২০১১ সালের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পাকো আলকাসের নাম এক স্প্যানিশ বালকের জীবন যেন হুট করে আলোকিত হয়ে উঠলো। ঐ বছরই সে জীবনের ১৮তম বছরে পর্দাপর্ণ করে। আর এই ১৮ বছরেই সে জাতীয় হিরোর তকমা পেয়ে গেছে। উয়েফা ইউরোপিয়ান অনূর্ধ্ব ১৯ চ্যাম্পিয়নসশিপে চেক রিপাবলিকের বিপক্ষে দ্বিতীয়ার্ধে নেমে জোড়া গোল করে স্পেনকে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছিলো এই স্প্যানিশ বালক। তখন থেকেই স্প্যানিশদের কাছে পাকো আলকাসের নামটি অনেক পরিচিত, অনেক ভালোবাসার।
ঐ বছরই প্রাক-মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়ার ঐতিহাসিক স্টেডিয়াম মেস্তায়াতে অরেঞ্জ ট্রফি খেলতে এসেছিলো এএস রোমা। রোমার কোচের দায়িত্বে তখন লুইস এনরিকে। তাই এ ম্যাচটি তার জন্য ঘরে ফেরার ম্যাচ। এনরিকে পেলেন উষ্ণ অভিবাদন। ঘরের মাঠে তার দল রোমাকে ভ্যালেন্সিয়া হারায় ৩-০ গোলে। ৮২ মিনিটে কফিনের শেষ পেরেকটি ঠুকে জয় নিশ্চিত করেন ভ্যালেন্সিয়ার তরুণ স্ট্রাইকার পাকো।
শেষ মিনিটের বাঁশি বাজার পর জেরেমি ম্যাথিউ থেকে জর্দি আলবা, সবাই হুয়ান মাতাকে ঘিরে ট্রফি জয়ের আনন্দে মত্ত ছিলো। পাকো আলকাসের একটু দ্রুতই ড্রেসিংরুমে ফিরে যান। সেখানে তার এজেন্ট আলবার্তো ও লরেঞ্জো প্রশ্ন করেন, বাসায় তিনি কখন ফিরতে চান? তারা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু পাকো না করে দেন। তিনি বলেন, “তিনি আগে তার বাবার সাথে দেখা করবেন, যিনি স্টেডিয়ামে ম্যাচটি দেখেছেন এবং এখনও স্টেডিয়ামের বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন।“
কিন্তু আলকাসেরের জন্য অপেক্ষা করছিলো তার ১৮ বছরের সবথেকে কষ্টদায়ক মুহূর্ত। আভেনিদা ডি সুসিইয়ার যে অংশে পাকোর বাবা অপেক্ষা করছিলেন, সেখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকগণ ৩০ মিনিট ধরে তাকে বাঁচানোর প্রবল চেষ্টা চালান। কিন্তু হাসপাতালে নিতে নিতে পথিমধ্যে তিনি মারা যান। তার বয়স তখন মাত্র ৪৪। পাকোর বাবার এমন মৃত্যুতে তার পাশে এসে দাঁড়ায় ভ্যালেন্সিয়ার সমর্থকরা। এমন সময়ে তারা পাশে থেকে সাহস দেবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।
এল মেরকানেত্তিল ভ্যালেন্সিয়ানো পত্রিকার সাংবাদিক কেইতানো রস বলেন, “এই হৃদয়বিদারক ঘটনার কারণে পাকো আলকাসের রাতারাতি ভ্যালেন্সিয়ার সমর্থকদের কাছে হিরোতে পরিণত হন, যদিও গোল করার ক্ষমতাও আরেকটি কারণ। গোল করায় তার দুর্দান্ত দক্ষতা ছিলো, শৈশব থেকে এই দক্ষতা তার ভেতর বিদ্যমান।”
ভ্যালেন্সিয়ার অ্যাকাডেমিতে বেড়ে ওঠা পাকো যখন মূল দলে ডাক পেলেন, ক্লাব তখন কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। মেস্তায়া ছেড়ে নতুন স্টেডিয়ামে যেতে হয়েছিলো আর্থিক সমস্যার কারণে। এই আর্থিক সমস্যা মেটাতে ক্লাবটির বোর্ড তাদের সেরা রত্নগুলোকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। জর্ডি আলবা, ডেভিড সিলভা এবং ডেভিড ভিয়াকে বিক্রি করে দেবার পর আলকাসের মূল দলে এসে পেলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি একাদশ। কিন্তু তরুণ দলটি ছিলো প্রতিভাবান মুখে উজ্বল। তাই আলকাসের ভ্যালেন্সিয়া মূল দলে এসে মিশে গেলেন ইসকো, হুয়ান মাতা, দানি পারেহো, হুয়ান ব্রেনার্ড ও এভার বানেগা নামগুলোর সাথে।
লা লিগায় তার অভিষেক হয় ২০১২ সালের জানুয়ারিতে, রিয়াল সোসিয়েদাদের বিপক্ষে দ্বিতীয়ার্ধে নেমে। আর বিশেষ করে ইউরোপের লিগের ম্যাচগুলোতে গোল করা শুরু করেন ২০১৩/১৪ সালে। তারই নিয়মিত গোল করার উপর ভর করে সেই মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়া ইউরোপা লিগের সেমি-ফাইনালে পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। ভ্যালেন্সিয়ার অন্ধকার সময়ে দলের দায়িত্ব গ্যারি নেভিলের হাতে তুলে দিলেও তিনি একটি কাজের কাজ করেছিলেন। কোচের চেয়ার পেয়ে নেভিল মাত্র ২২ বছর বয়সী পাকো আলকাসেরের হাতে পরিয়ে দেন দলের নেতৃত্বের বিশাল দায়িত্ব। কারণ দুর্বিষহ সে সময়ে পাকো ছিলেন ভ্যালেন্সিয়ার সবথেকে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়।
কিন্তু দলের ভার কাঁধে নিয়ে অন্ধকার সময়কে আলোর পথ দেখাতে পারেননি তিনি। স্প্যানিশ সাংবাদিক রস বলেছিলেন, ” যতক্ষণ না পর্যন্ত ভ্যালেন্সিয়া তাকে অদ্ভুত পন্থায় হুট করে বিক্রি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভ্যালেন্সিয়া দলে সবথেকে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়।“
২০১৬ সালের গ্রীষ্মকালীন দল-বদলের মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়ার মালিক পিটার লিম পাকো আলকাসেরকে মাত্র ৩০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনার কাছে বিক্রি করে দেন। তার এ দল-বদলের ঘটনা প্রথমে ধামাচাপা দেওয়া ছিলো। ভ্যালেন্সিয়ার ক্লাবভিত্তিক সাংবাদিক রস সে সময় বলেছিলেন, “পাকোকে বিক্রি করার আগে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট লাই হুর চান ও কোচের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, তাকে বিক্রি করা হবে না। কিন্তু মালিকানা বদলের পর আকস্মিক এ দল-বদলের ঘটনা ঘটে যায়, যা নিয়ে ক্লাবের সমর্থকেরা প্রচন্ত ক্ষিপ্ত ছিলো।“
পাকো ছিলেন সমর্থকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাই তার আকস্মিক বিদায়ের ঘটনা তারা কখনোই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। বিদায়ের সময় প্রচন্ড ভালোবাসা রাগে রূপান্তিত হয়। তাদের রাগের পরিমাণ এতটাই ভয়াবহ ছিলো যে, বার্সেলোনা থেকে পাকোকে ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ থাকার পরও ভ্যালেন্সিয়া বোর্ড সে পথে হাঁটেনি একমাত্র সমর্থক আর ভবিষ্যত পরিস্থিতির কথা ভেবে।
বার্সেলোনা অধ্যায় শুরুর পর ক্যাম্প ন্যুতে পাকো দুই মৌসুম কাটিয়েছেন। তবে প্রায় সময়ই তা বেঞ্চে বসে। নেইমার-সুয়ারেজ-মেসিত্রয়ীর সামনে তার সুযোগই হয়নি কিছু করে দেখানোর। আর যখন সুযোগ সামনে এসেছিলো, সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার তিনি করতে পারেননি। বার্সেলোনায় তাকে এনেছিলেন লুইস এনরিকে। এই এনরিকেই ১৮ বছর বয়সী পাকোকে দেখে একসময় মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তার অধীনে তিনি ছিলেন ভোঁতা, নিস্প্রভ প্রকৃতির। এনরিকে চলে যাবার পর নতুন কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দে পাকো আলকাসেরকে আর বাজিয়েও দেখেননি।
ভ্যালেন্সিয়া ক্লাবভিত্তিক পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক কেইতানো রস পাকোর এ পরিস্থিতিকে ব্যাখা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেন, “আমি ক্যাম্প ন্যুতে তার সেরাটা দিতে কখনও দেখিনি। চারিদিকে সে সুপারস্টারদের দেখতো। আর নিজের সাথে তুলনা করতো। সে সেই পর্যায়ে যেমন ছিল না তেমনই সেই পর্যায়ে নিজেকে তোলার চেষ্টাও করেনি। সে অজস্র সমস্যায় ভুগছিলো। আসলে সে সেখানে কখনোই খুশি ছিলো না।“
পাকো আলকাসের বার্সেলোনার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি, টিকতেও পারেননি। তবে তিনি কি বার্সেলোনার সেরা ফ্লপ তালিকাতেই জায়গা করে নেবেন? আসলে তেমনটা নয়। বার্সেলোনার হয়ে আলকাসের ২ মৌসুমে ৫০ ম্যাচে ১৫ গোল করেছেন, যার ভেতর মাত্র ২২ ম্যাচে ৯০ মিনিট করে সময় পেয়েছিলেন। কোপা দেল রে ফাইনালে তার গোল আছে, সেভিয়ার বিপক্ষে বিপদজনক ম্যাচে তার জয়সূচক গোল আছে। মুন্দো দেপোর্তিভোর সাংবাদিক ম্যানুয়েল ব্রুনার মতে, “বার্সেলোনা তার পেছনে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে সেই অর্থে আলকাসের ব্যর্থ। কিন্তু সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ বলা যাবে না, যতটা ব্যর্থ হয়েছিলেন একই মৌসুমে একই ক্লাব থেকে আসা আন্দ্রে গোমেজ।“
তার বিশ্লেষণ মতে, “আন্দ্রে গোমেজ ছিলেন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। ক্লাব যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে, তার বিন্দুমাত্র ব্যবহার করতে পারেনি গোমেজ। ক্লাব এবং কোচ তারপরও তাকে ভরসা করতো। বিশ্বাস করতো, তার ভেতর সুপ্ত প্রতিভা আছে। কিন্তু যথাযথ সুযোগের পরও গোমেজ সেই বিশ্বাসের মান রাখতে পারেননি। আর পাকোর ক্ষেত্রে কিন্তু ঠিক এমনটা ঘটেনি।“
শীর্ষস্থান থেকে পতনের পর আন্দ্রে গোমেজ এভারটনে লোনে গিয়ে এখনও নিজেকে ফিরে পাননি। কিন্তু পাকো আলকাসের আবারও ফিরেছেন তার নিজের ফর্মে। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে গিয়ে তার ভেতর আবার জেগে উঠেছে গোলক্ষুধা, যেমনটা ভ্যালেন্সিয়াতে থাকাকালীন সময়ে ছিলেন তিনি। প্রথম ম্যাচে গোল, অসবার্গের বিপক্ষে দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক। বুন্দেসলিগায় মাত্র ১২৭ মিনিট খেলে পাকো করেছেন ৭ গোল। একজন হারিয়ে যাওয়া স্ট্রাইকারের ক্ষেত্রে এর থেকে ভালো পূর্ণজন্ম আর কী হতে পারে?
তবে আলকাসেরের ফিরে আসার পেছনে মূল কলকাঠি নেড়েছেন কোচ লুইসিয়ান ফাভরে। এই ফাভরেই হারিয়ে যাওয়া মারিও বালোতেল্লিকে নতুন করে শিখিয়েছিলেন গোল করতে। আসলে ফাভরে তার দলে যেমন স্ট্রাইকার চান, পাকো আলকাসের একদম সেই ঘরানার। শুধুমাত্র অব্যবহৃত মরচে পড়া লোহাকে নতুন রূপ দিয়ে ব্যবহার করছেন ফাভরে।
আলকাসেরের পুনর্জন্মের পর লুইস এনরিকে স্পেনের দুয়ার তার জন্য খুলে দেন। সেখানেও নিজের দক্ষতার প্রমাণ রেখে এসেছেন তিনি। ওয়েলস এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন গোল করে এনরিকের নজর ঠিকভাবেই কেড়ে নিয়েছেন আলকাসের।
জার্মানিতে পাকো আলকাসের যেন অনেক বেশি মুক্ত। ক্যাম্প ন্যুর সেই চাপ আর নেই। খেলতে হবে আর খেলতে নামলে গোল পেতেই হবে এই মানসিক চাপ আর বিরক্ত করছে না তাকে। বরুশিয়া ডর্টমুন্ড এমন একটি ক্লাব, যেখানে প্রবল চিন্তা ব্যতীত একজন স্ট্রাইকার খেলতে পারেন। কোনো ম্যাচে ফ্লপ থাক বা পয়েন্ট হারানোর দায়ভার একজন খেলোয়াড়কে এককভাবে নিতে হয় না। সেজন্যই ইদুনা সিগনাল পার্কে ফিরে এসেছেন ভ্যালেন্সিয়ার সেই পাকো আলকাসের, যিনি নিয়মিত গোল করতে পারেন, আবার ম্যাচও জেতাতে পারেন।