শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাচীন অলিম্পিক ছিল ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া একটি অধ্যায়। একে জনসম্মুখে তুলে এনে নতুন করে অলিম্পিক উদ্বোধনের কৃতিত্ব অনেকেই দিয়ে থাকেন পিয়েরে ডি কুবার্তিন নামে এক ফরাসি অভিজাত ও ক্রীড়া সংগঠককে। তবে সত্যি কথা হল কুবার্তিন যদিও অলিম্পিকে আন্তর্জাতিক চরিত্র দান করেছিলেন, তিনি এর উদ্যোক্তা ছিলেন না। কুবার্তিন শুধু তার পূর্বসূরিদের কাজের সফল সমাপ্তি টেনেছিলেন। অলিম্পিক আসরের পুনরায়োজন কুবার্তিনের মস্তিস্কপ্রসূত ছিল না, তার অন্তত পঞ্চাশ বছর আগেই সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন গ্রীক কবি ও লেখক প্যানাজিয়োটিস সুটোস (Panagiotis Soutsos)।
অটোমানদের হাত থেকে স্বাধীন হবার পর গ্রীসের রাজা হিসেবে দায়িত্ব নেন প্রথম অটো। বন্দরনগরী নাফপ্লেও (Nafplio) ছিল নতুন এই রাষ্ট্রের প্রথম রাজধানী। রাজার সাথে প্রায় একই সময়ে নাফপ্লেওতে হাজির হন সুটোস। এখানে দ্য সান নামে একটি সংবাদপত্র চালু করেন তিনি। সেখানে গলা ফাটিয়ে বলতে থাকেন প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা। এর প্রতীক হিসেবে তিনি বেছে নেন অলিম্পিককে। কবিতার মাধ্যমেও অলিম্পিক নতুন করে শুরুর কথা বলতে থাকেন তিনি। তার ইচ্ছে ছিল প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার পুনর্জাগরণ।
১৮৩৫ সালে সুটোস সরকারের কাছে আবেদন জানান অলিম্পিক যেন নতুন করে আয়োজন আরম্ভ হয়। তিনি যুক্তি দেখান যে নতুন এই রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে শান্তি আর সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে এ রকম কোনো প্রতিযোগিতাই হতে পারে যুতসই সমাধান। অটো রাজি হন জাতীয়ভাবে বড় একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে। তবে সেই সময় অ্যাথেলেটিক্সের ইভেন্টের প্রতি মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। ফলে অটো শর্ত দেন যে কৃষি আর শিল্প এই দুই ক্ষেত্রের প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত করতে হবে জাতীয় আসরে।
এদিকে সুটোস তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৮৪২ সালে অলিম্পিকের নতুন সূচনার প্রস্তাব তার সংবাদপত্রে ছাপা হয়। তিন বছরের মাথায় এথেন্সে প্রায় এক হাজার লোকের সামনে তিনি তার প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করেন। তবে সুটোস একাই লড়ে যাচ্ছিলেন, কেউই তার কথায় বিশেষ পাত্তা দিচ্ছিল না। গ্রীকদের কাছে অলিম্পিক তখন বিস্মৃত এক অতীত।
অবশেষে সুটোসের ভাগ্যে শিকে ছিড়ল ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে গিয়ে। এর পেছনে ছিলেন ইভাঞ্জেলিস যাপ্পাস (Evangelis Zappas)। গ্রীসের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক সেনানী যাপ্পাসের জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ আলবেনিয়াতে, গ্রীক বাবা-মায়ের ঘরে। ১৯৫০ সালে তিনি রোমানিয়াতে বসবাস শুরু করেন। এখানে ব্যবসাপাতি করে ইউরোপের অন্যতম ধনবান ব্যক্তিতে পরিণত হন যাপ্পাস। জীবনে কখনো এথেন্সে আসেননি তিনি, কিন্তু সুটোসের বক্তব্য তার মধ্যে ভাবাবেগ জাগিয়ে তুলল। তিনি ১৮৫৬-তে গ্রীক সরকারকে অনুরোধ করলেন অলিম্পিক আয়োজন করতে, খরচ দেবেন যাপ্পাস।
অটোর নির্দেশে গ্রীসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক্সান্দ্রোস র্যঙ্গাভিস যাপ্পাসের সাথে বৈঠকে মিলিত হলেন। রাজার মতো তিনিও অ্যাথলেটিক্স ইভেন্টের জনপ্রিয়তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন, এবং তৎকালীন সময়ের বিচারে এই সংশয় ছিল যুক্তিযুক্ত। তবে যাপ্পাস নিজে অ্যাথলেটিক্সের ব্যাপারে খুব আগ্রহী। ফলে দুজনে একটি সমঝোতায় পৌঁছেন। র্যঙ্গাভিসের কথায় শিল্প আর কৃষি নিয়ে প্রতিযোগিতার পাশপাশি বেশ কয়েকটি অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা রাখা হলো। যাপ্পাস নিজে বিজয়ীদের নগর অর্থ পুরষ্কারের ভার নেন। সময় নির্ধারিত হল ১৮৫৯ সাল। আসর হবে এথেন্স অলিম্পিক নামে।সুষ্ঠুভাবে আসর পরিচালনার স্বার্থে গঠিত হলো এথেন্স অলিম্পিক কমিটি।
একই সময় ইংল্যান্ডে বাস করছিলেন আরেক ক্রীড়া আর শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব, তার নাম উইলিয়াম পেনি ব্রুকস (William Penny Brookes)। পেশায় শল্যচিকিৎসক ব্রুকসের কর্মস্থল ছিল ব্রিটিশ কাউন্টি স্যালোপ্সের (বর্তমান শ্রপশায়ার/ Shropshire) মাচ ওয়েনলক (Much Wenlock) শহর। প্রাচীন অলিম্পিক নিয়ে তার ছিল সীমাহীন আগ্রহ। নিজ গ্রামে অনেক বছর ধরেই তিনি আয়োজন করে যাচ্ছিলেন স্থানীয় প্রতিযোগিতার। ব্রুকস নিজে ১৮৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওয়েনলক অলিম্পিয়ান সোসাইটি। এর মূল লক্ষ্য ছিল শারীরিক, নৈতিক আর বুদ্ধিমত্তার অনুশীলন। ১৮৫৮ সালের শরতে ইংল্যান্ডে বসে একটি খবরের কাগজে এথেন্সে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিকের কথা চোখে পড়ল তার।
এথেন্সের অলিম্পিক হবার প্রায় দুই মাস আগে, ১৮৫৯ সালের জুলাইতে ব্রুকসের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হলো ওয়েনলকের বার্ষিক অলিম্পিক আসর (Annual Wenlock Olympic Games)। ব্রুকস এমনকি গ্রীসের অলিম্পিকের জন্যও নিজের পকেট থেকে পুরষ্কারের কিছু অর্থ দিয়েছিলেন। ১৮৫৯ সালের এথেন্স আসরে অলিম্পিক কমিটি ঘোষণা করেছিল যে যাপ্পাস বাদেও ইংল্যান্ডের ওয়েনলক অলিম্পিক সোসাইটি বিজয়ীদের অর্থ দিচ্ছে। গেমসের খুঁটিনাটি নিয়ে পরবর্তী বছর কমিটি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে গেমসের ফলাফল থেকে শুরু করে টিকেটের কপি পর্যন্ত ছিল। আজকের দিনেও আয়োজক শহরগুলো এরকম রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে।
যাপ্পাসের গেমসের সফল উদযাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রুকস বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নেন। ১৮৬১ সালে তিনি আয়োজন করেন শ্রপশায়ার অলিম্পিক গেমস। লিভারপুলে হেড অফিস কর জাতীয় অলিম্পিক কমিটিও বানিয়ে ফেললেন তিনি। তাদের মাধ্যমে পরের বছর লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেস এলাকাতে হয়ে গেল জাতীয় অলিম্পিকস। প্রায় ১০,০০০ দর্শক ছিল এই প্রতিযোগিতায়। ব্রুকসের উদ্যোগে এটি অনেকটা নিয়মিত আসরে পরিণত হয়। পাশাপাশি ব্রুকস দেশ বিদেশের ক্ষমতাশালীদের কাছে তদবির করতে থাকেন অলিম্পিক গেমসকে একটি বৈশ্বিক রূপ দেবার জন্য। ১৮৮১ সালে গ্রীক সংবাদমাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক একটি অলিম্পিক আসরের প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা তুলে ধরেন।
১৮৬৫ সালে বছর পর মারা যান অলিম্পিকের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা যাপ্পাস। নিজের সম্পত্তি দিয়ে যান অলিম্পিকের জন্য। এথেন্সে অলিম্পক ভবনের জন্য পুরো অর্থও রেখে যান তিনি। মৃত্যুর পর তার কবর নিয়ে তিনি বিচিত্র এক উইল করে যান। রোমানিয়াতে তার বাসভবনে তার প্রথম কবরের কথা লিখে যান তিনি। এক অলিম্পিয়াড, বা চার বছর পর তার মরদেহ তুলে আনার নির্দেশ দেন। এরপর তার হাড়গোড় চলে যাবে আলবেনিয়াতে, যেখানে তিনি জন্মেছিলেন। মাথা আলাদা করে রেখে দেয়া হবে এথেন্সে নব নির্মিত অলিম্পিক ভবনে যা চার বছরের মধ্যেই সমাপ্ত হবে বলে যাপ্পাস আশা করেছিলেন। অবশিষ্টাংশ ফিরে যাবে রোমানিয়ার মাটিতে। তবে অলিম্পিক ভবনের কাজ চলছিল ঢিমে তালে। যাপ্পাসের অলিম্পিকও চলে গিয়েছিল হিমাগারে।
গ্রীক রাজা জর্জ ১৮৭০ সালে আবার যাপ্পাসের নামে অলিম্পিক চালু করলেন। ১৮৮৮ সালে এথেন্সেও কাজ শেষ হলো ঝা চকচকে অলিম্পিক ভবনের। পূরণ হলো যাপ্পাসের শেষ ইচ্ছা, তার মাথা নিয়ে এসে রাখা হলো এই ভবনে। আজও সেখানে গেলে দেখা মিলবে যাপ্পাসের, তার নামানুসারে যা আজ যাপ্পেয়ন (Zappeion) নামে পরিচিত। নতুন এই ভবন স্মরণীয় করে রাখতে সেই বছরেই বিশেষ একটি অলিম্পিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তবে এরপর আবার সব স্তিমিত হয়ে গেল।
ইংল্যান্ডে বসে ব্রুকস কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি। তিনি নানাভাবে আন্তর্জাতিক একটি অলিম্পিকের জন্য চেষ্টা চরিত্র করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন ফরাসি অভিজাত পিয়েরে ডি কুবার্তিন (Pierre de Coubertin)। ব্রুকসের কাজকর্ম তার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল আগেই। তবে আন্তর্জাতিকভাবে অলিম্পিক নতুন করে শুরু করার কোনো প্রয়োজনীয়তা তখন তিনি বিশেষভাবে অনুভব করেননি। তবে আস্তে আস্তে তার মনোভাব পরিবর্তিত হয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসের এক প্রদর্শনীতে (Universal Exhibition in Paris) কুবার্তিন অভ্যাগত প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সাথে বেশ কয়েকটি সভা করেন। সবগুলির লক্ষ্যই ছিল আন্তর্জাতিক অলিম্পিক গেমস আয়োজনের জন্য সমর্থন তৈরি। ১৮৯০ সালের অক্টোবরে তিনি ব্রুকসের সাথে দেখা করতে ইংল্যান্ড পর্যন্ত চলে এলেন। ভিনদেশী অতিথির সম্মানে ব্রুকস ওয়েনলক অলিম্পক গেমসের বিশেষ আসর মাঠে নামান।
দেশে ফিরে কুবার্তিন পূর্ণোদ্যমে তার কাজ চালিয়ে যান। ১৮৯২ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক নিয়ে তার আহ্বান আবারও ব্যর্থ হয়। দমে না গিয়ে ১৮৯৪ সালে প্যারিসের সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কুবার্তিন বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামজাদা ব্যক্তিদের এক কংগ্রেস বা সভা ডাকেন (Congress for the Revival of the Olympic Games)। সেখানে আবারও তিনি প্রাচীন অলিম্পিকের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এবার কাজ হলো। ১৮৯৪ সালের জুনের ১৬ তারিখ সর্বোনের সেই কংগ্রেস থেকে আন্তর্জাতিকভাবে একটি অলিম্পিক আসর চালুর ঘোষণা আসে। গঠিত হলো আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। সর্বোনের কংগ্রেসে কমিটির প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন ডেমেট্রিওস ভিকেলাস (Demetrios Vikelas) নামে প্যারিসে বসবাসকারী এক গ্রীক বুদ্ধিজীবী।
চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে সর্বোনের কংগ্রেসে কিন্তু অলিম্পিকের স্বাগতিক হিসেবে নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল লন্ডনের। কেবল কুবার্তিনের চাপাচাপিতেই শেষাবধি এথেন্সের ভাগ্যে শিকে ছেড়ে। ভিকেলাস যখন এথেন্সের অলিম্পিক কমিটির সাথে এই নিয়ে আলোচনা করলেন তারা সরাসরি তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করল। শেষ পর্যন্ত গ্রীক যুবরাজের হস্তক্ষেপে আসরের রাস্তা পরিষ্কার হয়। ১৮৯৬ সালে অনুষ্ঠিত এথেন্স অলিম্পিক এখন পর্যন্ত আয়োজিত অলিম্পিকগুলোর মধ্যে অন্যতম সফল একটি আসর।
আধুনিক অলিম্পিককে বাস্তবে রূপ দেয়া কুবার্তিন ১৮৯৬-১৯২৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭ সালে জেনেভাতে তার দেহাবসান ঘটে। তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাকে কবর দেয়া হলো সুইজারল্যান্ডের লুজানে শহরে, আর হৃৎপিণ্ড নিয়ে যাওয়া হলো গ্রীসে। প্রাচীন অলিম্পিয়া নগরীর ধ্বংসস্তুপের মাঝে তৈরি সৌধে স্থান হলো কুবার্তিনের প্রাণশক্তির।