ঘড়ির কাঁটাটা ঘুরিয়ে একবার পেছন থেকে ঘুরে আসা যাক।
সোয়া এক বছর আগে ইংল্যান্ডের টেস্ট দলটার দায়িত্ব যখন বর্তাল বেন স্টোকস-ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কাঁধে, এর চেয়ে নাজুক অবস্থায় কোনো দলকে আবিষ্কার করা একটু কঠিনই। আগের ১৭ টেস্টে মাত্র এক জয়। অস্ট্রেলিয়া থেকে ক্যারিবিয়ান, একেকটা সফর যেন আসছিল দলটাকে তল থেকে আরও তলানিতে নিতেই। ম্যাককালাম-স্টোকসকে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল এই সংকল্পেই, ‘এবার ভিন্ন কিছু হোক।’
তবে সেই ভিন্নতাটা যে এমন করে আসবে, বদলে যাবে টেস্ট দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই, সাধারণ দর্শক হিসেবে এমন কিছু ভাবাটা কষ্টকল্পনাই হতো। এমন করে টেস্ট ব্যাটিংয়ের সংজ্ঞা বদলে ফেলেছে যে, ব্যাটিংটাই নজরে পড়ছে সবার। ধরে ফেলা যাচ্ছে আচমকা খেলা দেখতে বসেই, ইংল্যান্ডের টেস্ট ব্যাটিং বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে আদ্যন্তকালের টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে। গত ১৪ টেস্টে ইংল্যান্ড ব্যাট করেছে ৪.৮৩ রান রেটে; অন্তত ৫ টেস্ট নেতৃত্বে ছিলেন, এমন আর কোনো অধিনায়ক দলের স্কোরিং রেট তুলতে পারেননি ৩.৬৬-এর ওপরে। ইতিহাসেই তো রেকর্ড ছিল না এক বছরে তিনটা সফল ২৫০ রান তাড়া করার, ইংল্যান্ড চারটা করেছে গত বছরই। ব্যাটিংয়ের এই পরিবর্তনটা এতই সুবিশাল আর অকস্মাৎ যে, সাংবাদিক অ্যান্ড্রু মিলার একটা নামও দিয়ে দিয়েছেন এর, ‘বাজবল’।
তবে, বাজবল মানে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং বলে থেমে গেলে এর সত্যিকারের রোমাঞ্চটা হাতছাড়াই হচ্ছে আপনার। ওভারপ্রতি প্রায় ৫ করে রান তুললে যেরকম ধুন্ধুমার ক্রিকেট বোঝায়, ইংল্যান্ডের ব্যাটিং কিন্তু মোটেই সেরকম নয়। রান করার শিল্পটাকে বরং পরের ধাপে উঠিয়েছে তারা, যেখানে গায়ের জোরের চেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে ফাঁকা জায়গা খোঁজা। তারা বাউন্ডারি হাঁকাতে চাইছে এমন এমন জায়গাতে, যেখানটা বিরান।
উদাহরণ হিসেবে এজবাস্টন টেস্টের চতুর্থ দিন সকালে জো রুটের রিভার্স স্কুপ মনে করুন। সেই শটের আগে অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের সাজানো ফিল্ড সেটআপটা দেখুন। থার্ডম্যান ফাঁকা করে সাজিয়েছিলেন একদম পুরোদস্তুর টেস্ট মেজাজী ফিল্ড সেটআপ। তিন স্লিপ, এক গালি, কিন্তু কাভার ফাঁকা। যদি ব্যাটার চার মারতে চান, অফ স্টাম্পের বাইরের বল ড্রাইভই করতে হবে। সেখানে একটু গড়বড় হলেই ক্যাচ দেবেন উইকেটের পেছনে, এমন সুখস্বপ্নই দেখছিলেন কামিন্স। কিন্তু, এসবের কিছুই না করে দিনের প্রথম বলেই রিভার্স স্কুপ খেললেন রুট। সেই বলটা ব্যাটে-বলে না হলেও তাদের ক্রিকেট-দর্শনের বার্তাটা পরিষ্কারই দিয়ে দিলেন রুট। স্কুপ কিংবা সুইপে তিনি বরাবরই ভালো, রান করেছেন হাজারের বেশি। তাই, রান করার সুযোগ যদিও খুঁজবেন, তার জন্য বাড়তি ঝুঁকি নয়, বরং সবচেয়ে নিরাপদ সুযোগটাও তারা বাছবেন।
আর সুযোগ কাজে লাগানোতেও যে তারা সিদ্ধহস্ত, সেটাও বোঝা গিয়েছিল পরের ওভারেই। স্কট বোল্যান্ডকে তিন বলের মধ্যে দু’বার রিভার্স স্কুপ করলেন রুট, রান এলো ১০। আক্রমণ কী, কামিন্স তখন খুঁজলেন রানের লাগাম টেনে ধরার উপায়।
কেবল এই একবারই নয়, বার্মিংহাম টেস্টের পুরো সময়টা জুড়েই অস্ট্রেলিয়াকে খেলতে হলো প্রতিরোধের খেলা। এমনকি ম্যাচের প্রথম বলেই কামিন্স বাউন্ডারিতে রাখলেন ডিপ পয়েন্ট ফিল্ডারকে। প্রথম থেকেই উইকেট নেওয়ার বদলে অস্ট্রেলিয়াকে ভাবতে হচ্ছিল চার বাঁচানোর কথা। অস্ট্রেলিয়াকে লম্বা সময় অনুসরণ করে এলে আপনিও জানেন, রক্ষণের এই খেলাটা খেলে অস্ট্রেলিয়া অভ্যস্ত না।
তাতেও লাভের লাভ কিছু হলো না। অ্যাশেজের প্রথম বলেই জ্যাক ক্রলির ব্যাট থেকে চার এলো কাভার দিয়ে।
‘পাটা উইকেট। টস জিতে ব্যাট। “প্রথম ঘণ্টাটা বোলারদের দাও, তারপর দিনটা তোমার’ মেনে প্রথম সেশনে এই ৭০-৮০ তোলা। দিন শেষে ৩/৪ উইকেট হারিয়ে ২৮০-৩০০’ – এই অলিখিত নিয়মকেই যেন বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে ‘বাজ’ ম্যাককালামের ইংল্যান্ড। আদ্যিকালের ছকে বাঁধা চিত্রনাট্যটাকে বাতিল বলতে চাইছেন তারা। ম্যাচের প্রথম ঘণ্টা বোলারদের দেওয়া কেন, প্রথম বল থেকেই ব্যাট হাতে নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে ম্যাচের। প্রথম সেশনেই গুড়িয়ে দিতে চাইছে বোলিং আক্রমণ। পাটা উইকেট আর বিপজ্জনক উইকেট নয়, যতক্ষণ মাঠে, ততক্ষণ দর্শকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইল এই প্রশ্নটা ‘এরপরে কী হবে?’ পাঁচদিন পর গিয়ে এক মুহূর্ত নয়, যদি পাঁচদিনে টেস্ট গড়ায়, তাহলে ১৫ সেশনের খবরই যেন দর্শক রাখে, নিশ্চিত করতে চাইছে সেটাই।
শুধু ব্যাটিং নয়, আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের বিনোদন ইংল্যান্ড ছড়াতে চাইছে বোলিংয়ে নেমেও। বাজবলের ক্রিকেটে তাদের বোলিংটাও জেগে উঠেছে সঞ্জীবনী মন্ত্রে। ‘ব্যাট লং, বোল ড্রাই’ – ক্রিস সিলভারউডের শেখানো পাঠ ভুলে ইংল্যান্ড চাইছে উইকেট নিতে। স্টুয়ার্ট ব্রড এখন বল করছেন আগের চেয়ে ২০ সে.মি. সামনে, চাইছেন ব্যাটারদের আরও বেশি সংখ্যক বল খেলাতে। ব্যাটারের ভুলের জন্য অপেক্ষা নয়, ব্রড-অ্যান্ডারসন চাইছেন ব্যাটারদের ভুল করতে বাধ্য করতে। তার জন্য যদি বেশি রান হজম করতে হয়, তো হোক। ব্রড পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছেন,
– স্টুয়ার্ট ব্রড‘৮৫ ওভারে ৩.৩ রেটে নাকি ১২০ ওভারে ২.৫ করে রান হজম? আমরা প্রথমটাই বেছে নেব।’
তাদের এই বাড়তি ঝুঁকি নিতে চাওয়ার প্রবণতা যে পক্ষেই কাজ করছে, সেটা বোঝা যাবে উইকেটের ট্যালিতে তাকালেই। স্টোকস-ম্যাককালামের প্রথম ১২ টেস্টেই প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন তারা। ধারাটা যে ১৩ টেস্ট লম্বা হয়নি, সেটাও তাদের ব্যর্থতা নয়, বরং আয়ারল্যান্ডের জেমস ম্যাককালাম চোটে পড়ে আর ব্যাটে না নামাতেই।
মাঠের বাইরেও কি বদলে যায়নি ক্রিকেট খেলার ধরন? পরীক্ষার ফল মনঃপূত না হলে কিংবা ছেলে বেগড়বাই করলে বাড়ির ডিশের সংযোগ কেটে দেওয়ার সংস্কৃতি যে পৃথিবীর সব দেশেই আছে, সেটা বোঝা যাবে ২০১৮ সালের ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার দিকে তাকালেই। সে বছর স্যান্ডপেপার কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়ার পর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া প্রধান কোচ হিসেবে ডেকেছিল জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে, যেখানে তার কর্তৃত্ববাদী চরিত্রটাই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্তাদের মন কেড়েছিল। অজি ক্রিকেটারদের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপই ছিল যেখানটায় উদ্দেশ্য।
ইংল্যান্ড বদলে ফেলতে চেয়েছে জীবনকে দেখার এই চোখও। ম্যাচের ফলই যে শেষ কথা নয়, ক্রিকেটারদের কানে বারবার আওরানো হচ্ছে এই বুলি। তাদের আরও বল্গাহীন করা হয়েছে গত এক বছরে। সফরগুলোতে বান্ধবী-পরিবারের উপস্থিতি বেড়েছে, ক্রিকেটারদের মানসিকভাবে চাঙা রাখতেই। চেন্নাই সুপার কিংসের মতো ইংল্যান্ডের অনুশীলনগুলোও হয়ে গেছে ঐচ্ছিক। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ-নির্ধারণী ওভাল টেস্টের আগে দলটা অনুশীলন প্যাক-আপ করে দিয়েছিল সকাল ১১টাতেই। অন্য যেকোনো দল যেদিন অনুশীলন চালাত অন্তত আরও দুই ঘণ্টা। ম্যাককালাম কথা একদম পরিষ্কার, ‘যতক্ষণ মাঠে থাকছ, ততক্ষণ এর তীব্রতা ছাড়িয়ে যাবে ম্যাচকেও। এরপর খাও-দাও, ফুর্তি করো। তোমাকে কে আটকাবে!’ জানলে অবাক হতে পারেন, এই ইংল্যান্ড দলটার সঙ্গে কোনো পুষ্টিবিদও নেই এখন। কী খেতে হবে, কী করতে হবে – এগুলো বোঝার মতো বয়স আর জ্ঞান তাদের নিজেদেরই আছে, এ কারণেই।
আক্রমণাত্মক ক্রিকেটটাই চোখ বুলালে দেখা যাচ্ছে তো, তাদের ভয়ডরহীন ব্যাটিংটাই বাজার পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে, একটু খতিয়ে দেখলেই বেরিয়ে আসছে, বাজবলের গভীরতা শিকড় ছড়িয়েছে আরও গভীরে। ক্রিকেটাররা একজন আরেকজনের সঙ্গটা উপভোগ করছেন আরও বেশি। একেকটা সিরিজ যেন হয়ে উঠছে কাছে আসার আরও একটা উপলক্ষ। নিয়ম-শৃঙ্খলার বাঁধ ভেঙে নিজেকে তারা প্রকাশ করতে পারছেন আরও বেশি। এ কারণেই তো জীবনের ৪০ আর ৩৬ বসন্ত কাটিয়ে এসে অ্যান্ডারসন-ব্রড বলছেন, ক্রিকেটকে এতটা উপভোগ এর আগে তারা কখনো করেননি।
দিনশেষে বাজবলের মানেটা তাই নির্বিচারে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং বা জয়-পরাজয় নয়। বিনোদন।
সেটা দর্শক হিসেবে যেমন, খেলোয়াড় হলেও।