ইউরোপিয়ান লিগগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিক থেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ অন্য সব লিগের চেয়ে এগিয়ে। এই শুক্রবার মাঠে গড়িয়েছে ইপিএলের ২০১৮-১৯ মৌসুমের খেলা। দলবদলে ফেভারিট দলগুলোর অবস্থা একইরকম না থাকলেও প্রথম রাউন্ডে মোটামুটি সব বড় দলই প্রত্যাশিত জয় পেয়েছে। তবে এই প্রত্যাশিত জয়ের সূত্র মেলাতে গিয়ে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে হারতে হয়েছে আর্সেনালকে।
এবারের মৌসুমের প্রথম ম্যাচে শুক্রবার লেস্টার সিটির মুখোমুখি হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। দলবদলের বাজারে বেশ কিছু ভুল করলেও ঘরের মাঠে নিজেদের প্রথম ম্যাচে অবশ্য কোনো ভুল করেনি রেড ডেভিলরা। লেস্টার সিটির বিপক্ষে খেলা শুরুর তিন মিনিটের মাঝে পেনাল্টি থেকে পগবার করা গোলে এগিয়ে যায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। অথচ কোচের সাথে ঝামেলা, পাশাপাশি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে আসার ঝক্কি- সব মিলিয়ে বিশ্বকাপজয়ী এই ফ্রেঞ্চ মিডফিল্ডার খেলবেন কি না সেটা নিয়ে সংশয় ছিল। সেই পগবাকেই অধিনায়ক হিসেবে এই ম্যাচে নামান জোসে মরিনহো! কে জানে, হয়তো চলমান বিতর্কে কিছুটা পানি ঢালতেই মরিনহোর এই উদ্যোগ।
পগবার গোলের পর মরিনহোর সেই চিরচেনা ফুটবলই খেলতে থাকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। রক্ষণভাগ জমাট বেঁধে রেখে পাল্টা আক্রমণের আশায় কিছুটা খোলসবন্দী হয়ে যায় রেড ডেভিলরা। আর এই সুযোগে ইউনাইটেডের উপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে লেস্টার সিটি। তবে তাতে লাভ তেমন হয়নি, লেস্টার স্ট্রাইকারদের ব্যর্থতায় তাদের বেশ কিছু আক্রমণ শেষ মুহূর্তে এসে খেই হারিয়েছে। এক্ষেত্রে জেমি ভার্ডির অভাবটা বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছে লেস্টার সিটি। এ কারণেই খেলার ৬৩ মিনিটে ভার্ডিকে মাঠে নামান লেস্টার কোচ ক্লডে পুয়েল।
তবে ৮৩ মিনিটে রেড ডেভিল সেন্টারব্যাক লুক শ নিজের পেশাদার ক্যারিয়ারের প্রথম গোল করলে লেস্টারের খেলায় ফেরার আশা মোটামুটি শেষ হয়ে যায়। এ কারণেই জেমি ভার্ডির ৯২ মিনিটের গোল শুধুমাত্র ব্যবধানই কমিয়েছে, ২-১ গোলের জয় দিয়ে নতুন মৌসুমটা ভালোভাবেই শুরু করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
শনিবার প্রিমিয়ার লিগে ছিল মোট ছয়টি ম্যাচ, দিনের প্রথম ম্যাচে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের মুখোমুখি হয় টটেনহ্যাম হটস্পার। এবারের দলবদলের বাজারে একটা পয়সাও খরচ না করে অন্যরকম এক নজির গড়েছে স্পার্স, এই নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়েছে। তবে পুরনো দল নিয়েই শুরুটা মন্দ করেনি লন্ডনের এই দলটি, জান ভেট্রোগান ও ডেলে আলির গোলে অ্যাওয়ে ম্যাচে নিউক্যাসলকে ২-১ গোলে হারিয়েছে টটেনহ্যাম।
তবে সবার নজর ছিল চেলসি বনাম হাডার্সফিল্ড ইউনাইটেডের ম্যাচের দিকে। নতুন কোচ মাউরিজিও সারির অধীনে চেলসি কেমন খেলে এ ব্যাপারে সবাই বেশ আগ্রহী ছিল। প্রথম পরীক্ষায় বেশ ভালোভাবেই উতরে গিয়েছেন সারি, অ্যাওয়ে ম্যাচে হাডার্সফিল্ডকে ৩-০ গোলে হারিয়েছে তার দল। ম্যাচের শুরু থেকেই এক অন্য চেলসিকে দেখতে পায় দর্শকরা, যে দল সবসময় কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবলে অভ্যস্ত, তারাই এ ম্যাচে শুরু থেকেই সুন্দর ফুটবল খেলতে থাকে। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে ছোট ছোট পাসে আক্রমণ সাজিয়ে খেলার সিংহভাগ সময়ে নিজেদের পায়েই বল রেখেছে চেলসি।
ব্লুজদের প্রথম গোলটি আসে খেলার ৩৪ মিনিটে, উইলিয়ানের পাস থেকে এনগোলো কান্তের গোলে ১-০ তে এগিয়ে যায় তারা। প্রথমার্ধেই ব্যবধানটা দ্বিগুণ করেছে চেলসি, এই মৌসুমেই দলে যোগ দেওয়া জর্জিনহো পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নেন। দ্বিতীয়ার্ধের পুরোটা সময়েও দাপটের সাথে খেলতে থাকে চেলসি, তবে তৃতীয় গোল পেতে ৮০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় তাদের। বদলি হিসেবে খেলতে নামা ইডেন হ্যাজার্ডের অসাধারণ এক পাস থেকে গোল করে দলের বড় জয় নিশ্চিত করেন পেদ্রো।
এবারের দলবদলের বাজারে এভারটন আর উলভারহ্যাম্পটন- দুই দলই দেদারসে খরচ করেছে। তাই শনিবার এই দুই দলের মুখোমুখি লড়াই দেখার জন্যও অনেকে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। সেই আগ্রহ বিফলে যায়নি, ২-২ এ শেষ হওয়া ম্যাচটিই এই গেমউইকের সবচেয়ে জমজমাট ম্যাচ ছিল। ম্যাচের শুরু থেকেই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে দুই দল খেলা জমিয়ে তোলে। ম্যাচের প্রথম গোলটা পায় এভারটন, ৫০ মিলিয়নের বিনিময়ে দলে যোগ দেওয়া রিচার্লিসন ম্যাচের ১৭ মিনিটে গোল করে মার্সিডাইডের ক্লাবটিকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেন।
গোল হজমের পর খেলায় ফিরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে উলভস। আর তাদের কাজটা সহজ করে দেন এভারটনের অধিনায়ক ফিল জ্যাগিয়েলকা! খেলার ৪৩ মিনিটে পাগলাটে এক ফাউলের কারণে তিনি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লে দশজনের দলে পরিণত হয় এভারটন। আর সেই ফাউল থেকে প্রাপ্ত ফ্রি-কিক থেকে অসাধারণ এক গোল করে উলভসকে সমতায় ফেরান রুবেন নেভেস। দ্বিতীয়ার্ধে দশজনের দল নিয়েও সমান তালে লড়তে থাকে এভারটন। খেলার ৬৭ মিনিটে আবারো এগিয়ে যায় এভারটন। আর এবারো গোল করেন সেই রিচার্লিসন! অসাধারণ এই গোলের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন কেন তাকে চড়া দামে কিনেছে এভারটন।
তবে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি এভারটন, ৮০ মিনিটে রাউল জিমিনেজের করা গোলে ঘরের মাঠে ২-২ গোলের ড্র আদায় করেই মাঠ ছাড়ে উলভারহ্যাম্পটন। এছাড়া শনিবারের বাকি ম্যাচগুলোতে ফুলহ্যামকে ২-০ গোলে ক্রিস্টাল প্যালেস এবং কার্ডিফ সিটিকে ২-০ গোলে হারায় বোর্নমাউথ।
রবিবার লিগে মোট তিনটি খেলা ছিল, দিনের প্রথম ম্যাচে ঘরের মাঠ অ্যানফিল্ডে ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডকে আতিথ্য দেয় লিভারপুল। এবার লিভারপুলকে লিগজয়ের অন্যতম দাবিদার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, আর সেটার যৌক্তিকতা এ ম্যাচে বেশ ভালোভাবেই দেয় অলরেডরা। ম্যাচের ১৯ মিনিটে রবার্টসনের অসাধারণ এক মাইনাসে পা ছুঁইয়ে লিভারপুলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেন সালাহ। প্রথমার্ধের ইনজুরি সময়ে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন লিভারপুলের নতুন নাম্বার টেন সাদিও মানে।
৫৩ মিনিটে নিজের দ্বিতীয় গোলটি করেন মানে, যদিও এই গোলটির সময়ে তিনি পরিষ্কার অফসাইড পজিশনে ছিলেন। ম্যাচ শেষ হওয়ার ২ মিনিট আগে বদলি খেলোয়াড় ড্যানিয়েল স্টারিজের গোলে ওয়েস্ট হ্যামকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করে লিভারপুল। এই গেমউইকে এটাই সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়। একই সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া অন্য ম্যাচে মুখোমুখি হয় সাউদাম্পটন ও বার্নলি, এ ম্যাচের ফলাফল ছিল গোলশূন্য ড্র।
এই সপ্তাহের সবচেয়ে হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটির মুখোমুখি হয় আর্সেনাল। ঘরের মাঠে নতুন কোচ উনাই এমেরির অধীনে শুরুটা ভালোই করেছিলো আর্সেনাল, কিন্তু খেলার ১৪ মিনিটে স্টার্লিঙের আচমকা দূরপাল্লার এক গোলে এগিয়ে যায় সিটিজেনরাই! লিড পাওয়ার পর খেলার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেদের দিকে নিয়ে নেয় ম্যানচেস্টার সিটি। তবে প্রথমার্ধে ব্যবধান আর বাড়াতে পারেনি তারা। খেলায় ফিরতে মরিয়া আর্সেনাল দ্বিতীয়ার্ধে মিডফিল্ডার অ্যারন রামসির বদলে ল্যাকাজাত্তেকে মাঠে নামায়।
গোলশোধের বেশ ভালো একটা সুযোগ ল্যাকাজাত্তে পেয়েও গিয়েছিলেন, তবে সেই সুযোগ নষ্ট করেন তিনি। গোলের সুযোগ সিটিও নষ্ট করেছে, ৬২ মিনিটে আর্সেনাল গোলরক্ষক পিয়েঁতর চেককে একা পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হন সার্জিও আগুয়েরো। তবে সেই গোল মিসের দুই মিনিট পরেই মেন্ডির পাস থেকে গোল করে সিটিজেনদের ২-০ গোলে এগিয়ে দেন বার্নার্দো সিলভা। এরপর আর কোনো দল গোল করতে না পারায় হার দিয়েই আর্সেনালের নতুন কোচ উনাই এমেরির প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয়। আর অ্যাওয়ে ম্যাচে আর্সেনালের বিপক্ষে এই জয় দিয়ে গার্দিওলার দল প্রমাণ করে যে, শিরোপা ধরে রাখার সামর্থ্য তাদের বেশ ভালোভাবেই আছে।
সব মিলিয়ে প্রিমিয়ার লিগের প্রথম রাউন্ডের ফলাফল বেশ অনুমিতই ছিল, সেভাবে কোনো অঘটন এই রাউন্ডে দেখা যায়নি। তবে দলগুলো ভবিষ্যতে কী করবে এটা কিন্তু বেশ অনিশ্চিত। শিরোপার লড়াইয়ে আপাতত ম্যানচেস্টার সিটি ও লিভারপুলই এগিয়ে, মরিনহোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড প্রথম ম্যাচে জয় পেলেও তাদের অবস্থাটা ঠিক সুবিধার না। বিশেষ করে ইউনাইটেড বোর্ডের সাথে মরিনহোর দ্বন্দ্বের কারণে পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। রেড ডেভিলদের ভালো করতে হলে আগে মাঠের বাইরের এই সমস্যাগুলো দূর করতে হবে। সারির অধীনে প্রথম ম্যাচে দাপুটে ফুটবল খেললেও এখনই তাদের ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না। একই কথা এমেরির আর্সেনালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, প্রথম ম্যাচে হারলেও পরে ঘুরে দাঁড়ানোটা একেবারে অসম্ভব কিছু না। পচেত্তিনোর স্পার্স সেই আগের দল নিয়ে শিরোপার জন্য ঠিক কতটা লড়াই করতে পারবে সেটা নিয়েও বিশাল সংশয় রয়েছে।
সবচেয়ে অনিশ্চিত লড়াই হবে রেলিগেশন জোনে! সম্প্রচার স্বত্ত্বের টাকা ক্লাবগুলোর মাঝে বণ্টন করায় এখন ছোট ক্লাবগুলোর মাঝেও অর্থের ঝনঝনানি! এ কারণেই ফুলহ্যামের মতো প্রথম বিভাগ থেকে উঠে আসা দলও দলবদলের বাজারে বিশাল অঙ্কের খরচ করতে দ্বিধাবোধ করে না। তাছাড়া এভারটন এবার যে মানের দল সাজিয়েছে তাতে তারাও যদি শীর্ষ চারের জন্য দাবি জানিয়ে বসে তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাই প্রিমিয়ার লিগের পরের রাউন্ডগুলোও যে আরো অনেক রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষা করছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ফিচার ইমেজ : Africanstand