Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.
ছলনাময়ী। হ্যাঁ, ছলনাময়ী বলাই ভালো। বলছি, গেল অক্টোবর মাসের কথা।
শীত নামি নামি করে কাটল অক্টোবরের দিনগুলো। শীতের আগমন বার্তার লক্ষণ হিসেবে টানা কয়েকদিন বর্ষনও হলো ঢাকার আকাশে। কিন্তু শীতের দেখা মিলল না। লঘু চাপের প্রভাবে হওয়া গুড়ি গুড়ি বর্ষনে ছিল না ঝড়-দুর্যোগের আভাস। মৃদুমন্দ বাতাস, হঠাৎ ভর দুপুরে তেতে উঠা রোদ ছাড়া প্রকৃতি শান্তই ছিল। কিন্তু অক্টোবরের শেষ দুই সপ্তাহে বাংলাদেশের ক্রিকেটে রীতিমতো ঝড়ই বয়ে গেল। ক্রিকেটাঙ্গন কেঁপে উঠেছিল কয়েক দফায়।
গত ২১ অক্টোবর হুট করে ১১ দফা দাবিতে ক্রিকেটারদের ধর্মঘট নাড়িয়ে দেয় দেশের ক্রিকেট। ঘূর্ণাক্ষরেও যা আঁচ করতে পারেনি দেশের ক্রিকেট প্রশাসন। বিসিবি-ক্রিকেটার পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এসেছে। কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল ক্রিকেট। ঘোর অমানিশার অন্ধকারের আশঙ্কা ভর করেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের আকাশে। অস্থির সময়টা দীর্ঘায়িত হয়নি। বিসিবি-ক্রিকেটার দ্বন্দ্ব নিরসন হয়েছে তিনদিনের মাথায়ই। সপ্তাহ পার না হতেই আন্দোলনের ফল পেয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। জাতীয় ক্রিকেট লিগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছিল বিসিবি।
ধর্মঘট-পরবর্তী সময়ে ক্রিকেট জগতে নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ভারত সফরের ক্যাম্পে সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতি। কোথায় সাকিব, কোথায় সাকিব! হন্যে হয়ে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন সাংবাদিক, ক্রিকেটপ্রেমীরা। বিসিবির দায়িত্বশীলরাও দিয়েছিলেন এলোমেলো উত্তর। ভেতরে ভেতরে যে কত বড় রহস্য জট পাকাচ্ছে, তা ভাবতে পারেননি কেউ। ক্রিকেটারদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়া সাকিব হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অনুশীলনে পাওয়াই গেল না তাকে। নানা রকম সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। তার মাঝেই বিসিবির অনুমতি ছাড়া গ্রামীণফোনের সঙ্গে সাকিবের চুক্তি নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছিল।
সারাদিন নানা গুজবে মুখরিত ছিল গোটা ক্রিকেট অঙ্গন; Image Credit: Muntasir Nirob
গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, ধর্মঘটের কারণে বিসিবির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সাকিবের। ভারত সফরে না-ও যেতে পারেন তিনি। নেতৃত্বও ছেড়ে দিতে পারেন তিনি। গুঞ্জন হলেও পরের দু’টি তথ্যই সঠিক ছিল। বিসিবির সঙ্গে দূরত্বের বিষয়টি অবশ্য নিছকই ভুল অনুমান ছিল। কারণ, অনুশীলন না করলেও, মিরপুর স্টেডিয়ামে না আসলেও ওই কয়দিন নিয়মিতই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের অফিসে যাতায়াত ছিল সাকিবের। তাদের মিটিংয়ের আলাপ বেমালুম চেপে গিয়েছিল বিসিবি।
রহস্যের জট খুলে যায় ২৯ অক্টোবর। দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে ব্যানার হেড লাইন হয়, জুয়াড়ির ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করায় আইসিসি নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে সাকিবকে। ক্রিকেটারদের ধর্মঘট যদি হয় হঠাৎ প্লাবন, তবে এই খবর বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাত, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থার তৈরি করেছিল। সব আশঙ্কা সত্যি করে ওই দিন সন্ধ্যায় মোহাম্মদ আশরাফুলের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে আইসিসির নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সাকিবের উপর। দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।
এ যেন মহাতারকার মহাপতন।
সংবাদকর্মীদের ক্লান্তিকর অপেক্ষার প্রহর
২৯ অক্টোবর সকাল থেকেই দেশের ক্রিকেট কাটিয়েছে শ্বাসরুদ্ধকর সময়। দিনভর ক্লান্তিময় অপেক্ষায় থেকেছে গোটা দেশ। খুব সকালেই মিরপুর স্টেডিয়ামে সংবাদকর্মীদের ভিড়। দুপুর ১২টায় ভারত সফরের টি-টোয়েন্টি দলের বদলি ক্রিকেটারদের নাম ঘোষণা, টেস্ট দল ঘোষণার কথা ছিল। সাংবাদিকরা অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন। দিনের বয়স বাড়তেই একটার দিকে বিসিবিতে আসেন সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এর মাঝে কয়েকজন পরিচালকও বিসিবিতে চলে আসেন।
কী এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ছিল সেদিন; Image Credit: Dhaka Tribune
ততক্ষণে খবর চাউর হয়ে গেছে, সাকিবের বিষয়ে আইসিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেখার পরই কথা বলবে বিসিবি। সাংবাদিকদের কেউ কেউ আইসিসির বিভিন্ন বিভাগে যোগাযোগ করেও কূলকিনারা করতে পারেননি। কখন আসতে পারে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, তা স্পষ্ট করে জানা যায়নি। মিডিয়া লাউঞ্জ, বিসিবি কার্যালয়ের বিভিন্ন রুম, ভিআইপি গ্যালারি, স্টেডিয়ামের ফাঁকা জায়গায় সাংবাদিকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করেছেন। অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছিল না। হেমন্তের দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা হয় হয়, আসছিল না সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দিনভর টিভি চ্যানেলের সংবাদকর্মীরা লাইভে জানিয়ে গেছেন নানা সম্ভাবনার কথা। চূড়ান্ত কিছুর অপেক্ষা সবাইকেই করতে হয়েছে।
দিনের আলো যখন নিভু নিভু, তখন বিসিবিতে আসেন জাতীয় দলের হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। বিসিবি সভাপতির সঙ্গে মিটিংয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন এই প্রোটিয়া কোচ। ভারত সফরের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন। বিশ্বসেরা দলটার বিপক্ষে চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা এবং ইতিহাসে প্রথমবার গোলাপী বলে দিবা-রাত্রির টেস্ট খেলার রোমাঞ্চের কথা জানিয়ে বিদায় নেন ডমিঙ্গো। তারপরই আসেই সেই ক্ষণ। ইমেইলের মাধ্যমে আইসিসি জানিয়ে দেয় চূড়ান্ত রায়। দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় সাকিবকে। গঠন করা হয়েছিল তিনটি অভিযোগ। তিনবার (২০১৮ ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজ, ২০১৮ আইপিএলে হায়দরাবাদ-পাঞ্জাব ম্যাচ) জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন করেছিলেন তিনি।
খবরটা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশ, ক্রিকেট বিশ্বে। একই সময়ে মিরপুর স্টেডিয়ামে সাকিব আসছেন বলে জানা যায়। এবার শুরু হয় তার আগমনের অপেক্ষা।
সাকিব নিষিদ্ধ হওয়ার খবরটা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই মিরপুর স্টেডিয়ামের মূল গেইটের বাইরে শতাধিক ক্রিকেটপ্রেমী ভিড় জমান। ‘সাকিবের নিষেধাজ্ঞা মানি না, মানব না’, ‘সাকিব ছাড়া ক্রিকেট মানি না, মানবো না’ জাতীয় স্লোগানে সাকিব ভক্তরা কাঁপিয়ে তোলেন স্টেডিয়াম প্রাঙ্গন।
ঘড়ির কাটায় ৭.৫৭ মিনিট।
রাতের অন্ধকারের আধার ঠেলে চার নম্বর গেইট হয়ে একটি সাদা গাড়ি এসে থামে বিসিবির ফটকের সামনে, যার কারণেই ভক্তরাও দেখেননি সাকিবের আগমন। গাড়ি থেকে নামেন বিষণ্ন মুখশ্রীর সাকিব। পরনে সাদার উপর সবুজ স্ট্রাইপ শার্ট ও জিন্স। সবাই ছুটছেন তার দিকে। টের পেয়ে ক্যামেরা নিয়ে সংবাদকর্মীদের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। একসাথে জ্বলে গোটা পঞ্চাশেক ক্যামেরার লাইট। বিসিবির কর্মীরা দুই পাশ থেকে আগলে রেখে সাকিবকে লিফটের দিকে নিয়ে যান। দোতলায় লিফটের দরজার মুখে অবস্থান নেন অনেক সংবাদকর্মী। সাকিব বের হতেই জ্বলে ওঠে ফ্ল্যাশ। ভিড় ঠেলে দোতলায় বিসিবি কার্যালয়ে সভাপতির রুমে চলে যান তিনি। ১৫ মিনিট পরই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনসহ সংবাদমাধ্যমের সামনে আসেন সাকিব।
সাকিব এলেন; Image Credit: Raton Gomez / BCB
অবয়বে নিরাবেগ, নিরাসক্ত মনে হচ্ছিল সাকিবকে। বারবার কপালের ঘাম মুছছিলেন। কিছুটা লজ্জাবনত চেহারা নিয়ে বিসিবি সভাপতির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। পেছন থেকে বিসিবি পরিচালক এনায়েত হোসেন সিরাজ বারবার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিলেন বাঁহাতি এই অলরাউন্ডারকে। টিভি ক্যামেরাগুলো প্রস্তুত হতেই সাকিব বলেন, আমি একটা লিখিত বিবৃতি পড়ব আপনাদের সামনে। বিবৃতি পড়ার সময় চোখ ছলছল করছিল দৃঢ়চেতা এই ক্রিকেটারের। খুব সংক্ষিপ্ত নিজের লিখিত বিবৃতি পাঠ করা শেষেই সংবাদ সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন সাকিব। কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। যাওয়ার সময় ২-১ জন সাংবাদিকের সঙ্গে হাসিমুখে কথাও বলেছেন। মনে হচ্ছিল, লিখিত বক্তব্যটা পড়ার পর পাহাড়সমান ভার তার মন থেকে নেমে গেছে।
তারপর সংবাদ সম্মেলনে নিজের বক্তব্য দেন বিসিবি সভাপতি। ভারত সফরের টি-টোয়েন্টি দলের তিনটি পরিবর্তন, টেস্ট দল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। বিসিবি পরিচালক আকরাম খান ঘোষণা করেন টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দলের নতুন অধিনায়কদের নাম। সেই পর্ব শেষ হতেই স্টেডিয়াম ত্যাগের জন্য তৈরি হন সাকিব।
নিচে এসে সাদা গাড়িতে উঠার আগে বোর্ড সভাপতিকে শেষ কথা বলেছেন, পাপন ভাই, আমি গেলাম। গাড়িতে উঠে বসা সাকিবকে বিসিবি পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক, জালাল ইউনুস, বিসিবির কর্মকর্তার বিদায় জানিয়েছেন সান্ত্বনা দিয়ে। রাত তখন ৮টা ৩৩ মিনিট। মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে বিদায় নেন দুই বছর নিষেধাজ্ঞার শাস্তি পাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘রেকর্ডের বরপুত্র’ সাকিব।
আশা করি এই সমর্থনটা থাকবে: সাকিব
‘আমার আনুষ্ঠানিক এক বিবৃতি আছে। সেটি এখন পড়ছি।’ Image Credit: Raton Gomez / BCB
আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগকে দেয়া বিবৃতিটাই মিরপুর স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনে পাঠ করেছিলেন সাকিব। তবে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পড়ার আগে সাবেক এই অধিনায়ক সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন,
‘সবাইকে ধন্যবাদ যে, সবাই এভাবে সারাদিন অপেক্ষা করেছেন। আপনারা এরই মধ্যে আইসিসির একটি বিবৃতি পেয়ে গেছেন। সেটি নিয়ে আমার আনুষ্ঠানিক এক বিবৃতি আছে। সেটি এখন পড়ছি।’
আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে সাকিব বলেছেন,
‘যে খেলাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, সে খেলা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা পেয়ে আমি দুঃখিত। তবে অনৈতিক প্রস্তাবের ব্যাপারটি আইসিসির এসিইউ’কে না জানানোয় যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তা আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত করতে আইসিসির এসিইউ সবচেয়ে বেশি ভরসা করে ক্রিকেটারদের সহযোগিতার ওপর। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে পালন করতে পারিনি। শত কোটি ভক্ত ও অন্য খেলোয়াড়দের মতো আমিও চাই, ক্রিকেট থাকুক দুর্নীতিমুক্ত। তাছাড়া আগামীর তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা যেন আমার মতো ভুল না করে, সে জন্য আমি আইসিসির এসিইউ’র দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাব। ধন্যবাদ সবাইকে।’
বিবৃতি পাঠ শেষে সাকিব নিজে কিছু কথা বলেছেন সবার উদ্দেশ্যে। বিশ্বসেরা এই বাঁহাতি অলরাউন্ডার বলেছেন,
‘আরেকটা জিনিস আমি বলতে চাই। যেভাবে আপনারা আমাকে সবসময় সমর্থন করে এসেছেন, বাংলাদেশের সব ক্রিকেটভক্ত, সব মানুষ, বিসিবি, সরকার থেকে শুরু করে মিডিয়া, সবাই যেভাবে আপনারা আমার ভালো ও খারাপ সময়ে সমর্থন করে এসেছেন, আশা করি এই সমর্থনটা থাকবে। এই সমর্থন যদি থাকে, আমি ইনশাআল্লাহ শিগগিরই আবার ক্রিকেটে ফিরতে পারব, এবং আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী এবং ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারব দেশের হয়ে। ধন্যবাদ সবাইকে।’
ক্রিকেটারদের ধর্মঘট দিয়ে শুরু, সাকিবের অনাকাঙ্ক্ষিত-অপ্রত্যাশিত নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থেমেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে অক্টোবরের ঝড়। ক্রিকেটামোদীমাত্রই চাইবেন, এই ঝড়ের আয়ু যেন দীর্ঘায়িত না হয়। নভেম্বরের শুরুতে মাঠের ক্রিকেটের আনন্দ-বেদনাতেই আবার মশগুল হতে চাইবে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা।