১
ম্যাচটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এমন কিছু না। ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে শেষ ম্যাচের আগেই যদি ফাইনালের দুই দল নিশ্চিত হয়ে যায়, তাহলে শেষ ম্যাচটি ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আর নিশ্চিত হওয়া দুই দলই যখন গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটি খেলতে নামে, তখন সেটি হয়ে যায় কেবলমাত্র ফাইনালের ড্রেস রিহার্সেল। ঠিক এমনটিই ঘটেছিল সেই টুর্নামেন্টে। পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকা উভয়েরই ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায়, দুই দলই খেলেছিল তাদের নিয়মিত একাদশের কয়েকজন খেলোয়াড় বাদ দিয়ে।
তবে পাকিস্তানের তরফ থেকে ম্যাচের গুরুত্বটা কম ছিল না। গ্রুপের আগের মুখোমুখি হওয়া ম্যাচে ৫০ ওভারে ১৯৭ রানের টার্গেট দিয়ে ৬ ওভার বাকি থাকতেই ৩ উইকেটের হার ছাড়াও অন্য একটি কারণ পাকিস্তানিদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে খুব ভালো দল নিয়েও দক্ষিণ আফ্রিকাকে তারা হারাতে পারছিল না। সেটাও ১/২টি ম্যাচে নয়, টানা ১৪টি ম্যাচে! সময়ের হিসেবে সেটা প্রায় ৫ বছর ধরে! এই ফাঁড়াটাকে কাটানোর জন্য একটা জয় তাই জরুরি ছিল। আর ফাইনালের আগে এমন এক জয় নিশ্চিতভাবেই ফাইনালের জন্য আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে।
কিন্তু কোথায় কী! গ্রুপের ম্যাচে পাকিস্তান টার্গেট দিয়েছিল ১৯৭ রান, আর এই ম্যাচে অল আউট হলো ১৬৮ রানে, টার্গেট ৫০ ওভারে ১৬৯। ১৬ ওভারে ১ উইকেট হারিয়ে ৭৪ রান করে দক্ষিণ আফ্রিকা জয়ের পথেই ছিল। ৩৪ ওভারে রান দরকার আর মাত্র ৯৫। এই অবস্থা থেকে ম্যাচ জেতার জন্য বোলিং দলের প্রয়োজন বিপক্ষে দলকে আচমকা একটা ধাক্কা দেওয়া।
সেই ধাক্কাটা তারা দিল ১৭ তম ওভারে। প্রথম বলেই উইকেট কিপারের ক্যাচে পরিণত হলেন মার্ক বাউচার। মাঝে দুইটি বল খেললেন বেঙ্কেনস্টেইন। তৃতীয় বলেই বোল্ড। মাঠে নামলেন ক্লুজনার। মাত্র একটি বল টিকতে পারলেন, দ্বিতীয় বলেই বোল্ড। তবে ওভারটা শেষ করতে পারলেন না বোলার। ইনজুরিতে পড়ে মাঠের বাইরে চলে গেলেন। কিন্তু এতক্ষণে যে জিনিসটি প্রয়োজন ছিল, সেটি পেয়ে গেছে পুরো পাকিস্তান দল- আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাসের জোরেই মাত্র ১০১ রানে অল আউট করলো তারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে। পরে ফাইনাল ম্যাচেও জিতে একেবারে টুর্নামেন্টটাই জিতে নিল পাকিস্তান।
একটি মাত্র ওভারেই সবকিছুর মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সেই বোলারের নাম শোয়েব আখতার। সেই ম্যাচে তার বোলিং ফিগার ছিল ৪.৫ ওভার বল করে ৯ রানে ৩ উইকেট, সাথে হন ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
আজ শোনানো যাক তার কিছু গল্প।
২
যে সময়টায় তিনি ক্যারিয়ার শুরু করলেন, সেটা পাকিস্তান ক্রিকেটে একজন উঠতি ফাস্ট বোলারের জন্য সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল বললেও সম্ভবত ভুল বলা হবে না। সেরা হবার জন্য শুধু যোগ্যতা থাকলেই হতো না সেখানে, এর সাথে সাথে দলে জায়গাও ফাঁকা থাকতে হতো। পাকিস্তান ক্রিকেটে তখন টু-ডাব্লিউ যুগ চলছে। আকিব জাভেদের মতো বোলার সে দলে সুযোগ পান না। পাইপলাইনে সবচেয়ে গতিময় বোলার হিসেবে তখন উচ্চারিত হচ্ছে মোহাম্মদ জাহিদের নাম, যিনি কিনা অভিষেক টেস্টেই ১১ উইকেট পেয়ে হৈ চৈ সৃষ্টি করে ফেলেছেন। আতাউর রহমান কিংবা শহীদ নাজিরের মতো ফাস্ট বোলারও দলে আসা-যাওয়ার মাঝে আছেন।
এই কারণেই ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টেই দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষে এক ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়ার পরেও দলে জায়গা নিশ্চিত করতে পারছিলেন না শোয়েব আখতার। তবে বোলিং স্টাইলটা অনেকটা ওয়াকার ইউনুসের মতো হওয়ায় অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি। অনিয়মিতভাবে ওয়াকার কিংবা ওয়াসিমের অনুপস্থিতিতে পাকিস্তান দলে আরো কয়েকটা সুযোগ পাচ্ছিলেন, কিন্তু দলে জায়গা করে নেবার মতো পারফর্মেন্স দেখাতে পারছিলেন না।
সুযোগটা মিলে গেল ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের ভারত সফরের সময়। সিরিজটা প্রথমে ছিল ৩ টেস্টের, কিন্তু পরবর্তীতে তৃতীয় টেস্টটি এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলায় সিরিজ হয়ে যায় ২ টেস্টের। এই দুই টেস্টেও শোয়েব সুযোগ পাননি, পেলেন এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়ন্সশিপের ম্যাচে; সেটাও তার নিজের আইডল ওয়াকার ইউনুসের জায়গায়।
এই টেস্টেই সবার দৃষ্টি কেড়ে নিলেন শোয়েব। ব্যাটিংয়ে নেমে পাকিস্তান অল আউট হয় মাত্র ১৮৫ রানে। ভারতীয় সেই ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে এই রান শিশু সমতুল্যই। তবে ভারতীয় ইনিংসের শুরুতে ধাক্কাটা দেন শোয়েবই। লক্ষণকে বোল্ড করে প্রথম ব্রেক-থ্রুটা এনে দেন তিনি। পরে ক্রিজে সেট হয়ে যাওয়া দ্রাবিড়কে বোল্ড করেন দুর্দান্ত এক ইন-সুইংগারে। মাঠে নামলেন শচীন টেন্ডুলকার। প্রথম বলেই শোয়েবের এক অসাধারণ ইন-সুইংয়ে তিনিও বোল্ড। পুরো মাঠ নিশ্চুপ, শোনা যাচ্ছিল শুধুমাত্র শোয়েবের উল্লাসের আওয়াজ। শুরু হয়ে গেল শোয়েবের উত্থান। প্রথম ইনিংসে আরেকটি উইকেট পান, সবগুলোই বোল্ড। পরের ইনিংসে পান আরো চার উইকেট। ম্যাচটা জিতলো পাকিস্তান।
সেই সিরিজের পরেই ভারতের মাঠে পাকিস্তান-ভারত-শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে শুরু হলো একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ। সেখানে ৫ ম্যাচে পেলেন ১৫.৪৪ গড়ে ৯ উইকেট, ইকোনমি রেট ৩.৪৭। দল চ্যাম্পিয়ন হলো আর ক্রিকেট বিশ্ব পেল এক নতুন গতির রাজাকে। এরপর শারজাহর একটি সিরিজে নিলেন ৫ ম্যাচে ১১ উইকেট, গড় ছিল ১৫ আর ইকোনমি রেট ৩.৭৫। সাথে দল হলো চ্যাম্পিয়ন।
তবে এগুলো তো পরিসংখ্যানের অঙ্ক, পরিসংখ্যান আপনাকে এটা বলতে পারবে না যে, ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা তার গতির সামনে কতটা ভীত ছিল। বিশেষ করে শোয়েবের বোলিং এর সামনে সৌরভ গাঙ্গুলীর নাস্তানাবুদ হওয়া সেই সময় ক্রিকেটপ্রেমীদের বেশ একটা আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। এই সিরিজের পরেই শুরু হলো বিশ্বকাপ ক্রিকেট।
৩
বিশ্বকাপে শোয়েব ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। তার গতির সামনে প্রায় সব ব্যাটসম্যানই অসহায় ছিলেন। ১০ ম্যাচ খেলে সংগ্রহ করলেন ১৬ উইকেট, দল উঠলো ফাইনালে। তবে ফাইনালে ব্যাটিং ব্যর্থতায় পাকিস্তান হেরে গেল।
দল চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও তিনি একাদশের প্রথম পছন্দের খেলোয়াড়ে পরিণত হন। ক্যারিয়ারের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কখনো গতির সাথে আপোস করেননি। আন্তর্জাতিক ইতিহাসে তিনিই প্রথম বোলার, যিনি ১০০ মাইলের উপর গতিতে বোলিং করেছেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ওয়ানডে সিরিজে ক্রেইগ ম্যাকমিলানের বিপক্ষে তিনি এই কীর্তি গড়েন। যদিও আই.সি.সি এই স্বীকৃতিকে মূল্যয়ন করেনি, কারণ তাদের মতে, যে যন্ত্র দিয়ে গতি পরিমাপ করা হয়েছিল সেটি মানসম্পন্ন ছিল না।
তবে সেই বিতর্ককে পেছনে ফেলে শোয়েব ২০০৩ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বল করেন ১৬১.৩ কি.মি./ঘণ্টা গতিতে, যা কিনা আনুষ্ঠানিকভাবে একজন বোলারকে প্রথমবারের মতো ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতিতে বোলিং করার স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে ব্রেট লি আর শন টেইট ১০০ মাইলের গতি পেরুতে পারলেও, শোয়েবকে ছাড়াতে পারেননি। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি গতির বলের রেকর্ডটা তাই এখন পর্যন্ত শোয়েবেরই রয়ে গিয়েছে। এছাড়া পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই তিনি মোটামুটি ঘণ্টায় ১৫০ কি.মি. গতিতে বল করে গেছেন। এই গতির কারণেই তিনি আলোচনায় এসেছেন, আবার এই গতিই তাকে বারবার ইনজুরিতে পাঠিয়েছে। তবে কখনোই তিনি গতি কমানোর কথা ভাবেননি।
ক্যারিয়ারে তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য সফলতা ছিল সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাদের মাঠেই ওয়ানডে সিরিজ জয়। সিরিজের প্রথম ম্যাচটি খেলতে পারেননি। ১৭৭ রানের পুঁজি নিয়ে পাকিস্তান সেই ম্যাচে হারে। দ্বিতীয় ম্যাচে শোয়েব মোটামুটি বোলিং করেন, উইকেট পান ২টি। ম্যাচটিও জেতে পাকিস্তান। শোয়েব মূল খেলাটা দেখান সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ম্যাচে। ৮ ওভার বল করে পান ৫ উইকেট। তার শিকারে লোয়ার অর্ডারের এক গিলেস্পির সাথে পন্টিং, মার্টিন, লেহম্যান আর বেভান- সবাই ছিলেন টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যান। সেই ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচের সাথে জিতে নেন ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কারও।
১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর থেকে ২০০৫/০৬ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজ খেলেছিল মোট ১৬টি। এর মাঝে তারা সিরিজ হেরেছিল মাত্র ২টি, তার মাঝে একটি বলতে গেলে পুরোপুরি শোয়েবের কাছেই। কতটুকু শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে শোয়েব পরাস্ত করেছিলেন, সেটিও ভেবে দেখার বিষয়। ২৫৭ রান তাড়া করতে গিয়ে মাত্র ১৬৫ রানে অল আউট হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া।
৪
বিতর্কিত কাজ আর ইনজুরির জন্য তার ক্যারিয়ার বারবার বাধাগ্রস্ত হয়। কখনো অবৈধ বোলিং অ্যাকশন, কখনো ড্রাগ গ্রহণ, কখনো সতীর্থদের সাথে দুর্ব্যবহার কিংবা কখনো ইনজুরির কারণে বারবার দল থেকে বাদ পড়েছেন। এছাড়া একবার পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের বিপক্ষে প্রকাশ্যে নেতিবাচক কথা বলে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন। কিন্তু তার পারফর্মেন্স তাকে বারবার ফেরত এনেছে। নিরবচ্ছিন্ন ক্যারিয়ার না হওয়ার কারণে টেস্ট উইকেট তার মাত্র ১৭৮টি আর ওয়ানডে উইকেট ২৪৭টি। ২০১১ বিশ্বকাপে তিনি তার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন।
পরবর্তীতে তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের পক্ষে। প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি হন শক্তিশালী দিল্লী ডেয়ারডেভিলসের। কলকাতার সংগ্রহ ছিল মাত্র ১৩৩ রান। কিন্তু এই স্বল্প রানকেই অনেক বড় বানিয়ে ফেলেন শোয়েব। মারমুখী ব্যাটসম্যান শেবাগকে আউট করেন প্রথম বলেই। ২৮ রানের মাঝেই শেবাগ, গম্ভীর, ডি ভিলিয়ার্স আর মনোজ তিওয়ারীর মতো টপ অর্ডারের চারজন ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যান। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, মাত্র ৩ ওভার বল করে ১১ রানের বিনিময়ে ৪টি উইকেটই পান শোয়েব। ম্যান অব দ্য ম্যাচও হন তিনি। কিন্তু এখানেও পরবর্তীতে ইনজুরির জন্য তিনি সব ম্যাচ খেলতে পারেননি।
প্রচণ্ড গতিতে বোলিং করার কারণে তিনি প্রতিপক্ষের কাছে আতঙ্কের অপর নাম ছিলেন। তবে এর সাথে রিভার্স সুইং, বাউন্স, ইয়র্কার কিংবা মারাত্মক স্লোয়ার দিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
তবে তার উইকেট সংখ্যা কিংবা অন্য কোনো কীর্তিই ইতিহাস সেভাবে মনে রাখেনি। মনে রেখেছে তার গতিকেই। ক্রিকেট ইতিহাসে যখনই নতুন কোনো গতিদানব আসবে, তখনই তাকে তুলনা করা হবে শোয়েব আখতারের সাথে। দেখা যাক, নতুন কেউ এসে ছাড়িয়ে যেতে পারে কিনা রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেসকে।
বি.দ্র: সকল পরিসংখ্যান ৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ইং পর্যন্ত।
ফিচার ইমেজ: PRESS ASSOCIATION