১.
বিশ্বকাপের দিন পনেরো পরই অনুষ্ঠিত ছিল সেই টুর্নামেন্টটা, ফাইনালে উঠেছিল সর্বশেষ দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান। ফাইনালটা জমজমাটই হবার কথা ছিল।
কিন্তু প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের কষ্টার্জিত ২১৫ রানের ইনিংসের পরই বোঝা হয়ে যায় যে, ম্যাচটা একতরফাভাবেই জিততে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। একটা সময় ২০০ রানের নিচেই অলআউট হবার সম্ভাবনা ছিল পাকিস্তানের। কিন্তু সেখান থেকেই হাল ধরেন ৬ নম্বরে নামা ব্যাটসম্যান ইজাজ আহমেদ।
শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান রশিদ লতিফও দলীয় ১৪৩ রানে আউট হবার পর লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান আকিব জাভেদ, সাকলাইন মুশতাক, ওয়াকার ইউনিস এবং আতাউর রহমানকে সঙ্গী করে ৭২ রান যোগ করতে পারাটাই ছিল ইজাজ আহমেদের কৃতিত্ব। শেষ পর্যন্ত ৯ বল বাকি থাকতেই ব্যক্তিগত ৫১ রানে ইজাজ আহমেদ আউট হবার সাথে সাথেই পাকিস্তানের ইনিংসটা শেষ হলো।
১৯৯৬ সালের বিবেচনায় ২১৫ রান খুব বড় স্কোর না হলেও খুব ছোট স্কোরও ছিল না। কিন্তু এরপরও ‘হেসে খেলেই এই রানটা পার করবে শ্রীলঙ্কা’ এমন ভাবনাটা কেবল দর্শকদের মনেই নয়, পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের ভেতরেও আসার কারণটা জানতে হলে এর আগের কিছু ইতিহাস জানাটা জরুরী।
সেটাই প্রথমে জানা যাক।
২.
টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে শ্রীলংকার ইনিংসটা শেষ হবার পরই সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ৫০ ওভারে ৩৪৯ রান… ১৯৯৬ সালের বিবেচনায় তো বটেই, বর্তমানের হিসেবেও অনেক বড় স্কোর। তবে বিস্ময়ের প্রধান কারণ শুধু স্কোরটা ছিল না। এর আগেও এর চাইতে বড় স্কোর ক্রিকেটবিশ্ব দুইবার দেখেছে। এর একটা হয়েছিল ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে, তৎকালীন পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩৬০ রান করেছিল তৎকালীন ‘পুঁচকে’ শ্রীলংকার বিপক্ষে। অপর ইনিংসটা ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৯২ সালে, ইংল্যান্ডের করা। অবশ্য ইংল্যান্ডের ৩৬৩ রানের ইনিংসটা ছিল ৫৫ ওভারে করা।
সেই হিসেবে পাকিস্তানের মতো একটা শক্তিশালী বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে ৩৪৯ রান করাটা যথেষ্টই কৃতিত্বের পরিচায়ক। তবে আগেই বলা হয়েছে, কেবল রানসংখ্যাটাই বিস্ময়ের মূল কারণ নয়, মূল কারণটা ছিল রান করার ধরন। সেই ইনিংসটাতে এমন কিছু হয়েছিল, যা ক্রিকেটবিশ্ব আগে কখনো দেখেনি।
ওয়াকার ইউনিসের করা ইনিংসের প্রথম বলেই বাউন্ডারি মেরে রানের খাতা খুললেন জয়াসুরিয়া। মাত্র ৩.৪ ওভারেই শ্রীলংকার দলীয় রান হয়ে গেল ৫০। জয়াসুরিয়া ব্যক্তিগত অর্ধশত করলেন মাত্র ৩২ বলে, ৭টি চার আর ১টি ছয়ের সাহায্যে। তবে ফিফটি করার পর জয়সুরিয়া যা করলেন, তখন ৩২ বলে প্রথম অর্ধশত করাটাকেও অনেক ধীর মনে হলো। দ্বিতীয় ফিফটি করতে বল খরচ করলেন মাত্র ১৬টি, ছক্কা মারলেন ৪টি আর চার ২টি। ৪৮ বলে সেঞ্চুরী করে ভেঙে ফেললেন আজহারউদ্দিনের ৬২ বলে করা সেঞ্চুরির রেকর্ড। এর মাঝে আমির সোহেলের এক ওভারে তুলে নিলেন ৩০ রান।
১৪তম সেই ওভারের প্রথম বলটি ছিল ওয়াইড। পরের বলটি ছিল ‘নো’, কিন্তু সেই বলেই স্কয়ার কাট করে চার হাকালেন জয়াসুরিয়া। বৈধ বলের প্রথমটা থেকে কোনো রান হলো না, কিন্তু পরের চারটি বলের প্রতিটিতেই ছক্কা হলো। শেষ বলটাতে ১ রান নেওয়ায় ২৯টি রানই করেছিলেন জয়াসুরিয়া নিজে। তখন পর্যন্ত সেটাই ছিল একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১ ওভারে সবচেয়ে বেশি রান নেওয়ার রেকর্ড।
সেঞ্চুরি করার পরও আরো ৩৪ রান করেছিলেন জয়াসুরিয়া, সেটাও মাত্র ১৭ বলে। শেষ পর্যন্ত আউট হলেন ব্যক্তিগত ১৩৪ রানে, মাত্র ৬৫ বলে। ততক্ষণে ইনিংসে ১১টি ছক্কা মারা হয়ে গিয়েছে, যা সেই সময়ের আরো একটা রেকর্ড। এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার আগের রেকর্ডটা ছিল গর্ডন গ্রিনিজের, ৮টি।
জয়াসুরিয়া আউট হওয়ার পর পাকিস্তান ম্যাচে ফেরত আসতে পেরেছিল বলেই রানটা ৩৪৯ হয়েছিল। নয়তো শেষ পর্যন্ত সেটা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো, তা কল্পনারও অতীত।
৩.
তবে চমকটা কিন্তু জয়াসুরিয়া শুরু করেছিলেন বিশ্বকাপেই। ন্যূনতম ৮০ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মাঝে তার স্ট্রাইকরেটই ছিল সর্বোচ্চ (১৩১.৫৪)। ভারতের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের ম্যাচে ৭৬ বলে ৭৯ রানের একটা ইনিংস খেলে শচীন টেন্ডুলকারের ১৩৭ রানের মহাকাব্যিক রানকেও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পরাজিতের দলে। মনোজ প্রভাকরের মতো খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারও সেদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল জয়াসুরিয়ার তোপে পড়ে। তবে আসল চমকটা দেখালেন কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
১৯৯৬ সালের প্রেক্ষাপটে ২৩৫ রান নিশ্চিত জেতার মতো স্কোর না হলেও লড়াই করার মতো অবশ্যই। কিন্তু জয়াসুরিয়ার তান্ডবে মাত্র ৪০ ওভারেই রানটা টপকে গেল শ্রীলংকা।
জয়াসুরিয়া করলেন ৪৩ বলে ৮২ রান। সেই সময়ের কম বলে সেঞ্চুরীর রেকর্ড ভাঙ্গতে জয়ার প্রয়োজন ছিল ১৮ বলে ১৮ রান। তবে এতকিছুর পরও সেটাকে অনেকে ফ্লুক ভেবেই উড়িয়ে দিয়েছিল। ফ্লুক ভাবাটাও অমূলক ছিল না, ‘৯২ বিশ্বকাপে মার্ক গ্রেটব্যাচও তো তখনকার বিচারে সমসাময়িকদের চাইতে বেশ এগিয়ে ছিলেন। ৭ ম্যাচে ৩টি হাফসেঞ্চুরির সাহায্যে ৪৪.৭১ গড় আর ৮৭.৯২ স্ট্রাইকরেটের সাহায্যে ৩১৩ রান করে ক্রো’র পরিকল্পনাটাকে বেশ ভালোভাবেই সফল করেছিলেন গ্রেটব্যাচ। সেই বিশ্বকাপে তার চেয়ে বেশি রান করতে পেরেছিলেন মাত্র ৩ জন ওপেনার। কিন্তু ডেভিড বুন (স্ট্রাইকরেট ৬৮.৯১), রমিজ রাজা (স্ট্রাইকরেট ৬৪.৭৪) আর আমির সোহেল (স্ট্রাইকরেট ৬৩.৩০)-দের পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দেয়, সময়ের চেয়ে কতটা এগিয়ে ছিলেন গ্রেটব্যাচ। অথচ সেই বিশ্বকাপের পর আর গ্রেটব্যাচকে তেমন খুনে ফর্মে ফিরে পাওয়া যায়নি। কাজেই জয়াসুরিয়াকে নিয়ে সন্দেহটা অযৌক্তিক ছিল না।
সেই সন্দেহ দূর করার দায়িত্বটা নেবার জন্যেই হয়তো ইনিংসটা খেললেন জয়াসুরিয়া।
৪.
এক ইনিংস শেষেই ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ করার সুযোগ থাকলে হয়তো বা টুর্নামেন্টের কর্মকর্তারা পাকিস্তানের ইনিংসের পরই ট্রফিটা শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দিতেন। কিন্তু সেটা নিয়মের পরিপন্থী হওয়ায় ব্যাটিংয়ে নামলো শ্রীলঙ্কা। নামার পর হয়তো পাকিস্তানিরা ভাবতে থাকলেন, নিয়মটা থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। ম্যাচ হারার পাশাপাশি এখন তো মানসম্মান নিয়েই টানাটানি!
ওয়াকার ইউনিসের প্রথম ওভারে দুইটা বাউন্ডারিসহ এলো ১৪ রান। ১ ওভার করিয়েই অধিনায়ক আমির সোহেল ওয়াকারকে সরিয়ে আনলেন আতাউর রহমানকে। ফলাফল আগের চাইতেও খারাপ, সেই ওভারে ৩টি ছয় আর ১টি চারে জয়াসুরিয়া তুলে নিলেন ২২ রান। আকিব জাভেদও মার খেতে থাকলে কেউ হয়তো আমির সোহেলকে বুদ্ধি দিলেন, পেস পাল্টিয়ে স্পিন আক্রমণ আনতে।
তবে এরপরও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন এলো না। সাকলাইনের করা ওভারের প্রথম পাঁচটি বল খেললেন জয়া, স্কোরবুকে সেগুলোর রেকর্ড হচ্ছে – ৬, ৪, ৪, ৪, ১ । এর মধ্যে ব্যক্তিগত অর্ধশত রানটাও হয়ে গিয়েছে, সেটাও মাত্র ১৭ বলে। ৬ বছর আগে সাইমন ও’ডোনেলের ১৮ বলে করা হাফ সেঞ্চুরীর রেকর্ডটা ভেঙে নিজের করে নিলেন।
দলীয় ৭০ রানে শ্রীলঙ্কা একটু হোঁচট খেলো, আকিব জাভেদের বলে বোল্ড হলেন কালুভিথারানা। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, ১১টি বল খেললেও কালুভিথারানা আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে। ৭০ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপে এক পার্টনারের কোনো অবদানই নেই, ক্রিকেট ইতিহাসে এমন রেকর্ডই সম্ভবত খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর।
কালুভিথারানার বিষয়টা যদি বিস্ময়ের হয়, তাহলে এরপর যা ঘটলো, সেটা মহাবিস্ময়ের। দশম ওভারের তৃতীয় বলে ব্যক্তিগত ৭৬ রানে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে জয়াসুরিয়া আউট হলেন, বল খেলেছিলেন মাত্র ২৭ টি। পাঁচদিন আগে করা দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটি ভাঙতে জয়াসুরিয়াকে করতে হতো ১৯ বলে ২৪ রান। তবে মহাবিস্ময়ের বিষয়টা সেটা নয়। জয়াসুরিয়া আউট হবার পর শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন ছিল মাত্র ১২০ রান, সেটাও ২৪৩ বলে। উইকেটে গুণারত্নে, ডি সিলভা, মহানামা, তিলকারত্নে এবং অধিনায়ক রানাতুঙ্গার মতো নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান থাকার পরও ১৭২ রানে অলআউট হয়ে ৪৩ রানে পরাজিত হবার মতো ঘটনাকে তো মহাবিস্ময়ের বললেও কম বলা হয়।
এমন একটা ঝড়ো সুচনার পর এত অল্প রান ছুঁতে না পারার ইতিহাসটাও সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসে আর নেই।
৫.
শ্রীলঙ্কা টুর্নামেন্ট জিততে না পারলেও সেই আসরে জন্ম হয়েছিল ভবিষ্যৎ এক তারকার, ৭২.৩৩ গড় আর ২১২.৭৪ স্ট্রাইকরেটে মাত্র ৩ ইনিংসেই করেছিলেন ২১৭ রান। ক্যারিয়ারের প্রথম ১০৬ ইনিংসে শেষে ২০.৮০ গড় আর ৭৮.০৪ স্ট্রাইকরেটের একজন ব্যাটসম্যানকে নিয়ে খুব প্রত্যাশা না থাকলেই সেই আসরটাই বদলে দিয়েছিল জয়াসুরিয়ার ক্যারিয়ার। শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন ৩২.৫১ গড় আর ৯১.২৫ স্ট্রাইক রেট নিয়ে। জয়াসুরিয়ার দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীতে ক্রিকেটে এলেন শহীদ আফ্রিদি কিংবা বীরেন্দর শেবাগের মতো ব্যাটসম্যানরা। আর বর্তমান ক্রিকেটে তো হার্ডহিটারের অভাব নেই।
মার্ক গ্রেটব্যাচের হাত ধরে ইনিংসের শুরুতেই হার্ড হিটিংয়ের সূচনা হলেও ধারাবাহিকভাবে সেটার সফল প্রয়োগ করতে পারা প্রথম ব্যাটসম্যান জয়াসুরিয়াই। আর ১৯৯৬ সালের সেই সিঙ্গার কাপ টুর্নামেন্টেই যে জয়াসুরিয়া নবজন্ম হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।