আলোচনায় আসাটা তার জন্যে নতুন কিছু নয়। পত্রিকার পাতায় শিরোনাম আর খবরের হেডলাইন হবার মতো ঘটনার সাথে তো পরিচয় ঘটেছিল জীবনের চতুর্থ টেস্টেই। ১৯ বছরের আনকোরা এক যুবক, রিকি পন্টিংকে নাস্তানাবুদ করলে তাকে নিয়ে আলোচনা হতেই হতো!
তবুও এবারের আলোচনায় আসাটা ইশান্ত শর্মাকে অনির্বচনীয় এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করেছে বলেই বোধ হচ্ছে। পার্থে যে কুঁড়ির সৌরভে আবেশ ছড়িয়েছিলেন চারপাশে, তাতে যে ফল ধরতে শুরু করেছে!
অবশেষে….
ক্যাচ তুলে রিকি পন্টিং বিদায় নিচ্ছেন, টেস্ট ক্রিকেট এমন দৃশ্য দেখেছে ১১১ বার৷ তবে ২০০৮ সালের পার্থ টেস্টে যা হয়েছিল, দর্শকেরা যে এমন কিছু এর আগে-পরে দেখেননি, তা বেশ নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যায়। সেদিন রাহুল দ্রাবিড়ের ক্যাচ হবার আগে ‘পান্টার’ ঘন্টাখানেক ধরে যেভাবে নৃত্য করে গেলেন, তার ১৭ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে এমন দিন এসেছিল খুব কমই। কোনো বল পড়েই ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল তার বুক-সমান উচ্চতায়, কোনো বল আবার ব্যাট মিস করে যাচ্ছিল গ্যালারিতে ‘ইশ’ ধ্বনি তুলে। বলের সঙ্গে এমন ইঁদুর-বিড়াল খেলে পন্টিং বিদায় নিয়েছিলেন স্লিপে ক্যাচ তুলে, একপ্রান্ত থেকে টানা আট ওভার বল করে তাকে ভুগিয়ে যাওয়া ইশান্ত শর্মার বলে।
সে ম্যাচে ইশান্তের সুযোগ মিলেছিল শ্রীশান্ত আর মুনাফ প্যাটেল জুটি বেঁধে ইনজুরিতে পড়ার কারণে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে ম্যাচ শুরুর আগে ভারতের পথ ধরেন জহির খানও। অমন পরিস্থিতিতে অমন ম্যাচ জেতানো স্পেলের পর ভারতীয়রা যদি ভেবেও থাকে, ‘পাইলাম, উহাকে আমি পাইলাম,’ তবে আসলে খুব বেশি দোষারোপ করবার জায়গা থাকে না। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের পাশাপাশি ভারতের তখন যেন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন একজন সত্যিকারের ফাস্ট বোলার।
কিন্তু, গল্পটা যে খানিকটা অন্যরকম! পন্টিংকে এমন করে নাজেহাল করতে পারা যদি হয়ে থাকে ইশান্তের সামর্থ্যের প্রমাণ, তবে ওই পার্থ টেস্ট যেন রূপ নেয় তার ক্যারিয়ারেরই প্রতিচ্ছবিতে। ‘ফায়ারসাম-ফিয়ারসাম’ স্পেল বলতে যা বোঝায়, অমন স্পেলের পরও বোলারের নামের পাশে একটিমাত্র উইকেট, প্রথমবার এমন হলে ‘আনলাকি’ শব্দটিরই শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু, ম্যাচের পর ম্যাচ ধরে এমন কিছুরই পুনরাবৃত্তি ঘটে গেলে?
ইশান্তের ক্যারিয়ারের প্রথম ভাগটার গল্পটা তো এমনই। দীর্ঘদেহী এক ভারতীয় ফাস্ট বোলার দৌড়ে আসছেন বল হাতে, সমস্তটুকু নিংড়ে দিয়ে বল ছুঁড়ছেন, দিনের প্রথম হোক কি শেষ বল, একই উদ্যমে ঝাঁপাচ্ছেন, কিন্তু প্রাপ্তির খাতায় যোগ হচ্ছে লবডঙ্কা! ২০১২ সালের এক পরিসংখ্যান ঘেঁটে জানা যায়, প্রতি উইকেট পেতে ইশান্তকে খরচ করতে হচ্ছিল ৩৬ রানেরও বেশি। নামের পাশে উইকেট যোগ হচ্ছিল, প্রায় ৬৫ বল অন্তর!
তখন অব্দি ৪৩ টেস্ট খেলে ফেলা এক পেস বোলারের জন্যে সংখ্যাটা যথেষ্টই বিব্রতকর। বিশেষত, যাকে যখন ভাবা হচ্ছে দলের বোলিং আক্রমণের নেতা, পরিসংখ্যানটা যদি তারই হয়!
ভারত তবুও ভরসা রেখেছিল ইশান্তে। ‘ফাস্ট বোলার’ শব্দটার সঙ্গে ভারতীয়দের পরিচয় প্রতিপক্ষ দলের কল্যাণেই, ইশান্তের মাঝেই যে অনেকদিনের মধ্যে প্রথম কোনো ফাস্ট বোলারকে নিজেদের দলে দেখতে পাওয়া।
পরিসংখ্যান দিয়ে কী যায়-আসে! ইশান্তরা কি আর প্রতিদিন আসেন?
***
জেমস ফকনার নামটি আপনার ভুলেই যাবার কথা! ব্যাগি গ্রিন মাথায় দেয়ার যোগ্যতা ফুরিয়ে গিয়েছিল ২০১৩ সালে, এক টেস্ট খেলেই। ৬৯ ম্যাচ স্থায়ী ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষটিও খেলেছিলেন সেই ২০১৭ সালে। মার্কাস স্টোইনিস, অ্যাশটন টার্নাররা নিজেদের মেলে ধরতে শুরু করেছেন যে সময়টায়, তখন প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা খুব সম্ভবত ফকনার নিজেও করেন না।
তা ফকনার অজি দলে ফিরুন কিংবা না ফিরুন, তার কথা আপনি মনে রাখুন কিংবা না-ই রাখুন, ইশান্ত শর্মা তাকে কখনো ভুলতে পারবেন বলে মনে হয় না। ভারত ম্যাচ জিতে যাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে মোহালির দর্শকদের স্তব্ধ করে ১৮ বলে ৪৪ রানের সমীকরণকে ৬ বলের ব্যবধানে ফকনার নামিয়ে এনেছিলেন ১৪ রানে। যার বলে এই কীর্তি, হতভাগ্য সেই বোলারের নাম ইশান্ত শর্মা, চাইলেও তো তার পক্ষে ফকনারকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না!
‘আনলাকি’ ইশান্তের ভেতরের কঙ্কালটা যেন বেরিয়ে পড়েছিল সে ম্যাচের পরই। রেকর্ড বই যতই চেঁচিয়ে জানান দিক, ইশান্ত শর্মা ২০১৬ সালেও সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলেছিলেন, আদতে তার সাদা বলের ক্যারিয়ারের পাট চুকে গিয়েছিল সেই ম্যাচের পরই। ভুবনেশ্বর কুমার, মোহাম্মদ শামিরা যে উঠে আসতে শুরু করেছিলেন ততদিনে!
***
কী থেকে যেন কী হয়ে গেল! ভারতের মাটিতে ফাস্ট বোলাররা চিরকালই বিবেচিত হয়ে আসছিলেন ‘সৎ ছেলে’ রূপে। হঠাৎ করেই যেন হাওয়াটা গেল বদলে। ভুবনেশ্বর, শামির পথ বেয়ে ভারত পেল জসপ্রিত বুমরাহ নামের রত্ন, এদের সঙ্গে যোগ করুন উমেশ যাদব কিংবা উদীয়মান দীপক চাহার, শার্দুল ঠাকুর নামগুলোও। কোনো এক ঝড়ো হাওয়াতে ভারত যেন হয়ে উঠল ফাস্ট বোলারদের স্বর্গরাজ্য। ভারতও তাই সুযোগ পেয়েছিল ইশান্ত শর্মাকে ভুলে যাবার। ২৫০ টেস্ট উইকেট পেয়েছেন, এমন বোলারদের মাঝে যিনি কিছুটা কম গতিসম্পন্ন, তাকে বাদ দিয়ে পরিকল্পনা করাটাই তো কর্তব্য।
কিন্তু ইশান্ত যে অন্য কিছু ভেবেছিলেন! ২০১৮ সালের শুরু থেকে যেন পাওয়া গেল বদলে যাওয়া এক ইশান্তকে। ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্যে ভেতরে বল ঢোকানোর কৌশল তো জানাই ছিল, শিখে নিলেন বাঁহাতিদের বেলাতেও বল ভেতরে ঢোকানোর অস্ত্র! ইন্দোর টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে সাদমান ইসলামকে আউট করেছিলেন যে বলে, তা যেন তার বদলে যাবার আরেকটি প্রমাণ। বলটা যে করতে চেয়েছিলেন সেদিনই মধ্যাহ্ন বিরতির সময়।
***
তা এমন ‘আনপ্লেয়েবল’ হয়ে ওঠা তো তার জন্যে নতুন কিছু ছিল না। দিনশেষে সাফল্য মরীচিকা হয়ে রইতো বলেই না হায়-হায় রব উঠত!
প্রথম এগারো টেস্ট খেলে ফেলার পর তার বোলিং রেকর্ড দাঁড়িয়েছিল অনেকটা এমন: বোলিং গড় ৩১.১৭, স্ট্রাইক রেট ৫৭.৩। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গড়টা এরপরে ৩৫-য়ের নিচে নেমেছে একবারই, ২০১৮-য়ের মাঝামাঝি।
২০১৭ অব্দিও প্রতি উইকেট পেতে তাকে বল করতে হয়েছিল গড়ে ১১.২ ওভার। কিন্তু, ওই যে, বদলে যাওয়ার কথা হচ্ছিল! ২০১৮ সাল শুরুই করেছিলেন এবি ডি ভিলিয়ার্স আর ফ্যাফ ডু প্লেসির উইকেট তুলে। সেই থেকে এখন অব্দি খেলা ১৭ টেস্টে উইকেট নিয়েছেন ৬৬টি, ১২ বছরের মাঝে কোনো ভারতীয় ফাস্ট বোলারের ভারতের মাটিতে পাঁচ উইকেট পাবার কীর্তিও দেখা গিয়েছে তার সৌজন্যেই।
ক্যারিয়ারের ৯৬ টেস্ট খেলে ফেলার পর প্রথমবারের মতো পরিসংখ্যানের পাতায় পেছনে ফেলেছেন জেমস অ্যান্ডারসন, জশ হ্যাজলউড, কাগিসো রাবাদার মতো পেসারদের। সময়ের ব্যপ্তি যদি হয় ২০১৮-১৯, বোলিং গড়ে তার পেছনে পড়ে যাচ্ছেন এরা সবাই। যে জসপ্রিত বুমরাহকে নিয়ে ক্রিকেট পাড়ায় তুমুল কোলাহল, ‘এমন ফাস্ট বোলার ক্রিকেট আর আগে দেখেনি’ বলে যে শোরগোল, পরিসংখ্যান বলছে, সেই বুমরাহ আর ইশান্তের মাঝে গত দুই বছরে পার্থক্য খুব সামান্যই।
লাইন-লেংথেও তো পাওয়া যাচ্ছে বদলে যাওয়া ইশান্তকেই। উচ্চতা কাজে লাগিয়ে বাউন্সার দেবার দিকেই যার ছিল সমস্ত মনোযোগ, সেই তিনিই বিগত দুই বছরে কন্ডিশনকে কাজে লাগিয়ে বল করতে শুরু করেছেন কিছুটা উপরে। ২০১৭ অব্দি করা বলগুলোর ১২ শতাংশ ছিল শর্ট-পিচ ডেলিভারি, বিগত দুই বছরে যে সংখ্যাকে নামিয়ে এনেছেন ৪ শতাংশে।
তূণে সুইং যোগ করায় ফুল-লেংথে বল করে সাফল্যও মিলছে বেশ। পূর্বে ফুল-লেংথে বল করে সাফল্যের জন্যে অপেক্ষাটা ছিল ৬৪ বলের, এখন উইকেট মেলে চার ওভার পরপরই! ওভার-দ্য-উইকেট হোক বা রাউন্ড-দ্য-উইকেট, ইশান্ত এখন আর ‘আনলাকি’ নন, ‘আনপ্লেয়েবল’!
তাতেও যে তৃপ্ত হচ্ছেন, তা বলার সুযোগ রাখছেন কই! প্রতি ম্যাচেই যে মাঠে নামছেন আরও বেশি উইকেট পাবার নেশায়! ‘কোনো ম্যাচে উইকেট না পেলে, ভারতের জার্সিতে সেটাই আমার শেষ ম্যাচ,’ নিজেকে উদ্দীপ্ত রাখতে এমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন নিজেই। (লাইনটা লিখতে গিয়ে একটু আক্ষেপই ছুঁয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের বোলাররাও কি এমনটাই করেন?)
শততম টেস্ট খেলতে আর মাত্র চার টেস্টেরই অপেক্ষা, এর আগে যে কৃতিত্ব অর্জন করেছেন একজন মাত্র ভারতীয় ফাস্ট বোলার। ভদ্রলোকের নাম কপিল দেব!
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ