গল্পের মতো একটা সত্যি ঘটনা দিয়ে শুরু করি। মার্ক টেইলরের অনবদ্য ১২৪ রানের ইনিংসের সুবাদে ১৯৯৩ সালে অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্টের প্রথম দিন বেশ ভালোভাবেই শুরু করেছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ইংলিশ বোলার পিটার সাচের স্পিন ভেলকিতে ২ উইকেটে ২২১ রান থেকে মাত্র ২৮৯ রানেই গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়াকে অল্প রানেই বেঁধে ফেলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল ইংলিশরা। মাইক অ্যাথারটনকে সাথে নিয়ে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ৭১ রান যোগ করেন অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ। অ্যাথারটন ১৯ রান করে ফিরে গেলেও ম্যাচের লাগাম ভালোভাবেই ইংল্যান্ডের হাতে ছিল। গ্রাহাম গুচকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে আসেন স্পিনের বিরুদ্ধে বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন মাইক গ্যাটিং।
অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার বল তুলে দেন ২৪ বছর বয়সী লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নের হাতে। ক্রিজে তখন মাইক গ্যাটিং, স্পিনারদের বিপক্ষে তার রেকর্ড অন্য সব ব্যাটসম্যানের চেয়ে বেশ ভালো। তাই আনকোরা শেন ওয়ার্নকে নিয়ে ঘাবড়ানোর তেমন কোনো কারণ নেই। ওয়ার্ন বল শুন্যে ঘুরিয়ে দুয়েক পা দৌড়ে অ্যাশেজে নিজের প্রথম বল ছুঁড়লেন। বল পিচ করল লেগ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে, ব্যাটসম্যান গ্যাটিং ধীরেসুস্থে খেলতে চেয়েছিলেন। বল যদি না ঘুরে তাহলে লেগ স্ট্যাম্পের পাশ দিয়ে কিপারের গ্লাভসে যাবে আর ঘুরলে প্যাড না হয় ব্যাটে লাগবে। এই বল নিয়ে ভয় পাওয়ার তেমন কিছু নেই। কিন্তু বল মাটিতে পড়ার পরেই ঘটল ভিন্ন ঘটনা, গ্যাটিং কিছু বুঝে উঠার আগেই শেন ওয়ার্নের বলটি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি লাফিয়ে আঘাত হানল অফ স্ট্যাম্পের মাথায়। অস্ট্রেলিয়ার উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলি যখন শুন্যে লাফিয়ে উদযাপন করছেন, তখন গ্যাটিং অবাক দৃষ্টিতে বাইশ গজের দিকে তাকিয়ে।
অ্যাশেজে শেন ওয়ার্নের করা প্রথম বলটি ঠাঁই পেল শতাব্দীর সেরা বলের তালিকায়। সেই থেকে শুরু, শেন ওয়ার্নকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। ঐ ম্যাচে ৮ উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়ার জয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি ম্যাচ সেরার পুরস্কারও জিতে নেন ওয়ার্ন। ক্রিকেটে তখন পেসারদের স্বর্ণযুগ চলছিল। শেন ওয়ার্ন সেখান থেকে স্পিনারদের রাজত্ব শুরু করেন। তারপর মুত্তিয়া মুরালিধরন, অনিল কুম্বলে, হরভজন সিংরাও বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের স্পিন ভেলকি দেখিয়েছেন।
১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে কেইথ এবং ব্রিডজেটের ঘরে জন্মেছিলেন শেন কেইথ ওয়ার্ন। স্কুল ক্রিকেটেই প্রতিভার কারণে বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি। তার বয়স যখন ১৬, তখন ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পান। লেগ স্পিন এবং অফ স্পিন, দুটোতেই তার সমান পারদর্শিতা ছিল। সেইসাথে লোয়ার অর্ডারে ব্যাটসম্যান হিসাবেও দলে ভূমিকা রাখতেন। সেখান থেকে তার শহরের পাশে সেন্ট কিল্ডা ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দেন। ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি ফুটবলও খেলতেন তিনি। সেন্ট কিল্ডা ফুটবল ক্লাবের হয়ে অনুর্ধ্ব-১৯ ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলেন ওয়ার্ন। ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, সেটা বুঝতে খুব বেশিদিন সময় নিলেন না।
সেন্ট কিল্ডা ক্লাব ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন ১৯৯০ সালে। ইংলিশ ক্রিকেট দল অ্যাকরিংটন ক্রিকেট ক্লাবের সাথে ১৯৯১ সালে চুক্তিবদ্ধ হন। প্রথম মৌসুমে ১৫.৪ বোলিং গড়ে ৭৩ উইকেট শিকার করেছিলেন ওয়ার্ন। ঐ বছরেই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। ভিক্টোরিয়ার হয়ে অভিষেক প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০২ রান দিয়ে শিকার করেছিলেন মাত্র ১ উইকেট। ফেব্রুয়ারিতে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া শেন ওয়ার্ন নির্বাচকদের নজরে আসেন সেপ্টেম্বর মাসে। জিম্বাবুয়ে সফরে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া ‘বি’ দলে জায়গা করে নেন তিনি। চার দিনের ম্যাচে ৫২ রান দিয়ে ৭ উইকেট শিকার করে সবার নজর কাড়েন ওয়ার্ন।
অস্ট্রেলিয়া ‘বি’ দল থেকে ফিরে এসে ডিসেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের হয়ে ভারতের বিপক্ষে খেলেন। ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১৪ রানে ৩ উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৪২ রানে ৪ উইকেট শিকার করে আসন্ন ভারত সিরিজের জন্য মূল দলের জায়গা নিয়ে নির্বাচকদের ভাবনায় চলে আসেন। সুযোগটা চলে আসল সিরিজের তৃতীয় টেস্টে। সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে নিয়মিত স্পিনার পিটার টেইলর মাত্র ১ উইকেট শিকার করলে তার পরিবর্তে সুযোগ পান শেন ওয়ার্ন।
ওয়ার্নের ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল একেবারেই চাকচিক্যহীন। ১৯৯২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তার অভিষেক ঘটে। সিডনিতে ভারতের বিপক্ষে ৫ ম্যাচ সিরিজের তৃতীয় টেস্টে খেলার সুযোগ পেয়ে প্রথম ইনিংসে ১৫০ রান খরচায় শিকার করেছিলেন রবি শাস্ত্রীর উইকেট। নিজের অভিষেক ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে আর বল করার সুযোগ পাননি। ভারতের বিপক্ষে সিরিজের চতুর্থ এবং নিজের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৭৮ রান দিয়ে ছিলেন উইকেট শুন্য। ক্যারিয়ারের প্রথম সিরিজে এরকম সাদামাটা নৈপুণ্যের পর দল থেকে বাদ পড়েন।
শেন ওয়ার্ন দলে আবারো সুযোগ পান ১৯৯২ সালের আগস্টে, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলতে আসলে। কিন্তু সেখানেও তিনি ছিলেন নিষ্প্রভ। কলোম্বো টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১০৭ রান দিয়ে ছিলেন উইকেট শুন্য। তখন তার বোলিং গড় দাঁড়ায় ৩৩৫! ঐ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের ভেলকি দেখান শেন ওয়ার্ন। অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ১৮১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা শ্রীলঙ্কা এক পর্যায়ে ৭ উইকেট হারিয়ে ১৫০ রান করেছিল। সেখান থেকে শেন ওয়ার্ন ১১ রান দিয়ে ৩ উইকেট শিকার করে অজিদের জয় নিশ্চিত করেন। ওয়ার্নের এমন পারফরমেন্সের পর শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা বলেন, “৩০০ বোলিং গড়ের বোলারের কাছে আমরা হেরে গেলাম”।
শ্রীলঙ্কা সফরের পরের ম্যাচে ৪০ রান দিয়ে উইকেট শুন্য থাকার পর এক বছরের ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো বাদ পড়লেন শেন ওয়ার্ন। পুনরায় যখন দলে সুযোগ পেলেন তখন প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ঘরের মাঠ, ক্যারিয়ারের প্রথম বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচ। মঞ্চ সাজানো ছিল, এখন শুধুমাত্র তার ভেলকি দেখানোর অপেক্ষা। প্রথম ইনিংসে ৬৫ রান দিয়ে শিকার করলেন মাত্র ১টি উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ওয়ার্ন ম্যাজিক দেখালেন। মাত্র ৫২ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট শিকার করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নিলেন। টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৭ বারের মধ্যে প্রথমবার ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেলেন নিজের প্রথম বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচে। সেই থেকে শুরু, লেগ স্পিনকে নতুন রূপ দান করলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো অ্যাশেজ সিরিজে ডাক পান তিনি। নিজের প্রথম অ্যাশেজ সিরিজে ৩৪টি উইকেট শিকার করে হয়েছিলেন সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার।
শেন ওয়ার্ন ১৯৯৩ সালে ১৬ ম্যাচে ৭২ উইকেট শিকার করে নিজের আগমনী বার্তা বিশ্বক্রিকেটকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, যা টেস্ট ক্রিকেটে এক পঞ্জিকাবর্ষে স্পিনার হিসাবে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের তৎকালীন রেকর্ড ছিল। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে ৫৯ ম্যাচে ২৯১টি উইকেট শিকার করেছিলেন ওয়ার্ন।
মাঝখানে ১৯৯৬ সালে নিজের প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন তিনি। সবসময় বড় মঞ্চে পারফর্ম করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ‘৯৬ বিশ্বকাপে ১২ উইকেট শিকার করেছিলেন। তার মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ৩৬ রান খরচায় ৪ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন তিনি। শ্রীলঙ্কার সাথে ফাইনালের আগে অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক মার্ক টেইলর বলেন, “শেন ওয়ার্ন একাই বিশ্বকাপ জিতাতে পারবেনা। শেন ওয়ার্ন তার দলের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ নয়”। ফাইনালে শেন ওয়ার্ন ৫৮ রানের বিনিময়ে ছিলেন উইকেট শুন্য। অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে শিরোপা হারায়।
মার্ক টেইলরের অস্ট্রেলিয়াকে না পারলেও স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়াকে শিরোপা জেতান শেন ওয়ার্ন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ১২ উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়াকে শেষ চারে ওঠান তিনি, এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার সেরা চার ব্যাটসম্যান গ্যারি কারস্টেন, হার্শেল গিবস, জ্যাক ক্যালিস এবং অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়েকে আউট করে অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনালে তোলেন ওয়ার্ন। পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালে ৩৩ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট দখল করে অস্ট্রেলিয়ার সহজ জয় নিশ্চিত করেন তিনি।
তার ক্যারিয়ারে সাফল্যের পাশাপাশি সমালোচনাও ছিল অনেক। ‘৯৯ বিশ্বকাপের কদিন আগে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ককে মন্তব্য করে দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। পরে অবশ্য ক্রিকেটে ফিরেই অস্ট্রেলিয়াকে শিরোপা জেতান তিনি। মার্চ ১৯৯৮ সাল থেকে জুন ২০০১ পর্যন্ত শেন ওয়ার্ন টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। সেসময়ে নানান বিতর্ক এবং অফ ফর্মের কারণে অস্ট্রেলিয়া দল থেকেও বাদ পড়েছিলেন। সেসময় ওয়ার্ন শুধুমাত্র ভারতের বিপক্ষেই ৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন, আর ঐ ৯ টেস্টে উইকেট প্রতি খরচ করেছেন ৪০ এর চেয়ে বেশি রান।
শেন ওয়ার্ন তার টেস্ট ক্যারিয়ারে ভারতের বিপক্ষে কখনোই সফল ছিলেন না। ভারতের বিপক্ষে সব মিলিয়ে ১৪টি টেস্ট খেলে ৪৭.১৮ বোলিং গড়ে শিকার করেছেন মাত্র ৪৩টি উইকেট। শেন ওয়ার্নের অন্য সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে বোলিং গড় ৩০ এর চেয়ে কম, সেখানে ভারতের বিপক্ষে ৪৭.১৮! ওয়ার্ন ২০০০-০১ ক্রিকেট মৌসুমের পুরোটা সময় আঙ্গুলের ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি। এর আগে তার পারফরমেন্স ছিল অনুজ্জ্বল। তার অবর্তমানে স্টুয়ার্ট ম্যাকগেইল ভালোই পারফর্ম করছিলেন। তাই ওয়ার্নকে দলে টিক থাকতে হলে ভালো কিছু করেই থাকতে হতো। ২০০১ সালে অ্যাশেজ সিরিজে ৩১ উইকেট নিয়ে আবারো ছন্দে ফিরে আসেন তিনি। ঐ বছরেই অ্যালেক্স স্টুয়ার্টকে আউট করে ৬ষ্ঠ বোলার হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে ৪০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন ওয়ার্ন। লেগ স্পিনের বিষে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে ঘায়েল করতে করতে কখন নিজের শরীরে নিষিদ্ধ ড্রাগ প্রবেশ করালেন তা টেরই পেলেন না।
ক্যারিয়ারে অনেকবার বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন শেন ওয়ার্ন। ক্যারিয়ারের শুরুতে বাজিকরদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করে দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন। ২০০০ সালে ইংল্যান্ডের এক সেবিকাকে অরুচিকর বার্তা পাঠিয়ে বেশ সমালোচিত হয়েছেন। একবার ধূমপান করার সময় কিছু তরুণ তার ছবি তুললে মারপিট করেও বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন। সবকিছু ছাপিয়ে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের কদিন আগে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে ক্রিকেট থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। যার কারণে তার আর বিশ্বকাপ খেলা হয়নি এবং মুত্তিয়া মুরালিধরনের সাথে শীর্ষ উইকেট সংগ্রাহকের পজিশন নিয়ে যে লড়াইটা চলছিল তাতে অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছিলেন।
২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্রিকেটে ফিরে এসে পরের কয়েক বছর খেললেন আরো ভয়ংকর রূপে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফিরতি ম্যাচের দুই ইনিংসেই শিকার করেছিলেন ৫টি করে উইকেট। ঐ সিরিজে টেস্ট ক্রিকেটে ৫০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। ২০০৪ সালের অক্টোবরে ভারতের বিপক্ষে চেন্নাই টেস্টে ইরফান পাঠানকে আউট করে ৫৩৩ উইকেট নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলারদের তালিকার শীর্ষে উঠেছিলেন। মুত্তিয়া মুরালিধরনের সাথে প্রতিযোগিতাটা বেশ ভালোভাবেই জমিয়ে তুলেছিলেন। ২০০৫ সালে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের সেরা সময় কাটান। ঐ বছর অ্যাশেজ সিরিজে অতিমানবীয় ক্রিকেট খেলেন তিনি। বল হাতে শিকার করেছিলেন ৪০টি উইকেট, টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ৮বার এক সিরিজে ৪০ উইকেট শিকারের ঘটনা ঘটেছে। শুধুমাত্র বল হাতে নন, ব্যাট হাতেও ছিলেন সফল। প্রায় ২০ ব্যাটিং গড়ে করেছিলেন ২৪৯ রান।
শেন ওয়ার্ন এখন পর্যন্ত অ্যাশেজ সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার। ৩৬টি অ্যাশেজ টেস্টে ১৯৫ উইকেট নিজের পকেটে পুরেছেন। ইনিংসে ১১বার ৫ উইকেট এবং ম্যাচে ৪বার ১০ উইকেট শিকার করেছেন তিনি।
২০০৩ সালের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ক্রিকেটে ফিরে বাকিটা সময় বল হাতে দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছিলেন ওয়ার্ন। ২০০৪ সালে ১২ টেস্টে শিকার করেছেন ৭০ উইকেট এবং ২০০৫ সালে ১৫ টেস্টে ৯৬ উইকেট শিকার করে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েন। এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের রেকর্ডটি এখনো তার দখলে। শেন ওয়ার্ন ক্যারিয়ারের শেষ ১১টি টেস্টেও ৫১টি উইকেট শিকার করেছিলেন। ওয়ার্নের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ দুটো ম্যাচই অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। ২০০৬-০৭ মৌসুমে অ্যাশেজ সিরিজের পরেই গ্লেন ম্যাকগ্রা, জাস্টিন লাঙ্গারদের সাথে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন তা আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন। নিজেদের শেষ অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ডকে ৫-০ তে হোয়াইটওয়াশ করতে বড় অবদান রাখেন তারা।
মেলবোর্নে অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসকে আউট করে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বোলার হিসাবে ৭০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন ওয়ার্ন। সিডনিতে নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচে বল হাতে তেমন কিছু করতে না পারলেও ব্যাট হাতে খেলেন ৬৫ বলে ৭১ রানের ইনিংস। সিডনি টেস্টের প্রথম ইনিংসে মন্টি প্যানেসারকে আউট করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্বিতীয় বোলার হিসাবে ১,০০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন। ক্যারিয়ারের শেষ উইকেট হিসাবে তুলে নেন ইংলিশ অধিনায়ক অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফকে। শেন ওয়ার্ন নিজের শেষ ইনিংসে আউট হয়েছেন স্ট্যাম্পিংয়ে এবং শেষ ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে।
ওয়ার্ন ১৪৫টি টেস্টে ২৫.৪১ গড়ে শিকার করেছেন ৭০৮টি উইকেট। ইনিংসে ৫ উইকেট ৩৭বার এবং ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করেছেন ১০বার। তার খেলা ১৪৫ ম্যাচের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ৯২টি ম্যাচে জিতেছে। এই ৯২ ম্যাচে মাত্র ২২.৪৭ বোলিং গড়ে ৫১০ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। একমাত্র বোলার হিসাবে নিজ দলের জয় পাওয়া ম্যাচগুলোতে ৫০০ উইকেট শিকার করেছেন তিনি।
শুধুমাত্র বল হাতে নন, শেন ওয়ার্ন বেশ কয়েকবার ব্যাট হাতেও ভেলকি দেখিয়েছেন। ২০০১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট প্রায় শতক করেই ফেলছিলেন, কিন্তু ৯৯ রানের মাথায় ড্যানিয়েল ভেট্টোরির বলে আউট হয়ে সেঞ্চুরি থেকে বঞ্চিত হন। ওয়ার্ন টেস্ট ক্রিকেটে ১৯৯ ইনিংসে সর্বোচ্চ ৯৯ রানের ইনিংস খেলে ১৭.৩২ ব্যাটিং গড়ে ৩,১৫৪ রান করেছেন। একমাত্র ক্রিকেটার হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে ৭০০ উইকেট এবং ৩,০০০ রান করেছেন তিনি।
ওয়ার্ন তার সমসাময়িক ক্রিকেটারদের তুলনায় খুব বেশি ওডিআই ম্যাচ খেলেননি। তার ক্যারিয়ারে ১৯৪টি ওডিআই ম্যাচ খেলেছেন, যেখানে রিকি পন্টিং ৩৫২ ম্যাচ, স্টিভ ওয়াহ ৩২৫ ম্যাচ এবং অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ২৮৭ ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু যত ম্যাচ খেলেছেন, দাপটের সাথেই খেলেছেন। ১৯৪ ম্যাচে শিকার করেছেন ২৯৩টি উইকেট। নিজের খেলা ২টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতার ছাড়াও ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেন।
টেস্ট ক্রিকেট ছাড়ার আগেই ওডিআই ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন ২০০৫ সালে। আইসিসি বিশ্ব একাদশের হয়ে এশিয়া একাদশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে রঙিন পোশাককে বিদায় জানান। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেও ২০০৮ সালে আইপিএলের মধ্য দিয়ে আবারো প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ফিরেন। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে অধিনায়ক এবং কোচের ভূমিকা পালন করেন তিনি। তার নেতৃত্বে আইপিএলের প্রথম আসর রাজস্থান রয়্যালস জিতে নেয়। ওয়ার্ন ২০১১ সাল পর্যন্ত আইপিএল খেলেন। তারপর নিজ দেশের টি-টুয়েন্টি লীগ বিগ ব্যাশের দল মেলবোর্ন স্টার্সের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। ২০১৩ সালে মারলন স্যামুয়েলসের সাথে মাঠের মধ্যেই তার কথা কাটাকাটি হয় এবং আম্পায়ারদের সাথেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করার কারণে তাকে আর্থিক জরিমানার পাশাপাশি এক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। ঐ বছরের জুলাইয়ে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন তিনি।
উপমহাদেশের মাঠে স্পিনাররা এবং উপমহাদেশের বাইরে পেসাররা পিচের সহায়তা পান সেটা জানা কথা। কিন্তু উপমহাদেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে বেশি ম্যাচ খেলে শেন ওয়ার্নের এমন সাফল্য অন্যান্য স্পিনারদের থেকে তাকে অবশ্যই এগিয়ে রাখবে। ক্রিকেটে লেগ স্পিনটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তো তিনিই!
তথ্যসূত্র
১) espncricinfo.com/magazine/content/story/493394.html
২) espncricinfo.com/ci/content/player/8166.html
৩) en.wikipedia.org/wiki/Shane_Warne