গোলকিপার হিসেবে একজন খেলোয়াড়ের মূল কাজটা কোনটা? অবশ্যই গোল আটকানো।
তবে একজন স্ট্রাইকার এবং একজন গোলকিপারের ওয়ান-টু-ওয়ান মুখোমুখি লড়াইয়ে অবশ্যই স্ট্রাইকার বাড়তি সুবিধা পান। ওয়ান-টু-ওয়ান পজিশনে গোল হবার সম্ভাবনাই বেশি। ঠিক এই কারণেই প্রতিটা দল তার ডিফেন্স লাইনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে। ডিফেন্ডারদের লক্ষ্যই থাকে, যাতে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা নিজেদের সীমানায় গোল করার মতো যথেষ্ট সময় কিংবা জায়গা না পায়। তবে এরপরও কিছু কিছু সময় চলে আসে, যখন স্ট্রাইকাররা কিপারকে একাই পেয়ে যায়। সেই অবস্থা থেকে গোল খেয়ে গেলে কিপারকে দোষ দেওয়া না গেলেও আটকাতে পারলে অবশ্যই তাকে বাড়তি কৃতিত্ব দেওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেওয়া যায় পেনাল্টি আটকাতে পারলে। গোল করার জন্য সবচেয়ে বেশি জিনিসটা প্রয়োজন সেই সময়, আর জায়গাটা পেনাল্টি নেবার সময়ই একজন খেলোয়াড় সবচেয়ে বেশি পায়। আর সেই মুহূর্তে সবচেয়ে অসহায় থাকেন গোলকিপারই। এই অবস্থা থেকে গোল রক্ষা করতে পারাটাই অনেক বড় একটা কৃতিত্ব। আর কেউ যদি এই কৃতিত্বটা বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে দেখাতে পারেন, তাহলে সেই কৃতিত্বটা নিঃসন্দেহে অনেক বেড়ে যায়।
বিশ্বকাপে অনেক বিখ্যাত গোলকিপার খেলেছেন। দিনো জফ, লেভ ইয়াসিন, গর্ডন ব্যাঙ্কস, অলিভার কান, বুফন কিংবা হালের ক্যাসিয়াস অথবা ম্যানুয়ার নয়্যার – প্রত্যেকেই অনেক বড় বড় নাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এদের কারো দখলেই পেনাল্টি সেইভের রেকর্ডটা নেই। সেই রেকর্ডটা রয়েছে এমন একজন অখ্যাত গোলকিপারের, যার নাম হয়তো অনেক মানুষই শোনেননি।
তার নাম সার্জিও গোয়কচিয়া। ১৯৯০ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনার গোলকিপার।
অবশ্য রেকর্ডটা তার একার নয়। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি (৫টি) পেনাল্টি মিস হয়েছে তিনজন গোলকিপারের বিপক্ষে – ব্রাজিলের তাফারেল, ক্রোয়েশিয়ার দানিয়েল সুবাসিচ এবং আর্জেন্টিনার গোয়কচিয়া। তবে প্রতিপক্ষের ব্যর্থতায় নয়, বরং নিজের কৃতিত্বে সেইভ করেছেন এমন গোলকিপারের সংখ্যাও তিনটি: জার্মানির হ্যারল্ড শুমাখ্যার, ক্রোয়েশিয়ার দানিয়েল সুবাসিচ এবং আর্জেন্টিনার গোয়কচিয়া। প্রত্যেকেই ৪টি করে গোল আটকে দিয়েছেন।
কিন্তু এদের মাঝেও গোয়কচিয়া একটু ব্যতিক্রম। ইনি যে দুইবার ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণকারী পেনাল্টি সেইভ করেছিলেন!
অথচ তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের তৃতীয় পছন্দের গোলকিপার। দলের প্রথম পছন্দের গোলকিপার ছিলেন লুইস ইসলাস, যিনি কি না ১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যও ছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপের দলে তাকে ১ নং জার্সিটা না দেওয়ায় তিনি অভিমানে দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। দলের দ্বিতীয় পছন্দের গোলকিপার নুরি পুম্পিদো বিশ্বকাপে খেলা শুরুও করেন। কিন্তু নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে রাশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের মাত্র ১১তম মিনিটেই ডান পা ভেঙে মাঠের বাইরে চলে আসায় কপাল খুলে যায় গোয়কচিয়ার। এর আগে আর্জেন্টিনার হয়ে কেবলমাত্র ১টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল গোয়কচিয়ার।
গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে রোমানিয়ার বিপক্ষে ১টি গোল খেলেও দ্বিতীয় পর্বে ব্রাজিলের বিপক্ষে কোনো গোল হজম করেননি। ম্যারাডোনা-ম্যাজিকে সেই ম্যাচটা পার হয়ে গেলেও সমস্যা হয়ে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে। গোলশূন্য সেই ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত গড়ায় টাইব্রেকারে।
প্রথম স্পটকিক নেন আর্জেন্টিনার হোসে সেরিজুয়েলা। সেটাতে গোল করার পর যুগোস্লাভিয়ার পক্ষে ভ্লাদিমির স্টজকোভিচ প্রথম গোলটি মিস করেন। সেটিতে অবশ্য গোলকিপারের কোনো কৃতিত্ব ছিল না, বলটা পোস্টে লেগে ফেরত আসে। বুরুচাগা দ্বিতীয় গোল করার পর রবার্ট প্রসিনেকি গোল করলেও আর্জেন্টিনা এগিয়েই থাকে। এ সময় তিন নম্বর স্পটকিক নিতে আসেন ম্যারাডোনা, কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ম্যারাডোনা পেনাল্টি মিস করে ফেলেন। সাভিচেভিচ গোল করলে যুগোস্লাভিয়া খেলায় ফিরে আসে। তিনটি করে শ্যুট নিয়ে দুই দলের অবস্থান ২-২। এরপর আর্জেন্টিনার হয়ে পেদ্রো ট্রগলিও মিস করলে আর্জেন্টিনা পিছিয়ে পড়ে।
যুগোস্লাভিয়ার জন্য সহজ সমীকরণ, বাকি দুটো গোল করতে পারলেই নিশ্চিত সেমি। এই সময়েই সবচেয়ে চাপে থাকেন গোলকিপারেরা। প্রতিপক্ষ গোল পেলেই দল বাদ পড়ে যাবে, এমন অবস্থায় গোল আটকানোটা আরো কঠিন। তার উপর দলের নেতা ম্যারাডোনা গোল মিস করায় স্বাভাবিকভাবে গোয়কচিয়ার ভেঙে পড়ার কথা। কিন্তু ব্রাঙ্কো ব্রনোভিচ এর গোল ফিরিয়ে দিয়ে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচে ধরে রাখেন গোয়কচিয়া। গুস্তাবো ডেজোট্টি শেষ গোল করার পর হ্যাডজিবেগিচের গোলও ফিরিয়ে দিলে ম্যাচের নায়ক হন গোয়কচিয়া।
কোয়ার্টার ফাইনালের বাধাটা টাইব্রেকার ভাগ্যে পেরুলেও সেমিতে আসলো সত্যিকারের বাধা। সেমির প্রতিপক্ষ ইতালি, যারা কি না আবার সেই বিশ্বকাপের স্বাগতিক। স্বাগতিক বলেই হয়তো সেই বিশ্বকাপে ইতালি ছিল দুর্দান্ত ফর্মে। একমাত্র দল হিসেবে প্রতিটা ম্যাচে সরাসরি জয় পেয়ে তারা সেমিফাইনালে উঠে এসেছে। সেমিফাইনালের আগ পর্যন্ত ইতালি কোনো গোল হজম করেনি, এবং তাদের গোলকিপার ওয়াল্টার জেঙ্গা’র ছিল ৫১৮ মিনিট গোল না খাওয়ার বিশ্বরেকর্ড। ম্যাচের ১৭তম মিনিটেই শিলাচি গোল করে ইতালিকে এগিয়ে নেন। আর্জেন্টিনার স্বপ্নের সমাধি সম্ভবত সেখানেই রচিত হয়ে গেলো। কিন্তু ৬৭তম মিনিটে ক্যানিজিয়া গোল করে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচে নিয়ে আসেন। ম্যাচের বাকি সময়টাতে আর গোল না হলে টাইব্রেকারে যায় ম্যাচটা।
আগের ম্যাচেই গোয়কচিয়ার দক্ষতা এবং কিছুটা ভাগ্যের সহায়তায় ম্যাচটা পার পেয়েছে। কিন্তু প্রতি ম্যাচে কি ভাগ্য সহায়তা করবে? তার উপর প্রতিপক্ষের পোস্টে রয়েছেন জেঙ্গার মতো কিপার। দুই দলের প্রথম তিন শ্যুটেই তিনটি গোল হয়। ইতালির ডোনাডুনির চতুর্থ শুটটি আটকিয়ে দেন গোয়কচিয়া । ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার পক্ষে চতুর্থ গোলটি করে ম্যাচে এগিয়ে নেন। সেরেনার গোল আটকিয়ে দেয়ায় আর্জেন্টিনার আর শট নেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। অনেকটা অবিশ্বাস্যভাবে ফাইনালে উঠে যায় আর্জেন্টিনা।
ফাইনালে উঠলেও ১৯৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ছিল চরম ভাঙাচোরা একটা দল। সবাই জানতো যে, বাকি দলগুলোর সাথে পাল্লা দেয়ার মতো খেলোয়াড় বলতে একমাত্র একজন খেলোয়াড়ই ছিলেন, ম্যারাডোনা। কিন্তু সেনাপতি কি একা যুদ্ধ করতে পারেন? তলোয়াড়ের সাথে ঢালটাও তো প্রয়োজন হয়। সত্যিকার অর্থে, বাকি দলগুলোর তুলনায় আর্জেন্টিনার তলোয়ারগুলো অনেক ভোঁতা ছিল। এর মধ্যে ব্রাজিল আর ইতালির বিপক্ষে গোল করা ক্যানিজিয়া ছিলেন নিষেধাজ্ঞার কারণে ফাইনালে অনুপস্থিত। ঢালটাও খুব শক্ত ছিল তা নয়, তবে ম্যারাডোনা নামক জাদুকরের ছোঁয়াতে সেটা তখন পর্যন্ত গোয়কচিয়া যথেষ্ট বলে প্রমাণিত ছিলেন।
কিন্তু এরপরও পরপর তিনবারের ফাইনালিস্ট জার্মানির সেই প্রজন্মটা সত্যিকার অর্থেই ভয়ঙ্কর ছিল। সবাই জানতো যে, শুধু শুধু আক্রমণাত্মক খেলে লাভ নেই, টাইব্রেকারে গেলে হয়তো কিছু সম্ভব। ম্যাচটা ধীরে ধীরে সেদিকেই যাচ্ছিল। কিন্তু ৬৫ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টিনার পেদ্রো মনজনকে লাল কার্ড দেখানো হলে ১০ জনের দলে পরিণত হয় আর্জেন্টিনা। তারপর ৮৫ মিনিটের মাথায় একটা বিতর্কিত পেনাল্টি পায় জার্মান। ব্রেহেমে যেদিকে পেনাল্টি শ্যুট মেরেছিলেন, ঠিক সেদিকেই গোয়কচিয়া লাফ দিয়েছিলেন। কিন্তু অল্পের জন্য গোলটা বাঁচাতে পারেননি।
বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও সেই বিশ্বকাপের অলস্টার দলে জায়গা পান গোয়কচিয়া। আর্জেন্টিনা দল থেকে তিনি বাদে সেই দলে কেবলমাত্র আর একজন খেলোয়াড়ই সুযোগ পেয়েছিলেন, ডিয়েগো ম্যারাডোনা। এমনকি আর্জেন্টিনার ইতিহাসে গোয়কচিয়া বাদে কেবলমাত্র আর একজন গোলকিপারই বিশ্বকাপের অলস্টার দলে সুযোগ পেয়েছেন, তিনি ছিলেন ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপবিজয়ী ফিল্লোল।
বিশ্বকাপের পর আর দলে সুযোগ পেতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি তার। আর্জেন্টিনা দলের হয়ে এরপর জিতেছেন ১৯৯১ আর ১৯৯৩ সালের কোপা আমেরিকা এবং ১৯৯২ সালের কনফেডারেশনস কাপ। IFFHS কর্তৃক বর্ষসেরা গোলকিপারের তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন ২ বার – ১৯৯১ আর ১৯৯৩ সালে। প্রথমবার হেরেছেন ইতালিয়ান লিজেন্ড জেঙ্গা এবং দ্বিতীয়বার হেরেছেন ডেনমার্কের গোলকিপার ইউনাইটেড লেজেন্ড পিটার স্মাইকেলের কাছে। অনেকের হয়তো জানা নেই যে, আর্জেন্টিনা তাদের সর্বশেষ যে শিরোপা জয় করেছিল, সেই কোপা ১৯৯৩’এর সেরা খেলোয়াড় ছিলেন সার্জিও গোয়কচিয়া।
তবে কোপা জিতলেও গোয়কচিয়ার স্মরণীয় পারফরম্যান্স ১৯৯০ বিশ্বকাপেই। কাপ না জিতলেও আর্জেন্টিনার জনগণের কাছ থেকে গোয়কচিয়া চ্যাম্পিয়নের সম্মানই পেয়ে গিয়েছেন।