বাংলাদেশ দল তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টেস্ট খেলছে। মাশরাফি বিন মুর্তজা বাংলাদেশে। যেদিনের কথা বলা হচ্ছে, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য তার পরদিনই দক্ষিণ আফ্রিকায় উড়বেন মাশরাফি। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আঙিনায় গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে তুমুল আড্ডা দিচ্ছেন। কথায় কথায় উঠে এল টি-টোয়েন্টি ইস্যু। বিভিন্ন দল নিয়ে কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ নিয়েও কথা হচ্ছে। মাশরাফি দুটি বিষয় তুলে ধরলেন। এক, ২০ ওভারের ক্রিকেট খেলার জন্য শারীরিক গঠন নেই বাংলাদেশের। তাই মারকুটে হতে পারে না খুব বেশিজন। দুই, টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের উঠে দাঁড়াতে আরও বহু বছর লাগবে। ওই সিরিজে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে দুটি টি-টোয়েন্টিতেই হেরেছিল বাংলাদেশ। এরপর শ্রীলঙ্কা সফরে টি-টোয়েন্টি সফরে অবসর নেন তিনি।
এত কথার কারণ নিদাহাস ট্রফিকে কেন্দ্র করে। মাশরাফি নেই। কিন্তু ২০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের দুর্বলতা মিলিয়ে যায়নি। বরং বেড়েছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কতটা ভালো করবে টাইগাররা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নিন্দুকরা তো বলছেন, খেলতে নয় বেড়াতে গিয়েছে। দাবি, সবগুলো ম্যাচই নাকি হারবে বাংলাদেশ!
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে বলতে গেলে সবার আগে সাব্বির রহমানের কথা মনে আসবে। তাকে বলা হয় দেশের একমাত্র টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট। অথচ, এই ফরম্যাটে তার সর্বশেষ ১০ ইনিংস হল, ২৬, ১২, ১৬, ৪৮, ১৮, ১৬, ১৯, ১৯, ৫ ও ১! সেই তিনিই খেলছেন ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল)। সেখানে পেশোয়ার জালমির হয়ে দুই ম্যাচের একটিতে ব্যাট করার সুযোগই পাননি। আরেকটিতে তুলেছেন ১১ রান।
সঙ্গে আবার দুর্ভাগ্যের মালা গেঁথেছেন সাকিব আল হাসান। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফিল্ডিং করতে গিয়ে বাঁ হাতের আঙুলে পাওয়া চোট এখনও ভোগাচ্ছে তাকে। ফিল্ডিং আর বোলিং অনুশীলন করে নিদাহাস ট্রফি দিয়ে ফিরতে চেয়েছিলেন মাশরাফি পরবর্তী এই অধিনায়ক। কিন্তু ব্যাটিংটা করতে পারছেন না। তাই ছিটকে গেলেন আবারও। দল যখন শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে রওয়ানা দিচ্ছে, সাকিব তখন অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। অধিনায়কের দায়িত্ব বর্তেছে মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদের কাঁধে।
তবু ভাগ্য ভালো, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমরা ফর্মে আছেন। পরিসংখ্যানেও প্রমাণ মিলছে, টি-টোয়েন্টিতে এখনও বাংলাদেশের শক্তির জায়গা জ্যৈষ্ঠ ক্রিকেটাররা। তরুণদের মধ্যে সৌম্য সরকার বাংলাদেশের হয়ে সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি সিরিজে হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন।
ব্যাটিংয়ে বলার মতো যা-ও বা আছে, বোলিংয়ে খাতা-কলমে তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় বাংলাদেশ দল। বিশেষত পেস বোলিংয়ে। মাশরাফির অবসরের পর এই ফরম্যাটে তার মতো নতুন বলে কার্যকরী এখনও কেউ হতে পারেনি। তাই পেসারদের নিয়ে একটু আগেভাগেই ক্যাম্প শুরু করেছিলেন হেড কোচ ও পেস বোলিং কোচ উইন্ডিজ কিংবদন্তি কোর্টনি ওয়ালশ। ১৬ সদস্যর দলে রয়েছে ৬ জন পেসার! স্পিনার কেবল মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাজমুল হোসেন অপু। বোঝায় যাচ্ছে, রোহিত শর্মা-রবীন্দ্র জাদেজা আর দীনেশ চান্দিমাল-কুশল মেন্ডিসদের আটকাতে পেস আক্রমণে বেশি মনোযোগী বাংলাদেশ দল।
এখন পর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে ২০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয়েছে ৫ বার। সবকটিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তার চেয়ে অবস্থা বেশ খানিকটা উন্নত। ৯ বার ‘ফেস টু ফেস’ লড়াইতে ৭ বার জিতেছে লঙ্কানরা। দুবার বাংলাদেশ। তারচেয়েও বড় কথা, কদিন আগে ঘরের মাটিতে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারলেও, সর্বশেষ এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের সফর ছিল সেই শ্রীলঙ্কাতেই। সেখানে জয় পায় বাংলাদেশ। মাশরাফির ‘ফেয়ারওয়েল’ ম্যাচে সাকিবের নৈপুণ্যে জিতেছিল সাব্বির-রিয়াররা। কিন্তু সাকিব যে নেই! তারপরও লড়বে বাংলাদেশ।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ খেলেছে ৭১ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। যেখানে জয় ২১ ম্যাচে। বাকি সবগুলোতে হার। ওয়ানডেতে যেভাবে দুর্বার গতিতে এগোচ্ছে এই দল, টি-টোয়েন্টিতে ঠিক একই গতিতে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে চলেছে। র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের চেয়েও এগিয়ে আফগানিস্তান। পরিসংখ্যান, বাস্তবতা, আবেগ আর সামর্থ্যের বিচারে কয়েক ধরনের মতামত আছে।
সবচেয়ে বাস্তব ব্যাখ্যাটা বোধ হয় দিয়েছেন কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। সাকিব আল হাসান, মুমিনুল হকদের এই ‘গুরু’ বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ব্যর্থতার ক্ষেত্রে দায় দিচ্ছেন বোলিং বিভাগকে। এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “টি-টোয়েন্টি জিততে হলে আমার মনে হয় বোলিংটা খুব শক্তিশালী হওয়া জরুরী। এটা অনেক অভিজ্ঞতার খেলা। এ কারণে আমি বলবো আমাদের এখনও অনেক ল্যাকিংস আছে বোলিংয়ে। আমাদের আসলে ওই মানের বোলার কম আছে যারা টি-টোয়েন্টিতে ভালো বল করবে। আমাদের এই জায়গাটা ঠিক করাটা খুব বেশি জরুরী। হয়তো সাকিব আসলে একটা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বোলার। তারপরও আমি বলবো আমাদের বোলিং সাইটটা একটু দুর্বল। আশা করি তারা হয়তো ভালো করবে (নিদাহাস ট্রফিতে)।”
বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট ঘরের মাঠে সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি সিরিজে দুই ম্যাচে ৬ জন ক্রিকেটারের অভিষেক করায়। সেখান থেকে নিদাহাস ট্রফিতে জায়গা পেয়েছে কেবল তিনজন। সালাউদ্দিন মনে করেন, এটা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কৌশল। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ভবিষ্যৎ ক্রিকেট দলকে আরও বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কিনা তা তদন্ত করার পক্ষে তিনি।
বলেছেন, “এটা আসলে বোর্ডের স্ট্র্যাটেজি তারা আসলে কিভাবে ক্রিকেটারদের গ্রো আপ করাবে। তারা যখন একটা ছেলেকে সুযোগ দেবে আমার কাছে মনে হয় তাকে সঠিকভাবেই সুযোগটা দেওয়া উচিত। একটা ছেলেকে বড় করার জন্য সবার সবারই সাপোর্ট করা উচিত। আপনি যখন ছেলেকে একটা ম্যাচ খেলার পর ছুঁড়ে ফেলে দেবেন, সে কিন্তু ওই জায়গা থেকে ক্যারিয়ারে গ্রো আপ করতে পারবে না। অনেকে হয়তো ওই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু অনেকের ক্যারিয়ারে হয়তো বড়সড় প্রভাব (নেতিবাচক) পড়তে পারে। মনে হয় যে একটা সিস্টেম থাকা উচিত যে, আমি কোনো ছেলেকে সুযোগ দেবো এবং কোন ছেলেটাকে ধীরেসুস্থে গ্রো আপ করাবো, সে একটা ভালো পর্যায়ে যাবে। এরপর পর্যাপ্ত সুযোগ দিয়ে বড় পর্যায়ে নিলে আমার মনে হয় তাদেরকে আপনি বাদ দিতে পারবেন না। কারণ তাড়াতাড়ি দলে ঢোকাটাও যেমন ভালো না, তাড়াতাড়ি টিম থেকে বের করে দেওয়াও ক্ষতিকর হতে পারে।”
এই ফরম্যাটে যতই তরুণ নির্ভর দলের কথা বল হোক, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনও ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডগুলো ধরে রেখেছে ‘সিনিয়ররা’। সবার উপরে ড্যাশিং ওপেনার তামিম ইকবাল। ৫৭ ম্যাচে তার মোট রান ১,২৩১। ৬১ ম্যাচে ১,২২৩ রান করে দ্বিতীয় অবস্থানে সাকিব, তিন নম্বরে আছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ৬২ ম্যাচে ৯২১ রান তুলেছেন তিনি। বোলিংয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি বাঁ হাতি স্পিনার সাকিব। ঝুলিতে পুরেছেন ৭১ উইকেট। দ্বিতীয় অবস্থানে ‘উপেক্ষিত’ আরেক বাঁ হাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক। নিয়েছেন ৪৪ উইকেট। তিন নম্বরে মাশরাফি বিন মুর্তজা, ৪২ উইকেট নিয়েছেন। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় প্রথম পাঁচজনের তালিকায় নিদাহাস ট্রফিতে আছেন কেবলমাত্র বাঁ হাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। অর্থাৎ হাতে ধরে নিজের কথার প্রমাণ আগেভাগেই দিচ্ছেন কোচ সালাউদ্দিন।
তারপরও টি-টোয়েন্টি বলে কথা। নিজেদের সেরাটা দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ দল। ফরম্যাট যা-ই হোক, ‘প্রিয়’ প্রতিপক্ষ ভারতের বিপক্ষে লড়াইটা হয়তো জমিয়ে তোলার চেষ্টা করবে কোর্টনি ওয়ালশের শিষ্যরা। বাংলাদেশ ছাড়ার আগে দলের এই হেড মাস্টার নিজেদের পা মাটিতে রাখছেন। লক্ষ্য ফাইনাল, কিন্তু দাবি করছেন ‘আন্ডারডগ’। বলেছেন, “দলের পরিকল্পনার ধারাবাহিক বাস্তবায়ন হলে অনেক অর্জন সম্ভব। আমরা সেটাই বারবার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি আমাদের ভালো সুযোগ (নিদাহাস ট্রফিতে) আছে। অবশ্যই আন্ডারডগ হিসেবে আমরা সেখানে যাচ্ছি। দুটি শক্তিশালী দলের বিপক্ষে খেলব। আমরা যদি ধারাবাহিক ভালো খেলতে পারি, আমরা ফাইনাল খেলার ভালো সুযোগ পাবো।”
ঘরের মাটিতে ঘাম ঝরানোর পর বাংলাদেশের মিশন শুরু হবে ৮ মার্চ। ৬ তারিখ থেকে অনুষ্ঠেয় টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে লড়বে ভারত ও স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। ৮ তারিখে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে নিজেদের মিশন শুরু করবে।
ফিচার ইমেজ- AP