লেখাটি যখন তৈরি হচ্ছে, বাংলাদেশ তখন বিশ্বকাপের পয়েন্ট টেবিলের ছয় নম্বরে। বৃষ্টির আশীর্বাদের সাথে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘আপসেট’ ঘটিয়ে শ্রীলঙ্কা এখন বাংলাদেশের পুরনো অবস্থান, অর্থাৎ পাঁচ নম্বরে জায়গা করেছে। অন্যদিকে, সাত ম্যাচে তিনবার বাংলাদেশকে হারিয়ে মুহুর্মুহু গর্জন আফগানদের। হুমকি, এবারও হারাবে তারা। একইভাবে, বাংলাদেশও মোহাম্মদ নবী-রশিদ খানদের হালকাভাবে নিচ্ছে না। দলের ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ মিঠুন তো বলেই দিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার চেয়েও আফগানিস্তান বাংলাদেশের জন্য বেশি কঠিন।
তার কথার পেছনেও কারণ সুস্পষ্ট। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিতলে লাভ, হারলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আফগানিস্তানের বিপক্ষে পুরনো পরিসংখ্যানের চাপে থাকবে বাংলাদেশ, যে কারণে হারলেই ক্ষতি বেশি।
এদিকে, বাংলাদেশ দল উইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দু’টি ম্যাচ জিতেছে, লঙ্কানদের বিপক্ষে মাশরাফি বিন মুর্তজার ভাষায়, ‘শিওর শট’ হাতছাড়া করেছে বৃষ্টির বাগড়ায়। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে একটুর জন্য জয় হাতছাড়া, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৮২ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে নিজেদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ওয়ানডে রান তুলেও ৪৮ রানের হার; সবকিছু মিলিয়ে একটু একটু করে সেমিফাইনালের স্বপ্ন মিলিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের। আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের বিপক্ষে নিজেদের শেষ তিন ম্যাচে জিতলেও যে সেমিফাইনাল নিশ্চিত হবে, সেটিও বলা ভার।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের বোলিং ব্যর্থতা, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে উইকেট বুঝতে না পারা, সব বিভাগে মোটামুটি ভুল করা, সবচেয়ে বড় কথা প্রায় সব ম্যাচেই টুকটাক অনফিল্ড ফিল্ডিংয়ে ভুল করছে বাংলাদেশ। এত কিছুর পেছনে বাংলাদেশ দলের ওপেনার তামিম ইকবাল দায় দিচ্ছেন তরুণ, তথা অনভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের। তার চিন্তাটা মূলত ব্যাটিং নিয়েই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মুশফিক-রিয়াদের জুটি পর্যন্ত খেলায় ছিল বাংলাদেশ। তারপর সাব্বিরের ০ রানে আউট হওয়া, মিরাজের ব্যর্থতা; সবকিছু মিলিয়ে নিমিষেই ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়েছিল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা।
অজিদের বিপক্ষে ৭৪ বলে ৬২ রানের ইনিংস খেলা তামিম মনে করিয়ে দিয়েছেন, ৩০ ওভারের মধ্যেই বাংলাদেশ ২০০ রান তুলে ফেলেছিল। শেষ ২০ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৮২ রান। ট্রেন্টব্রিজের ওই ব্যাটিং স্বর্গে যা খুবই সম্ভব ছিল। প্রয়োজন ছিল কেবল খানিকটা টি-টোয়েন্টি মানসিকতার ক্রিকেট খেলার। তরুণরা বাংলাদেশকে সেটিই এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আবারও বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ দল এখনও তার চার সিনিয়র ক্রিকেটারের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল।
তামিম এ প্রসঙ্গে বলেন,
‘সত্যি কথাটা হল, আমাদের দলে খুব বেশি অভিজ্ঞ ক্রিকেটার নেই, যারা বড় লক্ষ্য তাড়া করে খেলতে পারে। আমি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্যাট করার সময় স্কোরবোর্ডের দিকেই তাকাচ্ছিলাম না। কারণ, আমি চিন্তা করছিলাম যে, যদি আমরা ৩০ ওভারের মধ্যে ১৮০-২০০ রান পার করতে পারি, তাহলে বাকি ২০ ওভারে আমাদের কিছু সুযোগ থাকবে।’
সুযোগটা কী ধরনের? ব্যাখ্যা দিয়েছেন তামিম নিজেই। বলেছেন,
‘কারণ হল, আপনি যদি শুরু থেকেই খুব বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ব্যাট করতে থাকেন, তাহলে যথারীতি উইকেট হারাবেন, সব মিলিয়ে তখন ৩৩০-৩৪০ রান করাও সম্ভব হবে না। আমাদের যদি শেষ ২০ ওভারে ১৬৯-১৭০ রান করতে হয়, তাহলে আমাদেরকে টি-টোয়েন্টি মেজাজে শেষ ২০ ওভার খেলতে হতো। মুশফিক-রিয়াদের জুটি সেভাবেই খেলছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রিয়াদ ভাই আউট হওয়ার পর আমরা আর এগোতে পারিনি।’
ম্যাচে নিজে যেভাবে আউট হয়েছেন, তা নিয়ে তামিম বিরক্ত। দ্বিতীয় উইকেটে সাকিব আল হাসানের সাথে ৭৯ রানের জুটি গড়েছিলেন, চেষ্টা করছিলেন দলকে এগিয়ে নেওয়ার। কিন্তু নিজে আউট হয়ে জুটি ভাঙলেন।
তামিমের ভাষায়,
‘আমি আর মুশফিক ভালোভাবে এগোচ্ছিলাম, যখন সাকিবের সাথে আমার জুটিটা ভাঙল। আমরা ভালোই খেলেছি। কিন্তু আমরা আরও ভালো খেলতে পারতাম, যদি ভুল সময়ে উইকেট না হারাতাম।’
এখানে সূক্ষ্ম একটা ব্যাপার আছে। বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপে ভালো করছে এখানকার রানের উইকেটে। তামিম ইকবাল মনে করেন, তার দল বিশেষ করে রান চেজ করার ব্যাপারে এগিয়ে আছে। শেষ কয়েক ম্যাচেই তাদের এই আত্মবিশ্বাস এসেছে। ড্রেসিংরুম বিশ্বাস করে, তারা যদি প্রতিপক্ষকে ৩৩০ রানের মধ্যে গুটিয়ে দিতে পারে, তাহলে যেকোনো প্রতিপক্ষকে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ হেরেছে বোলিংয়ে শেষ ৩-৪ ওভারে। যেটাকে ক্রিকেটের ডেথ ওভার বলা হয়, সেখানে অজি হিটার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ১০ বলে ৩২ রানের ইনিংস খেলেছেন। ৪০ ওভারে যেখানে অস্ট্রেলিয়ার ২৫০ রান ছিল, সেখানে ৫০ ওভারে শেষ হয় ৩৮১ রান নিয়ে।
তামিম বলেন,
‘একটা ইতিবাচক ব্যাপার হল, শেষ দুই ম্যাচে আমরা ৩০০ রান পার করেছি, দুইটাতেই রান চেজ করতে গিয়ে। এটা আপনাকে আলাদা আত্মবিশ্বাস দেবে যে আপনি যদি প্রতিপক্ষ দলকে ৩২০-৩৩০ রানের মধ্যে আটকে রাখতে পারেন, তাহলে আপনার জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কিন্তু আপনি যদি আমাদের বোলিং দেখেন, (অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে) শেষ ৩-৪ ওভারে আমাদের হাত থেকে ম্যাচ ছিটকে গিয়েছিল। প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভুল করেছে। আমরা সেখানেই হেরে গেছি। তারপরও আমরা চেষ্টা করেছি যতটা ঠিকঠাক করা যায়।’
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারের পর বাংলাদেশ পয়েন্ট টেবিলের পাঁচ নম্বরেই ছিল, ভারত ছিল চার নম্বরে। এখন পয়েন্ট টেবিলে ঝড়ের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। নিচের দলগুলো এগিয়ে আসা, কিংবা উপরের চার দল অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং ভারত; এই চার দলের মধ্যকার ম্যাচগুলোর ফলাফল; সবকিছুর উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশ দিনশেষে পয়েন্ট টেবিলের কোন অবস্থানে থাকবে। যদিও তামিম মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, বিশ্বকাপের সেমিতে যাওয়ার সম্ভাবনা এখনও বাংলাদেশের রয়েছে। অন্তত খাতা-কলমে তো বটেই।
সেই আশার তরী ভাসিয়েই বললেন,
‘দেখুন, এখনও আমাদের সুযোগ আছে (সেমিফাইনালে যাওয়ার)। আমার মনে হয় না, দলের কোনো ক্রিকেটার এখনও ভেবেছে যে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে। সবাই যেটা ভাবছে, তা হলো আমরা যদি শেষ তিন ম্যাচ (আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারত) জিততে পারি, তাহলে অবশ্যই আমাদের সামনে সেমিফাইনালে যাওয়ার সুযোগ থাকবে।’
তিনি আরও বলেন,
‘তো এখন পর্যন্ত আমাদের যে পয়েন্ট আছে; যে পরিস্থিতিতে আমরা আছি, আল্লাহ না করুক আমরা যদি সেমিতে পৌঁছতে না-ই পারি, তাহলে আমরা যেভাবেই হোক পাঁচ নম্বর পজিশনে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করতে চাইবো।’
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভাগ্যে কী আছে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এবারের বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে নিজেদের ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ দল। মাঠের পারফরম্যান্সেও তা নিয়মিত প্রমাণ করে চলেছে দলের ক্রিকেটাররা। কিন্তু ঘুরফিরে সেই একই কথা আবার চলে আসে, পঞ্চপাণ্ডব তথা তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং মাশরাফি বিন মুর্তজার বাংলাদেশ। যদিও দলের কোচ স্টিভ রোডস এই পাঁচ জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারকে সব কৃতিত্ব দিতে নারাজ; তিনি তরুণদের প্রশংসা করতে চান, তাদেরকে সুযোগ দিতে চান। তারপরও মাঠে পারফরম্যান্সে অন্তত ব্যাটিংয়ে বারবার তামিম-সাকিবরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তারাই সেরা।
তামিমের কথা ভুল প্রমাণিত করতে হলে এখন এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের। মোমবাতি নেভার আগে একবার দপ করে জ্বলে ওঠে, সেভাবে জ্বলে ওঠা চাই শেষ তিন ম্যাচে, সবাইকে একসাথে।