাঝে ১৯৯২ সালে ইউরোপিয়ান কাপ ‘উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ’ হিসেবে নতুন রূপে হাজির হয়। আর মাদ্রিদের ডাগআউটেও আসেন নতুন কোচ ফাবিও ক্যাপেলো। আগের মৌসুমেই এসি মিলানকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো ক্যাপেলোও কিন্তু রিয়ালের ভাগ্য ফেরাতে পারেনি।
অবশেষে জার্মান কোচ ইয়্যুপ হেইঙ্কেসের হাত ধরে ১৯৯৮ সালে বহু আকাঙ্ক্ষিত চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি ঘরে তোলার সুযোগ পায় রিয়াল। তবে লিগে যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্সের কারণে এক বছর পরই চাকরি হারান হেইঙ্কেস। একে একে তার স্থলাভিষিক্ত হন কোমাচ, হিডিক, তোষাক, কিন্তু কেউই পুনরায় সাফল্য এনে দিতে পারেননি। কারণ তারা তো আর দেল বস্ক নন! রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হয়ে ১৯৯৯ সালে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আসেন ভিসেন্তে দেল বস্ক। আর পরবর্তী ৪ বছরে রিয়াল মাদ্রিদ জেতে দুটি লা লিগা এবং দুটি চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা। এরই মাঝে রিয়ালে শুরু হয় প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের প্রথম অধ্যায়। তারপর গ্যালাকটিকো-১, পেরেজের দ্বিতীয় অধ্যায় ও গ্যালাকটিকো-২ এবং বাকি ইতিহাসটা আমাদের জানা। ইতিহাসের সফলতম ক্লাবটি সদ্যই জিতে নিয়েছে নিজেদের ত্রয়োদশ চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা!
রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়দের কিছু রেকর্ড
- রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৭৪১ ম্যাচ খেলেছেন রাউল গঞ্জালেজ।
- গোলকিপার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৭২৫ ম্যাচ খেলেছেন ইকার ক্যাসিয়াস।
- ডি স্টেফানো, পুসকাস, হুগো সানচেজ, স্যান্টিলানা, রাউল এবং রোনালদো রিয়ালের ২০০ এর অধিক গোল করেছেন।
- ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো রিয়ালের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড করেছেন। এখনো পর্যন্ত ৪৫০* টি।
- চ্যাম্পিয়নস লীগে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সর্বোচ্চ ১০৫* গোল করেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
- রিয়ালের ইতিহাসে দ্রুততম (১২ সেকেন্ড) গোলটি করেন ব্রাজিলিয়ান তারকা স্ট্রাইকার রোনালদো নাজারিও।
ক্লাব হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের কিছু রেকর্ড
- রিয়াল মাদ্রিদ সর্বোচ্চ ৩৩ বার লা লিগা শিরোপা জয় করেছে।
- সর্বোচ্চ ১৩ বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে।
- টানা ৫ মৌসুম লা লিগা জয়ের রেকর্ড কেবল রিয়াল মাদ্রিদেরই আছে। লস ব্লাঙ্কোসরা ১৯৬০-৬৫ এবং ১৯৮৫-৯০ এই রেকর্ড গড়ে।
- ঘরের মাঠে টানা সর্বোচ্চ ১২১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের।
- টানা ৭৩ ম্যাচে গোল করার রেকর্ড রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের।
হোম জার্সি হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদ একেবারে শুরু থেকেই সাদা জার্সি বজায় রেখে চলেছে। তবে একটি মৌসুমে কেবল প্যান্টের রং কালো ছিল। অন্যদিকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বাহারি রঙের মোজা পরে খেলতেন অভিজাত এই ক্লাবের খেলোয়াড়রা। তবে এরপর থেকে মোজাও সাদা রঙের বাছাই করা হয় যা রিয়াল মাদ্রিদের ‘অল হোয়াইট’ নামকরণে ভূমিকা রেখেছে। এই জার্সি তৈরিতে আবার রিয়ালের সবসময়ের সঙ্গী অ্যাডিডাস। মাঝে কিছুকাল হামেল তৈরি করলেও, অ্যাডিডাসই রিয়ালের ভরসার নাম। আর স্পন্সরের জন্য রিয়ালকে কখনো ভাবতে হয়নি। তারকাখচিত এই দলের স্পন্সর হবার জন্য নামিদামি সব কোম্পানি সবসময়ই লাইন ধরে থাকে। রিয়ালের বর্তমান স্পন্সর ফ্লাই ইমিরেটসের ৮৫০ মিলিয়ন পাউন্ড চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ বছরই। আরেকটি বিষয় ছোট্ট করে উল্লেখ করা যেতেই পারে। দর্শক সমর্থন নিয়েও রিয়াল মাদ্রিদের কখনো চিন্তা করতে হয়নি। চলতি দশকে, ৮১ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে প্রতি ম্যাচে গড় দর্শক উপস্থিতি ৭৬ হাজার!
ক্লাব হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের শ্রেষ্ঠত্বের একটি বড় পরিচায়ক হচ্ছে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইউরোপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ম্যাচ বলা হয় রিয়াল বনাম বার্সার ‘এল ক্লাসিকো’কে। তাছাড়া রিয়াল মাদ্রিদ এবং অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের মধ্যকার মাদ্রিদ ডার্বিও ব্যাপক জনপ্রিয়। অন্যদিকে চ্যাম্পিয়নস লিগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় লড়াই হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে রিয়াল বনাম বায়ার্ন মিউনিখের ‘ইউরোপিয়ান ক্লাসিকো’। আর এসব লড়াইয়ে নিজেদের আভিজাত্য প্রমাণ করে সবার চেয়ে এগিয়েই আছে রিয়াল। বার্সার সাথে সব ধরনের প্রতিযোগিতায় ২৩৭ বার মুখোমুখি হয়ে ৯৫ বার শেষ হাসি হেসেছে মাদ্রিদের ক্লাবটি। অন্যদিকে বার্সা জিতেছে ৯২ বার। গোল করায় ও রিয়াল (৪০১) এগিয়ে আছে বার্সেলোনার (৩৮১) চেয়ে। অন্যদিকে মাদ্রিদ ডার্বিতে অ্যাথলেটিকোর চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে আছে রিয়াল মাদ্রিদ। দুই দলের ২১৯ বারের দেখায় ১০৯ বারই জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ, ৫৫ বার জয় পেয়েছে অ্যাথলেটিকো। তবে সে তুলনায় ইউরোপিয়ান ক্লাসিকোতে দুই দল প্রায় সমানে সমান। ২৬ বারের দেখায় রিয়ালের ১২ জয়ের বিপরীতে বায়ার্ন জয় পেয়েছে ১১ বার।
রিয়াল মাদ্রিদ! কত ইতিহাস, কত ঐতিহ্য আর কত গৌরবময় অধ্যায় জড়িয়ে আছে এই নামের সাথে, তার ইয়ত্তা নেই। শুধু ঐতিহ্য আছে, তা নয়। এই ক্লাবের আছে ঈর্ষণীয় গ্ল্যামার, নাম, যশ আর সমর্থন। বছর বছর সবচেয়ে দামি ক্লাব হিসেবে তালিকার প্রথমে থাকা তো রীতিমতো স্বাভাবিক ব্যাপার রিয়াল মাদ্রিদের জন্য। প্রতিদিন বিশ্ব জুড়ে লক্ষাধিক মানুষ এই ক্লাবের থিম সঙ্গীতের নাম ‘আলা মাদ্রিদ’ (এর অর্থ এগিয়ে যাও মাদ্রিদ) লিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সয়লাব করছে। ডি স্টেফানো, পুসকাস, হুগো সানচেজ, জিদান, বেকহাম, রোনালদো নাজারিও, ম্যাকনামান, ক্যাসিয়াস, কাকা, রাউল আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো তারকারা যে ক্লাবে খেলেছেন বা খেলছেন, সে ক্লাবের নাম রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়াল মাদ্রিদ মানে আগ্রাসী ফুটবল, নিরন্তর সাফল্য ক্ষুধা। রিয়াল মাদ্রিদ মানে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সাফল্যে মোড়ানো বর্তমান, রিয়াল মাদ্রিদ মানে বিশ্বমাতানো তারকাদের মিলনমেলা, রেকর্ডের জন্মস্থান। রিয়াল মাদ্রিদ মানে উঠতি ফুটবলারের স্বপ্নের হাওয়াই জাহাজের গন্তব্যস্থান, বিশ্ব জুড়ে কোটি ভক্তের ভালোবাসার জাল! রিয়াল মাদ্রিদ নিজেই শুধু তার তুলনা।
ফিচার ছবি: Gipsypixel.com